ঈদুল আজহা, যাকে আমরা বলি কোরবানির ঈদ। এটা মুসলিম সমাজের অন্যতম পবিত্র উৎসব। এ উৎসব শুধু আনন্দের নয়; বরং আল্লাহর প্রতি আনুগত্য ও সমাজের প্রতি দায়িত্বশীলতার প্রতীক। ইবরাহিম (আ.) ও তাঁর পুত্র ইসমাইল (আ.)-এর ত্যাগের স্মরণে এ উৎসব পালিত হয়।

কোরবানির আচার শুধু একটি ধর্মীয় রীতি নয়; বরং এটি নফসের পরিশুদ্ধি, দানশীলতা ও সামাজিক ঐক্যের একটি গভীর দার্শনিক বার্তা বহন করে। আমরা ঈদুল আজহা ও কোরবানির আধ্যাত্মিক তাৎপর্য, মহানবী (সা.

)-এর সময়ে এর প্রচলন ও এর সামাজিক প্রভাব নিয়ে আলোচনা করব।

মহানবী (সা.) ঈদুল আজহার দিনে দুটি দুম্বা কোরবানি করতেন—একটি নিজের জন্য এবং অপরটি তাঁর উম্মতের জন্য। তিনি কোরবানির সময় বলতেন, ‘বিসমিল্লাহ, আল্লাহু আকবার।

কোরবানির আধ্যাত্মিক শিকড়

ঈদুল আজহার মূল কাহিনি ইবরাহিম (আ.)-এর ত্যাগের ঘটনার সঙ্গে সম্পর্কিত। কোরআনের সুরা সাফফাতে (আয়াত: ১০০-১১১) বর্ণিত হয়েছে যে আল্লাহ স্বপ্নে ইবরাহিম (আ.)-কে তাঁর প্রিয় পুত্র ইসমাইল (আ.)-কে কোরবানি করার নির্দেশ দেন।

ইবরাহিম (আ.) এ নির্দেশ পালনের জন্য প্রস্তুত হন এবং ইসমাইল (আ.) নিজেও আল্লাহর ইচ্ছার প্রতি সম্পূর্ণ সমর্পণ প্রকাশ করেন। তাঁদের এ আনুগত্য ও ত্যাগের প্রতি সম্মান জানিয়ে আল্লাহ ইসমাইল (আ.)-এর পরিবর্তে একটি দুম্বা কোরবানির জন্য প্রেরণ করেন।

এ ঘটনা মুসলিমদের শিক্ষা দেয় যে সত্যিকারের কোরবানি হলো আল্লাহর প্রতি নিঃশর্ত আনুগত্য ও নিজের প্রিয় জিনিস ত্যাগ করার মানসিক প্রস্তুতি।

ইমাম তাবারি (মৃ. ৩১০ হি.) তাঁর তাফসিরে তাবারি গ্রন্থে ব্যাখ্যা করেন, কোরবানির আচার শুধু পশু জবাই নয়; বরং এটি নফসের লোভ, অহংকার ও ইচ্ছাকে নিয়ন্ত্রণের প্রতীক। তিনি উল্লেখ করেন, ইবরাহিম (আ.)-এর ত্যাগ ছিল আধ্যাত্মিক জিহাদের একটি রূপ, যা মানুষকে আল্লাহর নৈকট্য লাভে সহায়তা করে।

আরও পড়ুনহজ, ঈদ, কোরবানি ও তাকওয়া০৮ জুলাই ২০২২মহানবী (সা.) ঈদের নামাজের জন্য মদিনার ঈদগাহে যেতেন একটি হারবা (বর্শা) সামনে রেখে। এ হারবা তাঁর সামনে স্থাপন করা হতো, যা পরবর্তীকালে খলিফাদের মধ্যে একটি শ্রদ্ধার প্রতীক হয়ে ওঠে।

সে সময়ে কোরবানি

মহানবী (সা.) মদিনায় হিজরতের পর ঈদুল আজহার প্রথাগত উদ্‌যাপন শুরু করেন। সহিহ বুখারি ও সহিহ মুসলিমে জাবির ইবনে আবদুল্লাহ (মৃ. ৭৮ হি.) থেকে বর্ণিত একটি হাদিসে আছে, মহানবী (সা.) ঈদুল আজহার দিনে দুটি দুম্বা কোরবানি করতেন—একটি নিজের জন্য এবং অপরটি তাঁর উম্মতের জন্য। তিনি কোরবানির সময় বলতেন, ‘বিসমিল্লাহ, আল্লাহু আকবার। এটি আমার পক্ষ থেকে এবং আমার উম্মতের যারা কোরবানি দিতে পারেনি তাদের পক্ষ থেকে।’

ইমাম তিরমিজি (মৃ. ২৭৯ হি.) তাঁর সুনানে তিরমিজি গ্রন্থে উল্লেখ করেন, মহানবী (সা.) কোরবানির মাংস তিন ভাগে ভাগ করতেন। এক ভাগ পরিবারের জন্য, এক ভাগ আত্মীয়স্বজনের জন্য ও এক ভাগ দরিদ্রদের জন্য। এ প্রথা কোরবানির সামাজিক দিককে তুলে ধরে, যা সমাজের দরিদ্র ও অভাবী মানুষের প্রতি দায়িত্বশীলতার শিক্ষা দেয়।

মহানবী (সা.) ঈদের দিনে সর্বোত্তম পোশাক পরতে ও সুগন্ধি ব্যবহার করতে উৎসাহিত করতেন। ইমাম বুখারি (মৃ. ২৫৬ হি.) উল্লেখ করেন, মহানবী (সা.) ঈদের নামাজের জন্য মদিনার ঈদগাহে যেতেন একটি হারবা (বর্শা) সামনে রেখে। এ হারবা তাঁর সামনে স্থাপন করা হতো, যা পরবর্তীকালে খলিফাদের মধ্যে একটি শ্রদ্ধার প্রতীক হয়ে ওঠে। নবী (সা.)-এর এ সাধারণ কিন্তু গভীর আচরণ ঈদুল আজহাকে একটি সামাজিক ও আধ্যাত্মিক উৎসব হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করে।

আরও পড়ুনজালালুদ্দিন রুমির ‘মসনভি’তে কোরআনের মর্মবাণী২৩ সেপ্টেম্বর ২০২৪কোরবানির মাংস বিতরণের মাধ্যমে মুসলিম সমাজে ধনী-দরিদ্রের মধ্যে বৈষম্য কমে এবং ভ্রাতৃত্বের বন্ধন মজবুত হয়।ইমাম গাজ্জালি (মৃ. ৫০৫ হি.), ইহয়াউ উলুমিদ্দিন

কোরবানির আধ্যাত্মিক প্রভাব

কোরবানির আচার শুধু ব্যক্তিগত ইবাদত নয়; বরং এটি সমাজের দরিদ্র ও অভাবীদের প্রতি দায়িত্ব পালনের একটি মাধ্যম। ইমাম গাজ্জালি (মৃ. ৫০৫ হি.) তাঁর ‘ইহয়াউ উলুমিদ্দিন’ গ্রন্থে ব্যাখ্যা করেন, কোরবানির মাংস বিতরণের মাধ্যমে মুসলিম সমাজে ধনী-দরিদ্রের মধ্যে বৈষম্য কমে এবং ভ্রাতৃত্বের বন্ধন মজবুত হয়। তিনি বলেন, কোরবানি হলো আল্লাহর প্রতি ভালোবাসা ও মানুষের প্রতি উদারতার সমন্বয়।

ঈদুল আজহার নামাজও একটি সামাজিক সমাবেশ। সহিহ মুসলিমে উম্মে আতিয়া আল-আনসারিয়ার (মৃত্যু: প্রায় ৭০ হিজরি) বর্ণনায় আছে, মহানবী (সা.) নারীদের ঈদের মাঠে উপস্থিত থাকতে বলতেন। এ অন্তর্ভুক্তি ঈদকে একটি সর্বজনীন উৎসব হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করে, যেখানে সমাজের সর্বস্তরের মানুষ সমবেত হয়।

আয়েশা (রা.) বলেন, ঈদুল আজহার দিনে মদিনার কতিপয় বাসিন্দা তাঁদের ঐতিহ্যবাহী তরবারি ও ঢাল নিয়ে খেলা প্রদর্শন করছিলেন।আরও পড়ুন রুমির ‘মসনভি’তে কোরআনের মর্মবাণী২৭ জুন ২০২৪

সহিহ বুখারিতে বর্ণিত হয়েছে, আয়েশা (রা.) বলেন, ঈদুল আজহার দিনে মদিনার কতিপয় বাসিন্দা তাঁদের ঐতিহ্যবাহী তরবারি ও ঢাল নিয়ে খেলা প্রদর্শন করছিলেন। মহানবী (সা.) আয়েশা (রা.)-কে এ খেলা দেখার অনুমতি দেন এবং তাঁর সঙ্গে দাঁড়িয়ে এটি উপভোগ করেন।

মহানবী মুহাম্মদ (সা.)-এর সময়ে শুরু হওয়া কোরবানির অনুষ্ঠান পরবর্তী ইসলামি যুগে কীভাবে আরও সমৃদ্ধ হয়েছে এবং কী মাত্রা যোগ করেছে, পরবর্তী পর্বে আমরা আলোচনা করব।

‘আল–জাজিরা ডট নেট’ অবলম্বনে

উৎস: Prothomalo

কীওয়ার্ড: ঈদ ল আজহ র দ ন ক রব ন র জ র জন য ত ন একট ইবর হ ম পরবর ত মদ ন র দর দ র ন র ঈদ আল ল হ করত ন র সময

এছাড়াও পড়ুন:

প্রয়োজন অনুসারে রাষ্ট্রকাঠামোর পরিবর্তনে সচেতনভাবে এগোচ্ছে বিএনপি: মির্জা ফখরুল

প্রয়োজন অনুসারে রাষ্ট্রকাঠামোর পরিবর্তনে বিএনপি সচেতনভাবে এগোচ্ছে বলে মন্তব্য করেছেন দলের মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। তিনি বলেন, ‘জনগণের যেটা প্রয়োজন, যুগের সঙ্গে সঙ্গে যে পরিবর্তনগুলো আনা দরকার, রাষ্ট্রকাঠামোর যে পরিবর্তন আনা দরকার, সে বিষয়ে আমরা অত্যন্ত সচেতন। সচেতনভাবেই সামনের দিকে এগোচ্ছি।’

আজ রোববার দুপুরে রাজধানীর মহাখালীর ব্র্যাক সেন্টারে ‘পদ্মা ব্যারাজ ও দ্বিতীয় পদ্মা সেতু বাস্তবায়ন প্রয়োজনীয়তা’ শীর্ষক এক সেমিনারে প্রধান অতিথির বক্তব্যে মির্জা ফখরুল এ কথা বলেন। ‘পদ্মা ব্যারাজ ও দ্বিতীয় পদ্মা সেতু বাস্তবায়ন জাতীয় কমিটি’ এ সেমিনারের আয়োজন করে।

দ্বিতীয় পদ্মা সেতু এবং পদ্মা ব্যারাজ এখন সময়ের দাবি বলে উল্লেখ করেন মির্জা ফখরুল। একই সঙ্গে তিনি সাতবার ফিজিবিলিটি স্টাডি (প্রস্তাবিত প্রকল্পের কার্যকারিতা এবং বাস্তবতার মূল্যায়ন) হলেও এই বিষয়ে একটি সিদ্ধান্তের জায়গায় আসতে না পারাকে দুঃখজনক বলে উল্লেখ করেন। তিনি বলেন, ‘এ জন্য রাজনৈতিক কমিটমেন্ট প্রয়োজন। এটি তখনই তৈরি হবে, যখন জনগণের মধ্য থেকে এ দাবি উঠে আসবে।’

বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া অনেক আগেই দ্বিতীয় পদ্মা সেতুর অঙ্গীকার করেছিলেন উল্লেখ করে বিএনপির মহাসচিব বলেন, দক্ষিণাঞ্চলের বহু অংশ ছেড়ে মানুষ চলে যাচ্ছে। বাসের উপযোগী আর থাকছে না। পরবর্তী সরকারগুলো শুধু নয়, জনগণেরও এ বিষয়ে অত্যন্ত সজাগ থাকা উচিত।

পরবর্তী সরকারগুলোকে এ বিষয়ে কাজ করতে হবে উল্লেখ করে মির্জা ফখরুল বলেন, ‘আমরা একটা ট্রানজিশন পিরিয়ডে আছি। আজ একটা সুযোগ তৈরি হয়েছে। অভূতপূর্ব ছাত্র গণ–অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে একটি জাতীয় ঐক্য তৈরি হয়েছিল। সেই ঐক্যকে সামনে নিয়ে আমরা সবাই যদি মূল বিষয়গুলোকে সামনে আনতে পারি, চিন্তার ঐক্য যদি থাকে, তাহলে নিঃসন্দেহে আমরা সফল হব।’

বিএনপির মহাসচিব বলেন, সবকিছুই নির্ভর করবে মানুষের ওপর। ঐক্যবদ্ধ থাকলে বাংলাদেশের মানুষ পারে। সেটি একাত্তর সালে প্রমাণিত হয়েছে। এমনকি চব্বিশেও তা প্রমাণিত হয়েছে। তিনি বলেন, ‘দেশের মানুষের পালস আমি বুঝি। দেশের মানুষ উন্নতি চায়, ওপরে উঠতে চায়, সত্যিকার অর্থে একটি গণতান্ত্রিক পরিবেশ চায়। সেই গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার মধ্য দিয়ে সব বিষয়ের সমাধানের পথ খুঁজে পাওয়া যাবে।’

আয়োজক কমিটির সভাপতি বিএনপির সাবেক সংসদ সদস্য আলী নেওয়াজ মাহমুদ খৈয়ামের সভাপতিত্বে সেমিনারে আরও বক্তব্য দেন সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) সম্মাননীয় ফেলো দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য, শিক্ষক ও গবেষক অধ্যাপক আইনুন নিশাত, পাওয়ার অ্যান্ড পার্টিসিপেশন রিসার্চ সেন্টারের (পিপিআরসি) নির্বাহী চেয়ারম্যান হোসেন জিল্লুর রহমান, বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টির সাধারণ সম্পাদক সাইফুল হক, গণসংহতি আন্দোলনের প্রধান সমন্বয়কারী জোনায়েদ সাকি প্রমুখ।

সম্পর্কিত নিবন্ধ

  • এলডিসি উত্তরণের পরবর্তী প্রস্তুতি নিতে উচ্চ পর্যায়ের কমিটি গঠন
  • সিডনিতে ড্র অনুষ্ঠানে বাংলাদেশের কেউ না থাকায় হতাশ প্রবাসীরা
  • ‘মুক্তির উৎসব’ করতে সহযোগিতা চেয়ে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে সাবেক সমন্বয়কের আবেদন
  • ‘আগামীর বাংলাদেশে মিডিয়াকে দালাল হিসেবে দেখতে চাই না’ 
  • এবার পরিবার নিয়ে ঘরে বসেই ‘উৎসব’
  • মাইলস্টোনে দগ্ধ ৩৩ জন এখনো ভর্তি, আইসিইউতে ৩
  • শেখ হাসিনার অডিওগুলো শুনলে বোঝা যায়, তাঁর এখনো প্রতিশোধ নেওয়ার ইচ্ছা আছে: আইন উপদেষ্টা
  • খুলনা প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ে ১৬০ দিন পর শ্রেণিকক্ষে শিক্ষার্থীরা, উৎসবের আমেজ
  • দ্বিতীয় প্রান্তিকে ব্র্যাক ব্যাংকের মুনাফা বেড়েছে
  • প্রয়োজন অনুসারে রাষ্ট্রকাঠামোর পরিবর্তনে সচেতনভাবে এগোচ্ছে বিএনপি: মির্জা ফখরুল