বিভিন্ন দেশের কূটনীতিকদের সম্মানে ইফতার মাহফিল করেছে জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি)। ইফতারের পর কূটনীতিকদের উদ্দেশে এনসিপির আহ্বায়ক নাহিদ ইসলাম বলেছেন, ‘আমাদের সংস্কার এজেন্ডা উচ্চাভিলাষী, কিন্তু প্রয়োজনীয়। আমরা জানি, এই পথচলা সহজ হবে না। তবে আমরা এটাও জানি যে বাংলাদেশ প্রস্তুত।’

আজ সোমবার রাজধানীর বনানীর হোটেল শেরাটনে এই ইফতার মাহফিল অনুষ্ঠিত হয়। অনুষ্ঠানে ঢাকায় নিযুক্ত বিভিন্ন দেশের রাষ্ট্রদূত ও দূতাবাসের প্রতিনিধিরা অংশ নেন।

অনুষ্ঠানে সমাপনী বক্তব্য দেন নাহিদ ইসলাম। তিনি ইংরেজিতে লেখা একটি বক্তব্য পড়ে শোনান। বক্তব্যের শুরুতেই ফিলিস্তিনের গাজায় নৃশংস হামলার নিন্দা জানিয়ে তিনি বলেন, প্রতিটি দেশ এবং প্রতিটি দায়িত্বশীল রাজনৈতিক শক্তির উচিত এই অন্যায়ের বিরুদ্ধে সোচ্চার হওয়া।

নাহিদ ইসলাম তাঁর বক্তব্যে রোহিঙ্গাদের টেকসই, মর্যাদাপূর্ণ ও স্বেচ্ছায় প্রত্যাবাসনের জন্য কার্যকর উদ্যোগ নিতে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের প্রতি আহ্বান জানান। তিনি বলেন, রোহিঙ্গা শরণার্থীদের দুর্দশা অন্যতম বড় মানবিক চ্যালেঞ্জ। বাংলাদেশ প্রায় এক মিলিয়ন শরণার্থীকে আশ্রয় দিয়ে বিরল মানবিক উদারতার পরিচয় দিয়েছে। তবে এই দায়িত্ব কেবল বাংলাদেশের একার নয়, এটি একই সঙ্গে বৈশ্বিক দায়িত্ব।

দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে মর্যাদা, ন্যায়বিচার, পারস্পরিক সম্মান এবং জাতীয় স্বার্থের সুরক্ষার ভিত্তিতে সম্পর্ক হতে হবে উল্লেখ করে নাহিদ বলেন, সম্পর্ক এমন হতে হবে, যেখানে কোনো দেশ নিজেকে অন্যের আধিপত্যের শিকার মনে করবে না এবং প্রতিটি জাতির সার্বভৌমত্বকে সম্মান করা হবে।

এনসিপির ইফতার অনুষ্ঠানে এসেছিলেন ঢাকায় নিযুক্ত চীনের রাষ্ট্রদূত ইয়াও ওয়েন, ফিলিস্তিনের রাষ্ট্রদূত ইউসুফ রামাদান, সুইডেনের রাষ্ট্রদূত নিকোলাস উইকস, স্পেনের রাষ্ট্রদূত গ্যাব্রিয়েল মারিয়া, কসোভোর রাষ্ট্রদূত লুলজিম প্লানা, পাকিস্তান দূতাবাসের ডেপুটি হাইকমিশনার মুহাম্মদ ওয়াসিম, যুক্তরাষ্ট্র দূতাবাসের রাজনৈতিক বিভাগের প্রধান ম্যাথিউ বে ও ভারতীয় হাইকমিশনের প্রথম সচিব (রাজনৈতিক) গোকুল ভি কে। এ ছাড়া যুক্তরাজ্য, রাশিয়া, কানাডা, স্পেন, নরওয়ে, সুইডেন, সুইজারল্যান্ড, নেদারল্যান্ডস, ডেনমার্ক, অস্ট্রেলিয়া, তুরস্ক, জাপান, আর্জেন্টিনা, ইরান, দক্ষিণ কেরিয়া, সিঙ্গাপুর, ভিয়েতনাম, শ্রীলঙ্কা, নেপালসহ বিভিন্ন দেশের প্রতিনিধি অংশ নেন। আরও ছিলেন ইউরোপীয় ইউনিয়নের প্রতিনিধি। এর বাইরে অন্যদের মধ্যে মেজর জেনারেল (অবসরপ্রাপ্ত) ফজলে এলাহী আকবর, বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যানের উপদেষ্টা মাহাদী আমিন ইফতার অনুষ্ঠানে অংশ নেন।

এনসিপির তিন লক্ষ্য

অনুষ্ঠানে এনসিপির আহ্বায়ক নাহিদ ইসলাম বলেন, গত জুলাই মাসে বাংলাদেশ এক ঐতিহাসিক মুহূর্ত প্রত্যক্ষ করেছে। শিক্ষার্থী, জেন–জি প্রজন্ম (জেনারেশন জেড), নারী, শ্রমিক, নাগরিক সমাজের সর্বস্তরের মানুষ দেশকে রক্ষার জন্য উঠে দাঁড়িয়েছিল। এটি ছিল এই সময়ের অন্যতম শক্তিশালী গণতান্ত্রিক আন্দোলন, যেখানে একটি নতুন রাজনৈতিক বন্দোবস্তের জন্য জনগণের সহজ অথচ গভীর আকাঙ্ক্ষা ছিল। অতীত সরকার নিপীড়ন, গুম, বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড, দুর্নীতি এবং সংবিধানে নিহিত কাঠামোগত বৈষম্যের মাধ্যমে জনগণের ন্যায়বিচার কেড়ে নিয়েছিল। এই অন্যায়ের বিবরণ আন্তর্জাতিক মহলেও স্বীকৃত হয়েছে।

নাহিদ ইসলাম বলেন, জুলাই আন্দোলনের নেতৃত্ব দিয়েছে শিক্ষার্থী ও জেন–জি প্রজন্ম। তারা নিরস্ত্র ছিল, কিন্তু লক্ষ্যে অবিচল ছিল। হাজার হাজার মানুষ শেখ হাসিনা সরকারের সময় হত্যাকাণ্ডের শিকার বা স্থায়ীভাবে পঙ্গু হয়েছেন। এই অপরাধগুলো স্পষ্টভাবে নথিভুক্ত হয়েছে এবং আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত। জুলাই বিপ্লবের কেন্দ্রীয় দাবি হলো মানবাধিকার লঙ্ঘনের জন্য ন্যায়বিচার নিশ্চিত করা।

নতুন রাজনৈতিক বন্দোবস্তের প্রয়োজনে এনসিপির জন্ম হয়েছে উল্লেখ করে নাহিদ ইসলাম বলেন, তাঁদের রাজনৈতিক রোডম্যাপে (পথনকশা) তিনটি মূল লক্ষ্য রয়েছে। এগুলো হলো ন্যায়বিচার, সংস্কার ও গণপরিষদ নির্বাচন। এই গণপরিষদ পরবর্তী সংসদ হিসেবে কাজ করবে। এই গণপরিষদ খুবই গুরুত্বপূর্ণ। কারণ, বর্তমান সংবিধান মৌলিকভাবে ত্রুটিপূর্ণ। একটি নতুন সংবিধানের মাধ্যমেই প্রকৃত গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের ভিত্তি স্থাপন করা সম্ভব।

নাহিদ বলেন, তাঁরা দ্বিতীয় প্রজাতন্ত্রের পক্ষে। জনগণের বৈচিত্র্যের প্রতিফলন ঘটবে, এমন একটি বাংলাদেশ তাঁরা চান; বহু ভাষা ও বহু সংস্কৃতির একটি অন্তর্ভুক্তিমূলক সমাজ চান। এমন একটি প্রজাতন্ত্র চান, যেখানে গণতন্ত্র ও আইনের শাসন প্রতিষ্ঠিত হবে, ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণ ও জবাবদিহি নিশ্চিত হবে, অন্তর্ভুক্তিমূলক রাজনীতি প্রতিষ্ঠা পাবে এবং একটি মধ্যপন্থী রাজনৈতিক দর্শন থাকবে।

সংস্কার এজেন্ডা উচ্চাভিলাষী, কিন্তু প্রয়োজনীয় উল্লেখ করে এনসিপির আহ্বায়ক বলেন, দায়মুক্তির সংস্কৃতি ভেঙে দিতে চান তাঁরা। রাজনৈতিক ব্যবস্থাকে এমনভাবে পুনর্গঠন করতে চান, যা সত্যিকার অর্থে জনগণকে সার্ভ (কল্যাণে কাজ করা) করবে। তবে তাঁরা জানেন, এই পথচলা সহজ হবে না। তবে এটাও জানেন, বাংলাদেশ প্রস্তুত। জনগণ শুধু পরিবর্তন চায় না, একটি মর্যাদাপূর্ণ বাংলাদেশ চায়।
এনসিপিকে শুধু একটি নতুন দল হিসেবে না দেখে একটি নতুন রাজনৈতিক সংস্কৃতির সূচনা হিসেবে দেখার অনুরোধও জানান নাহিদ ইসলাম।

রাজনৈতিক প্রক্রিয়ায় ফ্যাসিস্ট শক্তি নয়

অনুষ্ঠানে এনসিপির সদস্যসচিব আখতার হোসেন বলেন, তাঁরা বহুদলীয় গণতন্ত্রে বিশ্বাস করেন। সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্য, অন্তর্ভুক্তিমূলক দায়িত্ব ও সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতিপূর্ণ একটি সমাজের প্রতি তাঁরা প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। তাঁদের দাবি, ফ্যাসিস্ট শক্তির মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচার নিশ্চিত করতে হবে। বহুদলীয় গণতন্ত্রের সুযোগে ফ্যাসিস্ট শক্তি যাতে রাজনৈতিক প্রক্রিয়ায় অংশ নিতে না পারে।

আখতার বলেন, তাঁরা বিশ্বাস করেন, আগামী নির্বাচন হবে গণপরিষদ নির্বাচন, এর মধ্য দিয়ে একটি নতুন সংবিধান হবে। বাংলাদেশে একটি স্থায়ী গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠিত হবে। এই রূপান্তরের প্রক্রিয়ায় সবার সমর্থন চান তাঁরা।

এনসিপির যুগ্ম সদস্যসচিব আরিফ সোহেল আয়োজনটি সঞ্চালনা করেন। অনুষ্ঠানে আরও বক্তব্য দেন এনসিপির জ্যেষ্ঠ যুগ্ম সদস্যসচিব তাসনিম জারা।

.

উৎস: Prothomalo

কীওয়ার্ড: র জন ত ক ব অন ষ ঠ ন এনস প র ন র জন র জন য ইফত র

এছাড়াও পড়ুন:

মাঠের জবাব মাঠে দেওয়া হবে: সালাহউদ্দিন 

জাতীয় নির্বাচনে পিআর (সংখ্যানুপাতিক প্রতিনিধিত্ব) পদ্ধতির দাবিতে জামায়াতে ইসলামীর আন্দোলন প্রস্তুতির প্রেক্ষাপটে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমদ বলেছেন, “মাঠের জবাব মাঠে দেওয়া হবে।”

মঙ্গলবার (১৬ সেপ্টেম্বর) রাজধানীর গুলশানের নিজ বাসায় সমসাময়িক ইস্যুতে কথা বলার সময় তিনি এই হুঁশিয়ারি দেন।

আরো পড়ুন:

বাগেরহাটে হরতাল প্রত্যাহার, নির্বাচন অফিস ঘেরাওয়ের ঘোষণা

নড়াইলে বিএনপি নেতা বহিষ্কার

সালাহউদ্দিন আহমদ বলেন, “রাজনৈতিক হীন উদ্দেশ্যে বা কিছু আসন বেশি পাওয়ার লোভে জাতীয় স্বার্থের বাইরে গিয়ে কেউ যদি পিআর চায় সেটা ভয়ঙ্কর পরিণতি ডেকে আনবে।”

তিনি আরো বলেন, “উচ্চ-নিম্ন সবক্ষেত্রেই আমরা পিআর পদ্ধতির বিপক্ষে। তারা ইশতেহার নিয়ে জনগণের কাছে যাক, ম্যান্ডেট নিয়ে তারা তাদের ভাবনা বাস্তবায়ন করুক।”

জামায়াতসহ কয়েকটি দলের আন্দোলনের প্রস্তুতি সম্পর্কে বিএনপির এই নেতা বলেন,“যারা আন্দোলনের কর্মসূচি ঘোষণা করেছে, তাদের দাবি জুলাই সনদ বাস্তবায়ন। বাস্তবায়নের প্রক্রিয়াটি আলোচনাধীন। এমন সময় আন্দোলন করা কতটা উচিত, সেটা জনগণ দেখবে।”

স্বৈরাচারের দোসর জাতীয় পার্টি ও ১৪ দলের কার্যক্রম নিষিদ্ধ করার দাবি প্রসঙ্গে সালাহউদ্দিন বলেন, “নির্বাহী আদেশে নয়, বিচারিক প্রক্রিয়ার মাধ্যমে রাজনৈতিক দলের নিষেধাজ্ঞার বিষয়টি সমাধান হোক।”

নির্বাহী আদেশে রাজনৈতিক দল নিষিদ্ধ করার পরিণাম ভবিষ্যতে ভয়ঙ্কর চর্চায় রূপ নিবে জানিয়ে তিনি বলেন, “নির্বাহী আদেশে রাজনৈতিক দল নিষিদ্ধ করতে গেলে স্বৈরাচারের সঙ্গে যুক্ত ২৮টি দলকে নিষিদ্ধ করতে হবে। নির্বাচন কাদের নিয়ে হবে? এটার উদ্দেশ্য এমন হতে পারে যে, নিজেদের অতিরিক্ত সুবিধা নিতে আন্দোলনকারীরা আরো দলের নিষিদ্ধের দাবি জানাতে পারে। এতে জাতীয় ঐক্য বিনষ্ট হবে। এ সূত্র ধরে পতিত শক্তি সুযোগ নেবে।”

স্থিতিশীল সরকার গঠন করতে না পারলে জাতীয় নিরাপত্তার সঙ্গে আঞ্চলিক নিরাপত্তাও হুমকিতে পড়বে বলে শঙ্কা প্রকাশ করেন সালাহউদ্দিন আহমদ।

ঢাকা/রায়হান/সাইফ 

সম্পর্কিত নিবন্ধ

  • জুলাই সনদের আইনি ভিত্তি এখন ১৮ কোটি মানুষের দাবি: জামায়াত
  • ‘ভোটারদের আস্থা নিশ্চিত করা বিএনপির দায়িত্ব’
  • পটুয়াখালীতে সালিস বৈঠকে অংশ নিলে নেতা-কর্মীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেবে বিএনপি
  • জুলাই সনদের বাস্তবায়নে দেরি হলে জনগণ আবারও রাস্তায় নামবে: জামায়াত নেতা রফিকুল
  • বাস্তবায়ন প্রক্রিয়া নিয়ে ঐকমত্য না হলে গণভোট ছাড়া উপায় নেই: এবি পার্টি
  • রোহিঙ্গা সমস্যায় রাজনৈতিক সমাধান খুঁজে বের করতে হবে
  • মাঠের জবাব মাঠে দেওয়া হবে: সালাহউদ্দিন 
  • জামায়াত কীভাবে জাতীয় পার্টিকে নিষিদ্ধ করার দাবি তোলে: আনিসুল ইসলাম মাহমুদ
  • জুলাই সনদ নিয়ে যেসব বিষয় বিবেচনায় রাখতে হবে
  • ফরিদপুরে সীমানা নিয়ে ডিসির চিঠি, এলাকাবাসীর ৫ দাবি