দেশি–বিদেশি চ্যালেঞ্জের মধ্যেও দেশের পণ্য রপ্তানি ইতিবাচক ধারায় রয়েছে। বৈদেশিক মুদ্রা আয়ের আরেক উৎস প্রবাসী আয়েও স্বস্তি আছে। ফলে বিদেশের সঙ্গে বাংলাদেশের লেনদেন ভারসাম্য পরিস্থিতির উন্নতি হয়েছে।

রাজনৈতিক অস্থিরতা, গ্যাস–বিদ্যুতের সংকটসহ বিভিন্ন সংকটে দেশের ব্যবসা–বাণিজ্যের গতি এখন কম। সেই সঙ্গে বিনিয়োগে খরা, উচ্চ মূল্যস্ফীতি, ব্যাংকঋণের সুদের হার বেশি। এমন পরিস্থিতিতে পণ্য রপ্তানি খাত কত দিন এ ধারাবাহিকতা ধরে রাখতে পারবে, সেটি নিয়ে শঙ্কা রয়েছে। কারণ, রপ্তানি খাতের সামনে রয়েছে নতুন ধরনের বৈশ্বিক চ্যালেঞ্জ।

একাধিক পণ্য রপ্তানিকারক জানান, যুক্তরাষ্ট্রের আরোপ করা পাল্টা শুল্কের কারণে দেশটিতে পণ্য রপ্তানির ক্ষেত্রে একধরনের অনিশ্চয়তা তৈরি হয়েছে। প্রতিযোগী দেশগুলো এ শুল্ক কমাতে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে দর–কষাকষিতে এগিয়ে গেলেও বাংলাদেশ সরকারের দিক থেকে এখনো দৃশ্যমান কোনো অগ্রগতি নেই। এ ছাড়া সম্প্রতি ভারত কয়েকটি স্থলবন্দর দিয়ে বাংলাদেশের পণ্য আমদানিতে বিধিনিষেধ আরোপ করায় দেশটিতে রপ্তানির ক্ষেত্রে নতুন সংকট দেখা দিয়েছে। অর্থনীতিবিদেরা বলছেন, রপ্তানি কোনো কারণে ক্ষতিগ্রস্ত হলে বৈদেশিক লেনদেনেও তার নেতিবাচক প্রভাব পড়বে। তাই পণ্য রপ্তানিতে গতি ধরে রাখার বিষয়ে বাজেটে বিশেষ উদ্যোগ নিতে হবে সরকারকে। আগামীকাল সোমবার অর্থ উপদেষ্টা সালেহউদ্দিন আহমেদ টেলিভিশনের মাধ্যমে আগামী ২০২৫-২৬ অর্থবছরের জাতীয় বাজেট ঘোষণা করবেন।

রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর (ইপিবি) তথ্যানুযায়ী, চলতি ২০২৪–২৫ অর্থবছরের প্রথম ১০ মাসে (জুলাই–এপ্রিল) ৪ হাজার ২১ কোটি মার্কিন ডলারের পণ্য রপ্তানি হয়েছে। এ রপ্তানি গত অর্থবছরের একই সময়ের তুলনায় ৯ দশমিক ৮ শতাংশ বেশি। এ ধারা বজায় থাকলে অর্থবছর শেষে পণ্য রপ্তানি সাড়ে চার হাজার কোটি ডলার ছাড়িয়ে যাবে।

দেশের পণ্য রপ্তানি ৮০ শতাংশের বেশি তৈরি পোশাক খাত থেকে আসে। ফলে তৈরি পোশাকের রপ্তানির প্রবৃদ্ধির কাছাকাছি সামগ্রিক পণ্য রপ্তানিতে প্রবৃদ্ধি হয়। চলতি অর্থবছরের প্রথম ১০ মাসে পোশাক রপ্তানিতে ১০ শতাংশ প্রবৃদ্ধি হয়েছে। তৈরি পোশাকের পর রপ্তানি আয়ের শীর্ষ চার খাত—চামড়া ও চামড়াজাত পণ্য, কৃষি প্রক্রিয়াজাত পণ্য, হোমটেক্সটাইল এবং পাট ও পাট পণ্য। এর মধ্যে পাট ও পাটপণ্য ছাড়া বাকিগুলোর রপ্তানি ইতিবাচক ধারায় আছে।

সংকটে জর্জরিত রপ্তানি খাত

দীর্ঘদিন ধরে গ্যাস–বিদ্যুতের সংকটে ভুগছে শিল্পকারখানা। গত মাসে সেটি প্রকট আকার ধারণ করে। গাজীপুরের চন্দ্রা এলাকায় টাওয়েল টেক্স কারখানায় গ্যাস থাকলে দিনে সাড়ে চার হাজার কেজি টাওয়েল উৎপাদিত হয়। গত ১৪ এপ্রিল থেকে কারখানাটিতে গ্যাস নেই। বিকল্প ব্যবস্থায় বিদ্যুৎ ব্যবহার করে প্রতি ২৮ ঘণ্টায় ১ হাজার ৬০০ কেজি টাওয়েল উৎপাদন করা হচ্ছে। এতে প্রতিষ্ঠানটির টাওয়েল রপ্তানি মারাত্মকভাবে বাধাগ্রস্ত হচ্ছে।

টাওয়েল টেক্সের ব্যবস্থাপনা পরিচালক এম শাহাদাত হোসেন গত বৃহস্পতিবার বলেন, ‘জ্বালানি উপদেষ্টার ঘোষণার পর আমরা আশায় ছিলাম ২৮ মে থেকে গ্যাসের সরবরাহ বাড়বে, তবে কিছু হয়নি। অধিকাংশ সময় গ্যাসের চাপ শূন্যের কাছাকাছি।’

শুধু গ্যাস–বিদ্যুৎ নয়, ব্যাংকঋণের উচ্চ সুদহারও সংকটে ফেলেছে রপ্তানিকারকদের। গত আগস্টে রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর থেকে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি তৈরি পোশাকশিল্পকে বেশ চাপের মুখে ফেলে দেয়। এমনকি সাভার, গাজীপুর, আশুলিয়াসহ বিভিন্ন এলাকায় শ্রমিক অসন্তোষের কারণে রপ্তানি কার্যক্রম বাধাগ্রস্ত হয়েছিল।

জানতে চাইলে নিট পোশাকশিল্পের মালিকদের সংগঠন বিকেএমইএর সভাপতি মোহাম্মদ হাতেম প্রথম আলোকে বলেন, ‘বিভিন্নভাবে তৈরি পোশাকশিল্পের প্রতিযোগিতা সক্ষমতা ধ্বংস করা হচ্ছে। ব্যাংকের অসহযোগিতা, গ্যাস–বিদ্যুতের সংকট, অযৌক্তিক আইনকানুনসহ অনেক সমস্যায় ভুগছে পোশাক কারখানা। আমরা প্রত্যাশা করি, আাগামী বাজেটে ব্যবসা–বাণিজ্য সহজ করার উদ্যোগ থাকবে।’

পাল্টা শুল্ক ও বিধিনিষেধ

বিশ্বের বিভিন্ন দেশের ওপর ২ এপ্রিল ন্যূনতম ১০ শতাংশ পাল্টা শুল্ক বা রেসিপ্রোকাল ট্যারিফ আরোপ করেন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। ৫৭ দেশের ওপর বিভিন্ন হারে বাড়তি পাল্টা শুল্ক বসানো হয়। ৯ এপ্রিল পাল্টা শুল্ক কার্যকরের দিন অনেকটা ‘ইউটার্ন’ করে তা তিন মাসের জন্য স্থগিতা করা হয়। যদিও সব দেশের ওপর ন্যূনতম ১০ শতাংশ পাল্টা শুল্ক কার্যকর করা হয়। বাংলাদেশি পণ্য রপ্তানির সবচেয়ে বড় বাজার যুক্তরাষ্ট্র। তাই এ শুল্প নিয়ে দুশ্চিন্তায় রয়েছেন এ দেশের রপ্তানিকারকেরা।

ট্রাম্পের শুল্কের রেশ না কাটতেই স্থলবন্দর দিয়ে বাংলাদেশ থেকে পণ্য আমদানিতে বিধিনিষেধ আরোপ করে ভারত সরকার। গত ১৭ মে আরোপ করা এ বিধিনিষেধের কারণে অনেক ছোট ও মাঝারি প্রতিষ্ঠান বেশি ক্ষতির মুখে পড়েছে। অন্য খাতের চেয়ে প্রক্রিয়াজাত খাদ্য ও প্লাষ্টিক পণ্য খাতের কোম্পানিগুলোর ঝুঁকির মাত্রা বেশি, যারা সেভেন সিস্টার–খ্যাত ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের সাত রাজ্যে রপ্তানি করে।

ভারতের বিধিনিষেধের পর মধ্যপ্রাচ্যসহ বিভিন্ন দেশে শাকসবজি রপ্তানিকারকেরা চাপে পড়েছেন। বাংলাদেশ ফ্রুটস ভেজিটেবল অ্যান্ড অ্যালাইড প্রোডাক্টস এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক মনসুর আহমেদ প্রথম আলোকে বলেন, ভারতের বিধিনিষেধের কারণে কার্গোতে তৈরি পোশাকের চাপ আরও বেড়েছে। ফলে শাকসবজি রপ্তানি আরেকটু কঠিন হয়েছে।

ব্যবসার ব্যয় কমাতে হবে

অভ্যন্তরীণ ও বৈশ্বিক চ্যালেঞ্জকে ব্যবসার নতুন বাস্তবতা উল্লেখ করে বেসরকারি গবেষণাপ্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম প্রথম আলোকে বলেন, ব্যবসা খরচ কমিয়ে রপ্তানিকারক প্রতিষ্ঠানের সক্ষমতা বাড়াতে হবে। জ্বালানি ব্যয় হ্রাস করার উদ্যোগ নেওয়া দরকার। রপ্তানি খাতের প্রতিষ্ঠানগুলো যাতে সহজে নবায়নযোগ্য জ্বালানিতে যেতে পারে, সে জন্য সরকার প্রণোদনা দিতে পারে। এ ছাড়া গ্যাস কূপ অনুসন্ধানে বাজেটে পর্যাপ্ত রাখা প্রয়োজন।

.

উৎস: Prothomalo

কীওয়ার্ড: য ক তর ষ ট র প রথম ব যবস সরক র

এছাড়াও পড়ুন:

আগেও পরিকল্পনা ছাড়া সংস্কৃতি খাতের বাজেট বরাদ্দ হয়েছে, এবারও তাই: আনু মুহাম্মদ

২০২৫-২৬ অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেটে সংস্কৃতি খাতে ৮২৪ কোটি টাকা বরাদ্দের প্রস্তাব করেছেন অর্থ উপদেষ্টা ড. সালেহ উদ্দিন আহমেদ। এর মধ্যে পরিচালন ব্যয় ধরা হয়েছে ৪৮৭ কোটি এবং উন্নয়ন ব্যয় ৩৩৭ কোটি টাকা। সোমবার বিকেল ৩টায় বাংলাদেশ টেলিভিশনে প্রচারিত বাজেট বক্তৃতায় তিনি এ ঘোষণা দেন। 

তবে এবারের বাজেটে চলতি বছরের তুলনায় বরাদ্দ কিছুটা বৃদ্ধি পেলেও শিল্পী ও সংস্কৃতিকর্মীদের দীর্ঘদিনের দাবি এক শতাংশ বরাদ্দের বিষয়টি এবারও পূরণ হয়নি। 

চলতি অর্থবছরে সংস্কৃতি খাতে বরাদ্দ ছিল ৭৭৯ কোটি টাকা, যা সংশোধিত হয়ে দাঁড়ায় ৭৪২ কোটিতে। সেই হিসেবে এবারের বরাদ্দ ৮২ কোটি টাকা বেশি। তবে বাজেট প্রস্তাবে দেখা গেছে, এই বরাদ্দও মোট বাজেটের তুলনায় অত্যন্ত সামান্য।

প্রস্তাবিত বাজেটের মোট আকার ধরা হয়েছে ৭ লাখ ৯০ হাজার কোটি টাকা। এর মধ্যে বিনোদন, সংস্কৃতি ও ধর্ম খাতে বরাদ্দ রাখা হয়েছে মাত্র শূন্য দশমিক ৮ শতাংশ। এই খাতের আওতায় রয়েছে চারটি মন্ত্রণালয়-তথ্য ও সম্প্রচার, সংস্কৃতি, ধর্ম এবং যুব ও ক্রীড়া মন্ত্রণালয়। এই চার মন্ত্রণালয়ের জন্য মোট বরাদ্দ ৬ হাজার ৫৪০ কোটি টাকা, যা জাতীয় বাজেটের এক শতাংশেরও কম।

এবারের প্রস্তাবিত বাজেটের প্রতিক্রিয়ায় অর্থনীতিবিদ আনু মুহাম্মদ বলেন, অতীতেও যেমন পরিকল্পনা ছাড়া সংস্কৃতি খাতের বাজেট বরাদ্দ হয়েছে, এবারও তাই ঘটেছে। সংস্কৃতির সার্বিক উন্নয়ন ঘটানোর মতো কিছু নেই এই বাজেটে।

তিনি বলেন, আমরা দীর্ঘদিন ধরে সংস্কৃতি খাতের বরাদ্দ মোট বাজেটের এক শতাংশ দাবি করে আসছি। কারণ, সাংস্কৃতিক জাগরণ না ঘটলে মানবিক সমাজ বিনির্মাণ সম্ভব নয়। সেই বিবেচনায় এবার ৮২ কোটি বাড়ানো হলেও আমাদের প্রত্যাশা পূরণ হয়নি। 

৮২৪ কোটি টাকার বরাদ্দ দিয়ে সারা দেশে সংস্কৃতিচর্চা ছড়িয়ে দেওয়া সম্ভব নয় উল্লেখ করে তিনি বলেন, এই স্বল্প টাকায় প্রতিটি জেলা ও উপজেলা কিংবা গ্রাম পর্যায়ে পাঠাগার গড়া, বিভিন্ন আঙ্গিকের শিল্প পরিবেশনার জন্য সাংস্কৃতিক কেন্দ্র নির্মাণ, তরুণ প্রজন্মকে নাচ-গান আবৃত্তি শেখানো জন্য সাংস্কৃতিক প্রশিক্ষণ কেন্দ্র নির্মাণ করা সম্ভব নয়। তাছাড়া কিছু পরিমাণ টাকা বৃদ্ধি করা হলেও সংস্কৃতিকে গতিশীল করার মতো কোনো পরিকল্পনা নেই সংস্কৃতি খাতের জন্য বরাদ্দকৃত বাজেটে।

সম্পর্কিত নিবন্ধ

  • দিন পার করার বাজেট
  • দেশ পুনর্গঠনের প্রত্যয়ের আশানুরূপ প্রতিফলন নেই
  • করমুক্ত আয়সীমা বাড়বে তবে এক বছর পর
  • জ্বালানি খাতে বরাদ্দ দ্বিগুণ
  • নোবিপ্রবির রিসার্চ সেলে ৪৩ লাখ টাকা গড়মিল তদন্তে কমিটি
  • শিক্ষার দুই মন্ত্রণালয়ে বরাদ্দ টাকার অঙ্কে বেড়েছে, জাতীয় বাজেটের শতাংশে কমেছে
  • ওটিটি প্ল্যাটফর্মে নাটক, সিনেমা দেখায় খরচ বাড়তে পারে
  • তরুণ উদ্যোক্তাদের জন্য ১০০ কোটি টাকার তহবিল করবে সরকার
  • ব্যবসা ও বিনিয়োগবান্ধব বাজেট হয়নি: ঢাকা চেম্বার
  • আগেও পরিকল্পনা ছাড়া সংস্কৃতি খাতের বাজেট বরাদ্দ হয়েছে, এবারও তাই: আনু মুহাম্মদ