সাটুরিয়ার বরাইদ ইউনিয়নের সাভারের বাসিন্দা রজ্জব আলী। বাবা-দাদার সূত্রে রজ্জব একজন তাঁতি। নিজ বাড়িতেই বসিয়েছেন ২২টি বিদ্যুৎচালিত তাঁতযন্ত্র বা পাওয়ারলুম। বাড়িতেই তৈরি করেন সিল্ক ও হাফ সিল্ক কাপড়। কিন্তু কাপড় বুনে রজ্জবের ৫ সদস্যের সংসার চালানোই কঠিন হয়ে পড়েছে।
রজ্জব (৬৮) জানান, দিন দিন কাঁচামালের দাম অনেক বেড়ে যাওয়ায় ও ভারতীয় শাড়ি কম দামে বেচাকেনা হওয়ায় তাঁতশিল্পে ধস নেমেছে। ফলে লোকসান গুনতে হচ্ছে তাদের।
বরাইদ ইউনিয়নে রজ্জবের মতো দুই শতাধিক পরিবার তাঁতশিল্পের সঙ্গে জড়িত। তারা সবাই সংসার চালাতে হিমশিম খাচ্ছে।
রজ্জবের ভাষ্যমতে, এ গ্রামে প্রায় দুই হাজারের বেশি তাঁতকল ছিল। এর মধ্যে বন্ধ হয়ে গেছে আট শতাধিক তাঁতকল। তিনি বলেন, তাঁর পরিবারের সবাই কাপড় বোনার কাজ করেন। সুতার দাম অনেক বেড়ে যাওয়ায় আয় আগের চেয়ে অনেক কমেছে। আগে এক কেজি সুতা কিনতেন আড়াই থেকে তিনশত টাকায়। এখন সেই সুতার দাম হয়েছে ৮০০ টাকা। কিন্তু এটা তাদের আদি পেশা, তাই এই পেশা পরিবর্তন করতে পারছেন না। আবার অনেকে এ পেশা ছেড়ে দিয়ে অন্য পেশায় ঝুঁকছেন।
বরাইদ ইউনিয়নের পাশেই দিঘুলিয়া ইউনিয়ন। এ ইউনিয়নের গ্রামের রাস্তা দিয়ে চলার সময় কানে আসে তাঁতের খটাখট শব্দ। অধিকাংশ বসতভিটায় বসানো বিদ্যুৎচালিত তাঁতযন্ত্র। প্রতিদিন ভোররাত থেকে শুরু করে গভীর রাত পর্যন্ত চলে এসব যন্ত্র।
তাঁতকল মালিক আব্দুল কুদ্দুস বলেন, এখন তারা পাওয়ারলুমে সিল্ক শাড়ি তৈরি করছেন। আগে হস্তচালিত তাঁত বা হ্যান্ডলুমে কাপড়, লুঙ্গি ও গামছা বুনতেন। সে সময় এক কেজি রেন্ডি সুতার দাম ছিল তিন থেকে চারশত টাকা। এখন সেই সুতার দাম হয়েছে প্রায় ৫ হাজার টাকা। সুতার দাম বাড়লেও কাপড়ের দাম বাড়েনি। তাই হাটবাজারে কাপড় বিক্রি করে লোকসান গুনতে হচ্ছে।
আব্দুল কুদ্দুসের বসতবাড়িতে ১২টি তাঁতকল রয়েছে। তাঁর তাঁতকলে প্রতিদিন ৫০ থেকে ৬০ পিস রংধনু ও ধুপিয়ানা শাড়ি তৈরি করেন ছয়জন শ্রমিক। প্রত্যেক শ্রমিক শাড়িপ্রতি মজুরি পান ৫০ থেকে ৬০ টাকা। একজন শ্রমিক ভোর থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত প্রতিদিন গড়ে ৮ থেকে ১০টি শাড়ি বুনন করতে পারেন। একটি রংধনু শাড়ি তৈরি করতে খরচ হয় ২৮০ টাকা ও একটি ধুপিয়ানা শাড়ি তৈরি করতে খরচ হয় ৩৮০ টাকা। সেই শাড়ি টাঙ্গাইলের করটিয়া ও পাতরাইল হাটে ১০ থেকে ২০ টাকা ক্ষতিতে বিক্রি করতে হচ্ছে। বর্তমান দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির কারণে ঠিকমতো পোষাতে পারছেন না তিনি। সংসার চালাতে হিমশিম খাচ্ছেন।
দিঘুলিয়া ইউনিয়নের নাছুরপুর গ্রামের আবু তাহের। তাঁর বাড়িতে ২৮টি তাঁতকল ছিল। প্রায় ৬ বছর ধরে সব তাঁতকল বন্ধ। এখানে প্রায় দেড় শতাধিক শ্রমিক কাজ করত। এ বিষয়ে আবু তাহের বলেন, ‘ব্যবসা নেই। আমরা ইন্ডিয়ান সুতা কিনে তৈরি করতাম শাড়ি। ইন্ডিয়ানরা বিক্রি করে কম দামে। আমাদের খরচ বেশি হওয়ায় আমাদের শাড়ি বিক্রি হয় না। এ ছাড়া সুতার দাম বেড়ে যাওয়া ও বুনন করা শাড়ি কাপড় হাটবাজারে বিক্রি না হওয়ায় তাঁতকল বন্ধ করে দিয়েছি।’
সাভার গ্রামের জাহাঙ্গীর আলমের তাঁতকল ছিল ৫০টি। কাঁচামালের দাম বৃদ্ধি ও কাপড়ের দাম কম পাওয়ায় তিনিও ৫ বছর ধরে সব তাঁতকল বন্ধ করে দেন। এখন তারা পেশা বদলাতে বাধ্য হয়েছেন। এ ইউনিয়নে কয়েকশ’ তাঁতকল বন্ধ হয়ে গেছে।
তাঁত মালিকরা বলেন, বর্তমানে তাঁতিদের আর্থিক সংকট ও অন্যান্য সমস্যার কারণে সাটুরিয়ার ঐতিহ্যবাহী তাঁতশিল্প আজ ধ্বংসের মুখে। সরকারিভাবে সহযোগিতা পাওয়া গেলে ঐতিহ্যবাহী এই শিল্পকে বাঁচিয়ে রাখা সম্ভব।
বাংলাদেশ ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প কর্পোরেশন (বিসিক) মানিকগঞ্জ জেলার উপ-ব্যবস্থাপক মাহবুবুল ইসলাম বলেন, বিসিক কুটির শিল্প উন্নয়নে ১৯৫৭ সাল থেকে কাজ করে যাচ্ছে। তাঁতশিল্প ছাড়াও অন্য কুটির শিল্পের ক্ষেত্রেও তারা পরামর্শ দিয়ে থাকে। তাঁতিরা উপযুক্ত কাগজপত্র নিয়ে তাদের সঙ্গে যোগাযোগ করলে আর্থিকভাবে সহযোগিতা করা যাবে।
.উৎস: Samakal
এছাড়াও পড়ুন:
সব্যসাচী কাজী মোতাহার হোসেন বিজ্ঞান ও শিল্পের মেলবন্ধন ঘটিয়েছেন
প্রথিতযশা অধ্যাপক ও পরিসংখ্যানবিদ কাজী মোতাহার হোসেন ছিলেন একজন সব্যসাচী মানুষ। তিনি নিজের কাজের মাধ্যমে বিজ্ঞান ও শিল্পের মেলবন্ধন ঘটিয়েছেন। তাঁর ঐতিহ্য শিক্ষার্থীদের ধারণ করতে হবে।
জ্ঞানতাপস কাজী মোতাহার হোসেনের ১২৮তম জন্মবার্ষিকী উপলক্ষে আজ বুধবার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-শিক্ষক কেন্দ্র (টিএসসি) মিলনায়তনে আয়োজিত অনুষ্ঠানে বক্তারা এ কথাগুলো বলেন।
অনুষ্ঠানে স্মারক বক্তৃতা, বৃত্তি, পদক, পুরস্কার ও সনদ দেওয়া হয়। অনুষ্ঠানের যৌথ আয়োজক কাজী মোতাহার হোসেন ফাউন্ডেশন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিসংখ্যান বিভাগ এবং পরিসংখ্যান গবেষণা ও শিক্ষণ ইনস্টিটিউট।
অনুষ্ঠানে ‘যুগলের বন্ধন: কাজী নজরুল ইসলাম-কাজী মোতাহার হোসেন’ শীর্ষক স্মারক বক্তৃতা দেন অধ্যাপক ভীষ্মদেব চৌধুরী। তিনি দুই বন্ধুর সম্পর্কের রসায়নের নানা দিক তুলে ধরেন।
প্রধান অতিথি বক্তব্যে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য নিয়াজ আহমেদ খান বলেন, এই অনুষ্ঠানের দুটো প্রাপ্তি আছে। প্রথমত, মানুষের অবদান ও মেধাকে স্বীকার করা হচ্ছে। দ্বিতীয়ত, এই উপমহাদেশের একজন প্রথিতযশা সব্যসাচী মানুষের ঋণ স্বীকার করা হচ্ছে।
কাজী মোতাহার হোসেন যেকোনো বিবেচনায় একজন দার্শনিক বলে উল্লেখ করেন নিয়াজ আহমেদ খান। তিনি বলেন, কাজী মোতাহার হোসেন বিজ্ঞান ও শিল্পের মধ্যে মেলবন্ধন ঘটিয়েছেন। প্রথম সারির পরিসংখ্যানবিদ, বিভাগের প্রতিষ্ঠাতা ছাড়াও তিনি অনেকগুলো সামাজিক আন্দোলনে নেতৃত্ব দিয়েছেন, প্রভাব বিস্তার করেছেন। একজন মানুষের ছোট জীবদ্দশায় এত গুণ সন্নিবেশিত করা কঠিন। কিন্তু তিনি তা করে দেখিয়েছেন।
সবাইকে নিয়ে চলা, প্রতিষ্ঠান তৈরি করা, নিজের জগতের বাইরে নানা কিছুতে হাত বাড়িয়ে দেওয়ার মতো ঐতিহ্য কাজী মোতাহার হোসেন করে গেছেন বলে উল্লেখ করেন নিয়াজ আহমেদ খান। তিনি বলেন, তাঁর সম্মানে যাঁরা আজ স্বীকৃতি পেলেন, তাঁরা এই ঐতিহ্যকে ধারণ করবেন। এটা (বিশ্ববিদ্যালয়) যে সামাজিক প্রতিষ্ঠান, সে বার্তা দেবেন। যেসব শিক্ষার্থী সম্মাননা পাচ্ছেন, তাঁদের ছোট প্রোফাইল তৈরি করে ওয়েবসাইটে তুলে দেওয়ার আহ্বান জানান তিনি।
কাজী মোতাহার হোসেন ফাউন্ডেশনের সভাপতি অধ্যাপক আবদুল মাজেদ বলেন, কাজী মোতাহার হোসেন একজন সব্যসাচী মানুষ ছিলেন। বিজ্ঞানের এমন কোনো দিক নেই, যেখানে তাঁর পদচারণা ছিল না। তিনি দাবা খুব পছন্দ করতেন। দাবা খেলার কথা শুনলে তিনি ছুটে যেতেন। কাজী মোতাহার হোসেনকে নিয়ে তাঁর শোনা নানা গল্প তিনি স্মৃতিচারণা করেন।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিসংখ্যান বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক জাফর আহমেদ খান বলেন, কাজী মোতাহার হোসেন পরিসংখ্যান চর্চার পথিকৃৎ ছিলেন। বিজ্ঞান, দাবাচর্চারও পথিকৃৎ ছিলেন। এমন কোনো পুরস্কার নেই যে, তিনি পাননি। তাঁর দেখানো পথে যেন শিক্ষার্থীরা নিজেদের আলোকিত করতে পারেন।
অনুষ্ঠান সঞ্চালনা করেন কাজী মোতাহার হোসেন ফাউন্ডেশনের সাধারণ সম্পাদক কাজী রওনাক হোসেন। এই আয়োজনে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিসংখ্যান বিভাগের বিভিন্ন বর্ষের সেরা শিক্ষার্থীদের বই, নগদ অর্থ ও সনদ তুলে দেওয়া হয়। এ ছাড়া কাজী মোতাহার হোসেনকে নিয়ে আয়োজিত রচনা প্রতিযোগিতায় বিজয়ীদের পুরস্কার তুলে দেওয়া হয়।