উড়োজাহাজের টিকিট নিয়ে যাত্রীদের অভিযোগ ছিল অনেক দিন থেকেই। এর পেছনে কতিপয় ট্রাভেল এজেন্সির কারসাজি যেমন ছিল, তেমনি ছিল এয়ারলাইনসগুলোর একশ্রেণির কর্মকর্তার যোগসাজশও। উড়োজাহাজ কোম্পানির সহায়তা ছাড়া ট্রাভেল এজেন্সিগুলো যাত্রীদের কাছ থেকে বাড়তি মুনাফা হাতিয়ে নিতে পারত না। এসব ট্রাভেল এজেন্সি আগেভাগে বিপুল পরিমাণ টিকিট আগাম বুকিং দিয়ে কৃত্রিম সংকট তৈরি করত এবং সাধারণ যাত্রীদের বিপদে ফেলত।  

এই প্রেক্ষাপটে উড়োজাহাজের টিকিটের অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধি প্রতিরোধে বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন মন্ত্রণালয় যে ১০টি নির্দেশনা জারি করেছে, তা সময়োচিত পদক্ষেপ বলে মনে করি। এসব নির্দেশনার মধ্যে আছে অনতিবিলম্বে গ্রুপ-টিকিট বুকিংসহ যেকোনো টিকিট সংরক্ষণের ক্ষেত্রে যাত্রীর নাম, পাসপোর্ট নম্বর এবং পাসপোর্টের ফটোকপি বাধ্যতামূলকভাবে সংযুক্ত করা। বুকিংয়ের তিন দিনের মধ্যে নির্দিষ্ট যাত্রীর নামে টিকিট ইস্যু না হলে ৭২ ঘণ্টা পর স্বয়ংক্রিয়ভাবে তা বাতিল হয়ে যাবে।

নির্দেশনায় আরও বলা হয়, পরিপত্র জারির তারিখ পর্যন্ত গ্রুপ-বুকিংয়ের মাধ্যমে এয়ারলাইনস বা ট্রাভেল এজেন্সি যে টিকিট ব্লক করেছে, সেগুলো আগামী সাত দিনের মধ্যে যাত্রীর নাম, পাসপোর্ট নম্বর, পাসপোর্ট কপিসহ বিক্রি নিশ্চিত করতে হবে। অন্যথায় পরবর্তী তিন দিনের মধ্যে সংশ্লিষ্ট এয়ারলাইনস স্বয়ংক্রিয়ভাবে টিকিট বাতিল করবে। গ্রুপ-বুকিংয়ের ক্ষেত্রে বিক্রির সঙ্গে সঙ্গেই টিকিটের প্রকৃত মূল্য বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন মন্ত্রণালয়কে জানাতে হবে এবং তা ওয়েবসাইটে প্রকাশ করা হবে। কোনো এয়ারলাইনস কিংবা ট্রাভেল এজেন্সি বেবিচকের অনুমোদিত ভাড়ার বাইরে অতিরিক্ত দামে টিকিট বিক্রি করতে পারবে না বলেও পরিপত্রে জানানো হয়।  

সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, মধ্যপ্রাচ্যের এয়ারলাইনস ব্যবসায়ী ও দেশীয় কিছু ট্রাভেল এজেন্সির মধ্যে প্রভাবশালী এক সিন্ডিকেট তৈরি হয়েছে। তারা বিভিন্ন এজেন্সির চাহিদা না থাকা সত্ত্বেও যাত্রীদের কোনো ধরনের পাসপোর্ট, ভিসা ও ভ্রমণ নথিপত্র ছাড়াই শুধু ই-মেইলের মাধ্যমে কিছু এয়ারলাইনসের বিভিন্ন রুটের গ্রুপ সিট বুক করে থাকে। তারা এয়ারলাইনসগুলোর টিকিট আগাম ব্লক করে নিজেদের জিম্মায় রেখে পরে ইচ্ছেমতো দাম বাড়ায়। ফলে বিদেশগামী বিমানের যাত্রীদের স্বাভাবিক ভাড়ার তিন গুণ পর্যন্ত বেশি টাকা দিয়ে টিকিট কিনতে হতো। এই সিন্ডিকেটের কারণে ৬০ থেকে ৭০ হাজার টাকার টিকিট যাত্রীদের কিনতে হয়েছে দেড় লাখ কিংবা তারও বেশি টাকা দিয়ে। গুচ্ছ টিকিট বুকিং বন্ধ হলে যাত্রীরা অহেতুক হয়রানি ও বাড়তি খরচ থেকে রেহাই পাবেন বলে আশা করা যায়। 

তবে আমরা মনে করি, বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন মন্ত্রণালয়কে নির্দেশনা দিয়েই চুপচাপ বসে থাকলে হবে না। নির্দেশনাগুলো বাস্তবায়ন হচ্ছে কি না, সেটাও তদারক করতে হবে। এর পাশাপাশি বিভিন্ন এয়ারলাইনসের সঙ্গে যেসব ট্রাভেল এজেন্সি অসাধু উপায়ে এত দিন ব্যবসা করে আসছে, তাদের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নেওয়া জরুরি বলে মনে করি। উড়োজাহাজের টিকিট বেচাকেনার ক্ষেত্রে দুষ্টচক্রের আঁতাত ভেঙে দিতে হবে। এ ক্ষেত্রে ট্রাভেল এজেন্সিগুলোর সংগঠন অ্যাটাবও ইতিবাচক ভূমিকা নিতে পারে। তাদের কোনো সদস্য যাতে বেআইনিভাবে গুচ্ছ টিকিট বুকিং করে কৃত্রিম সংকট তৈরি করতে না পারে, সে বিষয়েও সতর্ক থাকতে হবে। যেকোনো আইন বা নির্দেশনা তখনই সুফল দেয়, যখন আইন অমান্যকারীদের শাস্তি নিশ্চিত করা যায়। 

.

উৎস: Prothomalo

এছাড়াও পড়ুন:

ভাঙা বেড়িবাঁধ, আমন নিয়ে দুশ্চিন্তায় মাতারবাড়ীর চাষিরা

চলতি মৌসুমে আমন চাষ করার জন্য এক ব্যক্তির এক একর জমি ১৮ হাজার টাকায় ইজারা নেন কক্সবাজারের মহেশখালীর সাগর উপকূলীয় মাতারবাড়ী ইউনিয়নের নয়াপাড়ার কৃষক জাকের হোছাইন। এই মাসের শেষের দিকে আমন চাষ শুরু করার কথা তাঁর। তবে সাগরে বিলীন হওয়া বেড়িবাঁধের ভাঙা অংশ দিয়ে বর্ষায় ফসলি জমিতে পানি ঢুকে পড়ার শঙ্কায় আমনের চাষাবাদ অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে। কেবল জাকের হোছাইন নন, তাঁর মতো একইভাবে আমনের চাষাবাদ নিয়ে দুশ্চিন্তায় রয়েছেন মাতারবাড়ী ইউনিয়নের অন্তত ২০০ চাষি।

কুহেলিয়া নদীর পশ্চিমে আর বঙ্গোপসাগরের পূর্বে জেগে ওঠা প্রায় ১২ বর্গকিলোমিটার চর নিয়ে মহেশখালীর মাতারবাড়ী ইউনিয়ন। এর পশ্চিম পাশে রয়েছে আট কিলোমিটার বেড়িবাঁধ, যার মধ্যে প্রায় এক কিলোমিটার ভাঙা অবস্থায় পড়ে রয়েছে এক দশক ধরে। ওই অংশ দিয়ে আশপাশের লোকালয় ও ফসলি জমিতে পানি ঢুকে পড়া ঠেকাতে সর্বশেষ চার বছর আগে বসানো হয়েছিল জিও টিউব। তবে গত ২৯ ও ৩০ মে নিম্নচাপের প্রভাবে সাগরের উত্তাল ঢেউয়ে জিও টিউব বিলীন হয়ে গেছে। এ অবস্থায় বেড়িবাঁধের ওই ভাঙা অংশ দিয়ে লোকালয় ও ফসলি জমিতে পানি ঢুকে পড়ার শঙ্কা দেখা দিয়েছে।

সম্প্রতি তিন দফায় লোকালয়ে পানি ঢুকে পড়েছে। এতে ভেঙে গেছে অন্তত ১০টি কাঁচা বসতঘর। স্থানীয় মানুষের চোখে ঘুম নেই। চাষিরাও আমন ধানের চাষাবাদ আদৌ করতে পারবেন কি না, তা নিয়ে উৎকণ্ঠায় রয়েছেন।সরওয়ার কামাল, সদস্য, মাতারবাড়ী ইউনিয়ন পরিষদ

বেড়িবাঁধের ক্ষতিগ্রস্ত অংশটি ইউনিয়নের ষাইটপাড়া এলাকায়। গত শনিবার সকালে সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, ভাঙা বেড়িবাঁধের পাশে বসানো জিও টিউব সাগরে বিলীন হয়ে গেছে। সাগরের পানি ঢেউয়ের সঙ্গে বেড়িবাঁধের ভাঙা অংশ উপচে পাশের ফসলি জমিতে ঢুকে পড়ছে। সেখানে স্থানীয় মাঝের ডেইল এলাকার বাসিন্দা আবদুল কাদেরের সঙ্গে কথা হয়। তিনি জানান, বেড়িবাঁধের জিও টিউব বিলীন হওয়ার দুই সপ্তাহ পার হয়ে গেলেও কোনো ব্যবস্থা না নেওয়ায় স্থানীয় বাসিন্দারা খুবই উৎকণ্ঠার মধ্যে দিন কাটাচ্ছেন। আমনচাষিরা চাষাবাদ করতে পারবেন কি না তা অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে। মানুষ তাঁদের ঘরবাড়ি প্লাবিত হয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার শঙ্কায় রয়েছেন। জরুরি ভিত্তিতে ক্ষতিগ্রস্ত বাঁধ সংস্কার করা উচিত।

মাতারবাড়ী ইউনিয়নে দায়িত্বরত উপসহকারী কৃষি কর্মকর্তা নুরুল হোছাইন মোহাম্মদ তৈয়ব প্রথম আলোকে বলেন, ভাঙা বেড়িবাঁধের কারণে ষাইটপাড়াসহ আশপাশের চারটি গ্রামে জলাবদ্ধতার শঙ্কা রয়েছে। এ কারণে এসব এলাকার অন্তত ৮০ একর জমিতে আমন চাষাবাদ অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে।

স্থানীয় মাতারবাড়ী ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) সদস্য সরওয়ার কামাল প্রথম আলোকে বলেন, ‘সম্প্রতি তিন দফায় লোকালয়ে পানি ঢুকে পড়েছে। এতে ভেঙে গেছে অন্তত ১০টি কাঁচা বসতঘর। স্থানীয় মানুষের চোখে ঘুম নেই। চাষিরাও আমন ধানের চাষাবাদ আদৌ করতে পারবেন কি না, তা নিয়ে উৎকণ্ঠায় রয়েছেন।’ ইউপি সদস্য সরওয়ার কামাল আরও বলেন, প্রতিবছর বর্ষা মৌসুম এলেই এলাকার মানুষের উদ্বেগ বাড়ে। অথচ ভাঙা বেড়িবাঁধ সংস্কারের কার্যকর কোনো উদ্যোগ নিচ্ছে না পানি উন্নয়ন বোর্ড।

মহেশখালীর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মো. হেদায়েত উল্যাহ প্রথম আলোকে বলেন, জরুরি ভিত্তিতে বেড়িবাঁধ সংস্কারের জন্য পানি উন্নয়ন বোর্ডকে বলা হয়েছে। জানতে চাইলে পানি উন্নয়ন বোর্ডের কক্সবাজারের নির্বাহী প্রকৌশলী মো. নুরুল ইসলাম বলেন, সম্প্রতি নিম্নচাপের প্রভাবে মহেশখালী ও কুতুবদিয়ায় অন্তত ১ হাজার ৬০০ মিটারের বেড়িবাঁধ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। আপাতত বর্ষা মৌসুমে জোয়ারের পানি টেকানোর জন্য ভাঙা বেড়িবাঁধের ওপর জিও টিউব বসানোর সিদ্ধান্ত হয়েছে। শিগগিরই কাজ শুরু হবে।

পানি উন্নয়ন বোর্ডের কক্সবাজারের উপবিভাগীয় প্রকৌশলী মো. জামাল মুর্শিদ প্রথম আলোকে বলেন, মাতারবাড়ী ও ধলঘাট ইউনিয়নে স্থায়ী বাঁধের জন্য প্রায় ৩ হাজার ৮২৫ কোটি টাকার একটি প্রকল্প হাতে নেওয়া হয়েছে। প্রকল্পের আওতায় চারপাশে ১৭ দশমিক ৯ কিলোমিটার সুপার ডাইকের আদলে স্থায়ী বেড়িবাঁধ ও ৭টি স্লুইসগেট নির্মাণ করা হবে। এ ছাড়া খনন করা হবে সাড়ে ১৯ কিলোমিটার কুহেলিয়া নদী। গত এপ্রিলে প্রকল্প প্রস্তাবনা ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের কাছে পাঠানো হয়েছে।

সম্পর্কিত নিবন্ধ