জেন–জি: দেশভেদে ভিন্ন ক্ষোভ, প্রজন্মভেদে এক সুর
Published: 29th, October 2025 GMT
দুনিয়ার নানা প্রান্তে তরুণদের পদধ্বনি এক নতুন রাজনৈতিক ভাষা হিসেবে আত্মপ্রকাশ করছে।
মাদাগাস্কার থেকে পেরু; মরক্কো থেকে সার্বিয়া, নেপাল থেকে ইন্দোনেশিয়া, শ্রীলঙ্কা থেকে বাংলাদেশ—সবখানেই ‘জেন জেড’ প্রজন্মের নেতৃত্বে মানুষ রাস্তায় নেমে এসেছে।
রাজনৈতিক ক্ষমতাকে চ্যালেঞ্জ করেছে। কারও স্লোগান ছিল ‘আমাদের ভবিষ্যৎ আমাদেরই’।
কোথাও তারা প্রতিবাদ করেছে সরকারি ব্ল্যাকআউট ও অর্থনৈতিক সংকটের। কোথাও তারা বিরোধিতা করছে, সরকারি সেন্সরশিপ ও দুর্নীতির।
দ্রব্যমূল্যের অতিরিক্ত দাম, জ্বালানি ও আবাসনসংকট, গণতন্ত্রের অভাব বিশ্বব্যাপী মানুষের ক্ষোভকে নানাভাবে প্রভাবিত করছে।
জেন জেডের নেতৃত্বে আন্দোলনের সময়ের মানুষের সংহতির যে রূপ আমরা দেখছি, তা কি নতুন কিছুর ইঙ্গিত দিচ্ছে?
যে প্রজন্ম এই আন্দোলনের নেতৃত্ব দিচ্ছে তারা মিম, অ্যানিমে-ফ্ল্যাগ, টিকটক দিয়ে নিজেদের বয়ান বানাচ্ছে।
তারা অনেক ক্ষেত্রেই প্রথাগত সংগঠনের ভেতর থেকে নয়; কিংবা কোনো কেন্দ্রীয় নেতা থেকে নয়; বরং সবাই নেতা—এমন একটা অবস্থান থেকে নিজেদের রাজনীতি জানান দিচ্ছে।
সাম্প্রতিক সময়ে মাদাগাস্কারে বিদ্যুৎ–সংকট, মূল্যবৃদ্ধি ও দুর্নীতির অভিযোগে রাস্তায় নেমে পড়ে সাধারণ মানুষ। এর নেতৃত্বে ছিল জেন জেড প্রজন্ম।
আন্দোলনকারীদের ওপর গুলি চালাতে সেনাবাহিনী অস্বীকার করলে মাদাগাস্কারে রাজনৈতিক দৃশ্যপট দ্রুত বদলে যায়। রাষ্ট্রপ্রধান পালিয়ে যান।
পেরুতে রাজনৈতিক বৈধতা সংকট ও সরকারের দুর্নীতির ইস্যু দীর্ঘদিন ধরে তরুণদের রাজপথমুখী করেছে।
আরও পড়ুনগণ–অভ্যুত্থানে বাংলাদেশ–নেপালে যে ৫টি জায়গায় বিস্ময়কর মিল ১০ সেপ্টেম্বর ২০২৫মরক্কোয় বিশ্বকাপ স্বপ্নকেন্দ্রিক অবকাঠামো বিনিয়োগের পরিপ্রেক্ষিতে যারা সুবিধাবঞ্চিত হয়েছেন, তারা সুবিধাভোগী সরকারের বিরুদ্ধে একত্র হয়েছে।
সার্বিয়ায় পরিবেশ ও নির্বাচনী অনিয়ম, বিরোধী সমাবেশ থেকে জেন জেড আন্দোলন দানা বাঁধে।
নেপালে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে সেন্সরশিপবিরোধী আন্দোলন তো সে দেশের সরকারকেই সরিয়ে দেয়। এসব আন্দোলনের কেন্দ্রীয় সুরটি একই ‘আমাদের কণ্ঠ শোনা হোক।’
বৈষম্য ও জীবনযাত্রার ব্যয়ের চাপ, কাজের অভাব, আবাসন-সংকট, জলবায়ুঝুঁকির দীর্ঘ ছায়া, ‘বয়স্ক’ রাজনৈতিক এলিটদের হাতে ভবিষ্যৎ বন্দী থাকার বিষয়গুলো তরুণদের মধ্যে ক্ষোভ তৈরি করেছে।
উদার গণতন্ত্র হোক বা অগণতান্ত্রিক দেশ হোক, দুই ক্ষেত্রেই তরুণেরা মনে করছে, সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রে তাদের অংশগ্রহণের সুযোগ কম। তারা আরও বেশি সুযোগ চায়।
এই আন্দোলনে অংশ নেওয়া প্রজন্মের একটি বিশেষ বৈশিষ্ট্য হলো ‘কানেকটিভ অ্যাকশন’। তারা বিশেষ কোনো প্রথাগত আদর্শগত বা সংগঠনগত জায়গা থেকে নয়; বরং ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা নেটওয়ার্ক নোড ও প্রতীকের মাধ্যমে নিজেরা একত্র হচ্ছে ও সমাবেশ করেছে।
টিকটক, ইনস্টাগ্রাম রিলস, ডিসকোর্ড সার্ভার, টেলিগ্রাম চ্যানেল—এসব প্ল্যাটফর্মে ঝটপট ‘ফ্রেম’ তৈরি হয়।
সংক্ষিপ্ত স্লোগান, স্মার্ট ভিজ্যুয়াল, ব্যঙ্গাত্মক মিম, অ্যানিমে-ফ্ল্যাগ তরুণদের বক্তব্যকে মুহূর্তে হাজার হাজার মানুষের কাছে নিয়ে যায়।
এর সুবিধা দুই ধরনের। প্রথমত, সরকারের পক্ষ থেকে দমন-পীড়ন বা ‘ডি-প্ল্যাটফর্মিং’ সত্ত্বেও খবর খুব দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে। মানুষ অংশ নেওয়ার সুযোগ পায়।
আরও পড়ুনগণঅভ্যুত্থান-উত্তর অনিশ্চয়তা দ্রুত কাটাতে হবে০৬ আগস্ট ২০২৪দ্বিতীয়ত হলো, নেতাকেন্দ্রিক আন্দোলন না হওয়াতে সরকার জলদি গ্রেপ্তার বা ‘ডিক্যাপিটেশন’ কৌশল নিয়ে খুব একটা সুবিধা করতে পারে না। ফলে আন্দোলন অব্যাহত থাকে।
একই সঙ্গে এ ধরনের আন্দোলনের ক্ষেত্রে সরকারের পক্ষ থেকে দমনমূলক পদক্ষেপের অনেক ঝুঁকি আছে। তবে এই সবলতাই আবার এই আন্দোলনগুলোর দুর্বলতা।
কাঠামোবিহীন এই আন্দোলন সফল হওয়ার পরেও প্রতিনিধিত্ব ও আলোচনার টেবিলে প্রাতিষ্ঠানিক রাজনীতির সঙ্গে সেতুবন্ধ করতে না পেরে জেন জেডদের এই আন্দোলন উদ্দেশ্য অর্জনে পিছিয়ে থাকছে।
আন্দোলন-পরবর্তী অস্থির অবস্থায় অপেক্ষাকৃত সাংগঠনিক রাজনৈতিক সংগঠনগুলো ক্ষমতার নিয়ন্ত্রণ নিচ্ছে, অথবা সামরিক নেতাদের হাতে ক্ষমতা চলে যাচ্ছে।
আমরা দেখতে পারছি জেন–জেড আন্দোলনের ক্ষেত্রে যেখানেই সরকার তরুণ বিক্ষোভকারীদের বিরুদ্ধে অতিরিক্ত বলপ্রয়োগ, নির্বিচার গ্রেপ্তার ও নজরদারি করেছে সেখানেই বিস্ফোরণ ঘটেছে। সরকার ভেঙে পড়েছে।
আরও পড়ুনকোথায় দাঁড়িয়ে আছে অন্তর্বর্তী সরকার২৬ জুলাই ২০২৫বাস্তবতা হলো অতিরিক্ত বলপ্রয়োগ ক্ষোভের ‘মোরাল ইকোনমি’কে আরও শক্তিশালী করে। বিক্ষোভের নৈতিক ভিত্তি দেয়। আন্দোলনের প্রতি আন্তর্জাতিক মনোযোগ বাড়ে। আন্দোলনকারীদের মধ্যে অভ্যন্তরীণ সংহতিও মজবুত হয়।
তাই এই ধরনের আন্দোলনের ক্ষেত্রে বল প্রয়োগ না করে নীতিনির্ধারকদের অন্য পথের কথা ভাবতে হবে।
যেমন তরুণদের কথা শোনা ও আলোচনায় বসা, দেশ শাসনে স্বচ্ছতা বৃদ্ধি ও অংশগ্রহণ মেকানিজম চালু করা, জীবনযাত্রার ব্যয়, শিক্ষা ব্যয়, চাকরি ও আবাসনসংকটের মতো ‘পকেট টাচিং’ বিষয়গুলোতে দীর্ঘ মেয়াদের সমাধানের জন্য ভাবনা জরুরি।
যেমন ২০২২ সালে শ্রীলঙ্কার ‘আরাগালায়া’ আন্দোলনের কথাই ধরি। এই আন্দোলনের ক্ষেত্রে তরুণেরা মূলত নেতৃত্বও দেন।
জ্বালানি, খাদ্য, বিদেশি মুদ্রার সংকট ও নীতিগত অব্যবস্থাপনায় জীবনের চাকা থমকে গেলে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী থেকে আইটি পেশাজীবী সবাই রাস্তায় নেমে আসেন। ঘেরাও, ‘অকুপাই’ ধাঁচের প্রতীকী দখল, সৃজনশীল ব্যঙ্গ—সব মিলিয়ে একটি জন–আন্দোলন তৈরি হয়।
এই আন্দোলন একটি উৎকৃষ্ট উদাহরণ, যা আমাদের দেখায় কেমন করে অর্থনৈতিক সংকট প্রজন্মগত ক্ষোভকে রাজনৈতিক নৈতিক প্রশ্নে রূপ দেয়।
আরও পড়ুনজুলাই আন্দোলন: কালার রেভল্যুশন, রেভল্যুশন নাকি গণ-অভ্যুত্থান১৩ জানুয়ারি ২০২৫শ্রীলঙ্কার পাশাপাশি বাংলাদেশের উদাহরণ প্রাসঙ্গিক। সাম্প্রতি তরুণদের নেতৃত্বে আন্দোলন সরকারের পতন ঘটায়।
ক্যাম্পাস-সেন্ট্রিক নেটওয়ার্ক, পাড়া-মহল্লার স্বেচ্ছাসেবী লজিস্টিকস এবং সোশ্যাল মিডিয়া-ভিত্তিক ‘মেসেজিং’ মিলেমিশে এক অভাবনীয় জনসংযোগ ঘটাতে পেরেছিলেন আন্দোলনকারীরা।
হাই-রিস্ক মুহূর্তে ‘লাইভস্ট্রিম’–এর ব্যবহার, পোস্ট-ট্যাগ-হ্যাশট্যাগ কোরিওগ্রাফির মাধ্যমে বয়ান ছড়িয়ে দেওয়া হয়।
স্থানীয় পর্যায়ে ‘গ্রুপ-অ্যাডমিন-মডারেটর’দের সমন্বয় করে দেখা যায়। সব মিলিয়ে এটি ছিল একটি ডিজিটাল-নেটিভ আন্দোলনের পাঠশালা।
একই সময়ে ভুয়া খবর, ডিপফেক, উসকানি কনটেন্ট সোশ্যাল মিডিয়াতে ছড়িয়ে পড়ে।
এই দুই দেশের উদাহরণের পরিপ্রেক্ষিতে আমরা এ–ও দেখলাম, ‘শাসক পরিবর্তন’-পরবর্তী অধ্যায়ে নীতি-সংস্কারের ধারাবাহিকতা, সামাজিক নিরাপত্তা জালের পুনর্গঠন, যুবকণ্ঠের প্রাতিষ্ঠানিক অন্তর্ভুক্তি—এই তিনে যদি ঘাটতি থাকে, তাহলে আন্দোলনের অর্জনের বড় অংশই প্রতীকে আটকে যেতে পারে।
বিশ্বব্যাপী জেন–জেড আন্দোলনের আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ দিক হলো, এক দেশের তরুণ উত্থান অন্য দেশে অনুপ্রেরণা জোগাচ্ছে, যদিও এটি নতুন কিছু না।
‘আরব বসন্ত’–পরবর্তী বিশ্বে আমরা ‘ডিফিউশন ইফেক্ট’ বহুবার দেখেছি। তবে আজকের দিনের বিশেষত্ব হলো প্ল্যাটফর্ম আর্কিটেকচার যথা হ্যাশট্যাগ, ফিল্টার, টেমপ্লেট, রিল—এসবের সহজ ব্যবহার।
মাদাগাস্কার, নেপাল, মরক্কো, সার্বিয়া, ইন্দোনেশিয়ার অভিজ্ঞতা আরও একটি কথা মনে করায়, ক্ষোভের সূত্রপাত ভিন্ন হতে পারে, কিন্তু ‘শোনা হোক’, ‘দেখা হোক’, ‘ভবিষ্যৎ নিরাপদ হোক’ এই তিনটি দাবিতে পৃথিবীর তরুণেরা এক সুরে গাইছে।এর ফলে মাদাগাস্কার, নেপাল, মরক্কো, সার্বিয়া ও ইন্দোনেশিয়া—সবখানে আমরা একই রকম ভিজ্যুয়াল ভাষা, স্লোগান, রিদম ও ‘প্রতীকের খেলা’ দেখতে পারছি। যা ইতঃপূর্বের আন্দোলন থেকে ভিন্ন।
তবে ক্ষোভের স্থানীয় ব্যাকরণ ভিন্ন; শ্রীলঙ্কার জ্বালানি-সংকটের চিকিৎসা যেমন বাংলাদেশে কপি-পেস্ট চলে না; তেমনি মাদাগাস্কারের ব্ল্যাকআউট-রাজনীতির সমাধান নেপালের সেন্সরশিপ-বিরোধী রাজনীতিতে প্রযোজ্য না–ও হতে পারে।
তাই ‘গ্লোবাল ইমাজিনেশন’-এর সঙ্গে ‘লোকাল গ্রিভ্যান্স-ডায়াগনসিস’ মিলিয়ে দেখা জরুরি।
জেন জেডের আন্দোলন এখনো কোনো একক ‘আন্তর্জাতিক সংগঠন’ নয়; বরং ‘গ্লোবাল কনভারসেশন’। এতে অংশ নেওয়া তরুণেরা দেখিয়ে দিচ্ছেন, গণতন্ত্র কেবল ভোটের চক্রের নাম নয়।
গণতন্ত্র হলো প্রতিদিনের কণ্ঠ, প্রতিদিনের আলাপের জায়গা। শ্রীলঙ্কার আরাগালায়া আমাদের শেখায় অর্থনৈতিক ন্যায় ও শাসন-নীতির প্রশ্নে তরুণদের ধৈর্য সীমিত।
বাংলাদেশের কেস আমাদের দেখায়—ডিজিটাল সংগঠন কত দ্রুত জনসমাবেশে রূপ নিতে পারে এবং তথ্য নিরাপত্তাহীনতা কত বড় হুমকি।
মাদাগাস্কার, নেপাল, মরক্কো, সার্বিয়া, ইন্দোনেশিয়ার অভিজ্ঞতা আরও একটি কথা মনে করায়, ক্ষোভের সূত্রপাত ভিন্ন হতে পারে, কিন্তু ‘শোনা হোক’, ‘দেখা হোক’, ‘ভবিষ্যৎ নিরাপদ হোক’ এই তিনটি দাবিতে পৃথিবীর তরুণেরা এক সুরে গাইছে।
এই সুর নীতিনির্ধারকদের জন্য সতর্ক-স্নিগ্ধ দুই বার্তাই আছে। সতর্ক হতে হবে; কারণ, এই দাবি উপেক্ষা করলে তরঙ্গ সুনামিতে বদলে যায়, ক্ষমতাকে ভাসিয়ে নিয়ে যায়।
আবার স্নিগ্ধ একটি ব্যাপারও আছে। যেমন যদি অংশীদারত্বের দরজা খুলে দেওয়া হয়, তবে এই তরুণদের তরঙ্গই হতে পারে টেকসই গণতন্ত্রের নতুন জ্বালানি। প্রশ্ন হলো রাজনৈতিক নীতিনির্ধারকেরা কি শুনবেন এই আওয়াজ?
আসিফ বিন আলী শিক্ষক, গবেষক ও স্বাধীন সাংবাদিক। বর্তমানে কাজ করছেন আমেরিকার জর্জিয়া স্টেট ইউনিভার্সিটিতে।
.উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: ইন দ ন শ য় গণতন ত র র জন ত ক সরক র র প রজন ম র তর ণ আম দ র তর ণ র ক ষমত স গঠন মরক ক
এছাড়াও পড়ুন:
তত্ত্বাবধায়ক ব্যবস্থা বাতিলে ধ্বংস হয় গণতন্ত্র, শুরু হয় গুম-খুন: শুনানিতে জয়নুল আবেদীন
দেশে গণতন্ত্র ধ্বংস হয়ে গুম-খুনের শুরুর জন্য তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা বাতিলকে কারণ হিসেবে আদালতে উপস্থাপন করেছেন জ্যেষ্ঠ আইনজীবী জয়নুল আবেদীন। এ সংকটের জন্য তিনি আওয়ামী লীগ সরকারের পাশাপাশি দায়ী করেছেন সাবেক প্রধান বিচারপতি এ বি এম খায়রুল হককে।
তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা বাতিলের রায়ের বিরুদ্ধে বিএনপির মহাসচিবের করা আপিল–সংক্রান্ত শুনানিতে আজ বুধবার অংশ নেন সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির সাবেক সভাপতি জয়নুল আবেদীন। প্রধান বিচারপতি সৈয়দ রেফাত আহমেদের নেতৃত্বাধীন সাত সদস্যের আপিল বেঞ্চে আজ এ মামলার পঞ্চম দিনের শুনানি হয়। পরবর্তী শুনানির জন্য আগামী রোববার দিন রাখা হয়েছে।
তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা প্রবর্তন করে আনা ত্রয়োদশ সংশোধনী বাতিল করে ১৪ বছর আগে সংখ্যাগরিষ্ঠমতে দেওয়া রায় সর্বোচ্চ আদালতের অন্য সব রায়কে লঙ্ঘন করেছে দাবি করে জয়নুল আবেদীন বলেন, বিশেষ করে অষ্টম সংশোধনী মামলা, মাসদার হোসেন মামলাসহ অন্য সব মামলার রায়। সংবিধানের অভিভাবক সুপ্রিম কোর্ট। এই ক্ষমতাকে রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে ব্যবহার করা যায় না, যা ত্রয়োদশ সংশোধনীর মামলায় ব্যবহৃত হয়েছে।
জয়নুল আবেদীন বলেন, ‘বিচার বিভাগের স্বাধীনতা নিয়ে সবাই কথা বলে। আগের যে সরকার, ফ্যাসিস্ট সরকার, সে–ও বলেছে, বিচার বিভাগের সব স্বাধীনতা দিয়ে দিয়েছে। কিন্তু এমন স্বাধীনতা পেয়েছি যে “রাতের বেলায় কুপিবাতি জ্বালিয়ে” বিচার হয়েছে।’
১৯৯৬ সালে সংবিধানে যোগ হওয়া তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা ২০১১ সালে আওয়ামী লীগ সরকার আমলে বাদ পড়ে। তার ঠিক আগে বিচারপতি খায়রুল হক নেতৃত্বাধীন তৎকালীন আপিল বিভাগ তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা অবৈধ বলে রায় দিয়েছিলেন।
বিএনপির সাবেক আইনবিষয়ক সম্পাদক জয়নুল আবেদীন তত্ত্বাবধায়ক ব্যবস্থা প্রবর্তনের পটভূমি শুনানিতে তুলে ধরেন। আপিল বিভাগের পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশিত হওয়ার আগেই সংবিধান সংশোধন করে তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা বাতিলের বিষয়টি নিয়ে তিনি বলেন, বিচারপতি খায়রুল হক সংক্ষিপ্ত রায় বদলে সরকারের ইচ্ছা অনুযায়ী সংবিধান সংশোধন অনুসারে পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশ করেন, যা অনৈতিক।
জয়নুল আবেদীন বলেন, ‘এ বি এম খায়রুল হক তাঁর রায়ে বলেছেন, সেখানে (তত্ত্বববধায়ক ব্যবস্থায়) কোনো বিচারপতি থাকতে পারবে না, তারা লাভবান হবে। কিন্তু সেই ক্রিমটা নিজে নিয়েছেন। তিনি আইন কমিশনের চেয়ারম্যান হয়েছিলেন। বিচার বিভাগের ওপর জনগণের আস্থার জায়গাটা যিনি ধ্বংস করেছেন।’
ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে আওয়ামী লীগ সরকার পতনের এক বছর পর গত আগস্টে বিচারপতি খায়রুল হক গ্রেপ্তার হন। তিনি এখন কারাগারে রয়েছেন।
এদিকে আওয়ামী লীগ ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পর ১৪ বছর আগের ওই রায় পুনর্বিবেচনা চেয়ে সুশাসনের জন্য নাগরিকের (সুজন) সম্পাদক বদিউল আলম মজুমদারসহ পাঁচ বিশিষ্ট ব্যক্তি, বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর, জামায়াতে ইসলামীর সেক্রেটারি জেনারেল মিয়া গোলাম পরওয়ার ও নওগাঁর রানীনগরের নারায়ণপাড়ার বাসিন্দা বীর মুক্তিযোদ্ধা মো. মোফাজ্জল হোসেন পৃথক আবেদন (রিভিউ) করেন। সেন্টার ফর ল গভর্ন্যান্স অ্যান্ড পলিসি নামের একটি সংগঠন ইন্টারভেনার (পক্ষ) হিসেবে যুক্ত হয়।
রিভিউ আবেদনের ওপর শুনানি শেষে গত ২৭ আগস্ট লিভ মঞ্জুর (আপিলের অনুমতি) করে আদেশ দেন আপিল বিভাগ। বদিউল আলম মজুমদারসহ পাঁচ বিশিষ্ট ব্যক্তি এবং বিএনপির মহাসচিবের করা রিভিউ আবেদন থেকে উদ্ভূত আপিলের সঙ্গে অপর রিভিউ আবেদনগুলো শুনানির জন্য যুক্ত হবে বলে আদেশে উল্লেখ করা হয়। এ অনুসারে পাঁচ বিশিষ্ট ব্যক্তির করা আপিলের সঙ্গে জামায়াতে ইসলামীর সেক্রেটারি জেনারেলের করা রিভিউসহ অপর রিভিউ আবেদন এবং বিএনপির মহাসচিবের আপিল শুনানির জন্য আদালতের কার্যতালিকায় ওঠে।
পাঁচ বিশিষ্ট ব্যক্তির করা আপিলের ওপর ২১ অক্টোবর শুনানি শুরু হয়। এরপর ইন্টারভেনার হিসেবে যুক্ত সংগঠনের পক্ষে শুনানি করেন সংশ্লিষ্ট আইনজীবী। এরপর জামায়াতে ইসলামীর সেক্রেটারি জেনারেলের আইনজীবী মোহাম্মদ শিশির মনির শুনানি করেন। এরপর বীর মুক্তিযোদ্ধা মো. মোফাজ্জল হোসেনের পক্ষে জ্যেষ্ঠ আইনজীবী এম বদরুদ্দোজা বাদল এবং এ এস এম শাহরিয়ার কবির শুনানি করেন। শাহরিয়ার কবিরের বক্তব্য উপস্থাপনের পর হিউম্যান রাইটস সাপোর্ট সোসাইটির (রিভিউ আবেদনকারী) পক্ষে জ্যেষ্ঠ আইনজীবী ইমরান এ সিদ্দিক শুনানি করেন। এরপর বিএনপির মহাসচিবের পক্ষে জয়নুল আবেদীন শুনানি শুরু করলেন, সঙ্গে ছিলেন জ্যেষ্ঠ আইনজীবী মো. রুহুল কুদ্দুস।