ডাকব্যবস্থাকে আধুনিক ও গতিশীল করতে দেশের ১৪ জেলায় মেইল প্রসেসিং ও লজিস্টিক সার্ভিস সেন্টার (এমপিসি) তৈরি করেছিল বিগত আওয়ামী লীগ সরকার। এতে প্রায় ৩৬৫ কোটি টাকা ব্যয় হলেও সেন্টারগুলো অনেকটা অব্যবহৃত অবস্থায় পড়ে আছে। চালুর তিন বছরের মধ্যে সেন্টারগুলো শতকোটি টাকা ব্যয়ে কেনা সরঞ্জামের ‘ভাগাড়ে’ পরিণত হয়েছে।
সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, উদ্যোগ নিয়েও সব সেবা চালু না করা এবং চাহিদা না বুঝে সরঞ্জাম কেনায় সরকারের টাকা গচ্চা যাচ্ছে। উদ্দেশ্য ছিল সরঞ্জাম কেনায় বাণিজ্য করা। তা দরকার কি না, তা যাচাই করা এবং ব্যবহার নিশ্চিত করার দিকে জোর ছিল না।
ডাক অধিদপ্তর ২০১৮ সালের জুলাই থেকে ২০২২ সালের জুন পর্যন্ত মেয়াদে ৩৬৫ কোটি ৪৯ লাখ টাকা ব্যয়ে এমপিসি প্রকল্প বাস্তবায়ন করে। এতে অবকাঠামো নির্মাণে ব৵য় হয়েছে ২৭ কোটি ৫০ লাখ টাকা। ডাক বিভাগের তথ্য অনুযায়ী, এমপিসির জন্য ২৮৯ কোটি টাকার সরঞ্জাম কেনা হয়। রাজধানীর তেজগাঁও, গোপালগঞ্জ, ময়মনসিংহ, খুলনা, চট্টগ্রাম, নোয়াখালী, রাজশাহী, পাবনা, রংপুর, বরিশাল, দিনাজপুর, হবিগঞ্জ, কুষ্টিয়া ও যশোরে এই সেন্টার তৈরি করা হয়।
জানা গেছে, মেইল প্রসেসিং সেন্টারের জন্য অন্তত ৩৩ ধরনের সরঞ্জাম কেনা হয়। তেজগাঁও সেন্টারের বরাদ্দ সরঞ্জামের কিছু এখনো বাক্সবন্দী হয়ে আছে, কিছু উন্মুক্ত অবস্থায় পড়ে আছে।ডাক বিভাগের এমপিসি সম্পর্কে কোনো তথ্য ওয়েবসাইটে পাওয়া যায়নি। তাদের কাছে ডিপিপি চাওয়া হলেও তা দেওয়া হয়নি। প্রকল্পটি কী উদ্দেশ্যে নেওয়া হয়েছিল, তা লিখিতভাবে জানতে চাওয়া হয়েছিল। এর সুস্পষ্ট জবাব পাওয়া যায়নি।
তবে এমপিসিতে কর্মরত একাধিক কর্মকর্তা জানিয়েছেন, নির্দিষ্ট কয়েকটি জেলার চিঠিপত্র-পার্সেল ডাক বিভাগের পরিবহনে করে এমপিসিতে এসে জমা হয়। সেখানে বাছাইপ্রক্রিয়া শেষে সংশ্লিষ্ট ডাক বিভাগের পোস্টম্যান ওই জেলার চিঠিপত্র ও মালামাল সেবাগ্রহীতার কাছে পৌঁছে দেন। আর অন্যান্য এলাকার চিঠিপত্র ও মালামাল চলে যায় পরবর্তী সেন্টারে। এই প্রক্রিয়া ডিজিটাল ব্যবস্থায় নেওয়ার জন্যই ৩৬৫ কোটি টাকার প্রকল্প নেওয়া হয়েছিল।
শতকোটি টাকার সরঞ্জাম অযত্নেরাজধানীর তেজগাঁওয়ে এমপিসি ভবনে গত ১২ মে দুপুরে গিয়ে দেখা যায়, ভবনের ভেতর সুনসান পরিবেশ। ভবনের নিচতলার এক পাশে ‘ফসল’ নামের একটি প্রতিষ্ঠানকে ভাড়া দেওয়া হয়েছে। মাঝখানে এমপিসির সরঞ্জাম অব্যবহৃত অবস্থায় পড়ে আছে। ডান দিকের এক পাশে নাখালপাড়া পোস্ট অফিসের কার্যক্রম পরিচালিত হচ্ছে। আর দোতলায় ‘বিলি’ নামের একটি প্রতিষ্ঠান আছে।
জানা গেছে, মেইল প্রসেসিং সেন্টারের জন্য অন্তত ৩৩ ধরনের সরঞ্জাম কেনা হয়। তেজগাঁও সেন্টারের বরাদ্দ সরঞ্জামের কিছু এখনো বাক্সবন্দী হয়ে আছে, কিছু উন্মুক্ত অবস্থায় পড়ে আছে। মেটাল ডিটেক্টর, আর্চওয়ে গেট, ট্রলি, এক্স-রে গুডসসহ বরাদ্দের সব সরঞ্জামই অযত্নে পড়ে আছে। তেজগাঁওয়ে প্রসেসিং সেন্টার হলেও এর কার্যক্রম কমলাপুরে হয় বলে জানিয়েছেন নাখালপাড়া পোস্ট অফিসের কর্মীরা।
তেজগাঁও এমপিসি সেন্টারের দায়িত্বে আছেন কমলাপুরে অবস্থিত সর্টিং অ্যান্ড এয়ার বিভাগের ডেপুটি পোস্টমাস্টার জেনারেল মোহাম্মদ ওয়াহিদ উজ জামান। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, বিকেলে সেন্টারটির কাজ চলে। যন্ত্রপাতি অব্যবহৃত থাকার বিষয়ে তিনি বলেন, না দেখে তিনি বলতে পারবেন না।
স্মার্ট পোস্টেজ সলিউশন সেবা চালু করতে একটি সফটওয়্যারের মাধ্যমে হার্ডওয়্যারগুলো সক্রিয় করতে হয়। কিন্তু তিন বছরেও সেই সফটওয়্যার বেশির ভাগ জায়গায় দেওয়া হয়নি। ফলে বেশির ভাগ জায়গায় সরঞ্জামগুলো তিন বছর ধরে পড়ে আছে।ডাক বিভাগ বলছে, কমলাপুরের সর্টিং সেন্টারটি তেজগাঁও সেন্টারে স্থানান্তর হওয়ার নির্দেশনা আছে। সেটা এখনো না হওয়ায় তেজগাঁও সেন্টারের কাজ পুরোপুরি শুরু হয়নি। তবে সেখানে কিছু কাজ চলছে। অবশ্য ঢাকার বাইরে বিভিন্ন জেলায় খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, সেখানেও সরঞ্জাম অব্যবহৃত পড়ে আছে।
মেইল প্রসেসিং সেন্টারের দাপ্তরিক কার্যক্রম শুরু হয় ২০২২ সালের ফেব্রুয়ারিতে। দিনাজপুর, ময়মনসিংহ, গোপালগঞ্জ ও চট্টগ্রামে প্রথম আলোর প্রতিবেদকেরা সরেজমিনে মেইল প্রসেসিং সেন্টার দেখেছেন।
ময়মনসিংহ সেন্টারেও কর্মচাঞ্চল্য দেখা যায়নি। সেখানকার সাব-রেকর্ড সুপারভাইজার মো.
হেলাল উদ্দিন বলেন, যেসব যন্ত্রপাতি সরবরাহ করা হয়েছে, তা উপযোগী ও ভালো। তবে ব্যবহারের জন্য যে পরিমাণ ডাক আসার কথা, তা আসে না।
দিনাজপুর এমপিসি সেন্টারে দিনে দুটি গাড়িতে চিঠিপত্র ও পার্সেল আসে। এই ভবনে ঢোকার ফটকে আর্চওয়ে গেট ও মেটাল ডিটেকটর থাকলেও তা বিকল। পাশে থাকা স্ক্যানার মেশিনটি বন্ধ। এই সেন্টারে থাকা সরঞ্জামের এক-তৃতীয়াংশেরই কোনো ব্যবহার নেই। কিছু সরঞ্জামের মোড়ক এখনো খোলা হয়নি। প্রায় সাড়ে তিন বছরেও চিলিং চেম্বার চালু করা হয়নি। পুরো ভবনে পাঁচটি শীতাতপনিয়ন্ত্রণ যন্ত্রের সব কটিই নষ্ট।
গোপালগঞ্জ সেন্টারের সহকারী সাব-রেকর্ড সুপারভাইজার মো. আবুল হাসেম বলেন, এই সেন্টারে অনেক মেশিন আছে, যেগুলো এখনো ব্যবহার করা হয়নি। শুধু পজ মেশিন ও বারকোড মেশিন ব্যবহার করা হয়। ফ্র্যাঙ্কিং মেশিনের ব্যবহার নেই। এ ছাড়া এসপিএস, নোট কাউন্টিং মেশিন, নোট বাইন্ডিং মেশিন ও কিউ ম্যানেজমেন্ট সিস্টেম নেই। চিলার চেম্বার থাকলেও তার ব্যবহার নেই।
চট্টগ্রাম মেইল প্রসেসিং সেন্টারের পরিদর্শক ও তত্ত্বাবধায়ক মোহাম্মদ আবদুল্লাহ বলেন, তাঁরা ফর্ক লিফট পাননি। বারকোড স্ক্যানার তেমন ব্যবহার হয় না। পার্সেল এলে মাঝেমধ্যে চিলার চেম্বার ব্যবহার করা হয়। ট্রলিগুলো ব্যবহার করা হয়। আর আর্চওয়ে গেট না থাকলেও চলত। তিনি বলেন, দক্ষ ও পর্যাপ্ত জনবলের অভাবে সব সরঞ্জাম শতভাগ ব্যবহার করা সম্ভব হয় না।
ঢাকার বাইরের এমপিসির কার্যক্রম ও সরঞ্জামগুলোর বর্তমান পরিস্থিতি নিয়ে কোনো সুস্পষ্ট জবাব দেয়নি ডাক বিভাগ।
সরঞ্জাম আছে, সফটওয়্যার নেইডাকটিকিট, সিল দেওয়া ও প্রথাগত পদ্ধতিতে ফি নির্ধারণ দ্রুততম সময়ে স্বয়ংক্রিয়ভাবে করতে স্মার্ট পোস্টেজ সলিউশন (এসপিএস) নামে এক প্যাকেজে কিছু সরঞ্জাম কিনেছিল ডাক বিভাগ। এই প্যাকেজে আছে কম্পিউটার, স্ক্যানার, বারকোড লেবেল প্রিন্টার ও ফ্র্যাঙ্কিং মেশিন ফর পার্সেল। এমপিসি প্রকল্পের আওতায় এই প্যাকেজ ৪২০ সেট কেনা হয় ১৩ কোটি টাকা ব্যয়ে। যদিও এসব সরঞ্জাম মেইল প্রসেসিং সেন্টারে ব্যবহারের জন্য কেনা হয়নি। কেনা হয়েছে কিছু ডাকঘরে ব্যবহারের জন্য।
স্মার্ট পোস্টেজ সলিউশন কেন এমপিসি প্রকল্পের আওতায় কেনা হলো এবং অন্যান্য বিষয়ে জানতে চাওয়া হয়েছিল ডাক বিভাগের মহাপরিচালক এস এম শাহাব উদ্দীনের কাছে। তিনি সহকারী প্রকল্প পরিচালক মো. শাহ আলম ভূঁইয়াকে জবাব দেওয়ার দায়িত্ব দেন। এই প্রকল্পের তিনজন পরিচালক থাকলেও শাহ আলমই শুরু থেকে প্রকল্পের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকায় ছিলেন এবং পিসিআর বা প্রকল্প সমাপ্তির প্রতিবেদন জমা দিয়েছেন।
লিখিত জবাবে শাহ আলম ভূঁইয়া বলেন, স্মার্ট পোস্টেজ সলিউশন মূলত ডাকঘরে পার্সেল ও ই-কমার্স ইস্যুর জন্য ব্যবহার হয়। এমপিসিতে সাধারণত স্মার্ট পোস্টেজ সলিউশন থাকার কথা নয়। এমপিসি প্রকল্পের ডিপিপিতে এটা কীভাবে যুক্ত হলো, এই প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, এমপিসিতে যদি বাল্ক মেইল ইস্যু হয়, তখন স্মার্ট পোস্টেজ সলিউশন ব্যবহার করা যেতে পারে।
স্মার্ট পোস্টেজ সলিউশন সেবা চালু করতে একটি সফটওয়্যারের মাধ্যমে হার্ডওয়্যারগুলো সক্রিয় করতে হয়। কিন্তু তিন বছরেও সেই সফটওয়্যার বেশির ভাগ জায়গায় দেওয়া হয়নি। ফলে বেশির ভাগ জায়গায় সরঞ্জামগুলো তিন বছর ধরে পড়ে আছে। ডাক বিভাগের একজন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে প্রথম আলোকে বলেন, পুরো প্রকল্প নিয়ে তদন্ত হলে কেন অপ্রয়োজনীয় সরঞ্জাম কেনা হয়েছিল, কে কে বাণিজ্য করেছে, তা বেরিয়ে আসবে।
উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: সরঞ জ ম ক ন ব যবহ র ন ই ব যবহ র কর সফটওয় য র এই স ন ট র সরঞ জ ম র র সরঞ জ ম র ব যবহ র প রকল প র র র জন য ব যবহ ত র এমপ স ত ন বছর এমপ স ত পর চ ল হয় ছ ল থ কল ও
এছাড়াও পড়ুন:
কামরাঙ্গীরচরে বাবার ছুরিকাঘাতে ছেলে খুন
রাজধানীর কামরাঙ্গীরচরে রাহাবুল ইসলাম (২৫) নামের এক হোটেল কর্মচারি খুন হয়েছেন। শনিবার রাত ১১টার দিকে এ ঘটনা ঘটে।
কামরাঙ্গীরচর থানার পুলিশ পরিদর্শক (তদন্ত) শেখ লুৎফর রহমান বলেন, কামরাঙ্গীরচর থানাধীন ঝাউচর এলাকায় হোটেল কর্মচারি রাহাবুল খুন হয়েছেন। পারিবারিক বিরোধের জেরে রাহাবুলকে তার বাবা জুয়েল রানা খুন করেছেন বলে প্রাথমিকভাবে জানা গেছে।
এ দিকে নিহত রাহাবুলের মামা হুমায়ুন বলেন, তার বোন শাহানাজ কাজের সূত্রে জর্ডানে থাকেন। তার ভাগনে রাহাবুল এবং বোনের স্বামী জুয়েল রানা কামরাঙ্গীরচরের যাউচর এলাকায় একটি হোটেলে কাজ করতেন। শনিবার রাতে পারিবারিক বিরোধের জেরে ছুরিকাঘাত করে রাহাবুলকে হত্যা করেন বোনের স্বামী।
পুলিশ জানায়, অভিযুক্ত জুয়েল রানাকে গ্রেপ্তারের চেষ্টা চলছে। কি কারণে ছেলেকে বাবা হত্যা করেছেন সেটিও খতিয়ে দেখছে পুলিশ। লাশ ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের মর্গে রাখা হয়েছে।