Prothomalo:
2025-10-31@13:26:14 GMT

উভয়সংকটে বিএনপি

Published: 31st, October 2025 GMT

জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের দেওয়া সংস্কার বাস্তবায়নের সুপারিশে স্পষ্ট এক রাজনৈতিক টানাপোড়েনে পড়েছে বিএনপি। দলটি গত দুই দিনে কমিশনের কিছু সুপারিশের কড়া সমালোচনা করলেও প্রত্যাখ্যান করার মতো অবস্থান নিতে পারছে না।

দলের নীতিনির্ধারণী পর্যায়ের সূত্র ও রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকেরা বলছেন, আগামী ফেব্রুয়ারির জাতীয় নির্বাচনের সময়সীমা সামনে রেখে সংস্কার বাস্তবায়নের সুপারিশগুলো বিএনপিকে এমন এক বেকায়দায় ফেলেছে—দলটি মেনে নিতে পারছে না, আবার প্রত্যাখ্যানও করতে পারছে না। কারণ, প্রত্যাখ্যান করলে নির্বাচন বানচালের অজুহাত তৈরি হতে পারে। রাজনৈতিক প্রতিপক্ষরা বিএনপিকে ‘সংস্কারবিরোধী’ হিসেবে চিহ্নিত করার সুযোগ নিতে পারে। আর মেনে নিলে সেটা বিএনপির জন্য রাজনৈতিক পরাজয় হিসেবে পরিগণিত হতে পারে।

বিএনপির নীতিনির্ধারকেরা মনে করছেন, অতিরিক্ত প্রতিক্রিয়া দেখালে বিএনপিকে সংস্কারে ‘বাধা সৃষ্টিকারী’ শক্তি হিসেবে উপস্থাপন করা হবে।

উদ্ভূত পরিস্থিতিতে কমিশনের সুপারিশ নিয়ে গত দুই দিনে দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের সঙ্গে স্থায়ী কমিটির নেতাদের কয়েক দফা আনুষ্ঠানিক ও অনানুষ্ঠানিক আলোচনা হয়েছে। তারা এখনো এ সংকট থেকে বের হওয়ার কৌশল ঠিক করতে পারেনি।

তবে বিএনপির নীতিনির্ধারকেরা এখনই অতিরিক্ত প্রতিক্রিয়া না দেখিয়ে সংযমী অবস্থান নিয়ে ধীরে ধীরে সরকারের ওপর পাল্টা চাপ তৈরির কৌশল নেওয়ার কথা ভাবছেন। তাঁরা মনে করছেন, অতিরিক্ত প্রতিক্রিয়া দেখালে বিএনপিকে সংস্কারে ‘বাধা সৃষ্টিকারী’ শক্তি হিসেবে উপস্থাপন করা হবে। উদ্ভূত পরিস্থিতিতে বিএনপির একটি প্রতিনিধিদল শিগগির জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সভাপতি ও প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসসহ অন্তর্বর্তী সরকারের সংশ্লিষ্ট উপদেষ্টাদের সঙ্গে দেখা করার কথা ভাবছে। দেখা করে আপত্তির বিষয়গুলো মীমাংসার দাবি জানাবে বিএনপি।

বিএনপি জুলাই সনদের সুপারিশ প্রত্যাখ্যান করছে কি না—সংবাদ সম্মেলনে এমন প্রশ্নের জবাবে বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন, ‘প্রত্যাখ্যানের কথা তো আমরা বলিনি।’

ঐকমত্য কমিশনের সুপারিশের বিষয়ে গতকাল বৃহস্পতিবার সংবাদ সম্মেলন করে আনুষ্ঠানিক প্রতিক্রিয়া জানিয়েছে বিএনপির স্থায়ী কমিটি। আগের দিন বুধবার রাতে অনুষ্ঠিত দলের স্থায়ী কমিটির সভার সিদ্ধান্ত জানাতে এই সংবাদ সম্মেলন ডাকা হয়।

বিএনপি জুলাই সনদের সুপারিশ প্রত্যাখ্যান করছে কি না—সংবাদ সম্মেলনে এমন প্রশ্নের জবাবে বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন, ‘প্রত্যাখ্যানের কথা তো আমরা বলিনি।’

এরপর আরেক সাংবাদিক প্রশ্ন করেন, প্রধান উপদেষ্টার কাছে এ ব্যাপারে নালিশ করবেন কি না। বিএনপির মহাসচিব বলেন, ‘নালিশের কী আছে এটা? আমরা আমাদের মতামত জাতির সামনে তুলে ধরলাম। প্রয়োজনে আমরা প্রধান উপদেষ্টার কাছে আবার যাব।’

বিএনপি এখন কী করবে—এ বিষয়ে গতকাল দলটির উচ্চপর্যায়ের একাধিক নেতার সঙ্গে এই প্রতিবেদকের কথা হয়। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ওই নেতারা জানান, এই মুহূর্তে বিএনপির একমাত্র লক্ষ্য হচ্ছে নির্বাচন। আগামী ফেব্রুয়ারি মাসের প্রথমার্ধে জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠানের ঘোষণা আছে অন্তর্বর্তী সরকারের। সে সময়সীমার মধ্যেই নির্বাচনটা হোক, সেটাই চায় বিএনপি। সরকার ও ঐকমত্য কমিশন বিএনপির এই চাওয়াকে ‘দুর্বলতা’ হিসেবে নিয়েছে।

বিএনপির এই নেতাদের ধারণা, সরকার ধরে নিয়েছে, বিএনপি সংস্কার বাস্তবায়নের সুপারিশগুলোর বিরোধিতা করলেও এটি প্রত্যাখ্যান করে শক্ত কোনো অবস্থান নিতে পারবে না। সরকার ও ঐকমত্য কমিশন বিএনপির নির্বাচন চাওয়াকে দুর্বলতা হিসেবে বিবেচনা করে ‘জুলাই জাতীয় সনদকে’ দুই পর্বে ভাগ করেছে। প্রথম পর্বে সংস্কার প্রস্তাব বা জুলাই সনদ প্রণয়ন, আর দ্বিতীয় পর্বে রাখা হয় সনদ বাস্তবায়নের সুপারিশ। বিএনপির বিশ্বাস ছিল, ভিন্নমতসহ সংস্কার বাস্তবায়নের সুপারিশ থাকবে। কিন্তু সরকার জুলাই সনদে রাজনৈতিক দলগুলোর স্বাক্ষর নিয়ে পরে সুপারিশে অনেক কিছু রাখেনি।

মূলত সংস্কার বাস্তবায়নের সুপারিশে গণভোটের সময়, ভিন্নমতের উল্লেখ না করা ও সংবিধান সংস্কার পরিষদ—এই তিনটি বিষয়ে বিএনপির আপত্তি। ঠিক এর বিপরীত অবস্থান জামায়াতে ইসলামী ও এনসিপির।

অবশ্য সংস্কার বাস্তবায়নের প্রক্রিয়া নিশ্চিত না হয়ে জুলাই সনদে স্বাক্ষর করাকে বিএনপির ‘খেলতে গিয়ে ভুল করা’ বলে মন্তব্য করেছেন জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) মুখ্য সমন্বয়ক নাসীরুদ্দীন পাটওয়ারী। তিনি এ প্রসঙ্গে গত বুধবার এক সংবাদ সম্মেলনে আরও বলেন, ‘আমরা বলেছি, সিদ্ধান্তটা না দেখে অন্ধভাবে সাইন করতে পারি না। বাস্তবায়ন প্রক্রিয়াটা কেমন হবে, সেটা দেখেই ওনাদের (বিএনপি) সাইন করা উচিত ছিল। ওনারা ভুল করেছেন। ওনাদের ভুলটা আমাদের ঘাড়ে তুলে দেওয়া উচিত না।’

সব মিলিয়ে সংস্কার বাস্তবায়নের প্রশ্নে বিএনপি এখন উভয়সংকটে পড়েছে। প্রত্যাখ্যান করলে ‘সংস্কারবিরোধী’, আর মেনে নিলে ‘পরাজিত’। এই দুই অবস্থানের মধ্যেই দলটি আপাতত কৌশলগত ভারসাম্য রক্ষার চেষ্টা করছে, যাতে জাতীয় নির্বাচনটা সময়মতো হয় এবং নিজেদের রাজনৈতিক অবস্থানও অক্ষুণ্ন থাকে। পাশাপাশি কমিশনের সুপারিশ নিয়ে সরকারের দিক থেকে যদি আলোচনার নতুন কোনো উদ্যোগ নেওয়া হয়, বিএনপি তাতে অংশ নিয়ে শক্ত অবস্থান দেখাবে।

বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য গয়েশ্বর চন্দ্র রায় গতকাল প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমরা রোগীটি (দেশ) বাঁচাতে চাই। নির্বাচনটা হোক, নির্বাচনে যাতে কোনো ব্যাঘাত না ঘটে, এটাই বিএনপির চাওয়া।’

মূলত সংস্কার বাস্তবায়নের সুপারিশে গণভোটের সময়, ভিন্নমতের উল্লেখ না করা ও সংবিধান সংস্কার পরিষদ—এই তিনটি বিষয়ে বিএনপির আপত্তি। ঠিক এর বিপরীত অবস্থান জামায়াতে ইসলামী ও এনসিপির।

বিশ্লেষকেরা বলছেন, বিএনপির বর্তমান অবস্থান একধরনের ‘কৌশলগত ভারসাম্য রক্ষা’। দলটি একদিকে সংস্কার নিয়ে প্রশ্ন তুলছে, অন্যদিকে পুরো প্রক্রিয়া থেকে নিজেকে বিচ্ছিন্ন রাখছে না। তবে বিএনপির এই সংযমী অবস্থান কতটা কার্যকর হবে, তা নির্ভর করছে সরকারের পরবর্তী পদক্ষেপের ওপর। যদি সরকারের পক্ষ থেকে বিএনপির প্রতিক্রিয়া উপেক্ষা করে সংস্কার বাস্তবায়নের চেষ্টা হয়, তাহলে দলটি হয়তো সরকারকে চাপে রাখার মতো পদক্ষেপ নিতে পারে।

বিএনপির নেতাদের অনেকেই মনে করেন, কমিশনের কিছু সুপারিশ এমনভাবে সাজানো হয়েছে, যা বাস্তবায়িত হলে আগামী নির্বাচনের মাধ্যমে গঠিত সরকার কার্যত দুর্বল অবস্থানে পড়বে। তবে এ বিষয়ে দলের ভেতরে একটু ব্যতিক্রম মতও আছে। সেটি হচ্ছে সুপারিশ মেনে নির্বাচনমুখী হওয়া। মাত্রাতিরিক্ত প্রতিক্রিয়া না জানিয়ে বিকল্প প্রস্তাব উপস্থাপন করাই কৌশলগতভাবে সঠিক পদক্ষেপ হবে বলে তাঁরা মনে করছেন।

লেখক ও গবেষক মহিউদ্দিন আহমদ প্রথম আলোকে বলেন, ‘ঐকমত্য কমিশনের সুপারিশে বিএনপি একটা চাপে পড়েছে। তারা সংস্কারবিরোধী—এই পরিচিতি হোক, সেটাও তারা চাচ্ছে না। আবার সংস্কারে এমন কিছু প্রস্তাব আছে, যেটা তাদের কাছে গ্রহণযোগ্যও নয়। অর্থাৎ তারা না পারছে গিলতে, না পাচ্ছে উগরাতে। এ ছাড়া সংস্কার নিয়ে যে পোলারাইজেশন হয়ে গেছে, তাতে বিএনপি অনেকটা একা হয়ে গেছে। তারা একটা সংকটে আছে।’ তবে তিনি মনে করেন, কমিশনের পক্ষ থেকে সুপারিশগুলো দেওয়া হয়েছে, তাতে পরিমার্জন হতে পারে। গণভোটে ‘হ্যাঁ’- ‘না’ কীভাবে উপস্থাপন করা হবে, সেটা নিয়েও জটিলতা আছে।

.

উৎস: Prothomalo

কীওয়ার্ড: ব এনপ র ন জ ল ই সনদ র জন ত ক উপদ ষ ট ব এনপ ক অবস থ ন সরক র র প রথম ইসল ম

এছাড়াও পড়ুন:

আগামীকালের মধ্যেই জুলাই সনদ বাস্তবায়ন আদেশ জারির দাবি জামায়াতের

আগামীকাল শুক্রবারের মধ্যেই জুলাই জাতীয় সনদ বাস্তবায়ন আদেশ জারির দাবি জানিয়েছে জামায়াতে ইসলামী। আজ বৃহস্পতিবার বিকেলে মগবাজারে জামায়াতের কেন্দ্রীয় কার্যালয় সংলগ্ন আল ফালাহ মিলনায়তনে এক জরুরি সংবাদ সম্মেলন ডেকে দলটি এ দাবি জানায়।

সংবাদ সম্মেলনে জামায়াতের নায়েবে আমির সৈয়দ আবদুল্লাহ মোহাম্মদ তাহের বলেন, জামায়াত রাষ্ট্র সংস্কারে দেওয়া ঐকমত্য কমিশনের প্রস্তাবগুলোর পূর্ণ বাস্তবায়ন চায়। সে জন্য আগামীকালের মধ্যে জুলাই সনদ বাস্তবায়ন আদেশ জারি করতে হবে। সরকার চাইলে আজ রাতের মধ্যেও সেটি করতে পারে।

প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসকে সময়ক্ষেপণ না করে জুলাই সনদ বাস্তবায়ন আদেশ জারির আহ্বান জানিয়ে তিনি বলেন, দেরি হলে তারা (অন্তর্বর্তী সরকার) জনগণের আস্থা হারাবে।

জামায়াতের এই নেতা বলেন, জুলাই সনদ বাস্তবায়ন আদেশ জারির পরে গণভোটের আয়োজন করতে হবে। জাতীয় নির্বাচনের দিন কিংবা নির্বাচনের আগে গণভোট আয়োজনের সুপারিশ ঐকমত্য কমিশন সরকারের কাছে জমা দিয়েছে। জামায়াত জাতীয় নির্বাচনের আগেই গণভোট আয়োজন করার দাবি জানিয়েছে। কারণ, একই দিনে নির্বাচন ও গণভোট হলে রাজনৈতিক দলের নেতারা নিজ দলের প্রার্থীকে জেতাতে ব্যস্ত থাকবেন। এর ফলে গণভোটের গুরুত্ব কমে যাবে

গণভোটের পরে ফেব্রুয়ারিতেই জাতীয় সংসদ নির্বাচন হতে হবে উল্লেখ করে সৈয়দ আবদুল্লাহ মোহাম্মদ তাহের বলেন, এমন কোনো বিষয় যাতে সামনে আনা না হয়, যে কারণে নির্বাচন সংশয় বা অনিশ্চয়তার মধ্যে পড়ে। জাতীয় নির্বাচনের জন্য ফেব্রুয়ারিই উপযুক্ত সময়।

সংবাদ সম্মেলন সঞ্চালনা করেন জামায়াতের প্রচার ও মিডিয়া বিভাগের সেক্রেটারি মতিউর রহমান আকন্দ। এতে আরও উপস্থিত ছিলেন দলটির নায়েবে আমির মুজিবুর রহমান, সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল এটিএম মাসুম ও হামিদুর রহমান আযাদ।

সম্পর্কিত নিবন্ধ

  • সমস্যা সমাধান করে নির্বাচনের পথে এগোন: অন্তর্বর্তী সরকারকে মির্জা ফখরুল
  • অধ্যাপক আলী রীয়াজের নতুন বই প্রকাশিত
  • সুপারিশ নিয়ে বিতর্ক, কতটা যৌক্তিক
  • গণভোট নিয়ে ‘ক্রসরোডে’ সরকার
  • ২৭০ দিন আলোচনার পর অনৈক্যে হতাশ উপদেষ্টা
  • আপনারা যদি এ রকম ভূমিকা নেন, সরকার কী করবে, আমরা ঠিক বুঝতে পারছি না: আইন উপদেষ্টা
  • গণভোট নিয়ে ঐকমত্যে পৌঁছাতে ব্যর্থ হলে প্রধান উপদেষ্টাকে পদত্যাগ করতে হতে পারে: এবি পার্টি
  • জুলাই সনদ নিয়ে বিরোধ হতাশাজনক, সিদ্ধান্ত দ্রুত হবে: আসিফ নজরুল
  • আগামীকালের মধ্যেই জুলাই সনদ বাস্তবায়ন আদেশ জারির দাবি জামায়াতের