একসময় খাল-নদীর শহর হিসেবে খ্যাত বরিশাল আজ মারাত্মক জলাবদ্ধতার মুখে। শহরে জালের মতো ছড়িয়ে থাকা খালগুলো একসময় প্রাণশক্তি ছিল। ভারী বর্ষণেও দ্রুত সময়ে পানি সরে যেত। কোথাও জলাবদ্ধতা দেখা দিত না। অথচ এখন সামান্য বৃষ্টিতেই নগরের বিভিন্ন এলাকা পানিতে ডুবে যায়। অচল হয়ে পড়ে জনজীবন।

নগরবাসীর ভোগান্তি লাঘবে নগরের মৃত খালগুলো পুনরুদ্ধারের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। ইতিমধ্যে মৃত খালগুলো পুনরুদ্ধারে প্রকল্পের প্রস্তাব দিয়েছে বরিশাল সিটি করপোরেশন। ৭০১ দশমিক ৫৩ কোটি টাকার প্রস্তাবিত প্রকল্পের ৮০ শতাংশ অর্থাৎ ৫৬১ দশমিক ২৩ কোটি টাকার সরকারি অনুদান এবং বাকি ১৪০ দশমিক ৩০ কোটি টাকা ঋণ হিসেবে পুনরুদ্ধারের ব্যাপারে অর্থ মন্ত্রণালয়ের অর্থ বিভাগ অনুমোদন দিয়েছে।

গত সোমবার থেকে টানা তিন দিন বরিশালে ভারী বৃষ্টিপাত হয়েছে। গতকাল বৃহস্পতিবারও থেমে থেমে বৃষ্টি অব্যাহত থাকায় নগরের বিভিন্ন এলাকায় এখনো হাঁটুপানি। বহু এলাকার বাড়িঘরেও পানি ঢুকেছে। এতে চরম দুর্ভোগে পড়েছেন নাগরিকেরা।

অক্সফোর্ড মিশন রোডের বাসিন্দা ও বরিশাল সাধারণ নাগরিক সমাজের আহ্বায়ক কাজী মিজানুর রহমান বলেন, ১৯৭০ সালের ভয়াবহ ঘূর্ণিঝড় ও জলোচ্ছ্বাসের সময়ও তাঁদের ঘরে পানি ওঠেনি। অথচ এখন সামান্য বৃষ্টিতেই পুরো শহর ডুবে যায়। তিনি বলেন, একসময় বরিশালে ২৪টি মূল খাল ও অসংখ্য শাখা খাল ছিল। তিন হাজারেরও বেশি সরকারি-বেসরকারি দিঘি ও পুকুর ছিল। এখন প্রায় সেগুলো নেই। তাঁরা দীর্ঘদিন ধরে খালগুলো দখলমুক্ত করতে দাবি জানালেও কর্তৃপক্ষ উদাসীন। এভাবে চলতে থাকলে বরিশাল অচিরেই বসবাসের অযোগ্য শহরে পরিণত হবে।

নগরের বিভিন্ন এলাকা ঘুরে দেখা যায়, ২৪টি খালের মধ্যে এখন জেল খাল, সাগরদী, লাকুটিয়া, টিয়াখালী, মোহাম্মদপুর, আমানতগঞ্জ, জাগুয়ার ও হরিনাফুলিয়া খালের আংশিক অস্তিত্ব আছে। এসব খালও দখল ও দূষণে মৃতপ্রায়। বাকি খালগুলো বিলুপ্তির পথে। সেগুলোর মধ্যে আছে নাপিতখালী, ভাটার খাল, নবগ্রাম, চাঁদমারী, ভেদুরিয়া, কলাডেমা, সাপানিয়া, কাশিপুর, সোলনা, ভাড়ানী, পুডিয়ার, উত্তর নবগ্রাম সাগরদী, ঝোড়াখালি, তাজকাঠি, চৌপাশা এবং শোভারানী খাল প্রভৃতি।

খাল পুনরুদ্ধারে অর্থায়ন অনুমোদন

বরিশালের পরিবেশবাদী সংগঠন ও নাগরিকদের দীর্ঘদিনের দাবির পরিপ্রেক্ষিতে খাল পুনরুদ্ধার করে পানি প্রবাহ সচল করতে একটি প্রকল্পের প্রস্তাব দিয়েছে বরিশাল সিটি করপোরেশন। ‘বরিশাল সিটি করপোরেশনের বিভিন্ন খালের পাড় সংরক্ষণসহ পুনরুদ্ধার ও পুনঃখনন কাজ (প্রথম পর্ব)’ শীর্ষক প্রকল্পে অর্থ মন্ত্রণালয়ের অর্থ বিভাগ সম্মতি দিয়েছে। ৭০১ দশমিক ৫৩ কোটি টাকার প্রস্তাবিত প্রকল্পে ৫৬১ দশমিক ২৩ কোটি টাকা সরকারি অনুদান এবং বাকি ১৪০ দশমিক ৩০ কোটি টাকা ঋণ হিসেবে পুনরুদ্ধারযোগ্য হবে। অর্থ বিভাগের বাজেট-১১ শাখার বাজেট-২ অনুবিভাগের যুগ্ম সচিব মোছা.

রুখসানা রহমান স্বাক্ষরিত স্মারকে গত সোমবার এ অনুমোদন দেওয়া হয়। এতে সাতটি শর্ত আরোপ করে অর্থায়নের অনুমোদন দেওয়া হয়।

জানতে চাইলে বরিশাল সিটি করপোরেশনের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা মো. রেজাউল বারী প্রথম আলোকে বলেন, সোমবার বিকেলে তাঁরা লিখিত অনুমোদনপত্র পেয়েছেন। প্রকল্পটি এখন একনেকে যাবে। প্রকল্পটি বাস্তবায়িত হলে নগরের ২৯টি খালের উন্নয়ন, পুনঃখনন ও আধুনিকায়ন করা হবে। তিনি বলেন, ‘নগরবাসীর দীর্ঘদিনের প্রত্যাশা পূরণে এটি বড় অগ্রগতি। আশা করি প্রকল্পটি একনেকে অনুমোদনের পর দ্রুত সব খাল পুনরুদ্ধার ও খনন করার উদ্যোগ বাস্তবায়িত হবে।’

সিটি করপোরেশন সূত্র জানায়, নগরের ৪৬টি খালের মধ্যে ২০টিতে খনন এবং ৯টিতে খনন, পাড় বাঁধাই, ওয়াকওয়ে নির্মাণ ও সৌন্দর্যবর্ধনের প্রস্তাব করা হয়েছে। নাগরিকদের বহু প্রত্যাশার এ প্রকল্পে নতুন আশার আলো দেখছেন নগর পরিকল্পনাবিদ ও পরিবেশবাদীরা।

বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলনের (বাপা) বরিশাল বিভাগের সমন্বয়কারী রফিকুল আলম বলেন, নগরের খাল ও জলাশয় ভরাট করে গড়ে ওঠা দখলনির্ভর উন্নয়নই আজকের জলাবদ্ধতার মূল কারণ। সামনে আরও ভয়াবহ চিত্র দেখা যাবে। তিনি বলেন, খাল খনন প্রকল্প বাস্তবায়নের আগে অবশ্যই প্রতিটি খালের সীমানা নির্ধারণ করে দখলমুক্ত করতে হবে। উৎস ও পতনমুখে যেসব স্থাপনা পানিপ্রবাহে বাধা তৈরি করছে, সেগুলো অপসারণ না করলে খাল খননের সুফল মিলবে না। তাই খাল খননের আগে নগরের বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষের মতামত নিয়ে প্রকল্প বাস্তবায়নে হাত দেওয়া উচিত।

উৎস: Prothomalo

কীওয়ার্ড: নগর র ব ভ ন ন বর শ ল স ট র প রস ত ব প রকল প দশম ক সরক র

এছাড়াও পড়ুন:

ভাসমান পথশিশুদের নিয়ে এলইইডিও-র অন্যরকম আয়োজন

কমলাপুর রেলস্টেশনের ভাঙাচোরা প্ল্যাটফর্মে বোতল কুড়িয়ে কিংবা হাত পেতে খাবার জুটত হাসান আলী মুসাফিরের। বয়স তখন পাঁচ কিংবা ছয়। রাতে স্টেশনের পাশে ঘুমিয়ে থাকলে মাঝে মাঝেই তাড়িয়ে দিত পুলিশ। 

এক রাতে স্টেশনের ইঞ্জিনের ছাদে উঠে পড়ে সে-তার ছোট্ট বন্ধুও সঙ্গে ছিল। বন্ধুকে টানতে গিয়ে পা পিছলে পড়ে যায় সে। গুরুতর আহত অবস্থায় স্থানীয় কয়েকজন স্বেচ্ছাসেবী তাকে উদ্ধার করে হাসপাতালে ভর্তি করে। চিকিৎসার সময় খোঁজ নেওয়া হয় তার পরিবারের, কিন্তু কোনো সন্ধান মেলে না।

একপর্যায়ে দায়িত্ব নেয় অলাভজনক সংগঠন লোকাল এডুকেশন অ্যান্ড ইকোনমিক ডেভেলপমেন্ট অর্গানাইজেশন (এলইইডিও)। তখন থেকেই তাদের আশ্রয়ে বড় হয় হাসান। এখন নবম শ্রেণির ছাত্র সে। শিখেছে গ্রাফিক ডিজাইনসহ নানা হাতের কাজ। স্বপ্ন-একদিন পুলিশ হয়ে অসহায়দের পাশে দাঁড়াবে।

দুই দশকে ৩০-৩৫ হাজার শিশুর পুনর্বাসন
হাসানের মতো হাজারো শিশুর জীবনের বাঁক ঘুরেছে এলইইডিও-র হাত ধরে। সংগঠনটির পক্ষ থেকে জানানো হয়, প্রতিষ্ঠার পর থেকে প্রায় আড়াই দশকে ৩০ থেকে ৩৫ হাজার সুবিধাবঞ্চিত ও পরিবারহারা শিশুকে উদ্ধার করে পুনর্বাসনের চেষ্টা করেছে তারা। কেউ কেউ ফিরে গেছে পরিবারের কাছে, আবার কেউ থেকে গেছে সংগঠনের আশ্রয়ে-গড়ে তুলেছে নিজের ভবিষ্যৎ।

গতকাল বৃহস্পতিবার (৩০ অক্টোবর) এমন ৩০০ শিশু-কিশোরকে নিয়ে আয়োজন করা হয় দিনব্যাপী আনন্দভ্রমণের। স্থান ছিল ঢাকার ধামরাইয়ের মোহাম্মদী গার্ডেন। সকাল থেকে চলেছে চকলেট দৌড়, পিলো পাসিং, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান-সব মিলিয়ে উৎসবমুখর এক দিন।

পথ থেকে আশ্রয়ে
এলইইডিওর সংগঠকরা জানান, ২০০০ সালে প্রতিষ্ঠার সময় থেকেই তাদের লক্ষ্য ছিল পাচার, নিখোঁজ ও ভাসমান শিশুদের সুরক্ষা ও উন্নয়ন। কর্মীরা প্রতিনিয়ত ঘুরে বেড়ান ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন জায়গায়। যেসব শিশুর পরিবারের সন্ধান মেলে না, তাদের উদ্ধার করে থানায় সাধারণ ডায়েরি করে ফিরিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করা হয়। যদি পরিবারের হদিস না মেলে, প্রথমে নেওয়া হয় ‘শেল্টার হোমে’, পরে ‘পিস হোমে’।

ঢাকার কমলাপুর ও কদমতলীতে রয়েছে দুটি শেল্টার হোম, আর ওয়াশপুরে একটি পিস হোম। শেল্টার হোমে প্রায় ২৫ জন ও পিস হোমে প্রায় শতাধিক শিশুর থাকার ব্যবস্থা রযেছে। শেল্টার হোমে থাকা শিশুদের পরিবারের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা চলতে থাকে, ব্যর্থ হলে পাঠানো হয় সরকারি ছোট মনি নিবাসেও। পিস হোমে থাকা শিশুদের স্কুলে ভর্তি করানো হয়, শেখানো হয় বিভিন্ন কারিগরি কাজ।

এছাড়া ঢাকার কদমতলী, সদরঘাট, এয়ারপোর্ট, মিরপুর, কমলাপুর ও তেজগাঁওয়ে ‘স্কুল আন্ডার দ্য স্কাই’ নামে ছয়টি মুক্ত বিদ্যালয় পরিচালনা করছে সংগঠনটি। খোলা আকাশের নিচে বসে পথশিশুরা সেখানে শেখে অক্ষর আর জীবনের নতুন দিশা।

আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতায় পথশিশুরা
‘এলইইডিও’র উদ্যোগে এই শিশুরাই অংশ নিয়েছে আন্তর্জাতিক টুর্নামেন্টেও। ২০২২ সালে কাতারে ফুটবল বিশ্বকাপে, আর ২০২৩ সালে ভারতে পথশিশুদের ক্রিকেট বিশ্বকাপে। সেমিফাইনাল পর্যন্ত খেলার গৌরবও অর্জন করেছে তারা।

বিশেষ শিশুর গল্প: মালেকা আক্তার
কুড়িগ্রামের রাজারহাট থেকে ট্রেনে উঠে ঢাকায় চলে এসেছিল বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন শিশু মালেকা আক্তার। স্মৃতিশক্তি দুর্বল, জন্মগতভাবে এপিলেপসিতে আক্রান্ত। তাকে উদ্ধার করে ‘এলইইডিও’।

এখন সে সংগঠনের পিস হোমে থাকে, স্কুলে যায়। শেখানো হয়েছে সেলাই ও ক্রাফটের কাজ। একসময় হাঁটতেও কষ্ট হতো তার, এখন নিয়মিত চিকিৎসায় অনেকটা সুস্থ। হাসতে হাসতে বলল, “এখানে আমি নিরাপদ, নিজের মতো করে বাঁচতে পারি।”

যে স্কুলে পড়েছেন, এখন সেই স্কুলেই শিক্ষক
মো. নিজাম হোসেনের গল্প যেন এক জীবন্ত অনুপ্রেরণা। রায়েরবাজারের ছেলেটি বাবার দ্বিতীয় বিয়ের পর ঘরহারা হয়। একসময় ভাসমান জীবনে জড়িয়ে পড়ে। ‘এলইইডিও’র কর্মীরা খুঁজে পেয়ে তাকে ভর্তি করান স্কুলে। এরপর পঞ্চম শ্রেণি থেকে উচ্চমাধ্যমিক পর্যন্ত কৃতিত্বের সঙ্গে উত্তীর্ণ হয়।

বর্তমানে একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে সমাজকর্ম বিভাগে পড়ছেন নিজাম। ২০১৯ সালে ইংল্যান্ডের লর্ডস স্টেডিয়ামে পথশিশুদের ক্রিকেট বিশ্বকাপে খেলেছেন। এখন ‘এলইইডিও’র স্ট্রিট স্কুলে শিক্ষকতা করছেন।

নিজামের ভাষায়, “আমি যে স্কুলে পড়েছি, আজ সেই স্কুলেরই শিক্ষক। এখানে ভাসমান শিশুদের প্রাথমিক শিক্ষা দিয়ে সরকারি স্কুলে ভর্তি করাই।”

তার আঁকা ছবি সংগ্রহ করেছেন ফুটবলার হামজা চৌধুরী, ছাপা হয়েছে মহিলা ও শিশু বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের ক্যালেন্ডারেও। ভবিষ্যতে জাতিসংঘে কাজ করার স্বপ্ন দেখেন তিনি।

দিনভর হাসি, আনন্দ
বিকেলের দিকে মঞ্চে পুরস্কার বিতরণ। মাইকে নাম ঘোষণা হতেই শিশুদের উল্লাস-পিলো পাসিংয়ে কমলাপুরের বিজয়, চকলেট দৌড়ে হাবিবা, পিস হোম থেকে শামীম। মাঠ জুড়ে হাততালি আর হাসি।

প্রতি বছরই এমন আয়োজন করে ‘এলইইডিও’। অংশ নেয় ‘স্কুল আন্ডার দ্য স্কাই’-এর শিক্ষার্থী, শেল্টার ও পিস হোমের শিশুরা।

এদিন মঞ্চে উপস্থিত ছিলেন সংগঠনের প্রতিষ্ঠাতা ও নির্বাহী পরিচালক ফরহাদ হোসেন, বোর্ড সদস্য তুষার আহমেদ ইমরান, এবং ফ্রেন্ডস অব স্ট্রিট চিলড্রেনের চেয়ারম্যান মাইক শেরিফ।

ফরহাদ হোসেন বলেন, “আড়াই দশক ধরে আমরা সুবিধাবঞ্চিত শিশুদের পাশে আছি। এবার ৩০০ শিশুকে নিয়ে এসেছি। রাষ্ট্র যদি আমাদের সঙ্গে এগিয়ে আসে, এই শিশুরাই ভবিষ্যতে রাষ্ট্রের সম্পদ হয়ে উঠবে।”

শেষে সাংস্কৃতিক পর্বে শিশুরা গেয়েছে দেশাত্মবোধক ও জনপ্রিয় গান। অতিথি মাইক শেরিফ গাইলেন ‘আমার হাড় কালা করলাম রে’ শিশুদের করতালিতে মুখর হয়ে ওঠে পুরো মাঠ। বিকেলের রোদে সবার যৌথ ছবি তোলার মধ্য দিয়ে শেষ হয় উৎসবের দিনটি- ভাসমান শিশুরা ফিরল মুখভরা হাসি নিয়ে, নতুন স্বপ্ন নিয়ে।

ঢাকা/এস

সম্পর্কিত নিবন্ধ

  • একসময় ছিলেন রিয়াল মাদ্রিদের ভবিষ্যৎ তারকা, এখন ক্লাব খুঁজে বেড়াচ্ছেন
  • ভাসমান পথশিশুদের নিয়ে এলইইডিও-র অন্যরকম আয়োজন