মহানবী হজরত মুহাম্মদ (সা.)-এর জন্ম মানব ইতিহাসের একটি অলৌকিক ও তাৎপর্যপূর্ণ ঘটনা, যা শুধু আরবের সীমানায় সীমাবদ্ধ নয়, বরং সমগ্র বিশ্বের ধর্মীয়, সাংস্কৃতিক ও আধ্যাত্মিক ক্ষেত্রে গভীর প্রভাব ফেলেছে।

তাঁর জন্মের সময়, স্থান ও এর সঙ্গে যুক্ত অলৌকিক ঘটনাগুলো ঐতিহাসিক ও হাদিস সূত্রে বিশদভাবে বর্ণিত হয়েছে।

তাঁর জন্মের সময়, স্থান ও এর সঙ্গে যুক্ত অলৌকিক ঘটনাগুলো ঐতিহাসিক ও হাদিস সূত্রে বিশদভাবে বর্ণিত হয়েছে।জন্মের সময় ও স্থান

মহানবী (সা.

) মক্কায় জন্মগ্রহণ করেন, যা তৎকালীন আরবের ধর্মীয় ও বাণিজ্যিক কেন্দ্র হিসেবে পরিচিত ছিল। বেশির ভাগ ঐতিহাসিক সূত্র অনুসারে, তিনি ৫৭০ খ্রিষ্টাব্দে (৫৩ হিজরিপূর্বে) রবিউল আউয়াল মাসের ১২ তারিখে জন্মগ্রহণ করেন। এই তারিখ ইবনে ইসহাক ও ইবনে হিশামের বর্ণনার ভিত্তিতে সর্বাধিক গৃহীত। (ইবনে হিশাম, সিরাতুন নবী, ১/১৫৮, দারুল কুতুবিল ইলমিয়া, বৈরুত, ১৯৯৮)।

তবে কিছু সূত্রে ২, ৮, ১০ বা ১৭ রবিউল আউয়ালের উল্লেখ পাওয়া যায়। ইবনে আবদুল বার ২ রবিউল আউয়াল এবং ইবনে হাজাম ৮ রবিউল আউয়ালের কথা উল্লেখ করেছেন। (ইবনে আবদুল বার, আল-ইসতিআব ফি মা‘রিফাতিল আসহাব, ১/২৫, দারুল জিল, বৈরুত, ১৯৯২)

আরও পড়ুনপ্রথম নারী হাওয়া (আ.)-র জন্ম যেভাবে০১ মে ২০২৫

তাঁর জন্ম হয় সোমবার, যেদিন তাঁর জীবনের অন্য অনেক গুরুত্বপূর্ণ ঘটনাও ঘটেছে। ইবনে কাসিরের মতে, তিনি সোমবার জন্মগ্রহণ করেন, সোমবার নবুয়ত লাভ করেন, মক্কা থেকে মদিনায় হিজরত করেন সোমবার, মদিনায় পৌঁছান সোমবার এবং মৃত্যুবরণও করেন সোমবার। (ইবনে কাসির, আল-বিদায়া ওয়ান নিহায়া, ২/২৬০, দারুল ফিকর, বৈরুত, ১৯৮৮)

হাদিসে তিনি বলেন, ‘এটি সেই দিন, যেদিন আমি জন্মগ্রহণ করি এবং এই দিনে আমার ওপর (কোরআন) অবতীর্ণ হয়।’ (সহিহ মুসলিম, হাদিস: ১,১৬২)

তাঁর জন্ম হয় কুরাইশ গোত্রের একটি সম্ভ্রান্ত পরিবারে। তাঁর পিতা আবদুল্লাহ ইবনে আবদুল মুত্তালিব এবং মাতা আমিনা বিনতে ওয়াহাব ছিলেন কুরাইশের সম্মানিত ব্যক্তিত্ব। আবদুল্লাহ তাঁর জন্মের আগেই মৃত্যুবরণ করেন।

এটি (সোমবার) সেই দিন, যেদিন আমি জন্মগ্রহণ করি এবং এই দিনে আমার ওপর (কোরআন) অবতীর্ণ হয়।সহিহ মুসলিম, হাদিস: ১,১৬২

মুহাম্মদ ইবনে সাদের মতে, আবদুল্লাহ মদিনায় তাঁর মায়ের আত্মীয়দের কাছে অসুস্থ হয়ে পড়েন এবং সেখানেই মৃত্যুবরণ করেন, যখন আমিনা তাঁকে গর্ভে ধারণ করেছিলেন। (আত-তাবাকাতুল কুবরা, ১/১০০, দারু সাদির, বৈরুত, ১৯৬০)

এই ঘটনা তাঁর জীবনের প্রথম দিন থেকেই তাঁকে একজন এতিম হিসেবে চিহ্নিত করে দেয়।

অলৌকিক ঘটনাবলি

মহানবীর জন্মের সঙ্গে যুক্ত অলৌকিক ঘটনাগুলো ঐতিহাসিক ও হাদিস সূত্রে বর্ণিত হয়েছে। তাঁর মা আমিনা বিনতে ওয়াহাব জানিয়েছেন, তিনি গর্ভধারণের সময় একটি নূর (আলো) দেখেছিলেন, যা শামের (সিরিয়া) প্রাসাদ পর্যন্ত আলোকিত করেছিল। (মুহাম্মদ ইবনে ইসহাক, সিরাতু রাসুলিল্লাহ, পৃ. ৬৯, দারুল মা‘রিফা, বৈরুত, ১৯৭৮)

তিনি আরও বলেন, জন্মের সময় তাঁর থেকে একটি নূর প্রকাশিত হয়, যা পূর্ব থেকে পশ্চিম পর্যন্ত বিস্তৃত হয় এবং শামের প্রাসাদ ও বাজারগুলো আলোকিত করে। (ইবনে কাসির, আল-বিদায়া ওয়ান নিহায়া, ২/২৭৩, দারুল ফিকর, বৈরুত, ১৯৮৮)

আমিনা জানান, তিনি গর্ভধারণের সময় একটি স্বপ্নে দেখেন যে তিনি এই উম্মতের ‘সাইয়্যিদ’ (নেতা)-কে গর্ভে ধারণ করেছেন এবং তাঁর নাম রাখতে বলা হয় মুহাম্মদ। (মুহাম্মদ ইবনে ইসহাক, সিরাতু রাসুলিল্লাহ, পৃ. ৬৯, দারুল মা‘রিফা, বৈরুত, ১৯৭৮)

আরও পড়ুনযে ৪টি পরীক্ষা নবীজি (সা.)–এর জীবনকে দৃঢ়তা দিয়েছে২২ জুলাই ২০২৫

জন্মের সময় আরও কিছু অলৌকিক ঘটনা ঘটে। আস-সুহাইলি উল্লেখ করেন, তাঁর জন্মের রাতে মক্কার প্রতিমাগুলো মুখ থুবড়ে পড়ে যায় এবং পারস্যের অগ্নিকুণ্ড, যা হাজার বছর ধরে জ্বলছিল, নিভে যায়। (আস-সুহাইলি, আর-রওদুল উনুফ, ১/১৫৫, দারুল কুতুবিল ইলমিয়া, বৈরুত, ১৯৮৫)

এই ঘটনাগুলো তাঁর আগমনের মাধ্যমে পৃথিবীতে একটি নতুন আধ্যাত্মিক যুগের সূচনার ইঙ্গিত দেয়। ইবনে কাসিরের মতে, এই ঘটনাগুলো তাঁর নবুয়তের প্রমাণ হিসেবে গণ্য হয়। (ইবনে কাসির, আল-বিদায়া ওয়ান নিহায়া, ২/২৭৫, দারুল ফিকর, বৈরুত, ১৯৮৮)

আরেকটি বর্ণনায় বলা হয়, তিনি জন্মের সময় হাতের ওপর ভর করে বসেন এবং মাথা আকাশের দিকে তুলে তাকান। (মুহাম্মদ ইবনে সা‘দ, আত-তাবাকাতুল কুবরা, ১/১০২, দারু সাদির, বৈরুত, ১৯৬০)

তাঁর জন্মের সময় ঘরটি নূরে আলোকিত হয় এবং তারাগুলো এত নিচে নেমে আসে যে মনে হয় তারা পড়ে যাবে। (আবু বকর আল-বাইহাকি, দালাইলুন নুবুওয়া, ১/১১৩, দারুল কুতুবিল ইলমিয়া, বৈরুত, ১৯৮৫)

তাঁর জন্মের রাতে মক্কার প্রতিমাগুলো মুখ থুবড়ে পড়ে যায় এবং পারস্যের অগ্নিকুণ্ড, যা হাজার বছর ধরে জ্বলছিল, নিভে যায়।একটি নতুন যুগের সূচনা

মহানবী (সা.)–এর জন্ম শুধু একটি ঐতিহাসিক ঘটনা নয়, বরং এটি একটি নতুন আধ্যাত্মিক যুগের সূচনা। তাঁর জন্মের সময় প্রকাশিত নূর এবং প্রতিমা ও অগ্নিকুণ্ডের ঘটনাগুলো ইঙ্গিত দেয় যে তাঁর আগমন পৃথিবীর ধর্মীয় ও নৈতিক কাঠামোকে বদলে দেবে। ইবনে দিহইয়া উল্লেখ করেন, তাঁর জন্মের সময় নক্ষত্রের অবস্থান এবং জ্যোতির্বিদ্যার ঘটনাগুলো তাঁর মহানত্বের প্রতীক ছিল। (ইবনে দিহিয়া, আত-তানওয়ির ফি মাওলিদিল বাশিরিন নাজির, পৃ. ৪৫, দারুল কুতুবিল ইলমিয়া, বৈরুত, ১৯৯০)

তাঁর জন্মের সময় তাঁর দাদা আবদুল মুত্তালিব তাঁকে কাবায় নিয়ে যান এবং তাঁর জন্য দোয়া করেন, বলেন, ‘আমি তাঁকে আল্লাহর কাছে সমর্পণ করছি, তিনি তাঁর নাম রাখেন মুহাম্মদ।’ (আবু বকর আল-বাইহাকি, দালাইলুন নুবুওয়া, ১/১১৫, দারুল কুতুবিল ইলমিয়া, বৈরুত, ১৯৮৫)

তাঁর নামকরণ ‘মুহাম্মদ’ করা হয়, যার অর্থ ‘প্রশংসিত’, যা তাঁর স্বর্গ ও পৃথিবীতে প্রশংসিত হওয়ার ইঙ্গিত দেয়। (ইবনে হিশাম, সিরাতুন নবী, ১/১৫৯, দারুল কুতুবিল ইলমিয়া, বৈরুত, ১৯৯৮)

মহানবী হজরত মুহাম্মদ (সা.)-এর জন্ম শুধু একটি ঐতিহাসিক ঘটনা নয়, বরং এটি মানবজাতির জন্য একটি আধ্যাত্মিক বিপ্লবের সূচনা। তাঁর জন্মের সঙ্গে যুক্ত অলৌকিক ঘটনা এবং তাঁর জীবনের প্রতিকূলতা তাঁর নবুয়তের সত্যতা ও সর্বজনীনতার প্রমাণ বহন করে।

সূত্র: আল-মালুম আন আল-জাদওয়াল আত-তারিখি লি-সিরাতির রাসুল

আরও পড়ুনজীবন ও মৃত্যু: পরিপূরক নাকি বিপরীত২১ আগস্ট ২০২৫

উৎস: Prothomalo

কীওয়ার্ড: দ র ল ক ত ব ল ইলম য র জন ম র সময ঘটন গ ল র জ বন স মব র উল ল খ আবদ ল

এছাড়াও পড়ুন:

ঋণ নেওয়ার আগে যে ১০টি বিষয় অবশ্যই জানা উচিত

নানা কারণে আপনার ঋণ নেওয়ার প্রয়োজন হতে পারে। অনেক সময় মানুষ ব্যক্তিগত ঋণ, গৃহঋণ নেয়। আবার গাড়ি কেনার জন্যও অনেকে ঋণ নেন। ক্রেডিট কার্ডের মাধ্যমেও ঋণ নেওয়া হয়।

কিন্তু অনেকেই ঋণের সঙ্গে সম্পৃক্ত কিছু মৌলিক শব্দ সম্পর্কে জানেন না। ব্যাংকের কর্মকর্তারা যখন এসব শব্দ বলেন, তখন অনেক কিছুই বোঝেন না ঋণ নিতে ইচ্ছুক গ্রাহকেরা। ফলে নিয়মকানুন না জেনেই ঋণ নেন। এতে নানা অপ্রত্যাশিত ঝামেলা তৈরি হয়। তাই ঋণ নেওয়ার আগে কিছু গুরুত্বপূর্ণ বিষয় বোঝা খুব দরকার।

১. আসল টাকা (প্রিন্সিপাল)

আপনি যে পরিমাণ টাকা ঋণ নিচ্ছেন, সেটিই আসল। এর ওপরই সুদ ধরা হয়। কিস্তি পরিশোধের সঙ্গে আসল ধীরে ধীরে কমতে থাকে।

২. সুদের হার (ইন্টারেস্ট রেট)

ঋণ নেওয়ার আগে সবচেয়ে ভাবতে হয় সুদের হার নিয়ে। সুদের হার বেশি হলে খরচ বেড়ে যায়। ঋণের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো সুদের হার। এটি স্থিরও হতে পারে, আবার বাজারদরের ওপর নির্ভর করে বাড়তে-কমতেও পারে।

৩. মাসিক কিস্তি (ইএমআই)

ঋণের সুদ ও আসল পরিশোধ বাবদ প্রতি মাসে যে নির্দিষ্ট টাকা আপনাকে দিতে হবে। সেটি হলো ইএমআই বা ঋণের কিস্তি।

৪. ঋণের মেয়াদ

কত বছরের মধ্যে ঋণ শোধ করতে হবে, সেটিই হলো ঋণের মেয়াদ। মেয়াদ বেশি হলে কিস্তি ছোট হয়। কিন্তু মোট সুদের টাকা বেড়ে যায়। ছোট মেয়াদে কিস্তি বড় হয়। কিন্তু মোট সুদের টাকা কমে।

৫. অ্যানুয়াল পারসেন্টেজ রেট (এপিআর)

শুধু সুদ ও আসল নয়, বরং ঋণের সব খরচ (যেমন ফি, চার্জ) মিলিয়ে আসল ব্যয় কত হবে, তার হিসাব হলো অ্যানুয়াল পারসেন্টেজ রেট (এপিআর)। এটিই প্রকৃত খরচ বোঝায়।

৬. আগাম পরিশোধ (প্রিপেমেন্ট)

ঋণের বোঝা কমাতে অনেকে ঋণের সুদ ও আসলের টাকা আগেই শোধ করে দিতে চান। এতে সুদের খরচ কমে যায়।

৭. প্রসেসিং ফি

আপনি ঋণের জন্য কোনো ব্যাংক বা আর্থিক প্রতিষ্ঠানে আবেদন করলেন। কিন্তু ঋণ আবেদন মঞ্জুর থেকে শুরু করে ছাড় কার্যক্রম পরিচালনার জন্য কিছু মাশুল দিতে হয়। এটিই প্রসেসিং ফি। এটি কখনো ঋণের টাকা থেকে কেটে নেওয়া হয়, আবার কখনো আলাদা দিতে হয়।

৮. স্থগিতকাল (মোরাটোরিয়াম)

বিশেষ পরিস্থিতিতে কিছুদিনের জন্য কিস্তি বন্ধ রাখার সুযোগকেই বলে স্থগিতকাল। তবে এই সময়েও সুদ জমতে থাকে। অনেক সময় ঋণ পরিশোধের জন্য বিশেষ কিস্তি ভাগও করে দেওয়া হয়।

৯. জামানত (কোলেটারাল)

ঋণের নিরাপত্তা হিসেবে আপনার সম্পদ (যেমন বাড়ি, সোনা, জমি) ব্যাংকে বন্ধক রাখা হয়। কিস্তি না দিলে ব্যাংক ওই সম্পদ বিক্রি করে টাকা তুলে নেয়।

১০. লোন-টু-ভ্যালু রেশিও

আপনি যত টাকা ঋণ নিচ্ছেন আর জামানতের মূল্য কত—এই অনুপাতকে বলে লোন টু ভ্যালু রেশিও (এলটিভি)। এর অনুপাত যত কম হয়, ব্যাংকের ঝুঁকি তত কম।

সম্পর্কিত নিবন্ধ