ইতিহাসের আয়নায় বদরুদ্দীন উমর ও বামপন্থা
Published: 27th, July 2025 GMT
বাংলাদেশের বাম রাজনীতির ইতিহাস নিয়ে আলোচনা করতে গেলে যাঁর নাম অবধারিতভাবে চলে আসে, তিনি বদরুদ্দীন উমর। একাধারে শিক্ষক, লেখক, চিন্তক ও রাজনৈতিক কর্মী—তিনি বামপন্থী ধারার এক ব্যতিক্রমী ও গভীরতম প্রতিনিধিত্বকারী ব্যক্তিত্ব। তাঁর জীবন ও রাজনৈতিক চিন্তার অনুপম পাঠ হলো মহিউদ্দিন আহমদের লেখা বামপন্থার সুরতহাল: বদরুদ্দীন উমরের ইতিহাস পরিক্রমা।
প্রথমা প্রকাশন থেকে প্রকাশিত ১৯২ পৃষ্ঠার এই বই এক দীর্ঘ সাক্ষাৎকারের ওপর ভিত্তি করে রচিত হলেও এটি নিছক কথোপকথন নয়। বরং এখানে মিলেছে আত্মজৈবনিক প্রসঙ্গ, রাজনৈতিক ইতিহাস, তাত্ত্বিক বিশ্লেষণ এবং বাংলাদেশের বাম রাজনীতির বহু অজানা অধ্যায়ের প্রাণবন্ত বিবরণ। বইটি যেমন ব্যক্তি বদরুদ্দীন উমরের ভাবনার ভেতর প্রবেশের দরজা খুলে দেয়, তেমনি পাঠককে নিয়ে যায় ইতিহাসের উত্থান-পতনের অভ্যন্তরেও।
‘অর্গানিক ইন্টেলেকচুয়াল’ হয়ে ওঠার পথেবদরুদ্দীন উমরের চিন্তাজগৎ বোঝার একটি গুরুত্বপূর্ণ ধারণা হলো ‘অর্গানিক ইন্টেলেকচুয়াল’, যার উৎপত্তি ইউরোপীয় মার্ক্সবাদী তাত্ত্বিকদের ভাবনায়। এই ধারণায় এমন এক বুদ্ধিজীবীর কথা বলা হয়, যিনি কেবল তত্ত্ব নির্মাণ করেন না, বরং বাস্তবেও সেই তত্ত্ব প্রয়োগে সক্রিয় থাকেন। বদরুদ্দীন উমর এ ধারণার বাস্তব প্রতিফলন। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকতার পেশা ছেড়ে তিনি যুক্ত হন পূর্ব পাকিস্তানের কমিউনিস্ট পার্টিতে (মার্ক্সবাদী-লেনিনবাদী)। যদিও পরবর্তীকালে মতপার্থক্যের কারণে দলীয় রাজনীতিতে তাঁর অবস্থান কিছুটা বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে, তবু বাম রাজনীতির সঙ্গে তাঁর সংলগ্নতা অটুট থাকে। গণতান্ত্রিক অধিকারের প্রশ্নে আন্দোলন, সভা-সেমিনার, লেখালিখি—সবখানেই তিনি থেকেছেন সক্রিয়।
রাজনীতি, দর্শন ও ব্যক্তিবইটির একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক হলো, রাজনৈতিক ইতিহাসের সঙ্গে বদরুদ্দীন উমরের ব্যক্তিজীবনের সংযোগটি এতে যত্নের সঙ্গে তুলে ধরা হয়েছে। পশ্চিমবঙ্গে কাটানো শৈশব ও কৈশোর, পরিবারের পূর্ব পাকিস্তানে চলে আসা, ছাত্রজীবনের বিচিত্র অভিজ্ঞতা, শিক্ষকতা, পরবর্তীকালে লেখালেখিতে সম্পূর্ণ মনোনিবেশ—সবই এসেছে তাঁর নিজস্ব কণ্ঠে। যদিও এটি কোনো পূর্ণাঙ্গ আত্মজীবনী নয়, তবু তাঁর চিন্তার পেছনের পারিপার্শ্বিক বাস্তবতা এখানে গভীরভাবে প্রতিফলিত।
বদরুদ্দীন উমর অকপটে জানিয়েছেন, ছাত্ররাজনীতিতে সরাসরি যুক্ত না থেকেও কীভাবে তিনি বাম রাজনীতির প্রতি আকৃষ্ট হন। কমিউনিস্ট পার্টি গঠনের চেষ্টাও করেন। তবে পরবর্তীকালে সক্রিয় রাজনৈতিক সংগঠকের চেয়ে তাঁর ভূমিকা বেশি হয়ে ওঠে চিন্তক ও লেখকের। এটি এক অর্থে তাঁর রাজনৈতিকতা ও আত্মজিজ্ঞাসার অনুপম দলিল।
বামপন্থার সুরতহালবইয়ের মূল অংশজুড়ে এসেছে বাম রাজনীতির নানা বাঁকবদলের আলোচনা। সেখানে অবধারিতভাবে এসেছে আওয়ামী লীগের জন্ম, শেখ মুজিবের উত্থান, ভাসানীর রাজনৈতিক অবস্থান, ন্যাপ গঠন, পূর্ব-পশ্চিম পাকিস্তানের মধ্যে বৈষম্য, ঊনসত্তরের গণ–অভ্যুত্থান, সত্তরের নির্বাচন, একাত্তর–পরবর্তী সময়, জাসদের উত্থান, সর্বহারা পার্টির রাজনীতি, ১৫ আগস্টের হত্যাকাণ্ড, এমনকি বর্তমান রাজনৈতিক বাস্তবতাও।
এ বই কেবল ইতিহাস নয়, দৃষ্টিভঙ্গিরও দলিল। বদরুদ্দীন উমরের বিশ্লেষণ তাঁর নিজস্ব রাজনৈতিক অভিজ্ঞতা ও দায়বদ্ধতা থেকে উৎসারিত। তিনি কেবল সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের তাত্ত্বিকতা নয়; বরং জীবনের বাস্তবতায় তার প্রয়োগযোগ্যতা নিয়েও প্রশ্ন তুলেছেন। ফলে বইটি হয়ে উঠেছে তত্ত্ব ও বাস্তবতার দ্বন্দ্ব-সন্ধির এক মনস্তাত্ত্বিক দলিলও।
বইয়ের একটি উল্লেখযোগ্য অধ্যায়জুড়ে রয়েছে তাঁর পুরস্কার প্রত্যাখ্যানের গল্প। ১৯৭৩ সালে বাংলা একাডেমি সাহিত্য পুরস্কার গ্রহণ না করে তিনি বলেছিলেন, ‘আমি নিজের তাগিদে, নিজের আনন্দে বই লিখি। এর জন্য কেউ আমাকে পুরস্কার দেবে, এটা আমি গ্রহণ করতে পারি না। এটা একধরনের ইগো বলতে পারেন।’ নোবেল পুরস্কার সম্পর্কেও তিনি সন্দেহ প্রকাশ করেছেন। তাঁর মতে, নোবেল অনেক সময় সাম্রাজ্যবাদের কূটকৌশলের অংশ হয়ে ওঠে। বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে এমন স্পষ্ট ও আত্মবিশ্বাসী অবস্থান নিঃসন্দেহে ব্যতিক্রম।
লেখক ও গবেষক মহিউদ্দিন আহমদ এখানে কেবল প্রশ্নকারী নন; তিনি একধরনের শ্রুতিলেখক, যিনি বক্তার কণ্ঠস্বর ও বয়ানের স্বচ্ছতা বজায় রেখে তাঁর অন্তর্গত চিন্তার বিন্যাসে এক ধ্যানস্থ দক্ষতা দেখিয়েছেন। তাঁর ভাষা সহজ, নির্ভার। রাজনৈতিক ইতিহাসের মতো কঠিন বিষয়কেও তিনি উপস্থাপন করেছেন কথোপকথনের প্রাণবন্ত ধারায়।
ইতিহাসের আয়নায় একটি চিন্তার পরিক্রমাএ গ্রন্থ বাংলাদেশের বাম রাজনীতির চূড়ান্ত বা সামগ্রিক সুরতহাল নয়, বরং একজন তাত্ত্বিক ও রাজনৈতিক কর্মীর আত্মপ্রবণ যাত্রার দলিল। ষাট-সত্তরের দশকের প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশের বাম রাজনীতির ইতিহাস ও অন্তর্দ্বন্দ্ব জানতে আগ্রহী পাঠকের জন্য এটি অবশ্যপাঠ্য। তবে এই পাঠ গ্রহণের জন্য প্রয়োজন পাঠকের বিশ্লেষণী মনোভাব। ‘বামপন্থার সুরতহাল’ শুধু ব্যক্তির আত্মকথা নয়, এটি বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসের এক মূল্যবান অনুরণন।
.উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: ল দ শ র ব ম র জন ত র বদর দ দ ন উমর র র র জন ত প রস ক র ব স তবত ব মপন থ স রতহ ল পরবর ত
এছাড়াও পড়ুন:
দেশে বহুত্ববাদী রাষ্ট্রের ধারণা দিয়েছিলেন এম এন লারমা
মানবেন্দ্র নারায়ণ (এম এন) লারমাই দেশে প্রথম আত্মপরিচয়ের রাজনীতিকে বৈজ্ঞানিকভাবে চিহ্নিত করেছিলেন। তিনি প্রথম দেশে কাঠামোগতভাবে আত্মপরিচয়ের রাজনীতিকে স্পষ্ট করেন। একটি বহুত্ববাদী রাষ্ট্রের ধারণা দিয়েছিলেন তিনি।
পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির (জেএসএস) নেতা ও সাবেক সংসদ সদস্য এম এন লারমার ৮৬তম জন্মবার্ষিকী উপলক্ষে আজ সোমবার রাজধানীর বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রে আয়োজিত এক আলোচনা সভায় বক্তারা এ কথাগুলো বলেন।
‘বিপ্লবী মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমার ৮৬ম জন্মবার্ষিকী উদ্যাপন কমিটি’ এ আলোচনা সভার আয়োজন করে। পরে এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে এসব কথা জানানো হয়।
আলোচনা সভায় লেখক ও গবেষক পাভেল পার্থ বলেন, ১৯৫৫-৬৫ সালের মধ্যে তৈরি হওয়া ‘বাইনারি বিভাজন’ পরবর্তীকালে প্রতিষ্ঠা করেছে বাংলাদেশে সরকার। ‘বাইনারি’ মনস্তত্ত্বকে এখনো এই দেশে টিকিয়ে রাখা হয়েছে। এম এন লারমা ‘বাঙালি হেজিমনি’র বিরুদ্ধে আত্মপরিচয়ের বয়ান বাঁচিয়ে রাখতে তৎকালে জোরালো প্রতিবাদ করেছিলেন।
জেএসএসের কেন্দ্রীয় সদস্য দীপায়ন খীসা বলেন, কাপ্তাই বাঁধ না করার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করতে গিয়েই ছাত্র এম এন লারমার প্রতিবাদী জীবন শুরু হয়। চব্বিশের গণ–অভ্যুত্থানের পর যে বৈষম্যহীন, অন্তর্ভুক্তিমূলক বাংলাদেশের কথা বলা হচ্ছে, এম এন লারমা ১৯৭২ সালে বাংলাদেশের সংবিধান প্রণয়নকালেই এসব বিষয় নিয়ে জোরালো বক্তব্য দিয়েছিলেন।
দীপায়ন খীসা বলেন, ‘সংবিধান সংস্কারের বিষয়ে সংবিধান সংস্কার কমিশন বা জাতীয় ঐকমত্য কমিশন কখনো ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর মানুষদের সঙ্গে সংলাপ করেনি। আমরাও এই দেশের অংশ। তাহলে ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর মানুষদের কেন কোনো সংলাপে অংশগ্রহণ করার জন্য আহ্বান জানানো হলো না?’ তিনি বলেন, চব্বিশের গণ–অভ্যুত্থানে ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর মানুষদেরও অংশীদারত্ব আছে। কিন্তু অভ্যুত্থান–পরবর্তী সময়ে তাদেরই ভুলে গেল এই সরকার।
সভাপতির বক্তব্যে পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি বাস্তবায়ন আন্দোলনের যুগ্ম সমন্বয়কারী জাকির হোসেন বলেন, ‘বাঙালি হয়ে যাও’ কথাটার পেছনে বাঙালি মুসলিমদের জাত্যভিমানের ব্যাপারটি রয়েছে। এম এন লারমা বাংলাদেশের মধ্যে থেকে নিজেদের অধিকার নিয়ে বেঁচে থাকার জন্য আন্দোলন শুরু করেছিলেন। সেই আন্দোলনের প্রেক্ষিতে পরবর্তীকালে ‘পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি’ নামে একটি চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছে।
পার্বত্য চট্টগ্রাম পাহাড়ি ছাত্র পরিষদ (পিসিপি) ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শাখার সাধারণ সম্পাদক শান্তিময় চাকমার সঞ্চালনায় আলোচনা সভায় অন্যদের মধ্যে বক্তব্য দেন বাংলাদেশ আদিবাসী ফোরামের অর্থ সম্পাদক মেইনথিন প্রমীলা, সাংবাদিক এহসান মাহমুদ, বাংলাদেশ মারমা স্টুডেন্টস কাউন্সিলের কেন্দ্রীয় কমিটির সাধারণ সম্পাদক অং শোয়ে সিং মারমা।
অনুষ্ঠানটি শুরু হয় এম এন লারমাকে সম্মান জানিয়ে কবিতা পাঠের মাধ্যমে। কবিতা পাঠ করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী রেই চাকমা ও লাল নিকিম বম। কবিতা আবৃত্তির পর এম এন লারমার জীবনবৃত্তান্ত পাঠ করেন হিল উইমেন্স ফেডারেশন ঢাকা মহানগর কমিটির সাধারণ সম্পাদক রিয়া চাকমা।
অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন বাংলাদেশ আদিবাসী ফোরামের তথ্য প্রচার ও প্রকাশনাবিষয়ক সম্পাদক হিরণ মিত্র চাকমা, জেএসএসের কেন্দ্রীয় স্টাফ সদস্য অনন্ত বিকাশ ধামাই, হিল উইমেন্স ফেডারেশনের কেন্দ্রীয় সভাপতি শান্তিদেবী তঞ্চঙ্গ্যা, পিসিপি ঢাকা মহানগর শাখার সভাপতি জগদীশ চাকমা, বাংলাদেশ আদিবাসী ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের সভাপতি অনন্ত তঞ্চঙ্গ্যা।