সড়ক নেই, ওপারে ধানি জমি, তবু চার কালভার্ট
Published: 4th, August 2025 GMT
সামনে ধানখেত আর পতিত জমি। জনবসতি নেই। নেই কোনো স্থাপনা ও সড়ক। এরপরও সেখানে যাওয়ার জন্য করা হয় একে একে চারটি কালভার্ট। এক কোটি টাকার বেশি ব্যয়ে চারটি কালভার্ট নির্মাণ করা হয়েছিল গণ-অভ্যুত্থানে পতন হওয়া আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে। এসব কালভার্ট এখন পড়ে আছে অব্যবহৃত, অকার্যকর অবস্থায়।
চট্টগ্রামের রাউজান উপজেলার পাহাড়তলী ইউনিয়নের চৌমুহনী বাজার এলাকায় চট্টগ্রাম-কাপ্তাই সড়কের পাশের খাদে এই চার কালভার্ট নির্মাণ করা হয়েছে। বাজারের সহকারী পুলিশ সুপার (এএসপি) কার্যালয়ের বিপরীতে মাত্র ২৫০ মিটারের ভেতরে কালভার্টগুলো তৈরি করা হয় প্রায় সাত বছর আগে। ওই সময় বলা হয়েছিল, এখানে সরকারি কিছু দপ্তর, যেমন ফায়ার সার্ভিস, পুলিশ সার্কেল কার্যালয়, হাইওয়ে থানা ও খাদ্যগুদাম গড়ে তোলা হবে। কিন্তু এত দিনেও কোনো প্রকল্পের বাস্তবায়ন শুরু হয়নি।
গতকাল রোববার সরেজমিন দেখা গেছে, ধানখেতের মধ্য দিয়ে বানানো কালভার্টগুলোর চারপাশে কোথাও কোনো রাস্তা নেই। নেই কোনো ভবন বা সরকারি স্থাপনার চিহ্নও। এগুলোর ওপর এখন বাজারের আবর্জনা ফেলা হয়। এ কারণে প্রতিটি কালভার্ট কয়েক ফুট ময়লায় ঢেকে আছে। মূলত চট্টগ্রাম-কাপ্তাই সড়কের ২০ ফুট দূরত্বের ধানি জমির পাশের খাদের ওপর নির্মিত হয়েছে এসব কালভার্ট। সেখানে কোনো খালও নেই। কালভার্টের পরেই শত শত একরের ধানি জমি, যেগুলোতে এবারও ধান চাষ করেছেন জমির মালিকেরা।
সড়ক না থাকলে সাধারণত সেতু-কালভার্টের প্রকল্প নেওয়া হয় না। কিন্তু ওই সময়ের সংসদ সদস্যের নির্দেশনায় এগুলো হয়েছে। হয়তো সেটা সঠিক হয়নি।আয়েশা সিদ্দিকা, প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তা (পিআইও), রাউজান উপজেলাদেখা যায়, সারি করা চারটি কালভার্ট। আড়াআড়িভাবে নির্মিত একটি থেকে আরেকটি কালভার্টের দূরত্ব ২৫০ ফুট হবে। ৪টি কালভার্টেরই দৈর্ঘ্য ৩০ ফুট, প্রস্থ ১৫ ফুট করে। বাজারের ময়লা-আবর্জনা এখন এই চার কালভার্টে ফেলে যান পরিচ্ছন্নতাকর্মীরা।
দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা অধিদপ্তরের উন্নয়ন প্রকল্পের আওতায় নির্মিত এই চার কালভার্টের নাম দেওয়া হয়েছে দক্ষিণ রাউজান খাদ্যগুদাম সড়ক বক্স কালভার্ট, দক্ষিণ রাউজান হাইওয়ে থানা সড়ক বক্স কালভার্ট, রাউজান-রাঙ্গুনিয়া পুলিশ সার্কেল কার্যালয় সড়ক বক্স কালভার্ট ও দক্ষিণ রাউজান ফায়ার সার্ভিস স্টেশন সড়ক বক্স কালভার্ট। প্রতিটিতে ২৫ লাখ ৮৪ হাজার টাকা করে চারটি কালভার্টে মোট ব্যয় হয়েছে ১ কোটি ৩ লাখ ৩৬ হাজার টাকা।
কালভার্টগুলো নির্মাণের সময় সংসদ সদস্য ছিলেন আওয়ামী লীগের এ বি এম ফজলে করিম চৌধুরী, যিনি বর্তমানে কারাগারে রয়েছেন। তাঁর মন্তব্য জানা সম্ভব হয়নি। তবে রাউজান উপজেলা প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তা (পিআইও) আয়েশা সিদ্দিকা প্রথম আলোকে বলেন, ‘সড়ক না থাকলে সাধারণত সেতু-কালভার্টের প্রকল্প নেওয়া হয় না। কিন্তু ওই সময়ের সংসদ সদস্যের নির্দেশনায় এগুলো হয়েছে। হয়তো সেটা সঠিক হয়নি।’
রাউজান উপজেলা সহকারী কমিশনার (ভূমি) অংছিং মারমা জানান, এসব প্রকল্পের জমি অধিগ্রহণের বিষয়ে তাঁদের কাছে কোনো তথ্য নেই। রাউজান-রাঙ্গুনিয়া পুলিশ সার্কেলের এএসপি নুরুল আমিন বলেন, এখনো সার্কেল কার্যালয়ের জন্য জমিই অধিগ্রহণ করা হয়নি।
দেখা যায়, সারি করা চারটি কালভার্ট। আড়াআড়িভাবে নির্মিত একটি থেকে আরেকটি কালভার্টের দূরত্ব ২৫০ ফুট হবে। ৪টি কালভার্টেরই দৈর্ঘ্য ৩০ ফুট, প্রস্থ ১৫ ফুট করে। বাজারের ময়লা-আবর্জনা এখন এই চার কালভার্টে ফেলে যান পরিচ্ছন্নতাকর্মীরা।এদিকে স্থানীয় বাসিন্দারা বলেন, উপজেলার অনেক এলাকায় এখনো খালের ওপরে সেতু না থাকায় সাঁকো দিয়ে পার হতে হয়। জলদাশপাড়ার জালিয়ে খালে বহু বছর ধরে সেতু না থাকায় গ্রামবাসী দুর্ভোগে আছে। আরডি মুহাম্মদীয়া সড়কের দমদমা সেতু ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায়, দেওয়ানপুর-পাঁচখাইন সড়কের সেতু দিয়ে গাড়ি চলাচলই বন্ধপ্রায়।
ইমাম গাজ্জালী ডিগ্রি কলেজ পরিচালনা কমিটির সদস্য আয়ুব খান বলেন, একটি জায়গায় চারটি কালভার্টের কোনো যৌক্তিকতা নেই। এটি ছিল একজন সংসদ সদস্যের ইচ্ছাপূরণের প্রকল্প। স্থানীয় বাসিন্দা ও শিক্ষক মুহাম্মদ জাহিদ কাদেরী বলেন, ‘আমার বাবার চাষাবাদ করা জমির পাশ দিয়েই কালভার্ট বানানো হয়েছে। ভূমিমালিকদের কিছু না জানিয়ে জমি দখলের পথ তৈরি করা হয়েছে।’
এ বিষয়ে রাউজান উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা জিসান বিন মাজেদ প্রথম আলোকে বলেন, এভাবে একসঙ্গে চারটি কালভার্ট নির্মাণ অনিয়মের শামিল। সরেজমিন এ বিষয়ে খোঁজ নেওয়া হবে।
সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন) চট্টগ্রামের সভাপতি আখতার কবির চৌধুরী বলেন, একটি সেতুর জায়গায় একসঙ্গে চারটি কালভার্ট করা মানে প্রকল্প বানিয়ে অর্থ আত্মসাতের চেষ্টা। এভাবে সরকারের অর্থের অপচয় শাস্তিযোগ্য অপরাধ হওয়া উচিত।
.উৎস: Prothomalo
এছাড়াও পড়ুন:
সরকারব্যবস্থায় কেন্দ্রের আধিপত্য ও প্রান্তের নীরবতা
জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের পর বাংলাদেশের সমাজ-রাজনীতির সামনে প্রধান প্রশ্নটা কে ক্ষমতায় আসবে তা নয়, বরং রাষ্ট্রের কাঠামো কেমন হবে—এই প্রশ্নই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। যে ক্ষমতার ভারসাম্য এত দিন ঢাকার কেন্দ্রভূমিতে আটকে ছিল, এখন সেটিকে নতুনভাবে কল্পনা করার সময় এসেছে।
কেমন হবে সেই নতুন কাঠামো? সেখানে কেন্দ্র ও প্রান্তের সম্পর্ক কীভাবে পুনর্গঠিত হবে? এই কাঠামোয় সাধারণ মানুষ, বিশেষ করে প্রান্তিক ও গ্রামীণ জনগণ, কীভাবে নিজের অভিজ্ঞতা, প্রয়োজন ও চাহিদার জন্য জায়গা তৈরি করবে? গণতন্ত্র যদি কেবল ভোটের মধ্যে সীমাবদ্ধ না থেকে জীবনের প্রতিদিনের বাস্তবতায় প্রভাব ফেলতে চায়, তবে এই প্রশ্নগুলোর উত্তর খুঁজতেই হবে। স্থানীয় সরকারব্যবস্থার মৌলিক সংস্কারের মধ্য দিয়ে এই প্রশ্নগুলোর যৌক্তিক উত্তর খুঁজে পাওয়া সম্ভব।
নামেই বিকেন্দ্রীকরণবাংলাদেশের উন্নয়ন–কাহিনি প্রায়ই কেন্দ্রের সাফল্যের গল্পে আটকে থাকে। ঢাকামুখী অর্থনীতি, নীতি, প্রশাসন ও ক্ষমতার একচেটিয়া প্রবাহই এ দেশের রাজনীতির স্থায়ী বৈশিষ্ট্য। এই কাঠামোতে গ্রাম, উপজেলা, ইউনিয়ন থাকে সিদ্ধান্তের বাইরে। বস্তুত বাংলাদেশে কেন্দ্র ও প্রান্তের মধ্যকার প্রকট বৈষম্য টিকে আছে কেন্দ্রের তুলনায় ক্ষমতাহীন এবং কেন্দ্রের ওপরে নির্ভরশীল বৈষম্যমূলক স্থানীয় সরকারব্যবস্থার মাধ্যমে।
বাংলাদেশের স্থানীয় সরকারব্যবস্থা একধরনের ঐতিহাসিক বৈষম্যের মধ্যে গড়ে উঠেছে। এটি নামেই ‘বিকেন্দ্রীকৃত’, বাস্তবে কেন্দ্রীয় নিয়ন্ত্রণের দীর্ঘ ছায়ায় আবদ্ধ। গ্রামীণ ইউনিয়ন পরিষদ, যা সবচেয়ে পুরোনো ও জনগণের সবচেয়ে কাছের প্রতিষ্ঠান—আজ কার্যত মন্ত্রণালয়ের এক্সটেনশন অফিস। তাদের বাজেট, প্রকল্প, এমনকি কর্মচারী নিয়োগও নির্ধারিত হয় ঢাকায়।
শহরের সিটি করপোরেশন ও পৌরসভাগুলো তুলনামূলকভাবে বেশি আর্থিক ও প্রশাসনিক স্বাধীনতা ভোগ করে এবং তাদের সিদ্ধান্ত দ্রুত বাস্তবায়িত হয়। কারণ, তারা কেন্দ্রীয় নেটওয়ার্কের অংশ। উদাহরণস্বরূপ—ঢাকায় একজন নাগরিকের জন্য যে পরিমাণ রাজস্ব ব্যয় হয়, তা একটি গ্রামীণ ইউনিয়ন পরিষদের মানুষের জন্য ব্যয়ের চেয়ে বহুগুণ বেশি। অথচ এখনো প্রায় ৭০ শতাংশ মানুষ বাস করে গ্রামে, যেখানে সন্তানের জন্মনিবন্ধন থেকে শুরু করে বয়স্ক ভাতা বা আশ্রয় প্রকল্প—সবকিছুতেই ইউনিয়ন পরিষদের ওপর নির্ভর করে। কিন্তু ইউনিয়ন পরিষদের হাতে বাজেট, কর্মী, প্রযুক্তি বা নীতিনির্ধারণের ক্ষমতা প্রায় নেই বললেই চলে।
এই কাঠামো কেবল প্রশাসনিক নয়, রাজনৈতিক ক্ষমতারও প্রতিফলন, যেখানে সিদ্ধান্ত নেওয়ার অধিকার কিছু গোষ্ঠীর হাতে কেন্দ্রীভূত, প্রান্তিক মানুষের বাস্তব অভিজ্ঞতা ও চাহিদা রয়ে যায় প্রান্তেই।
উপজেলা, ইউনিয়ন ও জেলা পরিষদের প্রতিনিধিরা নির্বাচিত হলেও তাঁদের বাস্তব ক্ষমতা সীমিত। বাজেট, উন্নয়ন প্রকল্প বা প্রশাসনিক সিদ্ধান্তের চাবিকাঠি থাকে কেন্দ্রীয় আমলাতন্ত্রের হাতে। ফলে প্রান্তিক জনগণ স্থানীয় সরকারের মাধ্যমে নিজেদের প্রয়োজন ও অভিজ্ঞতা রাষ্ট্রীয় নীতিতে প্রতিফলিত করতে পারেন না। এ কারণেই উন্নয়ন পরিকল্পনা অনেক সময় মানুষের বাস্তবতার সঙ্গে মেলে না; যেখানে রাস্তা আছে, সেখানে আবার রাস্তা হয়, আর যেখানে বন্যা প্রতিরোধ বাঁধ দরকার, সেখানে বরাদ্দ মেলে না।
রাজনৈতিক অর্থনীতির বাস্তবতাএই অন্যায্য ও অসম কাঠামো কেবল প্রশাসনিক ব্যর্থতা নয়; বরং একটি রাজনৈতিক অর্থনৈতিক বিন্যাস, যেখানে ক্ষমতা, সম্পদ ও প্রভাব কিছু এলিট গোষ্ঠীর হাতে কেন্দ্রীভূত। নয়া মার্ক্সবাদী বিশ্লেষণে রাষ্ট্রকে দেখা হয় এলিট শ্রেণির স্বার্থরক্ষাকারী যন্ত্র হিসেবে। বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে এই শ্রেণি কেবল অর্থনৈতিক নয়, প্রশাসনিক ও রাজনৈতিকও বটে, যারা ক্ষমতার কেন্দ্রে অবস্থান করে রাষ্ট্রীয় সম্পদ বণ্টনের নিয়ম নির্ধারণ করে।
কেন্দ্রীকৃত কাঠামো মানে ক্ষমতা সীমিত মানুষের হাতে। সিদ্ধান্ত হয় ঢাকায়, কিন্তু তার প্রভাব পড়ে প্রত্যন্ত গ্রামের মানুষের জীবনে। এই ‘এলিট ক্যাপচার’–এর ফলে স্থানীয় মানুষ, বিশেষ করে নারী, দরিদ্র ও প্রান্তিক গোষ্ঠীগুলো নীতিনির্ধারণ থেকে ছিটকে যায়। ইউনিয়ন পরিষদ, পৌরসভা ও জেলা পরিষদ নির্বাচনের মাধ্যমে যেসব প্রতিনিধিত্বমূলক কাঠামো তৈরি হয়, তা প্রকৃত অর্থে অংশগ্রহণমূলক হতে পারে না। কারণ, সিদ্ধান্তের বাস্তব ক্ষমতা তাদের হাতে নেই। ফলে গণতন্ত্র কেবল ভোটের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকে, নাগরিক অংশগ্রহণ হয়ে যায় প্রতীকী। স্থানীয় পর্যায়ের রাজনৈতিক জীবনে যে নৈরাজ্য, দুর্নীতি বা হীনম্মন্যতা দেখা যায়, তা এই কাঠামোগত অক্ষমতারই প্রতিফলন।
এখন প্রশ্ন হলো কেন এই অসম কাঠামো এত দিন টিকে আছে? উত্তর লুকিয়ে আছে রাজনৈতিক অর্থনীতির যুক্তিতে। কেন্দ্রীয় ক্ষমতা ও সম্পদ নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে একটি পারস্পরিক নির্ভরতার চক্র তৈরি হয়েছে। রাজনীতিকেরা নিয়ন্ত্রণে রাখতে চান প্রশাসন ও সম্পদ, আমলারা চান নীতি ও প্রক্রিয়ার মালিকানা। উভয় পক্ষই এই কেন্দ্রীকরণ থেকে লাভবান। কেন্দ্রীয় সরকার ও প্রশাসনের জন্য এই বৈষম্য আসলে একটি ‘ইনসেনটিভ স্ট্রাকচার’ এবং এখানেই নিয়ন্ত্রণ, নিয়োগ, প্রকল্প ও সম্পদ বণ্টনের সুযোগ। বিকেন্দ্রীকরণ মানে এই নিয়ন্ত্রণ হারানো। ক্ষমতাসীন গোষ্ঠীর স্বার্থ এই কেন্দ্রীভূত কাঠামো টিকিয়ে রাখার মধ্যেই নিহিত। ফলে সংস্কারের প্রস্তাব যতই থাকুক, বাস্তবায়িত হয় না। বাস্তবে বিকেন্দ্রীকরণ মানে রাজনৈতিক দল, আমলাতন্ত্র ও অর্থনৈতিক অভিজাত শ্রেণির মধ্যকার স্বার্থের শৃঙ্খল ভাঙা। তা সম্ভব হয়নি। এটাই স্থানীয় সরকারব্যবস্থা সংস্কারের মূল রাজনৈতিক বাধা।
প্রান্তিক মানুষের সেবা পাওয়ার কথা ইউনিয়ন পরিষদে। বরিশাল সদরের শায়েস্তাবাদ ইউপি কার্যালয়