ইরানে হামলা কি মধ্যপ্রাচ্যে ট্রাম্পের পরিকল্পনা ব্যর্থ করে দেবে
Published: 17th, June 2025 GMT
ডোনাল্ড ট্রাম্প ও বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু ইরানের পারমাণবিক কর্মসূচি ঠেকাতে সামরিক শক্তি ব্যবহারের বিষয়ে ভিন্নমত পোষণ করেন। ইরানের বিরুদ্ধে ইসরায়েলের সাম্প্রতিক কঠোর হামলা মধ্যপ্রাচ্যকে এক অশান্ত এবং উদ্বেগজনক পরিস্থিতির দিকে ঠেলে দিচ্ছে।
প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পকে একজন বিশ্লেষক বা কৌশলবিদ বলা যায় না। তিনি সিদ্ধান্ত নেন দ্রুত, অনেক সময় নিজেরই নেওয়া সিদ্ধান্ত পরিবর্তনও করেন। তিনি সোজা পথে হাঁটেন না। তবু তাঁর ২০২৫ সালের ১৪ মে রিয়াদ ভাষণ থেকে আমরা বুঝতে পারি, তিনি মধ্যপ্রাচ্য নিয়ে কী লক্ষ্য স্থির করছেন এবং কী ধরনের কৌশলকে তিনি সমর্থন করেন বা বর্জন করেন।
এই ভাষণটি ২০১৭ সালের একই স্থানে দেওয়া তাঁর আগের ভাষণের ধারাবাহিকতা। সেই ভাষণে তিনি ঘোষণা করেছিলেন যে যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যপ্রাচ্য নীতি হবে ‘নৈতিক বাস্তববাদ’।
ওবামা, বাইডেন ও ট্রাম্প—তিনজনই যুক্তরাষ্ট্রের জনগণের অসন্তোষের কথা ভেবে মধ্যপ্রাচ্যে সামরিক হস্তক্ষেপ কম করবেন বলে সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন। বুশ প্রশাসনের মধ্যপ্রাচ্যে শাসনব্যবস্থা পরিবর্তনের জন্য যুদ্ধ, বিশেষ করে ইরাক ও আফগানিস্তান যুদ্ধের প্রতি মার্কিন জনগণের বিরক্তি এই নীতিকে উৎসাহিত করেছে। ওবামা ও বাইডেন মানবাধিকারের ওপর গুরুত্ব দিয়েছিলেন। তবে তাঁদের প্রচেষ্টা বিশেষ সফল হয়নি।
ট্রাম্প শুরু থেকেই সরাসরি বলেছেন যে উদারনৈতিক বা লিবারেল আদর্শ দিয়ে কাজ হবে না। যুক্তরাষ্ট্রের নীতি ঠিক করতে হবে বাস্তবতার ভিত্তিতে। আমরা ট্রাম্পের সেই কথারই স্পষ্ট প্রতিফলন দেখতে পাচ্ছি তাঁর ইরান ও সিরিয়া নীতিতে।
২০১৭ সালের রিয়াদ ভাষণে ট্রাম্প বলেছিলেন, হঠাৎ করে সামরিক হস্তক্ষেপ বা শাসন পরিবর্তনের জন্য ঝাঁপিয়ে পড়া যুক্তরাষ্ট্রের নীতি হবে না। তিনি সাবধান করেছিলেন যে এ রকম পদক্ষেপ মধ্যপ্রাচ্যে বিপর্যয় এবং চরমপন্থার উত্থান ডেকে আনতে পারে। ২০২৫ সালে একই বক্তব্যকে আরও জোর দিয়েছেন। বলেছেন যে শুধু সামরিক নয়, রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ থেকেও যুক্তরাষ্ট্র দূরে থাকবে। তিনি বলেন, অন্য দেশের অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে নাক গলানো বা কাকে নেতৃত্বে রাখা উচিত, তা নির্ধারণ করার দিন শেষ।
ট্রাম্পের মধ্যপ্রাচ্য নীতির ভিত্তি মূলত ব্যবসা, বাণিজ্য এবং চীনের সঙ্গে প্রতিযোগিতা। তিনি চাচ্ছেন মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলো নিজেরাই নিজেদের প্রতিরক্ষাব্যবস্থায় নেতৃত্ব নিক। আর যুক্তরাষ্ট্র তাদের কাছে অস্ত্র বিক্রি করবে, অর্থনৈতিক চুক্তি করবে। কিন্তু সরাসরি যুদ্ধে জড়িয়ে খরচ করতে যুক্তরাষ্ট্র আর রাজি নয়। তিনি চান ইসরায়েলকে আঞ্চলিক নিরাপত্তা ও অর্থনৈতিক কাঠামোয় নিয়ে আসা হোক। আব্রাহাম চুক্তির সম্প্রসারণ তাঁর এই কৌশলের অংশ।এর ব্যতিক্রম ঘটেছিল ওবামা প্রশাসনে। ২০০৯ সালে কায়রোতে ওবামা বলেছিলেন, যুক্তরাষ্ট্র অন্য দেশের সরকার কেমন হওয়া উচিত, তা সেই দেশের জনগণের ওপর চাপিয়ে দেবে না। কিন্তু পরে তিনি মোবারক, গাদ্দাফি ও আসাদকে ক্ষমতা থেকে সরে যেতে আহ্বান জানিয়েছিলেন।
ট্রাম্প এ ধরনের নীতির দ্বিচারিতা পরিহার করতে চেয়েছেন। তিনি মনে করেন, রাজনৈতিক ব্যবস্থা তৈরি বা গণতন্ত্র রপ্তানি করার চেষ্টায় যুক্তরাষ্ট্রের সময় ও সম্পদ নষ্ট হয়েছে। আফগানিস্তান ও ইরাক তার জ্বলন্ত উদাহরণ।
আরও পড়ুনইরান-ইসরায়েল যুদ্ধের পরিণতি কী১৩ ঘণ্টা আগেট্রাম্পের ভাষণে বারবার এসেছে, যুক্তরাষ্ট্রের নীতি হবে বাস্তবতার ভিত্তিতে। ২০২৫ সালে তিনি সরাসরি বলেন, গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলার জন্য বড় বড় প্রকল্পের পেছনে কোটি কোটি ডলার ব্যয় করে কোনো লাভ হয়নি। তাই তিনি এই প্রকল্পগুলো বন্ধ করেছেন বা কাটছাঁট করেছেন। বহু এনজিও এবং সরকারি দপ্তরের কর্মী তাঁদের চাকরি হারিয়েছেন।
তাঁর মতে, সংস্কার হবে ধীরে ধীরে। বিপ্লবের মতো আকস্মিকভাবে নয়। এ কারণেই তিনি ভূমধ্যসাগরীয় দেশগুলোকে উদাহরণ হিসেবে তুলে ধরেছেন। তাদের ধাপে ধাপে সংস্কার, অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি এবং স্থিতিশীলতার পথে এগোনোকে তিনি প্রশংসা করেছেন।
সিরিয়ার ক্ষেত্রে ট্রাম্পের নীতিও একই ধরনের। তিনি ২০১৭ সালে সিআইএর ব্যর্থ অস্ত্র প্রকল্প বন্ধ করেন। তিনি স্বীকার করেছেন, যুক্তরাষ্ট্র-সমর্থিত বিদ্রোহীরা দুর্নীতিগ্রস্ত ছিল। নিজেদের স্বার্থের চেয়ে অর্থ উপার্জনে বেশি মনোযোগী ছিল তারা। অন্যদিকে আল-নুসরা ফ্রন্ট ছিল বেশি একনিষ্ঠ।
আরও পড়ুনইরানে ইসরায়েলের হামলার আসল যে কারণ১৬ জুন ২০২৫২০২৫ সালে ট্রাম্প সেই আল-নুসরা প্রধানের সঙ্গে হাত মেলান, যাকে একসময় সন্ত্রাসী বলা হতো। তিনি বলেন যে সিরিয়ার মতো দেশের জটিলতা সেই দেশের মানুষই ভালো বুঝবে। তাই সিরিয়ার রাজনৈতিক রূপান্তরের সিদ্ধান্তটি তাদের হাতেই ছেড়ে দেওয়া ভালো। আর যদি প্রয়োজন হয় তাহলে যুক্তরাষ্ট্র দূর থেকে স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করতে কাজ করবে। সিরিয়ায় এখন মার্কিন প্রশাসনের মূল লক্ষ্য নিরাপত্তা, সন্ত্রাসী গোষ্ঠী ও বিদেশি যোদ্ধাদের বিতাড়ন এবং ইসলামিক স্টেট বন্দীদের বন্দিশিবিরের ভবিষ্যৎ ঠিক করা।
ট্রাম্প প্রশাসন সিরিয়ার ওপর থেকে কিছু নিষেধাজ্ঞা শিথিল করেছে। এর পেছনে যুক্তি হলো নতুন গৃহযুদ্ধ এড়িয়ে স্থিতিশীলতা বজায় রাখা। তুরস্কের সঙ্গে কাজ করে সিরিয়ার নতুন সেনাবাহিনী গড়ে তোলার পরিকল্পনা রয়েছে। তুরস্কে নতুন রাষ্ট্রদূত হিসেবে ব্যবসায়ী টমাস বারাককে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। এই নিয়োগ থেকে বোঝা যায় যে অর্থনৈতিক সহযোগিতা ও ব্যবসার প্রসারই ট্রাম্পের লক্ষ্য।
আরও পড়ুনইরানে ইসরায়েলের হামলা: ট্রাম্প কি পাগল হয়ে গেছেন১৩ জুন ২০২৫ইরানের ক্ষেত্রেও ট্রাম্প একই বাস্তববাদী নীতি অনুসরণ করেছেন। তিনি বলেছেন, তাঁর কোনো স্থায়ী শত্রু নেই। ইরানে শাসন পরিবর্তন চান না তিনি। আলোচনার মাধ্যমে সমাধানই তাঁর পছন্দ। তবে তিনি কঠোরভাবে এ–ও বলেছেন, ইরান পারমাণবিক অস্ত্রসজ্জিত হতে পারবে না। এর জন্য প্রয়োজনে যুক্তরাষ্ট্র শক্তি প্রয়োগ করতে দ্বিধা করবে না। তবে তাঁর পছন্দ সামরিক নয়, কূটনৈতিক বা অর্থনৈতিক চাপ। তিনি ইরানের তেলের রপ্তানি শূন্যে নামিয়ে আনার জন্য কঠোর নিষেধাজ্ঞার পক্ষে কথা বলেছেন।
গত মে মাসে ট্রাম্প নেতানিয়াহুকে বলেছিলেন, আলোচনার সময় ইরানে হামলা করা ঠিক হবে না। কিন্তু নেতানিয়াহু সেই কথা শোনেননি। ১২ জুন ইসরায়েল হামলা চালালে ট্রাম্প ও তাঁর প্রশাসন স্পষ্ট করে বলেন, এতে যুক্তরাষ্ট্রের কোনো ভূমিকা নেই। ট্রাম্পের যুক্তি হলো যুক্তরাষ্ট্রের মিত্ররা নিজেদের নিরাপত্তার দায়িত্ব নিজেরা নেবে। এভাবেই যুক্তরাষ্ট্র নিজেদের সরাসরি যুদ্ধ এড়িয়ে চলবে।
ট্রাম্পের মধ্যপ্রাচ্য নীতির ভিত্তি মূলত ব্যবসা, বাণিজ্য এবং চীনের সঙ্গে প্রতিযোগিতা। তিনি চাচ্ছেন মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলো নিজেরাই নিজেদের প্রতিরক্ষাব্যবস্থায় নেতৃত্ব নিক। আর যুক্তরাষ্ট্র তাদের কাছে অস্ত্র বিক্রি করবে, অর্থনৈতিক চুক্তি করবে। কিন্তু সরাসরি যুদ্ধে জড়িয়ে খরচ করতে যুক্তরাষ্ট্র আর রাজি নয়। তিনি চান ইসরায়েলকে আঞ্চলিক নিরাপত্তা ও অর্থনৈতিক কাঠামোয় নিয়ে আসা হোক। আব্রাহাম চুক্তির সম্প্রসারণ তাঁর এই কৌশলের অংশ।
তবে ফিলিস্তিনি জনগণের স্থান এই পরিকল্পনায় কোথায়, সেটি এখনো স্পষ্ট নয়। ট্রাম্প বলেছেন, তিনি এ বিষয়ে ভূমধ্যসাগরীয় দেশ ও তুরস্কের নেতাদের কথা শুনবেন। তবে নিজের সরকারি বিশ্লেষকদের মতামত নিতেও খুব একটা আগ্রহী নন তিনি।
রবার্ট ফোর্ড সিরিয়া ও আলজেরিয়ায় যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক রাষ্ট্রদূত
মধ্যপ্রাচ্যভিত্তিক ম্যাগাজিন আল মাজাল্লা থেকে নেওয়া। ইংরেজি থেকে সংক্ষেপিত অনুবাদ
.উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: য ক তর ষ ট র র ব যবস থ জনগণ র র জন য র জন ত বল ছ ন কর ছ ন ন ইসর ইসর য
এছাড়াও পড়ুন:
জুলাই সনদ নিয়ে যেসব বিষয় বিবেচনায় রাখতে হবে
ফরাসি বিপ্লবের রক্তাক্ত অভিজ্ঞতা থেকে বলা হয়ে থাকে ‘বিপ্লব তার সন্তানদেরই খেয়ে ফেলে’। আধুনিক যুগের বিপ্লব প্রায়ই পুরোনো সংবিধানকে খেয়ে ফেলে। ব্রিটিশ রাজকবি আলফ্রেড টেনিসনের ভাষায়, পুরোনো বন্দোবস্ত সরে গিয়ে স্থান করে দেয় নতুন ব্যবস্থাকে। জার্মান আইনবিদ কার্ল স্মিটের ভাষায়, ‘স্টেট অব এক্সেপশন’ অর্থাৎ ‘পরম ব্যতিক্রমী ব্যবস্থা’র উদ্ভব ঘটে। ফরাসি বিপ্লবের অন্যতম পুরোধা এবি সিয়েসের মতে, জনগণের গাঠনিক ক্ষমতার উন্মেষ ঘটে।
স্মিটের মতে, ‘পরম ব্যতিক্রমী ব্যবস্থা’য় যে বা যাঁরা চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নিতে পারেন, তিনি বা তাঁরাই সার্বভৌম। এই সার্বভৌম শক্তি আইনের বাইরে ও আইনের ঊর্ধ্বে। পুরোনো আইনব্যবস্থা, শাসনতন্ত্র, ক্ষমতাকাঠামো বা বিধিবিধান, কোনো কিছু দিয়েই এই পরম ব্যতিক্রমী ব্যবস্থাকে ব্যাখ্যা করা যায় না; সেসব থেকে এর চূড়ান্ত বৈধতার নিদান খোঁজাও যায় না। পুরোনো ব্যবস্থা সেই সমাধান দিতেও সক্ষম নয়। বিদ্যমান সবকিছুই পরম ব্যতিক্রমী ব্যবস্থায় নয়া সার্বভৌম শক্তির সব সিদ্ধান্তের অধীনে প্রয়োগ হয়।
চব্বিশের গণ–অভ্যুত্থানের পর বাংলাদেশের বর্তমান রাষ্ট্রকাঠামোয় যে অবস্থা বিরাজ করছে, সেটাকে এক ‘পরম ব্যতিক্রমী ব্যবস্থা’ বলা যায়। কারণ, বিদ্যমান সংবিধানের আওতায় এটাকে ব্যাখ্যা করা ও সেই ব্যবস্থা চালিয়ে যাওয়া সম্ভব ছিল না; কোনো না কোনো অধিসাংবিধানিক প্রক্রিয়ার শরণ নেওয়া ছাড়া উপায় ছিল না।
বাস্তবে ‘পরম ব্যতিক্রমী ব্যবস্থা’য় বেশির ভাগ সিদ্ধান্ত ও পদক্ষেপ পুরোনো ব্যবস্থার পদ্ধতি মেনেই নেওয়া হয়। কারণ, পদ্ধতিগুলো প্রায় সব জায়গাতেই একই থাকে। পার্থক্য থাকে শুধু কোন সার্বভৌম শক্তি সিদ্ধান্ত দিচ্ছে, কেন, কীভাবে, কখন, কাকে দিচ্ছে, এসব ক্ষেত্রে।
আরও একটি কারণে আগের মতো করেই কাজগুলো করা হয়, সেটা হলো, এ পদ্ধতিগুলো শাসনতান্ত্রিক ধারাবাহিকতা রক্ষা, সার্বভৌম শক্তিকে সাধারণ জনগণের কাছে সহজে অনুভূত বা আবির্ভূত হওয়া ও অনুকরণযোগ্য সবচেয়ে ভালো শাসনতান্ত্রিক দৃষ্টান্ত হিসেবে প্রয়োগ করা সুবিধাজনক। কিন্তু যত যা–ই হোক না কেন, সব সিদ্ধান্ত ও পদক্ষেপই নতুন সার্বভৌম শক্তির সিদ্ধান্তের অধস্তন হয়ে যায়।
২.২০২৪ সালের ৫ আগস্টের পর আমরা যে ‘পরম ব্যতিক্রমী ব্যবস্থা’য় ঢুকে গিয়েছি, তা ছাত্র–জনতার দাবি ও সক্রিয় আন্দোলনের মুখে সাংবিধানিক পদাধিকারী বিভিন্ন ব্যক্তির পদত্যাগ বা অব্যাহতির ঘটনা থেকে আঁচ করা যায়। স্বাভাবিক সাংবিধানিক অবস্থায় ‘সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল’ বা জাতীয় সংসদে অভিশংসনের প্রক্রিয়া ছাড়া এদের পদচ্যুত করার সুযোগ নেই; কিন্তু সবই হয়েছে আর তা হয়েছে পরম ব্যতিক্রমী ব্যবস্থায়, যেখানে অভ্যুত্থানে বিজয়ীদের অভিপ্রায়ই প্রাধান্য লাভ করে।
তত্ত্বে যেভাবেই থাক না কেন, আমাদের রাষ্ট্র পরিচালনার ইতিহাসে এমন অনেক দৃষ্টান্ত রয়েছে। ১৯৫৮ সালের পাকিস্তানে আইয়ুব খান সংবিধান রদ করে ‘আইন (বলবৎকরণ) আদেশ, ১৯৫৮’ জারি করেন। তাতে ১৯৫৬ সালের সংবিধানকে মৃত সংবিধান অভিহিত করে রদ করা হলেও সেটিকেই আবার ‘ভেন্টিলেশন’–এ আনা হয়। বলা হয়, রাষ্ট্রীয় সব কর্মকাণ্ড যত দূর সম্ভব ‘মৃত সংবিধান’ অনুযায়ীই চলবে, তবে সামরিক আইনের ওপর প্রাধান্য পাবে।
১৯৬৯ সালে আইয়ুব নিজেই যখন মসনদ ছাড়তে বাধ্য হন, তখন ইয়াহিয়া খান মার্শাল ল জারি করে সংবিধান রদ করে হুবহু একই পদ্ধতি অবলম্বন করেন ‘অস্থায়ী সংবিধান আদেশ, ১৯৬৯’ দিয়ে।
আরও পড়ুনজুলাই সনদ নিয়ে মতভেদ এত প্রবল কেন?৩০ আগস্ট ২০২৫বাংলাদেশে ১৯৭৫ সালের ২০ আগস্টে জারি করা মার্শাল ল প্রোক্লেমেশনের ঙ ও চ—দফার মাধ্যমে ঘোষণাপত্র ও সামরিক আইন বিধিমালা ও আদেশ সাপেক্ষে সংবিধান বলবৎ রাখা হয়। এই অধিসাংবিধানিক বন্দোবস্তের অধীনেই ১৯৭৫-৭৯ পর্যন্ত প্রণীত অনেকগুলো ‘প্রোক্লেমেশন অর্ডার’ বলেই সংবিধান সংশোধন করা হয়।
এসব সংশোধন, সংযোজন, বিয়োজন ঘটানো সাংবিধানিক কাঠামো দিয়েই রাষ্ট্র পরিচালনা করে ১৯৭৯ সালের জাতীয় সংসদ নির্বাচনও সেই সাংবিধানিক বন্দোবস্তের অধীনেই সম্পন্নের পর গঠিত জাতীয় সংসদে সেগুলো অনুমোদিত হয়। ভুলে গেলে চলবে না যে পঞ্চম সংশোধনী দিয়ে প্রত্যক্ষভাবে সংবিধানে কোনো সংশোধনীই আনা হয়নি, শুধুই অধিসাংবিধানিক বন্দোবস্তের অধীনে আনা সংশোধনীগুলোই অনুমোদন করা হয়।
১৯৮২ সালে এরশাদ ক্ষমতা দখল করে সংবিধান স্থগিত করে দেন এবং আরেক কাঠি সরেস হয়ে ২৪ মার্চ ১৯৮২ জারি করা মার্শাল ল প্রোক্লেমেশনকে সর্বোচ্চ আইন হিসেবে ঘোষণা করে এর অধস্তন হিসেবে পূর্ববর্তী সব আইনকানুন, ব্যবস্থা চালু রাখেন। এর অধীনে তিনিও ‘প্রোক্লেমেশন অর্ডার’ জারি করে সংবিধানে সংশোধনী আনেন, যেগুলো পরে সপ্তম সংশোধনী হিসেবে অনুমোদিত হয়।
১৯৭১ সালে ১০ এপ্রিল স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রে বাংলাদেশ সরকার একটি আইন জারি করে ‘আইনের ধারাবাহিকতা বলবৎকরণ আদেশ, ১৯৭১’ নামে। এ আইনের বলে ২৫ মার্চ ১৯৭১ পর্যন্ত বিদ্যমান সব আইন, বিধিবিধানকে স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রের অধীনে কার্যকর রাখা হয়। এরও আগে ১৯৪৭ সালের ভারত-পাকিস্তান সৃষ্টির সময়েও দেখা যায়, নতুন বন্দোবস্তের আলোকে ভারতীয় স্বাধীনতা আইন, ১৯৪৭ এর ১৮(৩) ধারাতেও উভয় রাষ্ট্রের ক্ষেত্রে আগের সব আইন কার্যকর রাখা হয়।
এসব দৃষ্টান্ত থেকেই বোঝা যায়, যারাই একটা নতুন রাজনৈতিক ব্যবস্থা কায়েম করে, তারা পূর্বের সংবিধান বা আইনি কাঠামোর যেটুকু মানতে চায়, সেটুকুই নিতে পারে। চাইলে পুরোটাই নিতে পারে, না চাইলে পুরোপুরি বাদও দিতে পারে। একবার পূর্ববর্তী সংবিধানের কিছু নিয়েছে বলেই তা সব সময় মেনে চলতে হবে, এ রকম কোনো বাধ্যবাধকতা নেই।
প্রকৃতপক্ষে এটা অভ্যুত্থানের একটা মূলনীতি; পূর্বের কাঠামো থেকে যত দূর সম্ভব বেরিয়ে আসা। কিন্তু যত দিন পর্যন্ত পুরোপুরি বেরিয়ে আসা সম্ভব না হয়, তত দিন আগের রাষ্ট্রকাঠামোর কলকবজাগুলো প্রয়োজনমতো গৃহীত বা বর্জিত হয়। তাদের এই ম্যান্ডেট দেয় অভ্যুত্থানকারী রাজনৈতিক জনগোষ্ঠী।
৩.এমন পরিপ্রেক্ষিতে আমাদের রাজনৈতিক পরিসরে চাঞ্চল্য সৃষ্টি করা আরেকটা বয়ান নিয়ে দুটো কথা না বললেই নয়। এটি প্রথম প্রকাশ্যে আনেন কবি, লেখক ও চিন্তক ফরহাদ মজহার। তাঁর মতে, বিদ্যমান সংবিধান অনুযায়ী শপথ নেওয়ার মাধ্যমে অন্তর্বর্তী সরকারের ‘বিপ্লবী চরিত্র’ নষ্ট হয়ে গেছে।
ফরহাদ মজহারের এ রকম বক্তব্যে যুক্তি আছে কি নেই, তাঁর চেয়ে বড় কথা হলো, গণ–অভ্যুত্থানের রাজনীতি, সরকারের বৈধতা, শাসনতান্ত্রিক পরম্পরার ব্যাপারগুলোতে এটাই একমাত্র বা শেষ কথা নয়। এর কারণটি হলো, কাঠামো বদলে গেলেই বৈধতার নতুন পথ তৈরি হয়।
উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, ১৯৭১ সালে যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর পাকিস্তানিরা ১৯৭০ সালের নির্বাচনে বিজয়ী অনেক জাতীয় পার্লামেন্ট সদস্যকে (এমএনএ) অযোগ্য ঘোষণা করে। তারপর সেসব আসনে উপনির্বাচন দিয়ে বেশির ভাগ আসনে পছন্দের প্রার্থীদের একতরফাভাবে জিতিয়ে আনে।
কিন্তু বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর ’৭০-এর নির্বাচনে বিজয়ী পূর্বের পার্লামেন্ট সদস্যরাই গণপরিষদের সদস্য হিসেবে বাংলাদেশের সংবিধান প্রণয়ন করেন। একই সময় পাকিস্তানেও একটি গণপরিষদ গঠিত হয় ’৭০–এর নির্বাচনে বিজয়ীদের নিয়ে, যেখানে বাংলাদেশ থেকে নির্বাচিত দুজন এমপি ছিলেন নুরুল আমীন ও রাজা ত্রিদিব রায়। বাংলাদেশের গণপরিষদে আবার এই দুজনকে অযোগ্য ঘোষণা করা হয়।
এ থেকে বোঝা যায়, জনগণের অভিপ্রায় বদলে গিয়েছিল বলেই নতুন কাঠামোর জন্ম হয়েছিল, বৈধতার নতুন নতুন নিয়ম ও পদ্ধতি তৈরি হয়েছিল।
বিশুদ্ধ রাজনৈতিক অঙ্গীকার ছাড়া পরবর্তী সংসদকেও জুলাই সনদ বাস্তবায়নে বাধ্য করার সুযোগ নেই। কারণ, জনগণের মতামতের ভিত্তিতে গঠিত সেই সংসদও নিজেদের ইচ্ছেমতো সিদ্ধান্ত নেওয়ার ম্যান্ডেট পাবে। তখন তারা নতুন আরেকটি সাংবিধানিক কাঠামোর জন্ম দেবে। তারা যদি জুলাই সনদের আংশিক বাস্তবায়ন করে, তখন তাদের বাধ্য করার ক্ষমতা সংবিধানে থাকবে না; শুধুই রাজপথই হতে পারে তার সমাধান।৪.আধুনিক কালে সরকার বা কোনো রাজনৈতিক ব্যবস্থার বৈধতার সবচেয়ে গ্রহণযোগ্য পথ হলো সংশ্লিষ্ট রাজনৈতিক ভূখণ্ডের নাগরিক, সামাজিক–রাজনৈতিক সংগঠন ও আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের কাছ থেকে স্বীকৃতি লাভ। শুরুতেই জনগণ ও বহির্বিশ্বের স্বীকৃতির ভেতর দিয়ে জুলাই-উত্তর নয়া রাষ্ট্রব্যবস্থা তার সার্বভৌম ক্ষমতা সুসংহত করেছে।
এই দৃষ্টিভঙ্গির আলোকে চলতি সংবিধানের আওতায় শপথ নিলেও তাতে অন্তর্বর্তী সরকারের বিপ্লবী চরিত্র ক্ষুণ্ন হয়নি বলেই প্রতীয়মান হয়। কারণ, ৩৬ জুলাই এখানে জনগণের গাঠনিক ক্ষমতার উন্মেষ ও একটা ‘পরম ব্যতিক্রমী অবস্থা’র জন্ম দিয়েছে।
‘পরম ব্যতিক্রমী ব্যবস্থা’ সার্বভৌম ক্ষমতাকে বাছাই করার ম্যান্ডেট দেয়, কী করতে হবে আর কী না করলেও চলবে। তাই অন্তর্বর্তী সরকার গঠনে সংবিধানের ১০৬ অনুচ্ছেদের অধীনে আদালতের মতামত নেওয়া এবং বিদ্যমান সংবিধানের অধীনে শপথ গ্রহণকে ‘অবৈধ’ বলার সুযোগ নেই।
আরও পড়ুনজুলাই সনদ নিয়ে কিছু ভাবনা১৮ আগস্ট ২০২৫৫.তাহলে জুলাই সনদ নিয়ে কি সংবিধানের ১০৬ অনুচ্ছেদের শরণাপন্ন হওয়া যেতে পারে? এর জবাব হলো, সেটা হতেও পারে, আবার না–ও হতে পারে। এটাও সার্বভৌম ক্ষমতার সিদ্ধান্তের বিষয়। এ রকম প্রেক্ষাপটে প্রশ্ন হলো, আগামী নির্বাচন কি গণপরিষদ নির্বাচন হবে? সেখানে কি জুলাই সনদ অনুযায়ী সংবিধান পুনর্লিখন করার বিষয়টি অন্তর্ভুক্ত থাকা উচিত?
লক্ষণীয়, ১৯৭২ সালে গঠিত গণপরিষদ বাংলাদেশের সংবিধান প্রণয়নের জন্য ম্যান্ডেটপ্রাপ্ত ছিল না। ১৯৭০ সালের নির্বাচনে তারা পাকিস্তানের সংবিধান রচনার জন্য রায় পেয়েছিলেন। আবার সেই নির্বাচনে জয়ী দল তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান তথা বর্তমান বাংলাদেশে ভোট পেয়েছিল ৭৫ দশমিক ১১ শতাংশ। ফলে অঙ্কের হিসাবেই এখানকার ২৫ শতাংশ মানুষের প্রতিনিধিত্বও সেই গণপরিষদের ছিল না।
আবার গণপরিষদ গঠনের সঙ্গে সঙ্গে গণপরিষদের সদস্যদের সদস্যপদ বাতিল আদেশ পাস করে এর তাঁদের দলীয় সিদ্ধান্তের বাইরে গিয়ে মতপ্রকাশের সুযোগ বন্ধ করে দেওয়া হয়েছিল। এভাবে ২০ জনকে বহিষ্কারও করা হয়েছিল। ফলে ওই গণপরিষদের পক্ষে স্বাধীনভাবে জনগণের অভিপ্রায় ব্যক্ত করা সম্ভব ছিল কি না, তা নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে।
সর্বোপরি ওই গণপরিষদের দ্বারা প্রণীত সংবিধান অর্ধশতাব্দীর বেশি সময় ধরে জনগণের আকাঙ্ক্ষা পূরণ করতে পারেনি; এ দেশে বারবার ঘটা গণ–অভ্যুত্থান, সংবিধান স্থগিত, সংবিধান পুনর্লিখনের মতো ঘটনাগুলো থেকেই তা বোঝা যায়। এর ফলে জনগণকে স্বাধীনভাবে তাদের অভিপ্রায় প্রকাশের সুযোগ দিতে গণপরিষদ নির্বাচনের দাবিকে ইতিবাচক বলেই প্রতীয়মান হয়।
এ রকম পটভূমিতে জুলাই সনদের আইনগত অবস্থান বা এর বাস্তবায়নের পদ্ধতিকে বিবেচনায় নিতে হবে। ৫ আগস্ট থেকে অন্তর্বর্তী সরকারের ক্ষমতায় থাকা এবং রাষ্ট্র পরিচালনার ভিত্তি জুলাই অভ্যুত্থানের চেতনা। আর এই পুরো কর্মযজ্ঞের প্রতিভূ হিসেবেই ধরতে হবে জুলাই সনদকে। সে ক্ষেত্রে সাংবিধানিক বন্দোবস্তের ভেতর দিয়েই এর বাস্তবায়ন হওয়াই মানানসই হয়।
আগামী নির্বাচনের মাধ্যমে গতানুগতিক সাংবিধানিক বন্দোবস্তে ফেরত আসার পর জুলাই সনদের বাস্তবায়নকে বিদ্যমান সংবিধানের অধীনে বা এর মুখাপেক্ষী করা হলে জুলাই অভ্যুত্থানের চেতনা তার কর্তৃত্ব হারাবে। এতে যে সাংবিধানিক ব্যবস্থাকে উৎখাত করে জুলাই সংঘটিত হয়েছিল, সেই ব্যবস্থার অধীনেই জুলাই অভ্যুত্থানের বৈধতা-অবৈধতার বিচার বা পর্যালোচনার বিষয়টি উন্মুক্ত হয়ে পড়বে।
আরও পড়ুনজুলাই ঘোষণাপত্র: জন-আকাঙ্ক্ষা এবং রাষ্ট্রের অভিপ্রায়০৮ আগস্ট ২০২৫আবার পরবর্তী সংসদই কেবল এগুলো বাস্তবায়ন করার আইনগত ক্ষমতার অধিকারী, এটাও অলঙ্ঘনীয় কোনো ব্যাপার নয়।
পঞ্চম ও সপ্তম সংশোধনীর ক্ষেত্রে এ রকম দেখা গেছে; একইভাবে জুলাই সনদ আগে বাস্তবায়ন করে পরে নির্বাচিত সংসদের মাধ্যমে অনুমোদন নেওয়া যেতে পারে।
বিশুদ্ধ রাজনৈতিক অঙ্গীকার ছাড়া পরবর্তী সংসদকেও জুলাই সনদ বাস্তবায়নে বাধ্য করার সুযোগ নেই। কারণ, জনগণের মতামতের ভিত্তিতে গঠিত সেই সংসদও নিজেদের ইচ্ছেমতো সিদ্ধান্ত নেওয়ার ম্যান্ডেট পাবে। তখন তারা নতুন আরেকটি সাংবিধানিক কাঠামোর জন্ম দেবে। তারা যদি জুলাই সনদের আংশিক বাস্তবায়ন করে, তখন তাদের বাধ্য করার ক্ষমতা সংবিধানে থাকবে না; শুধুই রাজপথই হতে পারে তার সমাধান।
কিন্তু সব রাজনৈতিক প্রশ্নের মীমাংসা রাজপথে হওয়া রাজনৈতিক পরিপক্বতার লক্ষণ নয়। কিছু ফয়সালা জাতীয় ঐকমত্য, কিছু নির্বাচনে আর কিছু সংসদে নেওয়ার মধ্যেই নিহিত থাকে রাষ্ট্রের স্থিতিশীতলতা। জুলাই সনদ প্রশ্নে যে সিদ্ধান্তই নেওয়া হোক না কেন, এ বিষয়গুলো বিবেচনায় রাখতে হবে।
মিল্লাত হোসেন আইন–আদালত, সংবিধান বিষয়ে লেখক ও গবেষক
মতামত লেখকের নিজস্ব