বাংলাদেশের কৃষি অর্থনীতিতে বাণিজ্যিক ফলবাগানের গুরুত্ব ক্রমশ বাড়ছে। দেশি-বিদেশি উচ্চমূল্যের ফল ফসলের আবাদ বিস্তৃত হচ্ছে। তরুণ উদ্যোক্তারা কৃষিতে আসার ফলে আধুনিক প্রযুক্তির প্রয়োগও দ্রুতগতিতে বাড়ছে। 

বর্তমানে সীমিত পরিসরে আধুনিক প্রযুক্তির ব্যবহার হচ্ছে। এর ব্যাপক প্রয়োগ নিশ্চিত করা গেলে উৎপাদনশীলতা বাড়বে। অধিকতর লাভজনক বাণিজ্যিক বাগান গড়ে তোলা সম্ভব হবে। এই প্রেক্ষাপটে স্মার্ট গার্ডেন, ড্রিপ ইরিগেশন, মালচিং ফিল্ম, ড্রোন, সেন্সর প্রযুক্তি এবং সংরক্ষণ ব্যবস্থার সমন্বয়ে রূপ নিচ্ছে আধুনিক কৃষিব্যবস্থা।

স্মার্ট গার্ডেন হলো এমন এক আধুনিক প্রযুক্তিনির্ভর বাগান ব্যবস্থাপনা পদ্ধতি, যেখানে স্বয়ংক্রিয় ও নিয়ন্ত্রিত পরিবেশে উন্নতমানের ফসল উৎপাদন করা হয়। এখানে তাপমাত্রা, আলো, আর্দ্রতা এবং মাটির গুণাগুণ সেন্সরের মাধ্যমে সূক্ষ্মভাবে নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব। এই প্রযুক্তির সঠিক ব্যবহারে উৎপাদন ব্যয় কমায় এবং ফলনের পরিমাণ উল্লেখযোগ্য হারে বাড়ে। 

ড্রিপ ইরিগেশন পদ্ধতি মাটিতে সুনির্দিষ্ট পরিমাণে পানি সরবরাহ নিশ্চিত করে ফসলের স্বাভাবিক বৃদ্ধিতে সহায়তা করে। এতে পানির অপচয় কমে এবং গাছের সুষম বৃদ্ধি নিশ্চিত হয়। পানিসাশ্রয়ী আরেকটি জনপ্রিয় প্রযুক্তি হলো মালচিং ফিল্মের ব্যবহার, যা মাটির আর্দ্রতা সংরক্ষণ, আগাছা নিয়ন্ত্রণ করে কৃষকের উৎপাদন খরচ কমায়।

উন্নত দেশে কৃষিকাজে ড্রোন ও সেন্সর প্রযুক্তির ব্যবহার কৃষকদের ফসল উৎপাদন ও বাগান ব্যবস্থাপনা অনেক সহজ এবং দক্ষ করে তুলেছে। এর মাধ্যমে ফলবাগানের রোগ ও পোকামাকড়ের উপস্থিতি নির্ভুলভাবে চিহ্নিতকরণ এবং শুধু প্রয়োজনীয় স্থানে সার ও কীটনাশক প্রয়োগ করা যায়। 

টিস্যুকালচার প্রযুক্তির ব্যবহারে ফলবাগানে উন্নত গুণমানসম্পন্ন, রোগমুক্ত এবং মাতৃগুণাগুণ সম্পন্ন চারা উৎপাদনের নতুন সম্ভাবনার দ্বার উন্মোচিত হয়েছে। কৃষি মন্ত্রণালয়ের ‘টিস্যুকালচার ল্যাবরেটরি কাম হর্টিকালচার সেন্টার স্থাপন ও উন্নয়ন প্রকল্প’-এর মাধ্যমে ইতোমধ্যে এই খাতে গুরুত্বপূর্ণ অগ্রগতি অর্জিত হয়েছে। দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে এই প্রযুক্তির ব্যবহার বিস্তৃত করছে। 

টিস্যুকালচার প্রযুক্তির সাহায্যে অল্প জায়গায় বড়সংখ্যক উন্নতমানের একই বৈশিষ্ট্যসম্পন্ন চারা একসঙ্গে উৎপাদন করা সম্ভব। এতে উৎপাদনশীলতা বাড়ে এবং কৃষকের আয়ও বেড়ে যায়। কলা, আনারস, স্ট্রবেরি, আঙ্গুরের মতো উচ্চমূল্যের ফসল চাষে ইতোমধ্যে টিস্যুকালচারের সফল প্রয়োগ দেখা যাচ্ছে।
ফল ও সবজি সংরক্ষণেও আধুনিক প্রযুক্তির ব্যবহার ব্যাপক পরিবর্তন এনেছে। এ ক্ষেত্রে ফারমারস মিনি কোল্ডস্টোরেজ বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য।  
বাংলাদেশের কৃষিতে আধুনিক প্রযুক্তির যথাযথ ব্যবহারকে উৎসাহিত করতে সরকার, কৃষিবিদ, উদ্যোক্তা এবং কৃষকদের সমন্বিত প্রচেষ্টা অপরিহার্য। 
লেখক: প্রকল্প পরিচালক, টিস্যুকালচার অ্যান্ড হর্টিকালচার উন্নয়ন প্রকল্প, ডিএই।

.

উৎস: Samakal

কীওয়ার্ড: ফল ব যবস থ

এছাড়াও পড়ুন:

অবৈধভাবে খাল দখল: এক কিলোমিটারেই ১১ ভবন, ৭০ দোকান

লক্ষ্মীপুরে অবৈধভাবে খাল দখলের যেন মহোৎসব চলছে। জেলার পাঁচ উপজেলার প্রায় অর্ধশতাধিক খাল ইতিমধ্যে অস্তিত্ব সংকটে পড়েছে। প্রতিদিনই খালের দুই পাড় ভরাট করে গড়ে উঠছে অবৈধ স্থাপনা। এতে পানি নিষ্কাশন ব্যবস্থা ব্যহত হওয়ায় সামান্য বৃষ্টিতেই সৃষ্টি হচ্ছে জলাবদ্ধতা। 

জেলার কমলনগর উপজেলার হাজিরহাট বাজার এলাকায় জারিরদোনা খালের এক কিলোমিটার জায়গায় অবৈধভাবে গড়ে উঠেছে ১১টি বহুতল ভবন ও ৭০টির মতো দোকানপাট। নির্মাণ করা হয়েছে ১১টি বক্স কালভার্ট। সংশ্লিষ্ট দপ্তরের নাকের ডগায় খাল দখল করলেও প্রশাসন নীরব ভূমিকা পালন করছে। এতে দখলদাররা বেপরোয়া হয়ে উঠছে এবং দখল করেই যাচ্ছে। 

এদিকে, লক্ষ্মীপুর জেলা প্রশাসন কার্যালয় থেকে ৮০ জন দখলবাজের তালিকা তৈরি করে তাদের দখলে থেকে খালটি উদ্ধার করতে উচ্ছেদের আদেশ হলেও কার্যকর প্রদক্ষেপ নিচ্ছে না স্থানীয় প্রশাসন।

স্থানীয় ব্যবসায়ী আব্দুল ওহাব, আক্তার হোসেন ও এলাকাবাসী আজাদ উদ্দিন ও আব্দুর রহমান জানান, উপজেলার চরফলকন, চরলরেন্স, হাজিরহাট ও সাহেবেরহাট ইউনিয়নসহ বিস্তীর্ণ অঞ্চলের কৃষিকাজে এই খালের পানি ব্যবহার করা হয়। পানির স্বাভাবিক চলাচল বাধাগ্রস্ত হওয়ায় শুষ্ক মৌসুমে যেমন পানির সংকটে কৃষিকাজ ব্যাহত হয়। আবার বর্ষা মৌসুমেও পানি নিষ্কাশনজনিত সমস্যায় সয়াবিন, ধান, মরিচ, বাদাম ও সবজিসহ বিভিন্ন ফসল ও বীজতলা ক্ষতিগ্রস্ত হয়। জলাবদ্ধতা সৃষ্টি হয়ে মানুষ পানিবন্দি হয়ে পড়ে।

স্থানীয়দের অভিযোগ, খালের দুই পাড়ে রাজনৈতিক ও প্রভাবশালী নেতাদের ছত্রছায়ায় প্রতিদিনই অবৈধভাবে গড়ে উঠছে কোনো না কোনো স্থাপনা। পাউবোর কয়েকজন অসাধু কর্মকর্তার যোগসাজশে চলে এসব অবৈধ দখল। কয়েক দিন পরপর দখলদারদের হাত থেকে এসব অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদে অভিযান চালায় প্রশাসন। কিন্তু উচ্ছেদের কিছুদিন পর আবারও দখল হয়ে যায়।

সরেজমিন ঘুরে দেখা গেছে, হাজিরহাট বাজারের উত্তর অংশের ১০০ মিটারের মধ্যে ‘হাজী মোতাহের হোসেন সুপারমার্কেট, আল মোস্তফা মঞ্জিল নামে চারতলাসহ অন্তত ১১টি বহুতল ভবন নির্মাণ করা হয়েছে। এছাড়া ছোট-বড় প্রায় ৭০টি টিনশেড দোকানঘর নির্মাণ করা হয়েছে।

উপজেলা ভূমি অফিসের তথ্য মতে, পিএস জরিপে হাজিরহাট বাজার অংশে খালের প্রশস্ততা ছিল গড়ে প্রায় ৩২ ফুট। বর্তমান আরএস জরিপে তা দাঁড়িয়েছে মাত্র ২০ ফুটে।

কমলনগর উপজেলা সহকারী কমিশনার (ভূমি) আরাফাত হুসাইন বলেন, “এরই মধ্যে অবৈধ স্থাপনা নির্মাণকারীদেরকে নোটিশ করা হয়েছে। কিন্তু তারা কোন সাড়া দেয়নি। জেলা প্রশাসনের নির্দেশে তালিকাভূক্ত ৮০ স্থাপনার বিরুদ্ধে উচ্ছেদ অভিযানসহ শিগগিরই ব্যবস্থা নেওয়া হবে।”

অন্যদিকে রহমতখালী খালের লক্ষ্মীপুর পৌরসভা এলাকায় সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, ময়লা পানি, আবর্জনা আর সংকীর্ণতায় অস্তিত্ব হারাতে বসেছে খালটি। দুই পাড় দখল করে গড়ে উঠেছে দোকান ও বাড়িঘরসহ অবৈধ স্থাপনা। বছরের পর বছর ধরে গড়ে ওঠা এসব স্থাপনা চলছে বহাল তবিয়তে। এতে ময়লা-আর্বজনার স্তূপ জমে সংকীর্ণ হয়ে পড়েছে খালটি। এর ফলে পানি নিষ্কাশন বন্ধ হয়ে জলাবদ্ধতা সৃষ্টি হচ্ছে আর দুর্ভোগ বাড়ছে মানুষের। একই অবস্থা ডাকাতিয়া নদীতেও।

লক্ষ্মীপুর পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাউবো) ও এলাকাবাসী সূত্রে জানা যায়, লক্ষ্মীপুর সদর, রায়পুর, রামগতি, কমলনগর ও রামগঞ্জ উপজেলার ওপর দিয়ে বয়ে যাওয়া রহমতখালী খাল ও ডাকাতিয়া নদীসহ প্রায় অর্ধশতাধিক খালই এখন মৃতপ্রায়। প্রায় ১৫০ কিলোমিটার এলাকাজুড়ে এসব খাল ও নদীর অস্তিত্ব ছিল।

লক্ষ্মীপুর জেলা জজ কোর্টের আইনজীবী মাহীর আসহাব বলেন, “রহমতখালী খাল প্রায় ২০০ ফুট চওড়া ছিল। দখলের কারণে তা এখন মাত্র ৩০-৪০ ফুটে দাঁড়িয়েছে। পৌরসভার বেশির ভাগ বর্জ্যই এখন এই খালে যাচ্ছে। ফলে দূষিত হচ্ছে পরিবেশ।”

জেলা পাউবোর নির্বাহী প্রকৌশলী নাহিদুল জামাল বলেন, “খাল দখলে কোনো কর্মকর্তা জড়িত থাকলে তদন্ত করে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। এরই মধ্যে অবৈধ দখলদারদের তালিকা করা হয়েছে। এরপর উদ্ধার অভিযান চালানো হবে। কাউকে ছাড় দেওয়া হবে না। ইতোমধ্যে কিছু কিছু জায়গায় অভিযান চালানো হয়েছে।”

ঢাকা/লিটন/এস

সম্পর্কিত নিবন্ধ