চারপাশে মব সহিংসতা, গা-ছাড়া ভাব পুলিশের
Published: 6th, March 2025 GMT
‘আমার স্বামী কোনো অপরাধ করলে তাঁকে পুলিশে দিত। জমিজমার ঝামেলা মেটানোর কথা বলে আত্মীয়ের বাসা থেকে ডেকে নিয়ে দুই চোখ তুলে নিল, আঙুল কেটে দেওয়া হলো। ৪০-৫০ জন মিলে পিটিয়েছে। কাঁচি দিয়ে খুঁচিয়ে চোখ তুলেছে। ওরা চোখ-আঙুল ফেরত দিতে পারবে? পুলিশের সহযোগিতা চেয়েও পাইনি। আমি ওদের বিচার চাই।’ গত রোববার চুরির অভিযোগে ভোলার চরফ্যাসন উপজেলার দক্ষিণ আইচার শাহজাহান মিন্টিজ নামে এক ব্যক্তির ওপর বর্বরোচিত হামলা চালানো হয়। চোখের আলো হারিয়ে তিনি এখন ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন। গতকাল বুধবার হাসপাতালে তাঁর স্ত্রী ফাতেমা বেগম সমকালকে এসব কথা বলেন।
শাহজাহানের মতো এমন অনেকেই একের পর এক মব সহিংসতার শিকার। কিছু ঘটনায় টার্গেট করেও দলবদ্ধ হামলা করা হচ্ছে। নিরপরাধ ব্যক্তি, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্য, বিদেশি নাগরিকসহ অনেকেই এ ঘটনায় ভুক্তভোগী। সন্দেহের গণপিটুনিতে অনেকেই প্রাণ হারাচ্ছেন।
সংশ্লিষ্ট ও বিশেষজ্ঞরা বলছেন, গণআন্দোলনে সরকার পতনের পর পুলিশের ঢিলেঢালা ভাব ও নিষ্ক্রিয়তার সুযোগে অনেকে দলবদ্ধ হয়ে আইন হাতে তুলে নিচ্ছেন। তাৎক্ষণিক ‘শাস্তি’ নিশ্চিত করার যে প্রবণতা সমাজে দেখা যাচ্ছে, তা নিয়ে তৈরি হয়েছে উৎকণ্ঠা। অন্তর্বর্তী সরকারের পক্ষ থেকেও বিষয়টি নিয়ে উদ্বেগ জানানো হলেও মব সহিংসতা বন্ধ হচ্ছে না।
তাদের মতে, মব ট্রায়ালের ব্যাপারে সরকার যে কঠিন অ্যাকশনে রয়েছে এটা আরও দৃশ্যমান করা জরুরি। যৌথ বাহিনী মাঠে থাকার পরও যে ঘটনাগুলো ঘটেছে তাতে জড়িতদের চিহ্নিত করে দ্রুত আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়ার পরামর্শ তাদের। দ্রুত কার্যকর ব্যবস্থা না নিলে ভবিষ্যতে ‘প্রতিশোধ স্পৃহা’ তৈরি হওয়ার আশঙ্কার কথা বলছেন তারা।
চারপাশে প্রতিনিয়ত এমন ঘটনা ঘটছে। গত মঙ্গলবার বসুন্ধরা আবাসিক এলাকায় ‘ছিনতাইকারী’ বলে মব সৃষ্টি করে দুই ইরানি নাগরিকসহ তিনজনকে বেদম মারধর করা হয়েছে। মঙ্গলবার মধ্যরাতে ‘মব’ তৈরি করে গুলশানে সাবেক এমপি তানভীর ইমামের সাবেক স্ত্রীর বাসায় ঢুকে তল্লাশির নামে মালপত্র তছনছ, ভাঙচুর ও লুটপাটের ঘটনা ঘটে। আগের দিন সোমবার চট্টগ্রামের সাতকানিয়ায় লুটপাট ও আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে গণপিটুনিতে নেজাম উদ্দিন ও আবু সালেককে হত্যা করা হয়। একই দিন গাজীপুরে যাত্রীবাহী বাসকে সাইড দেওয়া নিয়ে বাগ্বিতণ্ডার জেরে রিটন মিয়া নামে এক অটোরিকশার চালকে হাত ও পায়ের রগ কেটে হত্যা করা হয়।
হিউম্যান রাইটস সাপোর্ট সোসাইটির প্রতিবেদনের তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, ২০২৪ সালে গণপিটুনির ঘটনা ২০১টি। এতে নিহত ১৭৯ ও আহত ৮৮ জন। ২০২৩ সালে ঘটনা ১১৪, নিহত ৭৩ ও আহত ৯১ জন। এই হিসাবে ২০২৩ সালের তুলনায় ২০২৪ সালে গণপিটুনিতে নিহতের সংখ্যা দ্বিগুণের বেশি। ২০২২ সালে ৭৯ ঘটনায় নিহত ৩৮ ও আহত ৮৩ জন। ২০২১ সালে ৮৩ ঘটনায় নিহত ৪৮ ও আহত ৮৫ জন। এ ছাড়া আইন ও সালিশ কেন্দ্রের (আসক) তথ্য অনুযায়ী, চলতি বছরের জানুয়ারিতে গণপিটুনিতে মারা গেছে ১৬ ও ফেব্রুয়ারিতে ১১ জন।
অন্তর্বর্তী সরকারের সাত মাসে দেশে গণপিটুনির অন্তত ১১৪টি ঘটনা ঘটেছে। এতে ১১৯ জন নিহত এবং ৭৪ জন আহত হয়েছেন। আর গত ১০ বছরে গণপিটুনিতে মারা গেছেন কমপক্ষে ৭৯২ জন। আহত হয়েছেন ৭৬৫ জন।
সাবেক পুলিশ মহাপরিদর্শক মুহাম্মদ নুরুল হুদা সমকালকে বলেন, যেসব ঘটনা ঘটে গেছে তার সঙ্গে জড়িতদের চিহ্নিত করে দ্রুত ব্যবস্থা নিতে হবে। দরকার হলে সামারি ট্রায়াল করা যেতে পারে। মব ভায়োলেন্স প্রতিরোধে সরকার যে কঠিন ব্যবস্থা নিতে পারে, সেটা দৃশ্যমান করা জরুরি। কর্তৃপক্ষের শৈথিল্য রয়েছে এটা মনে করার যুক্তিসংগত নানা কারণ আছে। একটা সুস্থ সমাজে আইন হাতে তুলে নেওয়ার মতো পরিস্থিতি থাকতে পারে না। এটা চলতে থাকলে দেশে-বিদেশে ভুল বার্তা যাবে।
অপরাধ ও সমাজ বিশেষজ্ঞ ড.
তিনি বলেন, কোনো অপরাধের তথ্য থাকলে বা কারও বিরুদ্ধে মামলা বা অভিযোগ থাকলে সুনাগরিক হিসেবে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে জানানো উচিত। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর মতো কারও বাসায় কোনো নাগরিকের তল্লাশি চালানো বা অভিযানের সময় দলবদ্ধ হয়ে বাসায় পুলিশের সঙ্গে থাকার আইনি অধিকার সাধারণ নাগরিককে দেওয়া হয়নি। বিশ্বের অনেক দেশে মব ভায়োলেন্স ছিল। তা অত্যন্ত কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রণ করেছে।
মানবাধিকার কর্মী ও বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বাংলাদেশের সংবিধান অনুযায়ী অপরাধী-নিরপরাধী নির্বিশেষে প্রত্যেক নাগরিকের আইনের আওতায় বিচার লাভ ও আত্মপক্ষ সমর্থনের সুযোগ রয়েছে। আইনের দৃষ্টিতে অপরাধী প্রমাণ না হওয়া পর্যন্ত কাউকে দোষী সাব্যস্ত করা যাবে না। ফৌজদারি কার্যবিধির ৫৯ ধারা অনুযায়ী অপরাধী ধরা পড়লে তাকে পুলিশে হস্তান্তর করতে হবে। এর ব্যতিক্রম হলে দণ্ডবিধির ১৮৭, ৩১৯, ৩২৩, ৩৩৫ ও ৩০৪ ধারা অনুযায়ী যাবজ্জীবন কারাদণ্ডসহ বিভিন্ন ধরনের শাস্তির বিধান রয়েছে। গণপিটুনিতে কোনো ব্যক্তি নিহত হলে দণ্ডবিধির ৩৪ ধারা অনুযায়ী অংশ নেওয়া সবাই সমানভাবে দায়ী হবে।
গণপিটুনি হলো মানবাধিকারের স্পষ্ট লঙ্ঘন। মানবাধিকারের সর্বজনীন ঘোষণা ১৯৪৮-এর তিন নম্বর অনুচ্ছেদে বলা আছে, প্রত্যেকের জীবন, স্বাধীনতা ও ব্যক্তিনিরাপত্তার অধিকার রয়েছে। অনুচ্ছেদ ৫ অনুযায়ী, কারও প্রতি নির্যাতন, অত্যাচার, নিষ্ঠুরতা, অমানবিক ও অবমাননাকর আচরণ করা যাবে না।
সম্প্রতি আসক এক বিবৃতিতে বলেছে ‘মব জাস্টিস’-এর নামে মানুষকে পিটিয়ে হত্যার ঘটনাগুলো উদ্বেগজনক। মব জাস্টিসের প্রসঙ্গ তুলে আসকের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে এক তরুণকে পিটিয়ে হত্যার বিষয়টি সমালোচনার ঝড় তোলে। চলমান পরিস্থিতিতে পিটিয়ে হত্যা বা মব জাস্টিসের মতো ঘটনার সঙ্গে রাজনৈতিক দলের পদধারী নেতা ও কর্মীরা হত্যাকাণ্ডের শিকার হচ্ছেন।
গত ৭ সেপ্টেম্বর রাতে পিটিয়ে হত্যা করা হয় রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ছাত্রলীগ নেতা আবদুল্লাহ আল মাসুদকে। বিশ্ববিদ্যালয়সংলগ্ন বিনোদপুর বাজারে তাঁর ওপর হামলা হয়। পরে তাঁকে গুরুতর আহত অবস্থায় থানায় সোপর্দ করা হয়। এর পর হাসপাতালে নেওয়া হলে মধ্যরাতে তিনি মারা যান। মাসুদ রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের সাবেক সহসম্পাদক ও কেন্দ্রীয় কমিটির সাবেক সদস্য ছিলেন। ২০১৪ সালের এপ্রিলে বিশ্ববিদ্যালয়ের জিয়া হলের সামনে হামলার শিকার হয়ে তিনি ডান পা হারিয়েছিলেন। বাঁ পা গুরুতরভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল তখন। তিনি কৃত্রিম পা নিয়ে চলাফেরা করতেন।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, মব জাস্টিসের নামে জোটবদ্ধ হয়ে হামলা-ভাঙচুরের অনেক ঘটনা পরিকল্পিতভাবে ঘটছে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষক, বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের প্রধান বা কর্মকর্তাকে জোর করে পদত্যাগে বাধ্য করা, মারধর করে তাড়িয়ে দেওয়া, আদালত এলাকায় আসামিদের ওপর হামলা এক ধরনের প্রতিশোধের মানসিকতা থেকে ঘটছে। এসব হামলা, ভাঙচুর, অগ্নিসংযোগ দেশজুড়ে যে পরিস্থিতি তৈরি করছে, তা শক্ত হাতে নিয়ন্ত্রণে সক্ষম না হলে স্থিতিশীলতা হুমকির মুখে পড়বে। হানাহানি ও বিদ্বেষ বাড়বে।
৫ আগস্ট সরকার পতনের পর থেকে প্রতিপক্ষের বাড়িঘরে আক্রমণ ও মাজারে মাজারে হামলা হচ্ছে। বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে ‘মব’ তৈরি করে অনেককে সরিয়ে দিতেও দেখা যায়। কক্সবাজার সৈকতে কয়েকজন দলবদ্ধ হয়ে এক নারীকে হেনস্তার ঘটনায় তুমুল সমালোচনা হয়। রাজধানীর শ্যামলীতে ভ্রাম্যমাণ যৌনকর্মী সন্দেহে কয়েকজন নারীকে মারধর করে এইচ এম রাসেল সুলতান নামের এক ব্যক্তি নিজের ফেসবুক আইডিতে ভিডিও প্রকাশ করেন।
পুলিশ সদরদপ্তরের মুখপাত্র এআইজি ইনামুল হক সাগর বলেন, আইন হাতে তুলে নেওয়া কোনোভাবেই কাম্য নয়। অপরাধী ধরতে গিয়ে অনেকে অপরাধী হয়ে যাচ্ছে। অপরাধীদের ব্যাপারে কোনো তথ্য থাকলে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে জানান; নাগরিকদের এই অনুরোধ আমরা করছি। মব ভায়োলেন্স ঠেকাতে সামাজিক সচেতনতা দরকার।
পুলিশের শৈথিল্যের সুযোগে এমন ঘটনা একের পর এক ঘটছে কিনা– এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, যারা আইন হাতে তুলে নিচ্ছে, তাদের অনেকের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে, গ্রেপ্তারও করা হয়েছে। পুলিশ আইন প্রয়োগ করতে গিয়ে বেআইনি দলবদ্ধ আক্রমণের শিকার হলে জড়িতদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে।
উৎস: Samakal
কীওয়ার্ড: মব ভ য় ল ন স মব জ স ট স গণপ ট ন ত দলবদ ধ হ ব যবস থ আইন হ ত অন য য় অপর ধ র ঘটন ও আহত ঘটন য় বলছ ন
এছাড়াও পড়ুন:
২৯ জুলাই থেকে ৮ আগস্ট সময়কালে ফ্যাসিবাদী শক্তি নৈরাজ্য সৃষ্টি করতে পারে, এসবির প্রতিবেদন
জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের বর্ষপূর্তি উপলক্ষে কর্মসূচি পালনকালে ফ্যাসিবাদী শক্তি অনলাইন-অফলাইনে প্রচারণা চালিয়ে সারা দেশে নৈরাজ্য সৃষ্টি করতে পারে বলে আশঙ্কা করছে পুলিশের বিশেষ শাখা (এসবি)।
গতকাল সোমবার এসবির এক প্রতিবেদনে এমন আশঙ্কার কথা বলা হয়েছে। প্রতিবেদনটি পুলিশের সব বিভাগকে পাঠিয়ে বিশেষ ব্যবস্থা গ্রহণের নির্দেশনা দিয়েছে এসবি। এসবির একটি সূত্র প্রথম আলোকে এই প্রতিবেদনের বিষয়টি নিশ্চিত করেছে।
প্রতিবেদনে বলা হয়, ঐতিহাসিক জুলাই অভ্যুত্থানের বর্ষপূর্তি উপলক্ষে সরকার, বিভিন্ন রাজনৈতিক দল ও ফ্যাসিবাদবিরোধী সামাজিক সংগঠনগুলো ১ জুলাই থেকে বিভিন্ন কর্মসূচি পালন করছে। এই ধারাবাহিকতায় ২৯ জুলাই থেকে ৮ আগস্ট পর্যন্ত কর্মসূচি পালনের সময়কাল বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ। এই সময়ে কর্মসূচি পালনকে কেন্দ্র করে বিতাড়িত ফ্যাসিবাদী শক্তি অনলাইন-অফলাইনে প্রচারণা চালিয়ে দেশব্যাপী নৈরাজ্য সৃষ্টি, ফ্যাসিবাদবিরোধী শক্তির কর্মসূচিতে বাধা প্রদানসহ বিভিন্ন কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে সার্বিক আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি ঘটানোর অপচেষ্টা চালাতে পারে।
আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি স্বাভাবিক রাখাসহ সরকারি-বেসরকারি সম্পত্তি ও জানমাল রক্ষায় পুলিশের বিভিন্ন বিভাগকে কয়েকটি নির্দেশনা দিয়েছে এসবি।
নির্দেশনাগুলো হলো ২৯ জুলাই থেকে ৮ আগস্ট পর্যন্ত বিশেষ অভিযান পরিচালনা করা। ৮ আগস্ট পর্যন্ত নিয়মিত সন্দেহজনক ব্যক্তিসহ মোটরসাইকেল, মাইক্রোবাস ও অন্যান্য যানবাহন তল্লাশি করা। বাস টার্মিনাল, লঞ্চঘাট, রেলস্টেশন ও বিমানবন্দরের পার্শ্ববর্তী এলাকায় বিশেষ নিরাপত্তা নিশ্চিত করা। গ্রেপ্তারি পরোয়ানা তামিল অভিযান পরিচালনা করা। মোবাইল প্যাট্রোল জোরদার করা। গুজব রোধে সাইবার পেট্রোলিং কার্যক্রম অব্যাহত রাখাসহ গোয়েন্দা তৎপরতা বৃদ্ধি করা।
এ ছাড়া কোনো অনভিপ্রেত ঘটনা ঘটার আশঙ্কা থাকলে তা তাৎক্ষণিকভাবে এসবিকে অবহিত করার কথাও বলা হয়েছে।