আমাদের জীবনের একটা বড় অংশ এখন সাপ্তাহিক ছুটির ওপর নির্ভর করে। শুক্র, শনি বা রোববার—বিভিন্ন দেশে ছুটির দিন ভিন্ন হলেও এটা আমাদের দৈনন্দিন জীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশ।

যদি প্রশ্ন করা হয়, এ ছুটির দিন কি ধর্মীয় বিধান থেকে এসেছে, নাকি আমাদের সমাজ আর অর্থনীতির প্রয়োজনে তৈরি হওয়া নিয়ম? বিশেষ করে ইসলামের দৃষ্টিকোণ থেকে শুক্রবারের ছুটি কি ধর্মীয়ভাবে বাধ্যতামূলক, নাকি শুধু প্রশাসনিক একটি সিদ্ধান্ত?

আসুন, এ প্রশ্নের উত্তর আমরা ইসলামি শরিয়াহ, ঐতিহ্য ও সমাজের বাস্তবতার আলোকে দেখি।

ধর্মে ছুটি ও উৎসবের ধারণা

ইহুদি, খ্রিষ্টান ও ইসলাম ধর্মে ছুটি ও উৎসবের ধারণা একেক রকম। ইহুদি ধর্মে শনিবার পবিত্র একটি দিন। বাইবেলের জেনেসিসে (২: ২-৩) বলা হয়েছে, ঈশ্বর সপ্তম দিনে বিশ্রাম নিয়েছিলেন এবং সেই দিনকে পবিত্র করেছিলেন। তাই শনিবারে কোনো কাজ করা যায় না, এটি পুরোপুরি বিশ্রাম ও উপাসনার জন্য নির্ধারিত। (বাইবেল, এক্সোডাস, ২০: ৮-১১)

এটি ইহুদিদের জন্য ঈশ্বরের সঙ্গে একটি চিরন্তন চুক্তি।

হে মুমিনগণ, শুক্রবারে যখন নামাজের জন্য ডাক দেওয়া হয়, তখন তোমরা আল্লাহর স্মরণের দিকে এগিয়ে যাও এবং বেচাকেনা বন্ধ কর। …নামাজ শেষ হলে পৃথিবীতে ছড়িয়ে পড়ো এবং আল্লাহর অনুগ্রহ সন্ধান করো।সুরা জুমুআ, আয়াত: ৯-১০

খ্রিষ্টধর্মে রোববার পবিত্র। কারণ, এই দিনে যিশুখ্রিষ্টের পুনরুত্থান হয়েছিল। বাইবেলের নিউ টেস্টামেন্টে (অ্যাক্টস, ২০: ৭) দেখা যায়, প্রথম শতকে খ্রিষ্টানরা রোববারে একত্র হতেন উপাসনার জন্য এবং সামাজিক আয়োজন হিসেবেও। দিনটি তাঁদের কাছে ‘প্রভুর দিন’, যখন তাঁরা বিশ্রাম ও আধ্যাত্মিক কাজে মন দিতেন।

ইসলামে শুক্রবারের বিশেষ মর্যাদা আছে। কোরআনে বলা হয়েছে, ‘হে মুমিনগণ, শুক্রবারে যখন নামাজের জন্য ডাক দেওয়া হয়, তখন তোমরা আল্লাহর স্মরণের দিকে এগিয়ে যাও এবং বেচাকেনা বন্ধ কর। …নামাজ শেষ হলে পৃথিবীতে ছড়িয়ে পড়ো এবং আল্লাহর অনুগ্রহ সন্ধান করো।’ (সুরা জুমুআ, আয়াত: ৯-১০)

আরও পড়ুনজীবনকে ছন্দে ফেরাবে ‘ধীর নামাজ’২৪ মে ২০২৫

হাদিসে এসেছে, ‘শুক্রবার সবচেয়ে উত্তম দিন। এই দিনে আদম (আ.

) সৃষ্ট হয়েছিলেন, জান্নাতে প্রবেশ করেছিলেন এবং তা থেকে বের হয়েছিলেন।’ (সহিহ মুসলিম, হাদিস: ৮৫৪)

তবে শুক্রবার কি পুরোপুরি বিশ্রামের দিন? না। কোরআন ও হাদিসে শুক্রবারে জুমার নামাজ ও খুতবার গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে, কিন্তু পুরো দিন কাজ বন্ধ করার কথা বলা হয়নি। নামাজের সময় ব্যবসা বন্ধ করতে বলা হয়েছে, কিন্তু তারপর কাজে ফিরে যাওয়ার অনুমতি দেওয়া হয়েছে।

ইসলামে শুক্রবারের গুরুত্ব অস্বীকার করা যাবে না। নবীজি (সা.) ও তাঁর সাহাবিরা এই দিনকে বিশেষভাবে মর্যাদা দিতেন। কিন্তু তাঁরা শুক্রবারে পুরো দিন কাজ বন্ধ করতেন না। সাহাবারা জুমার নামাজের আগে-পরে তাঁদের পেশায় নিয়োজিত ছিলেন। শুক্রবার ধর্মীয়ভাবে গুরুত্বপূর্ণ হলেও তা পুরোপুরি ছুটির দিন হিসেবে নির্ধারিত ছিল না। এটি ছিল ইবাদত ও সমবেত হওয়ার দিন, যেখানে জুমার নামাজ ও খুতবা মূল ভূমিকা পালন করে।

মুসলিম দেশগুলোতে শুক্র বা শুক্র-শনিবার ছুটির দিন হিসেবে প্রচলিত। মিসরে শুক্র-শনিবার, তিউনিসিয়ায় শনি-রবিবার, সৌদি আরবে শুধু শুক্রবার, পাকিস্তানে শনি-রবিবার।সাপ্তাহিক ছুটির ইতিহাস

সাপ্তাহিক ছুটির ধারণা প্রাচীন নয়। ইউরোপে শিল্পবিপ্লবের সময় এ ধারণা জনপ্রিয় হয়। খ্রিষ্টান সংস্কৃতির প্রভাবে রোববার ছুটির দিন হিসেবে গৃহীত হয়। পরে আধুনিক রাষ্ট্রব্যবস্থা ও অর্থনৈতিক প্রয়োজনে এ প্রথা বিশ্বজুড়ে ছড়িয়ে পড়ে।

মুসলিম দেশগুলোতে শুক্র বা শুক্র-শনিবার ছুটির দিন হিসেবে প্রচলিত হয়, যদিও এটি দেশভেদে ভিন্ন। যেমন মিসরে শুক্র-শনিবার, তিউনিসিয়ায় শনি-রবিবার, সৌদি আরবে শুধু শুক্রবার, পাকিস্তানে শনি-রবিবার।

ছুটির দিন নির্ধারণ প্রশাসনিক ও অর্থনৈতিক প্রয়োজনের ওপর নির্ভর করে হয়েছে, ধর্মীয় বিবেচনা করে নয়।

সমাজ ও প্রশাসনের দৃষ্টিকোণ

সাপ্তাহিক ছুটি নির্ধারণের পেছনে কয়েকটি বিষয় কাজ করে:

১. শ্রম আইন: শ্রমিকদের অধিকার রক্ষা ও কাজের সময় নির্ধারণ।

২. শিক্ষাব্যবস্থা: স্কুল-কলেজের সময়সূচি।

৩. অর্থনীতি: বিশ্ববাজারের সঙ্গে তাল মেলানো।

৪. সামাজিক জীবন: পারিবারিক ও সামাজিক সমাবেশের সুবিধা।

আরও পড়ুনধর্ম ও বিজ্ঞানের সম্পর্ক: পশ্চিমা অনুকরণ থেকে মুক্তির পথ২২ আগস্ট ২০২৫

এ বিষয়গুলো শরিয়তের দৃষ্টিকোণ থেকে ‘মুবাহ’ বা সাধারণ বৈধ, যদি না তা অন্য কোনো ধর্মীয় বিধান বা মানুষের কল্যাণের পথে বাধা সৃষ্টি করে। এগুলো সমাজের উন্নতি ও সভ্যতার অংশ হিসেবে বিবেচিত হয়।

কোনো কোনো আলেম মনে করেন, ধর্মীয় মর্যাদার কারণে শুক্রবারকে ছুটির দিন করা যুক্তিসংগত। তাজিকিস্তানে একসময় রোববারের পরিবর্তে শুক্রবারকে ছুটির দিন করা হয়েছিল, ইসলামি পরিচয়কে সামনে রেখে। (মুসলিম বিশ্বে আধুনিক মতবাদের প্রতিবাদ, ২/১৫০, দার আল-কিতাব, কায়রো, ২০০৫)

তবে অন্যরা বলেন, ছুটির দিন নির্ধারণ একটি প্রশাসনিক বিষয়, এটাকে ধর্মীয় বিধান ভাবা ঠিক নয়। এটি ইসলামি ফিকহের নীতি ‘সবকিছুর মূলে জায়েজ’ এবং ‘মাসলাহা’ (কল্যাণ) ও ‘মাফসাদা’ (ক্ষতি পরিহার) বিবেচনার ওপর নির্ভর করে।

সাইয়েদ কুতুব মনে করতেন, আধুনিক বিষয়ে ফতোয়া দেওয়ার আগে আমাদের ইসলামি সভ্যতার ভিত্তি মজবুত করা উচিত। তিনি জোর দিতেন শরিয়ার মূলনীতি ও ইসলামের চেতনার ওপর।সমাজে ছুটির প্রভাব

ছুটির দিন বদলালেও মানুষের দৈনন্দিন অভ্যাসে খুব বেশি পরিবর্তন আসে না। পারিবারিক সমাবেশ, বিনোদন বা খেলাধুলার সময় সহজেই নতুন দিনের সঙ্গে মানিয়ে নেয়। জুমার নামাজ বা দৈনন্দিন নামাজের মতো উপাসনা নির্দিষ্ট সময়ে থাকে, ছুটির দিন যাই হোক না কেন।

আজকের জীবন ১৪০০ বছর আগের থেকে অনেক বদলে গেছে। কাজের সময়, বার্ষিক ছুটি, শিক্ষার সময়সূচি—এসব এখন জটিল হয়ে গেছে। এ পরিবর্তনগুলো ‘মুবাহ’ (জায়েজ) বিষয়ের মধ্যে পড়ে, যেখানে ফিকহের নতুন ব্যাখ্যা দরকার।

সাইয়েদ কুতুব মনে করতেন, আধুনিক বিষয়ে ফতোয়া দেওয়ার আগে আমাদের ইসলামি সভ্যতার ভিত্তি মজবুত করা উচিত। তিনি জোর দিতেন শরিয়ার মূলনীতি ও ইসলামের চেতনার ওপর। (ফি জিলালিল কুরআন, ৬/৩২৫, দার আশ-শুরুক, কায়রো, ১৯৮০)

সাপ্তাহিক ছুটি একটি প্রশাসনিক ও সামাজিক ব্যবস্থা, যা সমাজ ও অর্থনীতির প্রয়োজনে তৈরি হয়েছে। শুক্রবার ইসলামে ইবাদতের দিন, কিন্তু পুরো দিন ছুটি বাধ্যতামূলক নয়। ধর্মীয় বিধান ও প্রশাসনিক সিদ্ধান্তের মধ্যে পার্থক্য বোঝা জরুরি, যাতে আমরা ভুল ধারণায় না পড়ি।

শুক্রবারের মর্যাদা রক্ষা করা আমাদের দায়িত্ব, কিন্তু ছুটির দিন নির্ধারণে সমাজের কল্যাণ ও বাস্তবতার কথা মাথায় রাখতে হবে। এ ভারসাম্যই আমাদের সমাজকে এগিয়ে নিয়ে যাবে।

আরও পড়ুনমুসলিম বিশ্বে আধুনিকতার ধারণা এল যেভাবে২০ সেপ্টেম্বর ২০২৫

উৎস: Prothomalo

কীওয়ার্ড: শ ক রব র র জ র সময রব ব র আম দ র র বব র র জন য ইসল ম ব যবস র ওপর

এছাড়াও পড়ুন:

যাঁরা জাতির ভবিষ্যৎ গড়েন, তাঁদের সুবিধা দিতে কেন পিছুটান দেখাই রাশেদা কে চৌধূরী

দেশের বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের এমপিওভুক্ত শিক্ষক-কর্মচারীরা টানা ১০ দিন ধরে ঢাকার রাস্তায় আন্দোলন করেছেন বাড়িভাড়া ও অন্যান্য সুবিধা বাড়ানোর দাবিতে। এ সময়ে সরকারের নীতিনির্ধারকদের কাছ থেকে নানা ধরনের বক্তব্য এসেছে; কিন্তু কার্যকর পদক্ষেপের ঘাটতি ছিল স্পষ্ট। শিক্ষা উপদেষ্টা অধ্যাপক সি আর আবরারকে ধন্যবাদ জানাই—তিনি নিজেও একজন শিক্ষক হিসেবে বিষয়টি অনুধাবন করে অর্থ বিভাগে প্রস্তাব পাঠিয়েছেন এবং বিভিন্ন পর্যায়ে উদ্যোগও নিয়েছেন। কিন্তু জানা গেছে, প্রস্তাবটি অর্থ মন্ত্রণালয়ে গিয়ে আটকে ছিল।

শিক্ষা পরিবারের একজন সদস্য হিসেবে আমার প্রশ্ন, সরকারি কর্মকর্তা–কর্মচারীদের বেতন–ভাতা বাড়াতে যখন বেতন কমিশন হয়, তখন বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের শিক্ষক–কর্মচারীদের বিষয়টি কেন গুরুত্ব পায় না? তাঁদের জন্য আলাদা বেতন কমিশন গঠন করা যেতে পারে। সরকারি কর্মচারীদের সুযোগ–সুবিধা ক্রমেই বাড়ছে, অথচ যাঁরা জাতির ভবিষ্যৎ নির্মাণের কারিগর, তাঁদের ক্ষেত্রে কেন পিছুটান দেখা যায়—এটাই দুঃখজনক।

আরও পড়ুনএমপিওভুক্ত শিক্ষকদের বাড়িভাড়া বাড়ছে ১৫ শতাংশ, কার্যকর দুই ধাপে২ ঘণ্টা আগে

নানা চ্যালেঞ্জের মধ্যেও অন্তর্বর্তী সরকার এমপিওভুক্ত শিক্ষক–কর্মচারীদের বাড়িভাড়া ১৫ শতাংশ বাড়ানোর সিদ্ধান্ত (দুই ধাপে কার্যকর হবে) নিয়েছে—এর জন্য তাঁদের ধন্যবাদ। আশা করব, আগামীতে যে সরকারই ক্ষমতায় আসুক, তারা যেন শিক্ষক–কর্মচারী ও শিক্ষাকে রাজনৈতিক দৃষ্টিতে না দেখে, মানবসম্পদ গঠনের দীর্ঘমেয়াদি লক্ষ্যকে সামনে রেখে কাজ করে।

বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান জাতীয়করণের প্রতিশ্রুতি বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের কাছ থেকে শোনা যাচ্ছে। সক্ষমতা অনুযায়ী সেটি করা যেতে পারে, তবে শুধু জাতীয়করণই সমস্যার পূর্ণ সমাধান নয়। মানসম্মত শিক্ষা নিশ্চিত করতে শিক্ষার্থী ও অভিভাবকের দিকও ভাবতে হবে।

বাড়ি ভাড়া বাড়ানোসহ তিন দফা দাবিতে ১২ অক্টোবর থেকে আন্দোলন করছেন এমপিওভূক্ত শিক্ষক–কর্মচারিরা

সম্পর্কিত নিবন্ধ