Samakal:
2025-05-01@09:59:23 GMT

পশুপাখির মৃত্যুশোক

Published: 23rd, January 2025 GMT

পশুপাখির মৃত্যুশোক

সম্প্রতি শিরোনামে এসেছে ঘাতক তিমি তাহলেকুয়া। তাকে আবারও দেখা গেছে, তার আরও একটা মৃত শাবকের দেহ বহন করতে। ২০১৮ সালে মৃত শাবকের দেহ ১৭ দিন ধরে ঠেলে নিয়ে আলোচনায় আসা তিমি তাহলেকুয়া সে সময় ক্রমশ ডুবে যাওয়া থেকে তার শাবকের মরদেহ রক্ষা করছিল। এই ঘটনা পুরোনো একটা প্রশ্ন আবারও সামনে নিয়ে আসে। তাহলে মানবীয় আবেগ অনুভূতির অংশ ‘শোক’ কি প্রাণিকুলের মধ্যেও বিদ্যমান? 
২০২১ সালে এডিনবরা চিড়িয়াখানা কর্তৃপক্ষ জানিয়েছিল, লিয়ান নামের একটা শিম্পাঞ্জি মৃত শাবকের জন্ম দেয়, কিন্তু শিম্পাঞ্জিটা তার শাবককে ফেলে দিতে চাচ্ছিল না। সে মৃত শাবকটিকে তার সঙ্গে নিয়ে ঘুরছিল। ডলফিন এবং বানরের মতো অন্যান্য বুদ্ধিমান স্তন্যপায়ী প্রাণীদেরও এই একই আচরণ করতে দেখা গেছে।
কার্ডিফ বিশ্ববিদ্যালয়ের বোধ (কগনেটিভ)-সংক্রান্ত বিজ্ঞান দর্শনের গবেষক বেকি মিলারের মতে, ‘এই আচরণগুলো অবশ্যই শোক প্রকাশের দৃষ্টিকোণ থেকে বিবেচনা করতে হবে। মানুষ হিসেবে আমরা যদি কাউকে হারিয়ে ফেলি, তাহলে আমরা কোনো না কোনোভাবে সেই ব্যক্তির সাথেই আঁকড়ে থাকতে চাই। এটা আসলে মৃত প্রিয়জনের সাথে বন্ধন ধরে রাখার প্রকাশভঙ্গি। তবে প্রাণিকুলের এই প্রকাশভঙ্গির মধ্যে উল্লেখযোগ্য বিষয় হলো, তারা জীবিত শাবকদের মতো করেই মৃত শাবকদের সাথেও একই ধরনের ব্যবহার করে। তাদের শাবক যে মৃত, সম্ভবত এটা তাদের বোঝার বাইরে। তারা মৃত শাবকটিকে ফেলে দিতে পারে না। দেখে মনে হয় যেন, তারা নতুন পরিস্থিতির সাথে যুদ্ধ করছে, বোঝার চেষ্টা করছে।’
আসলে প্রিয়জন মারা যাওয়ার পর মানবজাতি এবং প্রাণিকুল উভয়েই সৃষ্ট নতুন পরিবেশের সাথে মানিয়ে নিতে চায়। মিলার এই প্রসঙ্গটি উল্লেখ করে বলেন, প্রাণিকুল সব সময়ই তাদের সঙ্গীদের মৃত্যুর পরও তাকে খোঁজে। একইভাবে মানবজাতিও তাদের আপনজনের মৃত্যুর পরে পরিবেশ-পারিপার্শ্বিকতার মধ্যে মৃত ব্যক্তির কোনো না কোনো সংকেত খুঁজতে থাকে।   
এই আচরণগুলো কখনও কখনও মৃত্যুর অনেক পরে পর্যন্তও চলতে থাকে। স্কটল্যান্ডের এডিনবরায় গ্রেফ্রাইয়ার্স ববি নামের ছোট একটা শিকারি কুকুর তার মালিকের কবর ১৪ বছর ধরে পাহারা দিয়েছিল। আবার জাপানে আকিতা জাতের একটা কুকুর হাচিকো তার মালিকের মৃত্যুর দীর্ঘ সময় পরেও রেলস্টেশনে তার জন্য অপেক্ষা করতে থাকে। 
সঙ্গীকে হারানোর পর প্রাণিকুলের তীব্র যন্ত্রণার গল্পও আছে। যেমন– সি লায়নের (সিল মাছবিশেষ) শাবককে ঘাতক তিমি খেয়ে ফেললে, মা সি লায়নের হাহাকার নিয়েও খবর দেখা গেছে। 
নৃবিজ্ঞানী বারবারা কিং তাঁর ‘হাউ অ্যানিম্যালস্ গ্রিভ’ বইয়ে বিড়াল, কুকুর ও খরগোশদের কান্নাকাটি, তাদের সঙ্গীদের খোঁজার বর্ণনা এবং ঘোড়ার পালের একজন সদস্যের কবরের চারপাশে জড়ো হওয়ার ঘটনাগুলো আলোকপাত করেছেন। 
১৯৯৯ সালে ভারতীয় চিড়িয়াখানায় এক বৃদ্ধা হাতির বন্ধু সন্তান প্রসবের সময় মৃত্যুবরণ করলে বৃদ্ধা হাতিটিও শোকে মারা যায়।  ১৯৭২ সালে ইংরেজ প্রাইমেটোলজিস্ট জেন গুডাল তাঁর গবেষণার মাধ্যমে দেখতে পারেন যে, ফ্লিন্ট নামের এক তরুণ শিম্পাঞ্জির মা মারা যাওয়ার পর মানুষের মতো তার মধ্যেও ক্লিনিক্যাল ডিপ্রেশনের লক্ষণগুলো দেখা যায়।
এমনকি পাখিদেরও শোক প্রকাশ করতে দেখা যায়। গ্রেল্যাগ প্রজাতির বড় রাজহংসী তার সঙ্গীকে হারানোর পর যে প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করে, সেটা মানুষের সাথে সাদৃশ্যপূর্ণ বলে ব্যাখ্যা করেন অস্ট্রেলিয়ান প্রাণিবিদ কনরাড লরেঞ্জ। রাজহংসীরা হতাশায় স্তব্ধ হয়ে মাথা নিচু করে থাকে, খাবারের প্রতি আগ্রহ হারিয়ে ফেলে এবং চারপাশের জগতের প্রতি উদাসীন হয়ে পড়ে।
গবেষণার তত্ত্বেও এর প্রমাণ পাওয়া যায় যে, কিছু প্রাণী শোকের মতো মানবীয় আবেগ অনুভব করে। পরীক্ষাগারে গবেষণার সময় দেখা যায়, স্তন্যপায়ী প্রাণিকুলের মধ্যে শাবকরা হঠাৎ করে তাদের মাকে হারালে, তারা হাহাকার বা বিলাপ করে এবং কাঁদতে থাকে। কোনো আত্মীয় বা সঙ্গীর মৃত্যুর পর মানুষ যেমন অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ার আয়োজন করে, একইভাবে কিছু প্রাণীকেও ধর্মীয় আচার প্রকাশ করতে দেখা যায়। পরিবারের সদস্য কিংবা অপরিচিতদের দেহাবশেষ পরিদর্শন করে, তাদের দেহ অস্থির হাড় স্পর্শ করে ও হাত বুলিয়ে দেয় এবং কঙ্কালটার পাশে দীর্ঘক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকে।
শিম্পাঞ্জিদের মধ্যে কেউ মারা গেলে তারা মৃত প্রাণীর মুখ ও দেহ পরিষ্কার করে বলে প্রচলিত আছে। আবার অনেক উপাখ্যানে উল্লেখ করা আছে, কাক, দোয়েল তাদের নিজেদের কেউ মারা গেলে সেই মৃতদেহের চারপাশে তারা জমায়েত হয়, আবার কখনও কখনও তারা মৃতদেহের কাছে পাতা বা ডালপালা রেখে দেয়।   
যা হোক, এই আচরণগুলো প্রকৃতপক্ষে মানবীয় আবেগ ‘শোক’ হিসেবে পরিগণিত হবে কিনা– এটা নির্ভর করে ধারণাটি আপনি কীভাবে ব্যাখ্যা করছেন– তার ওপর। আসলে এটা একটা দার্শনিক প্রশ্ন, যেটা নিয়ে বিতর্ক আছে। সাম্প্রতিক একটি প্রবন্ধে মিলার উল্লেখ করেন যে, দুঃখ ক্ষণস্থায়ী। শোক দীর্ঘ সময় ধরে বিরাজ করে। কখনও কখনও এটায় মাস বা বছরও পেরিয়ে যায়। শোকের আরেকটা উপকরণ হলো, এটা অন্যান্য আরও আবেগ ধারণ করে। ‘আপনি হয়তো শোক অনুভব করছেন, কিন্তু সম্ভবত এটার সাথে অন্যান্য আবেগও; যেমন– রাগ অথবা আশাও বজায় থাকে।’
মিলার বলেন, ‘কেউ একজন মারা গেছেন, সুস্পষ্টভাবে জানার পরও দেখা যায় যে মৃত্যুটা এখনও আপনার নিজের জগতের মধ্যে এবং আপনার অভ্যাসগত আচরণ ও চিন্তার জগতের মধ্যে প্রবেশই করেনি। আপনি হয়তো তার জন্য টেবিলের ওপর থালা সাজিয়ে রাখতে চাইতে পারেন, অথবা আপনি হয়তো সন্ধ্যা ৬টায় তার গাড়ি আসার শব্দ, তার পছন্দের সোফায় বসে থাকা প্রভৃতি অনুভব করতে পারেন।’
কিছু দার্শনিক যুক্তি দেখান যে, সঙ্গীকে হারানোর জন্য কিছু প্রাণী নিঃসন্দেহে যন্ত্রণা অনুভব করে, কিন্তু প্রকৃত ‘শোক’ অনুভূতির জন্য আরও যেসব বোধ দরকার, সেগুলো প্রাণীদের মধ্যে দেখা যায় না। এগুলোর মধ্যে আছে, মৃত্যু যে স্থায়ী এবং মৃত ব্যক্তি যে ভবিষ্যতে আর কখনও কোথাও উপস্থিত থাকবে না– এই বিষয়টা তারা অনুধাবন করতে পারে না। 
মিলার এই মতগুলোর সাথে দ্বিমত পোষণ করে বলেছেন যে, বিষয়টি শুধু প্রাণিকুলের ক্ষেত্রেই নয়, বরং মানবশিশু ও বয়স্কদের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য। তিনি বলেন, ‘আমি মনে করি না, মরণশীলতার বৈশিষ্ট্য সব মানুষকে সমানভাবে দুঃখভারাক্রান্ত করে। কিংবা তাদের শোক পালনও যে দীর্ঘদিন পর্যন্ত গড়াতে পারে। প্রিয়জন হারানো ছোট শিশু ও বৃদ্ধরা হারানোর ব্যথাটা ঠিক বোঝে না। এর অর্থ এই নয় যে, তাদের শোক কম হয়।’   
মিলার তাঁর প্রবন্ধে ‘শোক’-কে ব্যাখ্যা করেছেন এভাবে, বাস্তবিক অর্থে শোক হলো সম্পূর্ণরূপে পরিবর্তিত পৃথিবীতে নতুন করে বাঁচতে শেখা। তিনি বিশ্বাস করেন যে, নিজেকে মানিয়ে নেওয়ার এই প্রায়োগিক প্রক্রিয়া প্রাণিকুলের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য। 
‘আমি বিশ্বাস করি যে অন্যান্য প্রাণীও তাদের জীবন একে অন্যের সাথে ভাগাভাগি করে সুসংগঠিতভাবে যাপন করে,’ বলেন মিলার। ‘এ ক্ষেত্রে তাদের পুরো আচরণগত কাঠামোটা আরেকজনের ওপর নির্ভর করে। সুতরাং যখন তাদের সঙ্গী মারা যায়, তখন তারাও তাদের জগৎকে ফের শেখার এবং অনুধাবন করার মতো একটা দীর্ঘ প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে যেতে বাধ্য হয়।’ v   


lজেসমিন ফক্স-স্কেলি যুক্তরাজ্যের বিজ্ঞানভিত্তিক ফ্রিল্যান্স সাংবাদিক ও লেখক।

.

উৎস: Samakal

কীওয়ার্ড: কখনও ক র জন য

এছাড়াও পড়ুন:

গানের ভুবনে লিজার অন্তহীন পথচলা

শীর্ষ তারকা হওয়ার দৌড়ে কখনও অংশ নিতে দেখা যায়নি তাঁকে। যদিও ২০০৮ সালে ‘ক্লোজআপ ওয়ান: তোমাকেই খুঁজছে বাংলাদেশ’ প্রতিযোগিতায় সেরা শিল্পীর মুকুট মাথায় উঠেছিল, তবু ধীরলয়ে পথ হেঁটে গেছেন। নিজের কাজে অতিমাত্রার উচ্ছ্বাসও দেখাননি কখনও। নীরবে নিভৃতে কাজ করে গেছেন সবসময়। গানে গানে কুড়িয়ে চলেছেন শ্রোতার ভালোবাসা। এ কারণে সমসাময়িকদের চেয়ে আলাদা করে তাঁকে চিনে নেওয়া যায়। বলছি, কণ্ঠশিল্পী সানিয়া সুলতানা লিজার কথা। গানের ভুবনে অন্তহীন পথচলায় যিনি এরই মধ্যে পেরিয়ে এসেছেন প্রায় দেড় যুগের পথ। সমান জনপ্রিয়তা নিয়ে এ দীর্ঘ পথ পাড়ি দেওয়ার রহস্যটা কী? শুরুতে যখন এ প্রশ্ন লিজার সামনে তুলে আনা হলো, তখন দেখা গেল, লিজা নিজেই এর উত্তর খুঁজতে বসে গেছেন। এ পর্যায়ে হেসে বললেন, ‘না, এর উত্তর সত্যি জানা নেই। আসলে আমি তো গান গাই শ্রোতার প্রত্যাশা পূরণ আর ভালোবাসা কুড়ানোর জন্য। হ্যাঁ, শিল্পীসত্তাকে খুশি রাখতে গানের চর্চা ধরে রেখেছি বললে ভুল হবে না। তারপরও প্রতিটি আয়োজনে শ্রোতার ভালোলাগা, মন্দলাগাকে প্রাধান্য দিয়েছি। এতে করে কতটুকু জনপ্রিয়তা পেয়েছি। সেই জনপ্রিয়তা শুরু থেকে একই রকম আছে কিনা– সেটি তো শ্রোতারা ভালো বলতে পারবেন।’ লিজার এ কথা থেকে বোঝা যায়, যাদের কারণে শিল্পীজীবন বেছে নেওয়া, সেই শ্রোতা তাঁর দীর্ঘ পথ পাড়ি দেওয়ার অনুপ্রেরণা জুগিয়েছেন। সেখানে তাঁর গানগুলো ছিল চালিকাশক্তি। তবে ১৭ বছরের সংগীতের এ পথচলায় লিজার কণ্ঠে মেলোডি গান বেশি শুনতে পাওয়া গেছে। এর কারণ জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘এই দেড় যুগে নানা ধরনের গান গেয়েছি, তবু কেন জানি শ্রোতারা আমাকে মেলোডি গানের শিল্পীদের দলে রেখে দিয়েছেন। অস্বীকার করব না যে, আমার কণ্ঠে যে ধরনের গান ভক্তরা বেশি শুনতে চান, সে ধরনের গান বেশি গাই। এটিও ঠিক যে, মেলো কিংবা স্যাড-রোমান্টিক গানের প্রতি শ্রোতার ভালোলাগা সবসময় ছিল। এখনও অনেকে মেলোডি ছাড়া গানের কথা ভাবতে পারেন না। এজন্য নিরীক্ষাধর্মী কাজ করলেও আমি চাই না মেলোডি থেকে কখনও দূরে সরে থাকতে। তাই মেলোডি গান যেমন গাইছি, তেমনি গানের নিরীক্ষাও চালিয়ে যাচ্ছি।’ লিজার এ কথা যে মিথ্যা নয়, তা সর্বশেষ প্রকাশিত গানগুলোর শুনলে প্রমাণ মেলে। ক’দিন আগে বিটিভির ‘বৈঠকখানা’ অনুষ্ঠানে ক্লোজআপ ওয়ান তারকা মুহিনের সঙ্গে গাওয়া ‘তোমার নামে’ গানে যে লিজাকে শ্রোতা আবিষ্কার করবেন, তার সঙ্গে মেলানো কঠিন হবে সামজ ও রিজানের সঙ্গে ‘তিতা কথা’ গানের লিজাকে। আরেকটু পেছন ফিরে তাকালে দেখা যাবে, ‘খুব প্রিয় আমার’, ‘তুমি এলে’, ‘পূর্ণিমা চাঁদ’ গানগুলোয় লিজা অতীতের গায়কীকে ছাপিয়ে কীভাবে আরও নতুন হয়ে নিজ কণ্ঠ তুলে এনেছেন। 

মাঝে কিংবদন্তি শিল্পীদের বেশ কিছু কালজয়ী গানের রিমেকে কণ্ঠ দিয়েও প্রশংসা কুড়িয়েছেন সংগীতবোদ্ধাদের। স্টেজ শো, রেডিও, টিভির আয়োজন থেমে শুরু করে সিনেমার প্লেব্যাক শিল্পী হিসেবে প্রমাণ দিয়েছেন, তিনি অন্যদের চেয়ে কোনোভাবে পিছিয়ে নন। এককথায়, বহমান সময়টিকে সুরেলা করে রেখেছেন অনিন্দ্য কণ্ঠ জাদুতে। 

আগামীতেও লিজার কণ্ঠ বাতাসে ভেসে বেড়াবে– এ অনুমান করা যায়। 

সম্পর্কিত নিবন্ধ

  • মিষ্টি মেয়ের গল্প
  • চেন্নাইয়ের ঘরে বিষাদের বাজনা, ধোনির চোখে বিদায়ের আভা
  • গানের ভুবনে লিজার অন্তহীন পথচলা
  • চিনি-লবণের অনুপম পাঠ
  • শততম ম্যাচটি স্মরণীয় করে রাখতে চান ইয়ামাল
  • নির্মাতার ঘোষণার অপেক্ষায় চিত্রাঙ্গদা
  • শিশুর মাথা ঘামে কেন
  • কাঠফাটা রোদ্দুরে তপ্ত হাওয়া