জনপ্রিয় মডেল ও অভিনেত্রী জারা জেরিনের ফ্ল্যাটে আচমকা লাঞ্চের দাওয়াত পেলে আমার সকালটা রহস্যে ভরে উঠল। কথা প্রসঙ্গে যখন জানলাম, লাঞ্চের গেস্ট শুধু আমি একা, দ্বিতীয় কোনো অভ্যাগত নেই, তখন আমার সকালটা শুধু রহস্যেই ভরে উঠল না, রোমাঞ্চেও ভরে উঠল। হঠাৎ কী মতলবে মুখোমুখি চেয়ারে বসিয়ে জারা আমাকে ভাত বেড়ে খাওয়াতে চায়, বুঝে উঠতে পারলাম না।
গত চার বছরে দুইটি বিয়ে করেছে জারা এবং শেষ পর্যন্ত কারো সাথে তার সংসার টেকেনি। একজন আলোচিত অভিনেত্রীর বারবার বিয়ে ভেঙে যাওয়া, আমার মতো যে কোনো বিনোদন সাংবাদিকের জন্যই এটা লুফে নেওয়ার মতো খবর। লুফে নিয়েওছি প্রত্যেকবার। যে ক’বার বিয়ে ভাঙার সংবাদ পেয়েছি প্রতিবারই জারাকে নিয়ে আমার পোর্টালে নিউজ করেছি। তারপরও, পেশাগত দায়িত্বের বাইরে দাঁড়িয়ে, যেহেতু জারার সাথে আমার ব্যক্তিগত পর্যায়ে সম্পর্ক রয়েছে, তার পুনঃপুনঃ ডিভোর্সের ঘটনায় আমি ব্যথিত হয়েছি। আমিসহ আমার সহ-পেশার সাংবাদিকরা যখনই সুযোগ পেয়েছে, জারাকে জিজ্ঞেস করেছে ডিভোর্সের কারণ। কিন্তু জারা মুখ খোলেনি। আমরা কেউই ডিভোর্সের আসল কারণ উদঘাটন করতে পারিনি। যখনই সে প্রশ্নের মুখোমুখি হয়েছে, মুখস্থ ধরনের উত্তর দিয়ে পাশ কাটিয়ে গেছে- বনিবনার অভাব। বনিবনার অভাবের কারণেই ডিভোর্স। কিন্তু স্রেফ বনিবনার অভাবে চার বছরে একজন সুন্দরী অভিনেত্রীর দুটি বিয়ে ভেঙে যাবে আমার বিশ্বাস হয়নি। যদিও দিন যত যাচ্ছে, শোবিজ তারকাদের জীবনে ভাত খেয়ে কুলি ফেলার মতো সাধারণ ঘটনা হয়ে উঠেছে ডিভোর্স। তারপরও জারার ডিভোর্সের ঘটনায় আমার সাংবাদিক মনে বারংবার কু ডেকেছে। নিশ্চয় এই ডিভোর্সের পেছনে আছে গোপন গভীর জটিল কোনো রহস্য। কি সেই রহস্য, যদিও তা জানি না। যদি সেই রহস্যের তলদেশ আমি স্পর্শ করতে পারি আর পাবলিশ করতে পারি আমার পোর্টালে, তবে বিনোদন সাংবাদিকতার লাইনে আমার অগ্রযাত্রা রুখবার সাধ্য কারো নেই।
অফিস থেকে জারার ফ্ল্যাটের দিকে যাচ্ছিলাম আর এসবই ভাবছিলাম এই মধ্য দুপুরে। উত্তেজনা চাপা দিয়ে সিএনজি থেকে নেমে জারার ফ্ল্যাটের নিচে যখন দাঁড়ালাম, ঘড়িতে দুপুর আড়াইটা। ফ্ল্যাটের সামনে একটি জারুল গাছ। জারুলের ডালে দুটি বুলবুলি ভালোবাসা আদান-প্রদান করছে। বুলবুলিদের দেখে আমার মনটা দুষ্টুমিতে ভরে উঠল। পাখি দুটোকে কল্পনা করলাম আমি আর জারা। আমরা জারুলের ডালে দুজন দুজনার হাত ধরে বসে আছি। ঠোঁটের কোনে ফুটে ওঠা কামগন্ধী হাসিটা ঝুলিয়ে রেখে আমি মোবাইল বের করলাম। জারার নাম্বারটা খুঁজতে খুঁজতে আমার ছয় বছর আগের এক সন্ধ্যার কথা মনে পড়ে গেল। যে সন্ধ্যার একটি ঘটনা অথবা দুর্ঘটনা আমাকে জারার কাছাকাছি নিয়ে এসেছিল।
আপন বলয়ে বিনোদন সাংবাদিক হিসেবে তখন মাত্রই আমার নামডাক ফাটতে শুরু করেছে। বিয়ে করেছি সদ্য। অফিসের স্পন্সরে হানিমুনে এসেছি কক্সবাজার। উঠেছি ‘সমুদ্র বিলাস’ হোটেলের ৪৭০ নম্বর রুমে। নতুন কাপলদের জন্য এই রুমটা দারুণ! রুমের দক্ষিণমুখি বারান্দায় দাঁড়ালে সমুদ্র তো দেখা যায়ই, সমুদ্রের গর্জনও শোনা যায় স্পষ্ট। শায়লা খুব পছন্দ করল রুমটা। বারান্দায় গিয়ে কয়েকবার লাফিয়ে উঠে হাততালিও দিলো। আপনারা হয়তো জানেন না, শায়লার ছবি ওঠার বাতিক ভয়াবহ। যেখানে যায় ছবি তুলে মোবাইল ভরে ফেলে। আমি সঙ্গে থাকলে ছবিগুলো আমাকেই তুলে দিতে হয় অবধারিতভাবে। হানিমুনে এসেও তার ব্যত্যয় হলো না। সমুদ্র সৈকতে তো বটেই; রুমে, বারান্দায়, এমনকি করিডোরেও তার নানা পোজের ছবি তোলা চাই। এইসব ছবি তোলাতুলির ভেতর শায়লার ফ্রেমের ভেতর কখন যে আমার পেশাগত জীবনের খুব মূল্যবান এক দৃশ্য ঢুকে পড়ল, টেরও পেলাম না। টের পেলাম মাসআটেক পর, যখন গর্ভে সন্তান নিয়ে শায়লা গ্রামে ওর মায়ের কাছে চলে গেল। ঢাকার বাসায় আমি একা। অফিস থেকে ফিরে ফাঁকা বাসায় কী করব বুঝে উঠতে পারি না। সেদিন শায়লার রুটিন খোঁজখবর নিয়ে শুয়ে শুয়ে মোবাইলের পুরনো ছবিগুলো দেখছিলাম। হঠাৎ দেখি শায়লার সমুদ্র বিলাসের ছবির ভেতর জারার মুখ। এক ছেলের কোমর জড়িয়ে ধরে ৪৬৯ নম্বর রুমে ঢুকছে। আর তখনই আমার ক্লিক। উত্তেজনায় আমার শরীর কাঁপতে লাগল। এই ছবি যদি পাবলিশ করি আমার পোর্টালে আর শিরোনাম করি এমন : ‘কক্সবাজারের হোটেলে যুবকের সাথে একান্ত মুহূর্তে জারা’- ফাটাফাটি একটা ব্যাপার হবে। অবশ্য তার আগে ছবিটা থেকে আমার বউটার মুখ ও শরীর পুরোপুরি ব্লার করে দিতে হবে। উত্তেজনায় কী করব বুঝে উঠতে পারছিলাম না।
মোবাইলটা সামনে ধরে রুমের মধ্যে পায়চারি করতে লাগলাম। ফ্রিজ খুলে ঢকঢক করে ঠান্ডা পানি খেয়ে বুকটা ভিজিয়ে নিলাম। ভাবতে লাগলাম, এমন খোলামেলা জায়গায় কীভাবে একটি ছেলের সাথে লিভ টুগেদারের সাহস পেল জারা! পরক্ষণে মনে হলো, মাসছয়েক আগেও এতটা পপুলার হয়ে ওঠেনি জারা। বেশ কিছু বিজ্ঞাপন, দু’তিনটা নাটক আর একটি ওয়েবসিরিজে কাজ করেছে কেবল। শোবিজ জগতের লোক ছাড়া গণমানুষের কাছে তখনো সেভাবে পরিচিতি পায়নি তার কাজ। হয়তো এই কম জনপ্রিয়তাই জনসমাগমে প্রেমিক নিয়ে ঘুরতে তাকে সাহসী করে তুলেছিল। মূলত গেল মাসে মুক্তি পাওয়া ‘মুক্তি চাই’ ওয়েবসিরিজ তাকে তুমুল খ্যাতি এনে দিয়েছে। আর হঠাৎ খ্যাতি পাওয়া মানুষের কিছু বিব্রতকর অতীত থাকেই। সেই বিব্রতকর অতীতকে পুঁজি করে জারার টাটকা খ্যাতির ওপর ভর দিয়ে কীভাবে আমার পোর্টালের রিচ আরো বাড়ানো যায় ভাবতে লাগলাম।
উত্তেজনায় আমার মস্তিষ্ক জট পাকিয়ে রইল। কিন্তু রাত তো জট পাকিয়ে থাকার পাত্র না। সে আপন নিয়মে গভীর হতে লাগল। আর বিবাহিত পুরুষের বউবিহীন রাত গভীর হওয়ার বিড়ম্বনা কী, তা আপনারা জানেন নিশ্চয়। রাতের সে নীরবতার প্রশ্রয়ে আমার মাথায় নানা ধরনের শয়তানি বুদ্ধি চাগিয়ে উঠতে লাগল। একবার মনে হলো, ছবিটি হোয়াটসঅ্যাপ করে জারাকে ভড়কে দিই। জারার নাম্বার আমার কাছে আছে। একটি নাটকে পার্শ্বচরিত্রে অভিনয় করার পর আমিসহ বেশ কয়েকজন বিনোদন সাংবাদিককে জারা নক করেছিল, আমরা যেন তাকে নিয়ে নিউজ করি। কোনো দৈনিক জারার নাটক কাভার না করলেও আমি ঠিকই করেছিলাম আমার পোর্টালে। মনে পড়ে, নিউজ পাবলিশড হলে জারা ছোট্ট একটা থ্যাংকসও জানিয়েছিল। তুরুপের তাস তো আমার হাতে থাকছেই, তার আগে তাসটা দেখিয়ে নায়িকাকে ভড়কে দেওয়ার লোভ সামলাতে পারলাম না। দেখিই না ছবিটি দেখে তার অভিব্যক্তি কী রকম হয়।
জারাকে হোয়াটসঅ্যাপ করলাম। সঙ্গে সঙ্গে সিন হলো না। চ্যাটবার খুলে বসে রইলাম। পনেরো মিনিট পর সিন হলো। সঙ্গে সঙ্গে কলব্যাক। পুরনো বাংলা সিনেমায় একটা দৃশ্য খুব দেখা যায়। আহত নায়ক স্ট্রেচারে শোয়া। নায়িকা হাসপাতালের করিডোরে স্ট্রেচার ঠেলছে আর চিৎকার করে ডাক্তার ডাকছে। জারা ওই স্ট্রেচার ঠেলা নায়িকাদের মতো উত্তেজিত কণ্ঠে বলল, সামাদ ভাই, এই ছবিটা আপনি কই পাইলেন? এ তো অনেক আগের ঘটনা।
আলাপের শুরুতেই ‘আগের ঘটনা’ বলার মানে কি! আগের ঘটনা বলে সে কি বিষয়টাকে নরমাল করতে চায়? দেখেছি, কেউ কোনো অকাম করে ধরা খেলে বলে, ভাই, ওটা বহু আগের ঘটনা। মানে কোনো অপকর্ম আগের হলে সেটার দায় ও দোষ তেমন সজীব থাকে না। কিন্তু এটা তো বেশি আগের ঘটনা না। মাত্র আট মাস। বললামও সেই কথা, বেশি আগের না, মাত্র আট মাস আগের। আপনার মুক্তি চাই ওয়েবসিরিজ মুক্তি পাওয়ার কিছুদিন আগের।
ছবিটা ডিলিট করে দেন সামাদ ভাই। আর কাউকে পাঠায়েন না। জারার কণ্ঠে কেমন আকুতি ঝরে পড়ল।
কিন্তু ছবির প্রধান চরিত্র তো আমার বউ। আপনি পার্শ্বচরিত্র। পার্শ্বচরিত্রের কারণে প্রধান চরিত্রকে কীভাবে ডিলিট করি বলেন তো! আমার কণ্ঠে যেন শয়তান কথা বলে উঠল, যা শুনে আমি নিজেই অবাক হয়ে গেলাম।
ভাবীর তো আরো অনেক ছবি আছে সামাদ ভাই। এইটা ডিলিটি করে দেন প্লিজ।
সেই গভীর রাতে, যখন রাস্তায় থেমে থেমে বেজে ওঠা অ্যাম্বুলেন্সের সাইরেনও নিশ্চুপ হয়ে গেছে, তখন হঠাৎ খ্যাতি পাওয়া এই নায়িকার কণ্ঠের আকুতি আমাকে মাতাল বানিয়ে দিল। কথার টোপ দিয়ে নানাভাবে উল্টেপাল্টে তাকে খেলতে লাগলাম। কিন্তু ছবিটা যে ডিলিট করব, ভুলেও সেটা স্বীকার করলাম না। এক পর্যায়ে নায়িকা বলেই বসল, আপনি যত টাকা চান দেব, তবু ছবিটা ডিলিট করেন। এই ছবি যদি সোশ্যাল মিডিয়ায় ছড়ায়ে যায়, আমার মহাসর্বনাশ হয়ে যাবে। আমার ক্যারিয়ার ধ্বংস হয়ে যাবে।
নায়িকা আমাকে টাকার লোভ দেখাচ্ছে অথচ আমার প্রয়োজন দেহ। বহুদিন স্ত্রীসঙ্গ থেকে বঞ্চিত আমার এই তেতে থাকা শরীরের জন্য প্রয়োজন একটি নারীদেহ। টাকা যাকে ঠান্ডা করতে অক্ষম। তাই, নির্লজ্জের মতো প্রস্তাবটা আমি দিয়েই বসি।
ফোনের ওপাশে জারা কতক্ষণ স্তব্ধ হয়ে বসে থাকে। ক্রুদ্ধ সাপিনীর হিসহিস নিঃশ্বাস আমি দূর থেকেও স্পষ্ট শুনতে পাই। কয়েক সেকেন্ড পর ‘কুত্তার বাচ্চা’ গালি দিয়ে ফোন কেটে দেয় জারা। নায়িকার গালি খেয়ে আমি হো হো করে হাসতে থাকি। আমার শয়তানি হাসিতে রাতের নীরবতা খানখান করে ভেঙে পড়লে আবার ফোন করে জারা। গালির প্রায়শ্চিত্ত করতে তার কণ্ঠের মিনতি এবার আগের চেয়েও দরদমাখা। জারার মিনতিমাখা কণ্ঠ আমি তারিয়ে তারিয়ে উপভোগ করি। কিন্তু সেই মিনতি আমার ভেতরে জেগে ওঠা শয়তানকে ঘুম পাড়াতে পারে না। আমি আমার প্রস্তাবে আগের মতোই অবিচল থাকি। নয়তো ছবিটি আমার পোর্টালে ছেড়ে দেয়ার হুমকি দিই।
নিরুপায় জারা পরদিন দুপুরে তার ফ্ল্যাটে আসতে বলে আমাকে, যে ফ্ল্যাটের নিচে দাঁড়িয়ে এখন আমি বুলবুলি দম্পতির আদর দেখছি। পকেটে জন্মনিরোধক আর শরীরে কামনা নিয়ে সেদিন জারার ফ্ল্যাটে হাজির হলেও শরীরঘটিত কোনো ঘটনা সেদিন ঘটেনি। চূড়ান্ত মুহূর্তে হঠাৎ আমার বিবেক জেগে উঠলে পিছু হটেছিল শয়তান। কোনো নারীকে শয্যাসঙ্গী হিসেবে পাওয়ার পরও অবহেলায় মুখ ঘুরিয়ে নেওয়ার মতো সাধু আমি নই। কিন্তু তার জন্য প্রয়োজন সঙ্গীর সম্মতি। আবার ব্লাকমেইলের সুযোগে কারো সতীত্বের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ার মতো শয়তানও আমি নই। তার জন্যও প্রয়োজন সঙ্গীর সম্মতি। এক্ষেত্রে যেহেতু পারস্পরিক সম্মতি নেই, আছে ব্লাকমেইল, তাই চূড়ান্ত মুহূর্তে আমি সরে আসি আমার কুইচ্ছা থেকে। আমার প্রতি জারার তীব্র ঘৃণাবোধ এবং অসহায়ত্ব আমাকে এই সিদ্ধান্ত নিতে সাহায্য করে। আমি জারা থেকে সরে তো আসিই, ওর সামনে সমুদ্র বিলাসের ছবিটাও ডিলিট করে দিই এবং আমার এই অস্বাভাবিক আচরণের জন্য ক্ষমা চাই।
আমার এই অবিশ্বাস্য পরিবর্তন জারা যেন বিশ্বাসই করতে পারে না। খানিক পর যখন বুঝতে পারে ঘটনা, তখন তার মুখে ফুটে ওঠে প্রশান্তি ও প্রসন্নতা। যেন এতক্ষণ সে মাথার ওপর বিশাল এক পাহাড় বহন করে চলেছিল। ছবিটা ডিলিট করার সঙ্গে সঙ্গে তার মাথা থেকে পাহাড়টা সরে গেছে। জারার মুখের ওই প্রসন্নতা আমার হৃদয়কেও প্রসন্ন করে তোলে। সততার যে শান্তি, সেই শান্তির স্রোতধারা আমার রক্তকণিকার প্রতিটি শিরায় শিরায় ছড়িয়ে পড়ে। আজ যদি সত্যি সত্যি কিছু ঘটে যেত, জীবনভর আমি পুড়তাম, বিক্ষত হতাম। কৃতজ্ঞতা ও ধন্যবাদ জ্ঞাপনের শব্দভাণ্ডারে খুব বেশি সমৃদ্ধ নয় বাংলা ও ইংরেজি ভাষা, থাকলে তার সবটুকু দিয়েই জারা আমাকে ধন্যবাদ জানাত। এরপর থেকেই মূলত জারার সাথে স্থাপিত হয়েছে আমার এক সুস্থ-স্বাভাবিক সম্পর্ক। সেদিন আমার ওপর এতটাই খুশি হয়েছিল জারা, ওর অনুরোধে দুপুরের খাবার খেয়ে বেরোতে হয়েছিল। কিন্তু আজ, সেই একই ফ্ল্যাটে লাঞ্চের দাওয়াত পাওয়ার কারণ বুঝতে পারি না আমি। তাও আবার তখন, যখন পরপর দুটি ডিভোর্সের ঘটনায় মিডিয়াপাড়ার চূড়ান্ত আলোচিত নাম জারা। ফোন করি জারাকে। জারা ওপাশ থেকে জানায়- আসেন। আমি আপনার জন্য অপেক্ষা করতেছি।
কলিংবেল বাজাতেই খুলে যায় নায়িকার ফ্ল্যাটের দুয়ার। জারার কাজের বুয়া দরজা খুলে পাশে দাঁড়িয়ে থাকে। অপ্রতিভ ভাব ঝেড়ে ফেলে এক নজর বুয়াকে দেখে আমি ডান পা প্রবেশ করাই। ড্রয়িংরুমের সোফার দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করি- জারা কোথায়?
দরজার সিটকিনি তুলতে তুলতে বুয়া বলে, সামাদ ভাই, ভালো করে দেখেন, আমিই তো জারা।
এবার আমি পূর্ণ চোখ তুলে তাকাই মেয়েটার দিকে। অমনি আমার মাথায় আকাশ ভেঙে পড়ে। জারার এ কোন রূপ আমি দেখছি! তার সেই আবেদনময়ী তীক্ষ্ম নাক-চোখ-ঠোঁট কোথায়! পথে-ঘাটে এবং নিজের ঘরে নিত্যদিন আমি যেসব আটপৌরে নারীদের দেখে থাকি, ঘরের মেকাপবিহীন জারা তাদের মতোই এক সাধারণ নারী। আর তাতেই এক মুহূর্তের মাঝে আমার নায়িকা-বিষয়ক সকল মুগ্ধতা ধসে যায়। জারা আমাকে বসতে বলে নিজেও উলটো পাশের সোফায় পায়ের ওপর পা তুলে বসে। তাতে ওর মসৃণ পায়ের অনেকখানি বেরিয়ে আসে চোখের সামনে। অন্য সময় হলে, এই নির্জন ফ্ল্যাটে, জারার ওই উন্মুক্ত পায়ের গোছা দেখে হয়তো আমার শরীর চনমনিয়ে উঠত। কিন্তু জারার মুখ দেখার পর থেকে আমি নিস্তেজ, নির্বিষ, এমনকি নিবীর্যও। আমার শুধু মনে হয়, আর দশটা সাধারণ নারী এবং জারার মাঝে কোনো তফাৎ নেই। জানি, আপনারা মনে মনে বলছেন, তবে কি সাধারণ নারী দেখে আমার কামনা জাগে না? জাগে। কিন্তু বহু বছর ধরে যাকে আবেদনময়ী নারীর প্রতিভূ হিসেবে দেখে এসেছি, তার এই আটপৌরে রূপ আমার কেন, আপনাদের কামনার ছুরিকেও ভোতা বানিয়ে দিতে যথেষ্ট।
জারার পা থেকে চোখ তুলে আমি কুশল জিজ্ঞেস করি- কেমন আছেন?
কুশল বিনিময়ের ধার না ধেরে জারা আসল কথা পাড়ে। বোঝাই যায়, সে ক্লান্ত এবং জীবনের বোঝা বইতে বইতে অবসন্ন। বলে, আপনি বিভিন্ন সময়ে আমার ডিভোর্সের বিষয়ে প্রশ্ন করেছিলেন। কোনোবারই আমি সত্য বলিনি। আজ বলার জন্য ডেকেছি।
জারার কথায় আমার বুকের ভেতর আনন্দের হুইসেল বেজে ওঠে। ভাবতেই পারিনি এক্সক্লুসিভ ইন্টারভিউ দেওয়ার জন্য জারা আমাকে ওর ফ্ল্যাটে ডেকেছে, যেখানে অন্য কোনো সাংবাদিক উপস্থিত নেই। এতেই বোঝা যায়, মানুষ এবং সাংবাদিক হিসেবে আমাকে কতটা গুরুত্ব দেয় জারা। আমি দ্রুত মোবাইল বের করে ভিডিও রেকর্ডার অন করি।
জারা থামিয়ে দিয়ে বিষণ্ন কণ্ঠে বলে, রেকর্ড করতে হবে না। আপনাকে সাংবাদিক হিসেবে নয়, বন্ধু হিসেবে কথাগুলো বলতে চাই। এবং এও চাই, আমার এই সংকট যেন পাবলিক না হয়।
জারার কথায় আমি রেকর্ডার অফ করি। কিন্তু উৎসাহে বিন্দু পরিমাণ ভাটা পড়ে না আমার। এই জীবনে পেশাই তো সব না। একজন নায়িকা তার সংকট শেয়ার করবার জন্য আমাকে ডেকেছে, আমার ওপর আস্থা রেখেছে, মিলিয়ন মিলিয়ন লাইক কমেন্টের চেয়ে এই অর্জন বড়।
জারা আমাকে ডাইনিং টেবিলে নিয়ে যায়। টেবিল জুড়ে সাজানো সাদা ভাতের সাথে কয়েক পদের ভর্তা, রূপচাঁদা মাছ ভুনা, গরুর মাংস, হাঁসের মাংস, মাষকলাইয়ের ডাল এবং পায়েস। জারা চেয়ার দেখিয়ে বলে বসুন, খেতে খেতে শুনুন।
আপনি খাবেন না?
আমি পরে খাব।
আমি হাত ধুয়ে খেতে বসি। খেতে খেতে জারার জীবনের এমন এক অদ্ভুত গল্প শুনি, যা কখনো নাটক সিনেমাতেও দেখিনি, বইতেও পড়িনি। জারার প্রথম স্বামী ছিল ব্যবসায়ী। মডেলিং ও নাটক-সিনেমা দেখে জারার প্রেমে পড়েছিল সে। জারাও মজেছিল তার প্রেমে। কিন্তু বিয়ের পরেই বাধে গোল। বিছানায় স্বামীর শরীর জাগে না। জারা ভেবেছিল, ফাহাদের এই সমস্যা সাময়িক। দিন গেলে ঠিক হয়ে যাবে। কিন্তু দিন গেলেও ঠিক হয় না ফাহাদ। তবে হ্যাঁ, একটা সময় শরীর জাগে ফাহাদের, জারা যখন শ্যুটিং শেষে বিধ্বস্ত শরীরে ঘরে ফেরে। তখন আবার ঘুমিয়ে থাকে জারার শরীর। এই জারা যখন মেকাপ ধুয়ে ফ্রেশ হয়ে বিশ্রাম নিয়ে জেগে ওঠে, তখন আবার ঘুমায় ফাহাদ। দিনে দিনে ফাহাদ বুঝে যায়, জারার যে মেকাপি রূপ দেখে সে প্রেমে মজেছিল, বিয়ের পর বিছানায় সেই জারাকে সে পাচ্ছে না। বিছানার জারা বড্ড আটপৌরে, বড্ড মলিন, বড্ড সাধারণ। তার সেই বিয়েপূর্ব কল্পনার সাথে বিছানার জারার কোনো মিল নেই। ফলে ফাহাদ চেষ্টা করেও জাগতে পারে না। এক পর্যায়ে সে প্রস্তাব রাখে, তাকে জাগাতে হলে বিছানায়ও মেকাপ নিতে হবে জারাকে। এর কোনো বিকল্প নেই। স্বামীর প্রস্তাব শুনে ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠে জারা। অপমানে ডিভোর্স দেয় স্বামীকে। বছরখানেক পর দ্বিতীয় বিবাহে জড়ায় সে। এই স্বামী সিনেমার প্রযোজক। কিন্তু জারার দুর্ভাগ্য- প্রযোজক স্বামীর জীবনেও প্রতিফলিত হয় ফাহাদের জীবন। প্রযোজক রায়হান প্রজননে অক্ষমতার পরিচয় দেয়। তার ব্যাখ্যাও ফাহাদের অনুরূপ। ত্যক্ত হয়ে এই স্বামীকেও ত্যাগ করে জারা।
জারার গল্পে আমি এতটাই হতভম্ব হই, কখন যে খাবার থামিয়ে দিয়েছি টের পাই না। সাংবাদিকতা করতে এসে কত রকম সংকটের গল্প যে শুনেছি, হিসাব নেই। কিন্তু আমার কেন জানি মনে হয়, জারার জীবনের এই সংকট পৃথিবীর দীর্ঘ পরিভ্রমণে এবারই প্রথম। জীবনের দুর্লভ এক অভিজ্ঞতার মুখোমুখী দাঁড়িয়ে আমি বাকরহিত হয়ে যাই।
খাওয়া শেষ করুন সামাদ ভাই। আমার কথা এখনো শেষ হয়নি। জারা গরুর মাংস তুলে দেয় আমার পাতে। তারপর বলে, আমার খুব সংসার করতে ইচ্ছা করে জানেন। রান্না করতে, ঘর গোছাতে, ঘরের জিনিসপত্র কিনতে আমার খুব ভালো লাগে। আজ যা কিছু খাচ্ছেন, সব আমার রান্না করা। আমি খুব সংসারী মেয়ে। অথচ আমার দু’দুটো সংসার শুরুর আগেই ভেঙে গেল।
জারা ফোঁপাতে থাকে। আমি এঁটো হাতে ওর ফুলে ফুলে ওঠা পিঠ দেখি। ওর এই সংকট এমন অপরিচিত, সান্ত্বনা দেওয়ার উপযুক্ত শব্দ খুঁজে পাই না।
আমার কেন জানি মনে হয়, ওরা ফ্রড। নিজেদের অক্ষমতা ঢাকতে মেকাপের ওপর দোষ চাপাইতেছে। আপনি এই প্রথম আমাকে মেকাপবিহীন দেখতেছেন। আপনার অনুভূতিও কি ওদের মতো, সামাদ ভাই? চোখ মুছে খুব আগ্রহ নিয়ে জারা আমার দিকে তাকিয়ে থাকে।
জারার এই জিজ্ঞাসার সামনে আমি থতমত খাই। যদি সত্য বলি তবে বলতে হয়, তার প্রাক্তন স্বামীরা মিথ্যা বলেনি। জারার মেকাপবিহীন মুখ দেখে আমিও হতভম্ব হয়েছি। নয়তো যার শরীরের জন্য একদা আমি পশু হয়ে উঠেছিলাম, সেই মানুষটাকে একান্তে পেয়েও আজ কেন আমি ঘুমিয়ে থাকব! কিন্তু সত্যটা সত্যের স্বার্থেই প্রকাশ করি না আমি। এই সংকট থেকে বাঁচতে আমি বরং এক আড়ালের আশ্রয় নিই। বলি, ছ’বছর আগের সেই ঘটনার পর থেকে আমি আপনাকে ‘ওই’ চোখে দেখি না।
কিন্তু আজ আপনাকে দেখতে হবে। আমার প্রাক্তন স্বামীদের সত্য-মিথ্যা যাচাইয়ের মানদণ্ড আপনি। এ জন্যই আপনাকে ডাকছি। আপনি ছাড়া এ সংকট থেকে উদ্ধার করার দ্বিতীয় কেউ নেই। আমি খুব বন্ধুহীন মানুষ। বলতে বলতে আমার চেয়ারের কাছে উঠে আসে জারা। নায়িকাকে ছোঁয়ার দূরত্বে পাওয়ার পরও আমি নিজের ভেতর গুটিয়ে যাই অস্বস্তিতে। জারাকে পাশ কাটিয়ে উঠে যাই বেসিনে। সময় নিয়ে হাত ধুয়ে যখন ফিরে আসি, ততক্ষণে পৃথিবী তার নাট্যমঞ্চে আমার জন্য তৈরি করে ফেলেছে নতুন বিস্ময়। জারা নগ্ন। শরীরে একটা সুতা পর্যন্ত নেই। ডাইনিং টেবিলের সামনে দাঁড়িয়ে আছে বুক টান করে। বলুন সামাদ ভাই, এরপরও কি আপনি জাগতেছেন না? একটি নিটোল সংসারের স্বার্থে তবে কি আমাকে চিরকালের জন্য মেকাপই ত্যাগ করতে হবে?
জারার কথায় আমি হ্যাঁ না কিছু বলি না। চূড়ান্ত হতাশ করে দিয়ে ওর ফ্ল্যাট ছেড়ে আমি হনহন করে বেরিয়ে আসি।
তারা//
.উৎস: Risingbd
কীওয়ার্ড: চ কর চ কর আম র প র ট ল প রস ত ব ড ল ট কর র জন য আম র ম র স মন আম র ক র কর ড আম র স আম র শ র জ বন জ বন র র এই স কর ড র ল গল ম আম র ব য় র পর র ভ তর ন য় আম য় আম র আপন ক রহস য শয়ত ন র ওপর আপন র করল ম
এছাড়াও পড়ুন:
নিউমুরিং কনটেইনার টার্মিনাল পরিচালনায় বিদেশি কোম্পানির সঙ্গে চুক্তির চলমান প্রক্রিয়া প্রশ্নে রুল
চট্টগ্রাম বন্দরের নিউমুরিং কনটেইনার টার্মিনাল (এনসিটি) পরিচালনায় চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের বিদেশি কোম্পানির সঙ্গে চুক্তির চলমান প্রক্রিয়া কেন আইনগত কর্তৃত্ববহির্ভূত ঘোষণা করা হবে না, তা জানতে চেয়ে রুল দিয়েছেন হাইকোর্ট।
এক রিটের প্রাথমিক শুনানি নিয়ে বিচারপতি হাবিবুল গনি ও বিচারপতি শেখ তাহসিন আলীর সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্ট বেঞ্চ আজ বুধবার এ রুল দেন। একই সঙ্গে যেকোনো অপারেটরকে এনসিটি পরিচালনার দায়িত্ব (নিযুক্ত) দেওয়ার আগে সংশ্লিষ্ট আইন ও নীতি অনুসারে ন্যায্য ও প্রতিযোগিতামূলক পাবলিক বিডিং (দরপত্র আহ্বান) নিশ্চিত করতে কেন নির্দেশ দেওয়া হবে না, তা-ও জানতে চাওয়া হয়েছে রুলে।
আরও পড়ুননতুন ব্যবস্থাপনায় নিউমুরিং টার্মিনাল পরিচালনা শুরু০৭ জুলাই ২০২৫নিউমুরিং কনটেইনার টার্মিনাল বিদেশি প্রতিষ্ঠানের হাতে ছেড়ে দেওয়ার প্রক্রিয়ার বৈধতা নিয়ে বাংলাদেশ যুব অর্থনীতিবিদ ফোরামের পক্ষে সংগঠনটির সভাপতি মির্জা ওয়ালিদ হোসাইন রিটটি করেন। রিটে নৌসচিব, চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের চেয়ারম্যান ও পিপিপি কর্তৃপক্ষের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তাকে বিবাদী করা হয়।
‘নিউমুরিং টার্মিনালে সবই আছে, তবু কেন বিদেশির হাতে যাচ্ছে’ শিরোনামে গত ২৬ এপ্রিল প্রথম আলোয় একটি প্রতিবেদন ছাপা হয়। এ প্রতিবেদনসহ এ বিষয়ে বিভিন্ন গণমাধ্যমে প্রকাশিত প্রতিবেদন যুক্ত করে এনসিটি পরিচালনায় ন্যায্য ও প্রতিযোগিতামূলক দরপত্র আহ্বান করার নির্দেশনা চেয়ে রিটটি করা হয়।
আগের ধারাবাহিকতায় ৯ জুলাই রিটের ওপর শুনানি শেষ হয়। সেদিন আদালত ২৩ জুলাই আদেশের জন্য দিন রাখেন। ধার্য তারিখে আদালত আদেশের জন্য ৩০ জুলাই দিন রাখেন। এ অনুসারে আজ বিষয়টি আদেশের জন্য আদালতের কার্যতালিকার ৭ নম্বর ক্রমিকে ওঠে।
আজ মধ্যাহ্নবিরতির পর আদালত আদেশ দেন। আদালত বলেন, শুধু রুল দেওয়া হলো।
আদেশের সময় রিটের পক্ষে জ্যেষ্ঠ আইনজীবী জয়নুল আবেদীন, এ এম মাহবুব উদ্দিন খোকন ও আহসানুল করিম এবং আইনজীবী কায়সার কামাল ও আনোয়ার হোসেন উপস্থিত ছিলেন। রাষ্ট্রপক্ষে ছিলেন ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল মো. মহাদ্দেস-উল-ইসলাম।
পরে জ্যেষ্ঠ আইনজীবী আহসানুল করিম প্রথম আলোকে বলেন, চার সপ্তাহের মধ্যে রুলের জবাব দিতে বলা হয়েছে।
উল্লেখ্য, চট্টগ্রাম বন্দরের নিউমুরিং কনটেইনার টার্মিনাল পরিচালনার নতুন দায়িত্ব নিয়েছে নৌবাহিনীর প্রতিষ্ঠান চিটাগং ড্রাইডক লিমিটেড। টার্মিনালটি পরিচালনার জন্য বন্দর কর্তৃপক্ষের সঙ্গে সাইফ পাওয়ারটেকের চুক্তির মেয়াদ শেষ হওয়ার পর ৬ জুলাই দিবাগত রাত ১২টা ১ মিনিটে এ দায়িত্ব নেয় জাহাজ মেরামতের এ প্রতিষ্ঠান। প্রথমবারের মতো বন্দরে টার্মিনাল পরিচালনায় যুক্ত হলো চিটাগং ড্রাইডক।
চট্টগ্রাম বন্দরের বৃহৎ এই টার্মিনাল নির্মিত হয় ২০০৭ সালে। টার্মিনালটি নির্মাণ ও যন্ত্রপাতি সংযোজনে বন্দর কর্তৃপক্ষ ধাপে ধাপে মোট ২ হাজার ৭১২ কোটি টাকা বিনিয়োগ করেছে। বন্দরের আমদানি-রপ্তানি কনটেইনারের সিংহভাগ এই টার্মিনাল দিয়ে পরিবহন হয়।