বাংলা সাহিত্যের বিস্তীর্ণ প্রাঙ্গণে বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায় এক জ্যোতির্ময় নক্ষত্র, যাঁর সৃজনশীলতা প্রকৃতি ও মানবাত্মার অবিচ্ছেদ্য ও নিগূঢ় বন্ধনকে নিপুণভাবে উন্মোচন করেছে। তিনি কেবল একজন গল্পকার বা ঔপন্যাসিক ছিলেন না, ছিলেন এক দার্শনিক কবি, যাঁর লেখায় বিধৃত হয়েছে জীবন ও জগতের সুগভীর রহস্য, প্রকৃতির শাশ্বত রূপ এবং মানবচেতনার অন্তর্নিহিত স্পন্দন। নাগরিক জীবনের কোলাহল ও কৃত্রিমতা থেকে দূরে, মাটির কাছাকাছি এক সহজিয়া জীবনের প্রতিচ্ছবি তাঁর সাহিত্যে এমনভাবে প্রতিফলিত হয়েছে, যা পাঠককে এক চিরন্তন সত্যের মুখোমুখি দাঁড় করায়। বিভূতিভূষণের সাহিত্য নিছক গ্রামীণ জীবনের চিত্রায়ণ নয়, বরং তা প্রকৃতি ও মানুষের মধ্যে বিদ্যমান প্রায়-আধ্যাত্মিক সম্পর্কের এক মহাকাব্য, যেখানে জড় ও চেতনের বিভেদরেখা প্রায়ই বিলীন হয়ে যায়।

বিভূতিভূষণের সাহিত্যসত্তার প্রাণকেন্দ্রে রয়েছে প্রকৃতি। তাঁর লেখায় প্রকৃতি নিছক একটি পটভূমি বা আলংকারিক উপাদান নয়, বরং তা এক জীবন্ত, অনুভূতিশীল সত্তা—এক সক্রিয় চরিত্র, যা কথা বলে, চরিত্রদের জীবনকে প্রভাবিত করে, তাদের মনোজগতে গভীর ছাপ ফেলে। এই প্রকৃতি কখনো মায়ের মতো আশ্রয় দেয়, কখনো প্রেমিকার মতো স্বপ্ন দেখায়, আবার কখনোবা রুদ্ররূপে নিষ্ঠুরতার প্রকাশ ঘটায়। তাঁর কালজয়ী সৃষ্টি ‘পথের পাঁচালী’ উপন্যাসে নিশ্চিন্দিপুরের আমবাগান, বাঁশবন, ইছামতী নদী, ধানের খেত এবং অসংখ্য বুনো ফুল ও লতাগুল্ম যেন অপু ও দুর্গার শৈশবের নিত্যসঙ্গী। এই প্রকৃতি কেবল তাদের খেলার মাঠ ছিল না, ছিল তাদের বিস্ময় ও কৌতূহলের উৎস, তাদের মনন গঠনের অন্যতম ভিত্তি।

তিনি কেবল একজন গল্পকার বা ঔপন্যাসিক ছিলেন না, ছিলেন এক দার্শনিক কবি, যাঁর লেখায় বিধৃত হয়েছে জীবন ও জগতের সুগভীর রহস্য, প্রকৃতির শাশ্বত রূপ এবং মানবচেতনার অন্তর্নিহিত স্পন্দন।

অপু ও দুর্গার শৈশবের অসংখ্য মুহূর্ত, বিশেষত রেলগাড়ি দেখার সেই অসামান্য অভিজ্ঞতা, প্রকৃতির বিশালত্বের কাছে মানুষের অসীম জিজ্ঞাসাকে প্রতীকায়িত করে। রেলগাড়ি এখানে কেবল একটি যন্ত্র নয়, তা দূরের পৃথিবী, অজানার হাতছানি, যা প্রকৃতির বুক চিরে নবদিগন্তের বার্তা বয়ে নিয়ে আসে। নিশ্চিন্দিপুরের প্রকৃতির প্রতিটি উপাদানই চরিত্রদের সংবেদনশীলতাকে ধারালো করে তোলে, তাদের কল্পনার জগৎকে প্রসারিত করে। আম-আঁটির ভেঁপু, টোপা কুড়ানো, বিলের ধারে কলমিশাক তোলা—এসব আপাত সাধারণ ঘটনাগুলো প্রকৃতির সঙ্গে মানুষের আত্মিক সংযোগের মাধ্যম হয়ে ওঠে। শৈশবের সেই অমেয় আনন্দ, প্রকৃতির পরতে পরতে লুকিয়ে থাকা রহস্যের আবিষ্কার বিভূতিভূষণ এমন ভাষায় বর্ণনা করেছেন যে পাঠকও যেন সেই বিস্ময়ের ভাগীদার হয়ে ওঠে।

তাঁর প্রকৃতিচেতনার চূড়ান্ত ও পরিপক্ব রূপায়ণ ঘটেছে ‘আরণ্যক’ উপন্যাসে। এটি গতানুগতিক উপন্যাস নয়, বরং বিহারের লবটুলিয়ার গভীর অরণ্য-প্রান্তরের এক জীবন্ত ডায়েরি, এক আত্মজৈবনিক উপলব্ধি। এখানে বিভূতিভূষণ দেখিয়েছেন কীভাবে প্রকৃতি মানুষের আত্মাকে পরিশোধিত করে, কীভাবে তার আদিম, অকৃত্রিম সৌন্দর্য মানুষের ভেতরের সত্তাকে জাগিয়ে তোলে। নগরজীবনের ধূসরতা ছেড়ে লবটুলিয়ার বিশাল অরণ্যানী, তার বুনো জীবন, সেখানকার সরল মানুষজন, বন্য প্রাণী ও বিচিত্র উদ্ভিদরাজির সঙ্গে মিশে গিয়ে উপন্যাসের প্রধান চরিত্র সত্যচরণ যেন নিজের সত্তাকে নতুন করে আবিষ্কার করে। অরণ্য এখানে একটি নিছক ভৌগোলিক স্থান নয়, এটি এক মহাজীবনের প্রতীক, এক আধ্যাত্মিক আশ্রয়, যেখানে মানুষ তার ক্ষুদ্র আমিত্ব ভুলে এক বৃহত্তর সত্তার সঙ্গে একাত্ম হতে শেখে। বিভূতিভূষণ ‘আরণ্যক’-এ আধুনিক সভ্যতার আগ্রাসী থাবা থেকে প্রকৃতির আদিম সৌন্দর্যকে রক্ষার এক আকুতিও ফুটিয়ে তুলেছেন। তিনি দেখিয়েছেন কীভাবে অরণ্য ধ্বংসের সঙ্গে সঙ্গে বিলুপ্ত হচ্ছে মানুষের ভেতরের সহজ-সরল মানবিকতা। লবটুলিয়ার ধাতুরিয়া, রাজু পাড়ে, ভানুমতী, ধাওতাল সাহুদের মতো চরিত্রগুলো অরণ্যেরই অংশ, তাদের জীবনযাপন, প্রথা ও বিশ্বাস অরণ্যের সঙ্গে নিবিড়ভাবে মিশে আছে। তাদের মাধ্যমে লেখক অরণ্যের প্রতি এক গভীর শ্রদ্ধা, ভালোবাসা এবং ধ্বংসের বিরুদ্ধে এক নীরব প্রতিবাদ জানিয়েছেন। বিভূতিভূষণের কাছে প্রকৃতি শুধু সৌন্দর্যের আধার নয়, তা এক নৈতিক শিক্ষক, এক আধ্যাত্মিক গুরু, যা মানুষের আত্মাকে উচ্চতর উপলব্ধির দিকে ধাবিত করে।

তাঁর লেখায় প্রকৃতি নিছক একটি পটভূমি বা আলংকারিক উপাদান নয়, বরং তা এক জীবন্ত, অনুভূতিশীল সত্তা—এক সক্রিয় চরিত্র, যা কথা বলে, চরিত্রদের জীবনকে প্রভাবিত করে, তাদের মনোজগতে গভীর ছাপ ফেলে।

বিভূতিভূষণের সাহিত্যের আরেকটি প্রধান সুর হলো ‘যাত্রা’ বা ‘পথ’। বিভূতিভূষণের চরিত্ররা এক জায়গায় স্থির থাকে না; তারা অজানার ডাকে সাড়া দিয়ে ঘর ছাড়ে, পরিচিত পরিমণ্ডল ত্যাগ করে নতুন দিগন্তের সন্ধানে পা বাড়ায়। এই যাত্রা কেবল ভৌগোলিক পরিবর্তন নয়, এ হলো মানসিক ও আত্মিক উত্তরণের এক অবিরাম প্রক্রিয়া। ‘পথের পাঁচালী’র অপু গ্রামীণ মায়া ও নিশ্চিন্দিপুরের সরল জীবন ছেড়ে ‘অপরাজিত’ উপন্যাসে বৃহত্তর জীবনের পথে পা বাড়ায়। তার এই যাত্রা কেবল কলকাতা বা পাটনার দিকে নয়, এ হলো গ্রামীণ সরলতা থেকে শহুরে জীবনের জটিলতা, দুঃখ-কষ্ট আর আত্ম-আবিষ্কারের পথে এক অবিরাম অভিযান। অপুর জীবন যেন এক অনন্ত পথিক, যার গন্তব্য স্থির নয়, বরং পথচলার মধ্যেই তার জীবনদর্শন নিহিত। সে সাহিত্য, সংস্কৃতি, প্রেম, বিরহ, দারিদ্র্য ও সাফল্য—সবকিছুর মধ্য দিয়ে এক অসীম জিজ্ঞাসায় তাড়িত হয়ে চলতে থাকে। বিভূতিভূষণ বিশ্বাস করতেন, মানুষ মূলত এক ‘পথিক’ এবং জীবনের সার্থকতা কোনো নির্দিষ্ট গন্তব্যে পৌঁছানোতে নয়, বরং এই অবিরাম পথ চলার মধ্যেই নিহিত। এই দর্শন তাঁর অন্যান্য রচনাতেও মূর্ত হয়ে উঠেছে। কিশোর উপন্যাস ‘চাঁদের পাহাড়’-এর শঙ্কর চরিত্রের অ্যাডভেঞ্চার কেবল একটি রোমাঞ্চকর গল্প নয়, এটি তার অদম্য আত্মবিশ্বাস, অজানাকে জানার দুর্নিবার কৌতূহল এবং প্রতিকূলতার মধ্যেও নিজের স্বপ্ন পূরণের এক মহাযাত্রা। আফ্রিকার অরণ্য ও পর্বতমালার গভীরে শঙ্করের এই যাত্রা যেন মানবাত্মার অদম্য শক্তি ও আবিষ্কারের নেশাকেই প্রতীকায়িত করে। ‘আরণ্যক’-এর সত্যচরণও লবটুলিয়ার অরণ্যে একধরনের আত্মিক যাত্রাতেই লিপ্ত হয়, যা তাকে নগরজীবনের শুষ্কতা থেকে মুক্তি দিয়ে এক গভীরতর সত্যের কাছাকাছি নিয়ে যায়। এই ‘পথ’ বা ‘যাত্রা’ বিভূতিভূষণের সাহিত্যের এক মৌলিক কাঠামো, যা চরিত্রদের জীবনকে গতিশীলতা দান করে এবং তাদের আত্মিক বিকাশকে সম্ভব করে তোলে।

বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায় (১২ সেপ্টেম্বর ১৮৯৪—১ নভেম্বর ১৯৫০).

উৎস: Prothomalo

কীওয়ার্ড: প রক ত র উপন য স চর ত র র জ বন ক জ বন জ বন র অরণ য

এছাড়াও পড়ুন:

উত্তর কোরিয়ার সঙ্গে আলোচনার জন্য চীনের সহযোগিতা চাইলো দক্ষিণ কোরিয়া

পারমাণবিক অস্ত্রধারী প্রতিবেশী উত্তর কোরিয়ার সাথে আলোচনা পুনরায় শুরু করতে চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিংয়ের সাহায্য চেয়েছেন দক্ষিণ কোরিয়ার প্রেসিডেন্ট লি জে মিউং। শনিবার দক্ষিণ কোরিয়ার গিয়ংজু শহরে এশিয়া-প্যাসিফিক নেতাদের ফোরামের পর এক রাষ্ট্রীয় শীর্ষ সম্মেলন এবং নৈশভোজে চীনা প্রেসিডেন্টের কাছে এই অনুরোধ করেছেন তিনি।

জবাবে শি লিকে জানিয়েছেন, তিনি সহযোগিতা আরো বিস্তৃত করতে এবং তাদের মুখোমুখি চ্যালেঞ্জগুলো যৌথভাবে মোকাবেলা করতে ইচ্ছুক।

দক্ষিণ কোরিয়ার প্রেসিডেন্টের কার্যালয় জানিয়েছে, শীর্ষ সম্মেলনের আগে শি বলেছেন, বেইজিং সিউলের সাথে সম্পর্ককে অত্যন্ত গুরুত্ব দেয় এবং দক্ষিণ কোরিয়াকে একটি অবিচ্ছেদ্য সহযোগী অংশীদার হিসেবে দেখে।

জুন মাসে আকস্মিক নির্বাচনে প্রেসিডেন্ট হিসেবে নির্বাচিত লি চীনকে না চটিয়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সাথে সম্পর্ক জোরদার করতে চাইছেন এবং উত্তর কোরিয়ার সাথে উত্তেজনা কমাতে চাইছেন।

চীন এবং উত্তর কোরিয়ার মধ্যে সাম্প্রতিক উচ্চ পর্যায়ে বৈঠকের উল্লেখ করে লি বলেন, “উত্তর কোরিয়ার সাথে সম্পর্কের জন্য যে পরিস্থিতি তৈরি হচ্ছে সে সম্পর্কে আমি খুবই ইতিবাচক।”

তিনি বলেছেন, “আমি আশা করি দক্ষিণ কোরিয়া এবং চীন এই অনুকূল পরিস্থিতির সুযোগ নিয়ে উত্তর কোরিয়ার সাথে কৌশলগত যোগাযোগ জোরদার করবে এবং সংলাপ পুনরায় শুরু করবে।”

লি উত্তর কোরিয়াকে পরমাণু নিরস্ত্রীকরণের জন্য পর্যায়ক্রমে পদক্ষেপ নেওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন, যার শুরুতে পারমাণবিক অস্ত্রের আরো উন্নয়ন স্থগিত করার বিষয়টি রয়েছে।
 

ঢাকা/শাহেদ

সম্পর্কিত নিবন্ধ