সিপিবির নেতৃত্বকে দেয়ালের লিখন পড়তে হবে
Published: 13th, February 2025 GMT
দেশের বৃহৎ বাম দল বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি (সিপিবি) কি আবারও ভাঙছে? জানি, বামপন্থার প্রতি ন্যূনতম টান আছে, এমন মানুষের কাছে প্রশ্নটা শুধু অনাকাঙ্ক্ষিত নয়, ক্ষুব্ধ হওয়ার মতোও। এমনকি ভিন্ন আদর্শ পোষণ করেন, তবে অন্তর্ভুক্তিমূলক রাষ্ট্র ও সমাজ গঠনে বামপন্থার গুরুত্ব বোঝেন, এমন মানুষকেও প্রশ্নটা হয়তো বিচলিত করছে।
তবে সাম্প্রতিক কিছু ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে রাজনৈতিক পর্যবেক্ষক হিসেবে প্রশ্নটা এড়িয়ে যাওয়ার সুযোগ নেই। এসব ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে সামাজিক মাধ্যমে সিপিবির নেতাকর্মী ও সমর্থক-শুভানুধ্যায়ীদের মন্তব্য ও প্রতিক্রিয়া খেয়াল করলেই বোঝা যায়, তাদেরও মনে এ শঙ্কা বিরাজ করছে।
সিপিবির গণসংগঠন বলে পরিচিত দেশের সর্ববৃহৎ সাংস্কৃতিক সংগঠন উদীচীর ২৩তম জাতীয় সম্মেলনে সংঘটিত একেবারে সর্বসাম্প্রতিক ঘটনা দিয়ে শুরু করা যাক। ৬ ফেব্রুয়ারি শুরু তিন দিনের সম্মেলনে পরবর্তী নেতৃত্ব নির্বাচন করতে গিয়ে কার্যত দু’ভাগ হয়ে গেছে সংগঠনটি। দু’পক্ষ পরস্পরের বিরুদ্ধে সংগঠনের গঠনতন্ত্র লঙ্ঘনের অভিযোগ এনে নিজ নিজ পছন্দের কমিটি বানিয়েছে। এমনকি এ নিয়ে প্রথমে বাগ্বিতণ্ডা, পরে হাতাহাতিও হয়েছে। এক পক্ষ কেন্দ্রীয় কার্যালয় দখল করে নেওয়ায় দু’পক্ষের সম্পর্ক এখনও বেশ তিক্ত।
সিপিবির কোনো কোনো নেতা বলছেন, দলের বয়োজ্যেষ্ঠরা দু’পক্ষকে অচিরেই মিলিয়ে দেবেন। তবে মূল দলের নেতৃত্বের ফাটলই উদীচীর এ বিভক্তির উৎস কিনা, ভেবে দেখা প্রয়োজন। যে কারণে উদীচী আদৌ অখণ্ড থাকবে কিনা, তা নির্ভর করতে পারে সিপিবির আগামী কংগ্রেসের ওপর।
প্রসঙ্গত, ৩ অক্টোবর সমকালের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছিল– শিক্ষার্থী-জনতার অভ্যুত্থানের মূল্যায়ন প্রশ্নে দুটি পক্ষে বিভক্ত হয়ে পড়েছে সিপিবির কেন্দ্রীয় কমিটি। এমনকি এক পক্ষ বর্তমান নেতৃত্বের পদত্যাগ ও বিশেষ কংগ্রেস আয়োজনের দাবিও জানিয়েছে। প্রতিবেদনমতে, ৫ আগস্ট শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর গত ১০ আগস্ট সিপিবির কেন্দ্রীয় কমিটির সভায় গণঅভ্যুত্থানের মূল্যায়ন প্রশ্নে মতভেদ প্রকাশ্য হয়। সভায় কেন্দ্রীয় কমিটির সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশ শেখ হাসিনার পতন আন্দোলনকে ‘চরম প্রতিক্রিয়াশীল গোষ্ঠীর ক্যু’ হিসেবে দেখালে অন্য অংশ আপত্তি জানায়। সংখ্যালঘু অংশ গণঅভ্যুত্থানে ‘জনতার আকাঙ্ক্ষা বিশেষত গণতান্ত্রিক দেশ ও সমাজ নির্মাণের প্রত্যাশা’য় প্রাধান্য দিয়ে রাজনৈতিক সংগ্রাম অগ্রসরের প্রস্তাব দেয়। শেষ পর্যন্ত সিদ্ধান্ত ছাড়াই সভা শেষ হয়।
দু’পক্ষের বিরোধ এমন পর্যায়ে যায় যে, দলের সংখ্যাগুরু অংশকে অন্য পক্ষের সঙ্গে এক প্রকার আপসরফা করতে হয়। তারই অংশ হিসেবে গত বছরের ১৮ থেকে ২১ অক্টোবর অনুষ্ঠিত সভায় সিপিবির কেন্দ্রীয় কমিটি এ বছরের মে মাসে দলের ত্রয়োদশ কংগ্রেস অনুষ্ঠিত করার সিদ্ধান্ত নেয় (সর্বশেষ খবর অনুযায়ী, গত ১০-১১ ফেব্রুয়ারি অনুষ্ঠিত কেন্দ্রীয় কমিটির বৈঠকে কংগ্রেসের তারিখ এ বছরের জুলাই মাসে নেওয়া হয়েছে)। আরেকটি সিদ্ধান্তে দলের প্রেসিডিয়াম ও কেন্দ্রীয় কমিটিতে বেশ কয়েকজনকে অন্তর্ভুক্ত করা হয়, যেখানে প্রাধান্য ছিল ওই ‘সংখ্যালঘু’ অংশের।
গঠনতন্ত্র অনুযায়ী, সিপিবির কংগ্রেস হয় চার বছর পরপর। সর্বশেষ কংগ্রেস হয়েছে ২০২২ সালের ফেব্রুয়ারিতে। সেই হিসাবে পরবর্তী কংগ্রেস হওয়ার কথা ২০২৬ সালের ফেব্রুয়ারি বা তার কিছু আগে-পরে। বিগত কংগ্রেসের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী, সিপিবির বর্তমান ৪৮ সদস্যের কেন্দ্রীয় কমিটির ২৭ জন সভাপতি-সাধারণ সম্পাদকের পক্ষে; অন্য পক্ষে ২১ জন। প্রথম পক্ষ চাইলে শুরুতেই অন্য পক্ষ থেকে কয়েকজনকে দলের নীতিনির্ধারণী ফোরাম প্রেসিডিয়াম ও সম্পাদকমণ্ডলীতে স্থান দিতে পারতেন। তা হলে হয়তো দু’পক্ষের বিরোধ এতদূর গড়াত না। সত্য হলো, তারা যতক্ষণ পেরেছেন অন্য পক্ষকে ওই দুই গুরুত্বপূর্ণ ফোরামের বাইরে রেখেছেন। আজকে যখন বিশেষত গণঅভ্যুত্থান-পরবর্তী বাস্তবতায় তা আর পারা যাচ্ছে না, তখন আপাত বিদ্রোহী পক্ষকে আইনত বাধ্যবাধকতা না থাকলেও ওই দুই ফোরামে জায়গা দিতে হয়েছে।
কারণ যাই হোক, এ সিদ্ধান্ত অবশ্যই সাধুবাদযোগ্য। সিপিবির মতো দলের ভাঙন শুধু বামপন্থি মহলেই হতাশা ছড়াবে না; দেশের সামগ্রিক রাজনীতির ভারসাম্যও ক্ষতিগ্রস্ত হবে।
সিপিবির মধ্যে ঐক্য ধরে রাখার প্রয়াস সত্ত্বেও উদীচীর সাম্প্রতিক বিভক্তি কেন ভিন্ন কিছু বলে, তা খতিয়ে দেখা দরকার। রাজনীতি সচেতন মানুষও জানেন, এদেশে কোনো দলের ভাঙন প্রক্রিয়ার শুরু অঙ্গ বা গণসংগঠনে ভাঙনের মধ্য দিয়ে। অর্থাৎ উদীচীর বিভক্তি রোগ নয়, তা রোগের উপসর্গ মাত্র। এটাও মনে রাখা দরকার, ২০২১ সালে সিপিবিরই আরেক গুরুত্বপূর্ণ গণসংগঠন বাংলাদেশ ছাত্র ইউনিয়ন দু’ভাগ হয়েছিল, যা এখনও ঘোচেনি। এখানেও পর্যবেক্ষকরা সিপিবির ওই অভ্যন্তরীণ বিরোধের ছায়া দেখেন। এর আরেকটা কারণ হলো, সিপিবির দু’পক্ষ পরস্পরকে যে ভাষায় আক্রমণ করছে, অনুরূপ বুলি-বচন গণসংগঠনগুলোর পক্ষ-বিপক্ষ গোষ্ঠীগুলোর মধ্যেও চালাচালি হয়। মূল দল বা গণসংগঠন– সর্বত্র এক পক্ষ নিজেকে বলছে বিপ্লবী, অন্য পক্ষকে বলছে আপসকামী। এমনকি অনানুষ্ঠানিক আলোচনায় সিপিবির সংখ্যালঘু অংশ অন্য পক্ষকে আওয়ামী লীগের বিটিম বলতেও কসুর করে না। আবার সংখ্যাগুরু অংশ অপর পক্ষকে বলে বিএনপি-জামায়াতের ঘনিষ্ঠ।
শুধু কি তাই? লক্ষ্য করলে দেখা যাবে, সিপিবি নতুন করে শ্রমিকদের মধ্যে সংগঠন গড়ে তোলার যে উদ্যোগ নিয়েছে, সেখানে দলের কেন্দ্রীয় কমিটির সংখ্যালঘু অংশের প্রাধান্য স্পষ্ট। বিশেষ করে তৈরি পোশাক শ্রমিক এবং ব্যাটারিচালিত রিকশাচালকদের মধ্যে সিপিবির প্রভাব এখন একেবারে কম নয়। এ ইউনিটগুলোতে দলের বর্তমান সভাপতি-সাধারণ সম্পাদকের অনুসারীদের তেমন দেখা যায় না, যতটা দেখা যায় দলের সাবেক একজন সভাপতির অনুসারীদের। বলা হয়ে থাকে, সিপিবির মধ্যে যারা নিজেদের অভ্যুত্থানপন্থি মনে করেন, তাদের নেতৃত্বে আছেন ওই সাবেক সভাপতি। জানা যায়, সিপিবির প্রভাবাধীন বাংলাদেশ কৃষক সমিতিতে ঐতিহ্যগত কারণে অন্য দলের লোক থাকলেও সেখানেও ওই অভ্যুত্থানপন্থিরা প্রভাব বলয় সৃষ্টির চেষ্টা চালাচ্ছেন।
সিপিবির সাধারণ সম্পাদক রুহিন হোসেন প্রিন্স বলেছেন, ‘সিপিবিতে পরিপূর্ণ গণতন্ত্রচর্চা হয়। ফলে নানা বিষয়ে মত-দ্বিমত থাকে। তবে আলাপ-আলোচনা শেষে সংখ্যাগরিষ্ঠ মত গ্রহণ করা হয়।’ (সমকাল, ৩ অক্টোবর, ২০২৪) যে কোনো গণতন্ত্রপ্রিয় ও আশাবাদী মানুষই তাঁর এ বক্তব্যকে স্বাগত জানাবেন। সেই আশার গুড়ে যেন বালি না পড়ে। অবশ্য তা তখনই সম্ভব হবে যখন সিপিবির দু’পক্ষই সিদ্ধান্ত গ্রহণের এ সর্বজনস্বীকৃত গণতান্ত্রিক নীতি মেনে চলবে।
এটি ঠিক, এক সময়ে প্রায় প্রতিটি উপজেলায় শক্তিশালী কার্যক্রম থাকলেও বিশেষত ১৯৯০-এর দশকে বিশ্ব সমাজতান্ত্রিক আন্দোলনে বিপর্যয়ের পাশাপাশি অভ্যন্তরীণ নানা দুর্বলতার কারণে দলটি বড় ধরনের বিপর্যয়ের মুখে পড়ে। তার পর অনেক কাঠখড় পুড়িয়ে দলটি ইতোমধ্যে একটু সোজা হয়ে দাঁড়ালেও ১৯৯০-পূর্ববর্তী সুবর্ণ সময় আর ফিরে পায়নি।
বিদ্যমান কঠিন পরিস্থিতিতে সব উদারমনা মানুষ সিপিবি ও অন্যান্য বামশক্তির দিকেই তাকিয়ে আছে। তাই কে শুদ্ধ, কে অশুদ্ধ– সে প্রশ্ন আপাতত স্থগিত করে সিপিবির উভয় পক্ষ যে কোনো মূল্যে দলকে ঐক্যবদ্ধ রাখবেন এবং ন্যূনতম কর্মসূচির ভিত্তিতে গোটা বাম-উদারনৈতিক শিবিরকে ঐক্যবদ্ধ করে বিশেষত মুক্তিযুদ্ধের অর্জনগুলো রক্ষার লড়াইয়ে নামবেন, এটাই দেয়ালের লিখন। এর অন্যথা হলে ইতিহাস কাউকে ক্ষমা করবে না।
সাইফুর রহমান তপন: সহকারী সম্পাদক, সমকাল; সাবেক ছাত্রনেতা
.উৎস: Samakal
কীওয়ার্ড: ক ন দ র য় কম ট র র ক ন দ র য় কম ট র জন ত স গঠন
এছাড়াও পড়ুন:
জামায়াতের প্রস্তাব কতটা বাস্তবসম্মত
চব্বিশের গণ–অভ্যুত্থানের পর অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে বাংলাদেশে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠিত হয়। এই সরকার গঠনের প্রক্রিয়াটি ছিল বেশ অভিনব। কারণ, তখন দেশে সাংবিধানিক শূন্যতা সৃষ্টি হয়েছিল। রাষ্ট্রযন্ত্রের শীর্ষ পদের মধ্যে একমাত্র কার্যক্ষম ব্যক্তি ছিলেন রাষ্ট্রপতি। বহাল ছিলেন তৎকালীন প্রধান বিচারপতি জনাব ওবায়দুল হাসানের নেতৃত্বাধীন সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ।
তৎকালীন পরিস্থিতিতে রাষ্ট্রপতি একটি অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠন করে তাদের শপথ পাঠ করাতে পারবেন কি না, এই মর্মে বিদ্যমান সংবিধানের ১০৬ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী সুপ্রিম কোর্টের উপদেশমূলক মতামত চান। সুপ্রিম কোর্ট ইতিবাচক মতামত দেন। রাষ্ট্রপতি সুপ্রিম কোর্টের এই উপদেশ গ্রহণ করে বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের শপথ পড়ান।
বিভিন্ন সাংবিধানিক পদধারী যে শপথ গ্রহণ করেন, সেটাও বিদ্যমান সংবিধানের ১৪৮ অনুচ্ছেদের বিধানমতে তৃতীয় তফসিলে বর্ণিত শপথ। যেহেতু বিগত শেখ হাসিনা সরকার ১৫তম সংশোধনীর মাধ্যমে নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা বাতিল করে, কাজেই প্রধান উপদেষ্টাসহ অন্য উপদেষ্টাদের শপথবাক্যও সংবিধান থেকে বাদ দেওয়া হয়।
স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন উঠতে পারে, মুহাম্মদ ইউনূস সরকার তাহলে কোন শপথ পাঠ করলেন? উত্তর হলো, ত্রয়োদশ সংশোধনীর মাধ্যমে সংবিধানে অন্তর্ভুক্ত নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ও অন্য উপদেষ্টারা যে শপথ পাঠ করতেন, বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের উপদেষ্টারা সেই শপথ পাঠ করেন। সুতরাং এই অন্তর্বর্তীকালীন সরকার মূলত বিদ্যমান সাংবিধানিক রীতি মেনে শপথ নিয়েছে।
আবারও প্রশ্ন উঠতে পারে, বিদ্যমান সংবিধানবহির্ভূত শপথ গ্রহণ করার জন্য এই সরকার কি বৈধ না অবৈধ? এ বিষয়ে উভয় দিকেই যুক্তিতর্ক উপস্থাপন করা সম্ভব। এই বিষয়ে আমি সরাসরি উত্তর দেওয়া থেকে বিরত থাকছি।
বাস্তবতা হচ্ছে, একটি ক্রান্তিকালে বর্তমান সরকার দায়িত্ব গ্রহণ করেছে। এমন জরুরি ও ক্রান্তিকালীন পরিস্থিতি থেকে উত্তরণের সাংবিধানিক বিধান আমাদের বিদ্যমান সংবিধানের ১৫০ অনুচ্ছেদ ও চতুর্থ তফসিলে রয়েছে। আমি এর আগে অনেক সাক্ষাৎকারে বিষয়টি বলেছি, লিখেছি।
২০২৪ সালের ৫ আগস্ট থেকে পরবর্তী নির্বাচন পর্যন্ত এই সরকারের সব কার্যক্রম, এমনকি পরবর্তী নির্বাচনের মাধ্যমে সরকার গঠন পর্যন্ত সময়কালের বৈধতা দিতে গেলেও সংবিধান সংশোধনের প্রয়োজন পড়বে। সে ক্ষেত্রে সমাধান হলো বিদ্যমান সংবিধানের ১৫০ অনুচ্ছেদ সংশোধন করে পূর্বাবস্থায় ফিরিয়ে নেওয়া বা অধিকতর সংশোধন করা।
এখন প্রশ্ন হলো, জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের প্রণীত জুলাই সনদ কীভাবে বাস্তবায়ন হবে? আমি আগেই উল্লেখ করেছি, পরবর্তী সংসদ গঠিত হওয়ার পর অবশ্যই সংবিধান সংশোধনের প্রয়োজন পড়বে। আর কিছু না হোক, মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বাধীন সরকারের কার্যক্রমে বৈধতা প্রদানের জন্য হলেও এটি করতে হবে। আমার সুস্পষ্ট মতামত হলো, জুলাই সনদ সংবিধানে অন্তর্ভুক্তকরণ, এর সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতা সৃষ্টিসহ সবকিছুই সেই সংশোধনীর মাধ্যমে করা সম্ভব এবং সেটিই বাস্তবসম্মত হবে।
আরও পড়ুনসংস্কার প্রশ্নে বিএনপি যে ছাড় দিল, অন্যরা কি দিচ্ছে২৯ জুন ২০২৫২.বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর পক্ষ থেকে এখনই একটি বিশেষ অন্তর্বর্তীকালীন সাংবিধানিক আদেশ (আইন) জারি করে জুলাই সনদ বাস্তবায়নের প্রস্তাব করা হয়েছে। এর নাম দেওয়া হয়েছে প্রভিশনাল কনস্টিটিউশনাল অর্ডার ২০২৫।
আমি এই প্রস্তাবটি দেখেছি। এ ধরনের যেকোনো আদেশ প্রণয়নের ক্ষেত্রে এর প্রেক্ষাপট বর্ণনা করতে হয় এবং বাংলায় ‘যেহেতু’ ও ইংরেজিতে ‘হোয়ারএস’ শব্দ দিয়ে শুরু করতে হয়। প্রস্তাবিত আদেশে মোট ৯টি ‘যেহেতু’ ব্যবহার করা হয়েছে। দ্বিতীয় যেহেতুতে উল্লেখ করা হয়েছে, ৫ আগস্ট ২০২৪–এর ঘটনাপ্রবাহে ‘কন্সটিটিউয়েন্ট পাওয়ার’ (গাঠনিক শক্তি) বাংলাদেশের নাগরিকের ওপর হস্তান্তরিত হয়েছে এবং সেই ক্ষমতাবলে জনগণ ক্ষমতার মালিকানা গ্রহণ করেছে।
এই ধরনের ধারণা সৃষ্টি করা বাস্তবতাবর্জিত। কারণ, আগেই বলেছি, একটি সাংবিধানিক প্রক্রিয়ায় বর্তমান সরকার গঠিত হয়েছে ও পরিচালিত হচ্ছে পরবর্তী সংসদ কর্তৃক অনুমোদন সাপেক্ষে। কাজেই এমন ধারণার বশবর্তী হয়ে কোনো আদেশ জারি করা হলে, বর্তমান সরকারের অস্তিত্বই অস্বীকার করা হবে।
প্রস্তাবিত আদেশের মাধ্যমে বিদ্যমান সংবিধানকে ১৯৭২ সালের সংবিধান হিসেবে আখ্যায়িত করে এর অস্তিত্ব অস্বীকার করা হয়েছে এবং পরবর্তী নির্বাচনের মাধ্যমে গঠিত সংসদের তিন–চতুর্থাংশ সংখ্যাগরিষ্ঠতার মাধ্যমে নতুন সংবিধান প্রণয়ন ও গণভোটের মাধ্যমে অনুমোদন করা হবে বলে বলা হয়েছে। তত দিন পর্যন্ত এই আদেশ কার্যকর থাকবে বলে বলা হয়েছে। এই প্রস্তাবনা একেবারেই অগ্রহণযোগ্য।প্রস্তাবিত আদেশের মাধ্যমে বিদ্যমান সংবিধানকে ১৯৭২ সালের সংবিধান হিসেবে আখ্যায়িত করে এর অস্তিত্ব অস্বীকার করা হয়েছে এবং পরবর্তী নির্বাচনের মাধ্যমে গঠিত সংসদের তিন–চতুর্থাংশ সংখ্যাগরিষ্ঠতার মাধ্যমে নতুন সংবিধান প্রণয়ন ও গণভোটের মাধ্যমে অনুমোদন করা হবে বলে বলা হয়েছে। তত দিন পর্যন্ত এই আদেশ কার্যকর থাকবে বলে বলা হয়েছে। এই প্রস্তাবনা একেবারেই অগ্রহণযোগ্য।
তাহলে এত দিন মুহাম্মদ ইউনুসের নেতৃত্বাধীন সরকার যে সাংবিধানিক, প্রশাসনিক, বিচারিক দায়িত্ব পালন করল, সংস্কারের উদ্যোগ নিল, সেগুলো কিসের ভিত্তিতে করল? জামায়াতের প্রস্তাবিত আদেশে বলা হয়েছে, ‘জনগণের সর্বসম্মতি’তে (ওয়াইডস্প্রেড কনসেনসাস) ও জনগণের ‘কন্সটিটিউয়েন্ট পাওয়ার’ বলে এই সরকারের কাজ সম্পাদিত হয়েছে বলে ধরে নিতে হবে।
তাই যদি হবে, তাহলে কেন রাষ্ট্রপতি সংবিধানের ৯৫ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী প্রধান বিচারপতি ও অন্যান্য বিচারপতি, সংবিধানের ১১৮ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী প্রধান নির্বাচন কমিশনারসহ অন্যান্য কমিশনার, সংবিধানের ১২৭ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী মহাহিসাবনিরীক্ষক, সংবিধানের ১৩৮ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী সরকারি কর্ম কমিশনের চেয়ারম্যান ও সদস্য এবং অন্যান্য সাংবিধানিক পদে নিয়োগ দিলেন? রাষ্ট্রপতি যে এত দিন ধরে সংবিধানের ৯৩ অনুচ্ছেদ বলে এত এত অধ্যাদেশ জারি করলেন, আইন প্রণয়ন, সংশোধন ও তার অধীনে বিচারকাজ চলমান রইল, তার কী হবে?
আরও পড়ুনশিবিরের এই সাফল্য জাতীয় নির্বাচনে জামায়াতকে সুবিধা দেবে কি১৬ সেপ্টেম্বর ২০২৫৩.এটা অস্বীকার করার উপায় নেই যে বর্তমান সরকারের কার্যক্রম বিদ্যমান সাংবিধানিক কাঠামোর অধীনে পরিচালিত হচ্ছে এবং এসব কাজের অনুমোদন (র্যাটিফিকেশন) ও ধারাবাহিকতা রক্ষার স্বার্থে বিদ্যমান সংবিধানকে অস্বীকার করার সুযোগ নেই। কিন্তু জামায়াতের প্রস্তাব অনুসারে এই বিশেষ সাংবিধানিক আদেশ জারি করা হলে দেশে ব্যাপক ‘সাংবিধানিক বিশৃঙ্খলা’ সৃষ্টি হবে। সাংবিধানিক পদ ও প্রতিষ্ঠানগুলো অকার্যকর হয়ে পড়বে।
এই প্রস্তাবে বর্ণিত এই আদেশের সঙ্গে অসংগতিপূর্ণ হলে সংবিধান, আইন, আদেশ পুরোপুরি কিংবা এগুলোর অসংগতিপূর্ণ অংশ বাতিল হিসেবে গণ্য হবে মর্মে উল্লেখ করা হয়েছে। প্রকারান্তরে এই প্রস্তাবিত আদেশকে সংবিধানের ওপরে স্থান দেওয়া হয়েছে। এই বিধান আমাদের বিদ্যমান সংবিধানের ২৬ অনুচ্ছেদের অনুকরণে লিখিত।
এ ছাড়া এই আদেশ অমান্য করলে বা চেষ্টা করা হলে সেটা রাষ্ট্রদ্রোহের শামিল হবে বলে উল্লেখ করা হয়েছে। আরও বলা হয়েছে, কোনো আদালত এই আদেশের সঙ্গে অসংগতিপূর্ণ কোনো রায় বা আদেশ দিতে পারবেন না। পরবর্তী নির্বাচনের প্রার্থীকে এটি মেনে চলার জন্য আবশ্যিকভাবে হলফনামা দিতে হবে; এই আদেশের বিরুদ্ধে কোনো প্রচারণা করা যাবে না, এমন বিধানও সন্নিবেশিত করা হয়েছে। জামায়াতের পক্ষ থেকে এমন একটি অবাস্তব ও অকার্যকর আইনি বিধানের প্রস্তাব করা হয়েছে।
৪.প্রভিশনাল কন্সটিটিউশনাল অর্ডার ২০২৫ জারি করবে কে? সহজেই অনুমেয় যে সংবিধানের ৯৩(১) অনুচ্ছেদের দফা ক) এবং খ)–এর বিধানমতে, কোনো অধ্যাদেশ জারির মাধ্যমে সংবিধানের সঙ্গে সাংঘর্ষিক বা সংবিধানের কোনো বিধান পরিবর্তন বা রহিতকরণ হয়ে যায়, এমন বিধান করা যাবে না।
সংবিধানের এই বিধান উপেক্ষা করার জন্য আদেশ জারি করে সেটাকে সংবিধানের ওপরে স্থান দেওয়ার প্রস্তাব করেছে জামায়াত। প্রস্তাবিত আদেশে বলা হয়েছে, অন্তর্বর্তীকালীন সরকার এই আদেশ প্রণয়ন ও জারি করবে এবং ৫ আগস্ট ২০২৪ থেকে এই প্রস্তাবিত আইন কার্যকর হবে।
স্বভাবতই প্রশ্ন ওঠে, অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের বৈধতা যখন বিদ্যমান সংবিধানের ওপরই নির্ভরশীল, তাহলে তারা কীভাবে এমন একটি অযৌক্তিক আদেশ প্রণয়ন করবে?
মো. রুহুল কুদ্দুস সুপ্রিম কোর্টের জ্যেষ্ঠ আইনজীবী ও সাবেক সম্পাদক, সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতি; সদস্য, জাতীয় নির্বাহী কমিটি, বিএনপি।
*মতামত লেখকের নিজস্ব