Prothomalo:
2025-08-02@06:44:57 GMT

একুশের মুখোমুখি আমরা

Published: 21st, February 2025 GMT

প্রতিবছরের মতো আবার আমাদের মুখোমুখি একুশে ফেব্রুয়ারি; অথবা বলা যায়, একুশে ফেব্রুয়ারির মুখোমুখি আমরা। বাংলা ভাষার অধিকার প্রতিষ্ঠার স্মারক একুশে ফেব্রুয়ারি—এই কথার মধ্যে একটা কূটাভাস বা আপাতবিরোধ আছে। তার পেছনে যে প্রশ্ন, স্মারকটি ৮ ফাল্গুন নয় কেন? এ প্রসঙ্গে বলা যায়, বাংলাদেশ এমনকি বৃহত্তর ভারতবর্ষে বা এশিয়া-আফ্রিকার বহু দেশে খ্রিষ্টীয় সালটি অধিকতর ব্যবহৃত ও পরিচিত। ফলে চেয়ার, টেবিল, মিনিট, মাইলের মতো জানুয়ারি, ফেব্রুয়ারি ইত্যাদি বাংলায় আত্তীকৃত হয়ে গেছে। ভাষা ও সংস্কৃতির রূপ-রূপান্তরের ক্ষেত্রে এটিই স্বাভাবিক। জাতীয়তাবোধে উজ্জীবিত বাঙালি যে একই সঙ্গে আন্তর্জাতিক, একুশে ফেব্রুয়ারি পালন তার উজ্জ্বল উদাহরণ।

দেশভাগের পর পাকিস্তানের অধিবাসীদের মধ্যে উর্দুভাষীর সংখ্যা ছিল ৩ শতাংশের কম। বাংলা, পাঞ্জাবি, সিন্ধি, এমনকি বেলুচি ও পাখতুনভাষীও তার চেয়ে বেশি ছিল। মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ উর্দুকে ‘অনলি স্টেট ল্যাঙ্গুয়েজ’ ঘোষণা করেছিলেন ইংরেজি ভাষায় প্রদত্ত ভাষণে। পাকিস্তানের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী লিয়াকত আলী খানের মতো ভারতত্যাগী মোহাজির বা খাজা নাজিমউদ্দিনের মতো জনবিচ্ছিন্ন তথাকথিত নবাবরাই পাকিস্তানের শাসকদের মধ্যে উর্দুতে কথা বলতেন। তবু সেদিনের বাঙালি বাংলা ভাষার প্রতিষ্ঠা চেয়েছিল পাকিস্তানের ‘অন্যতম রাষ্ট্রভাষা’ হিসেবে; একমাত্র রাষ্ট্রভাষা হিসেবে নয়। তাই একুশে উৎসারিত যে বাঙালি জাতীয়তাবাদ, তা অন্য জাতি বা জাতীয়তাবাদের বিরোধী কোনো উগ্র জাত্যভিমান নয়; বরং উদার গণতান্ত্রিক জাতীয়তাবাদ।

সম্প্রতি ‘বৈষম্য’ কথাটি বাংলাদেশের রাজনৈতিক জীবনে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ শব্দ হিসেবে উচ্চারিত হচ্ছে। বায়ান্নর ভাষা আন্দোলন, ছেষট্টির স্বায়ত্তশাসনের দাবি, উনসত্তরের গণ-অভ্যুত্থান, ১৯৭১ সালের রক্তক্ষয়ী স্বাধীনতাযুদ্ধ—সবই প্রকৃতপক্ষে বৈষম্যের বিরুদ্ধে গণ-প্রতিরোধ। বায়ান্নর ভাষা আন্দোলন বাংলা ভাষার প্রতি বৈষম্যের বিরুদ্ধে, ছেষট্টির আন্দোলন পূর্ব বাংলার প্রতি পাকিস্তানি শাসকদের বৈষম্যের বিরুদ্ধে, উনসত্তরের গণ-অভ্যুত্থান রাজনৈতিক জীবনে বাঙালিদের দাবিয়ে রাখার বিরুদ্ধে জনরায় বললে ভুল হয় না। ১৯৭১-এর অসহযোগ আন্দোলন এবং সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধ এই বৈষম্যের বিরুদ্ধেই পরিচালিত হয়েছিল। পরাস্ত করেছিল আত্মগর্বী শক্তিশালী পাকিস্তানি বাহিনীকে। তাই ২০২৪ সালের বৈষম্যবিরোধী ছাত্র–জনতার গণ-অভ্যুত্থান পূর্ব বাংলা ও বাংলাদেশের সব গণ-আন্দোলনের থেকে বিচ্ছিন্ন কিছু নয়।

আগস্ট ২০২৪-এর পর আমরা এখন আরও অর্ধবছর পেরিয়ে গেছি। এই আন্দোলন সম্পর্কে বহু তথ্য ও তত্ত্ব এখন পরিচিত। এতে অংশ নিয়েছিল বিপুলসংখ্যক রাজনৈতিক ও সামাজিক শক্তি, যাদের মতাদর্শ এক নয়; বরং কোনো কোনো ক্ষেত্রে পরস্পরবিরোধী। তাদের ঐক্যের ভিত্তি ছিল বৈষম্যের অবসান। জীবনযাপনের ক্ষেত্রে এই বৈষম্য সৃষ্টি হয়েছিল দুর্নীতি ও অন্যান্য অনাচারের মাধ্যমে একদল মানুষের বিপুল পরিমাণ সম্পদ কুক্ষিগত ও ভোগ-বিলাস করার ফলে। সামাজিক জীবনে একদল মানুষের প্রতিপত্তি ও নিপীড়ন অন্যদের বৈষম্যের শিকারে পরিণত করেছিল। এই প্রতিপত্তিশালীদের মধ্যে রাজনৈতিক কুশীলবদের সঙ্গে সমান মাত্রায়, এমনকি কখনো অধিক মাত্রায় ক্ষমতাবান হয়েছিল একদল সামরিক বেসামরিক আমলা ও ব্যবসায়ী। পরিণতিতে সাধারণ মানুষ ক্ষিপ্ত হয়েছিল এবং একটি বৈষম্যহীন সমাজ কামনা করেছিল।

বাংলাদেশের বর্তমান রাজনৈতিক জীবনে ‘বৈষম্য’-এর পরে জনপ্রিয় শব্দ ‘সংস্কার’। সম্প্রতি সরকার পরিবর্তনের পর অনেকে প্রথমে বাংলাদেশের সংবিধান, রাষ্ট্রনীতি, মুক্তিযুদ্ধের পরম্পরা, নির্বাচন ব্যবস্থা সবটাই নাকচ করার পক্ষে বলেছিলেন। পরে আবার তা সংস্কারের পথে গেছে। প্রকৃতপক্ষে ১৯৭২-এর সংবিধানের আলোকে বাংলাদেশে রাষ্ট্রীয়ভাবে বৈষম্য সৃষ্টির কোনো সুযোগ নেই; সংকট সৃষ্টি হয়েছে তা মান্য না করা বা তার অপপ্রয়োগের ফলে। বাংলাদেশের সংবিধানে বলা হয়েছে: ১৯.

(১) সকল নাগরিকের জন্য সুযোগের সমতা নিশ্চিত করিতে রাষ্ট্র সচেষ্ট হইবেন। (২) মানুষে মানুষে সামাজিক ও অর্থনৈতিক অসাম্য বিলোপ করিবার জন্য, নাগরিকদের মধ্যে সম্পদের সুষম বণ্টন নিশ্চিত করিবার জন্য এবং প্রজাতন্ত্রের সর্বত্র অর্থনৈতিক উন্নয়নের সমান স্তর অর্জনের উদ্দেশ্যে সুষম সুযোগ-সুবিধাদান নিশ্চিত করিবার জন্য রাষ্ট্র কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করিবেন। ২০. (২) রাষ্ট্র এমন অবস্থা সৃষ্টির চেষ্টা করিবেন, যেখানে সাধারণ নীতি হিসাবে কোনো ব্যক্তি অনুপার্জিত আয় ভোগ করিতে সমর্থ হইবেন না। ২৭. সকল নাগরিক আইনের দৃষ্টিতে সমান এবং আইনের সমান আশ্রয়লাভের অধিকারী।

সংবিধানের এসব ধারা-উপধারা থেকে স্পষ্ট যে গত অর্ধশতকে বাংলাদেশের রাষ্ট্রব্যবস্থায় কর্তৃত্ব করতে গিয়ে যাঁরাই ‘বৈষম্য’ করেছেন, তাঁরা সবাই ’৭২-এর সংবিধান লঙ্ঘন করেছেন।

বাংলাদেশে বর্তমান সরকার দায়িত্ব গ্রহণের পর অনেক ক্ষেত্রে বৈষম্য নিরোধ এবং সংস্কারের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। দুঃখের বিষয়, শিক্ষা ও শিক্ষার ভাষানীতি সংস্কারের কোনো প্রয়াস আমাদের চোখে পড়েনি। এখানেই একুশের চেতনার সঙ্গে আমাদের বোঝাপড়ার প্রশ্নটি সামনে আসে।

একুশের মূলকথা ছিল সর্বস্তরে বাংলা ভাষার প্রচলন। নিঃসন্দেহে এর প্রধান জায়গাটি হচ্ছে শিক্ষা। আমরা কি বাংলাদেশের সর্বস্তরের শিক্ষা মাতৃভাষায় প্রদান করতে পারছি? এর স্পষ্ট উত্তর, না। বাংলাদেশে বর্তমানে প্রাথমিক ও উচ্চমাধ্যমিক স্তরে তিন ধরনের শিক্ষাদান প্রচলিত রয়েছে। সরকারি প্রাথমিক, মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানসমূহে মূলত বাংলায় পাঠদান করা হয়। এসব প্রতিষ্ঠানে অধিকাংশ ক্ষেত্রেই পাঠদান দুর্বল, শিক্ষকদের দক্ষতা ও নৈতিকতা প্রশ্নবিদ্ধ এবং শ্রেণিকক্ষসহ শিক্ষা উপকরণ অপর্যাপ্ত। এর বিপরীতে বড়-ছোট নগরগুলোতে রয়েছে উন্নত মানের স্কুল, যেখানে ইংরেজিতে পাঠদান করা হয়। এখানে আর্থিক সংগতিসম্পন্ন পরিবারের ছেলেমেয়েরা পড়ে। এদের অধিকাংশ প্রতিষ্ঠানেই শিক্ষকেরা দক্ষ এবং পরিশ্রমী, শিক্ষার্থীরাও মানসম্পন্ন। তবে এ ধরনের মডেলের অনুকরণে শহরতলি ও মফস্‌সলে গড়ে উঠেছে কিছু ‘কিন্ডার গার্ডেন’, যেখানে ইংরেজিতে পাঠদান করা হলেও যোগ্য শিক্ষক, এমনকি যথাযথ শ্রেণিকক্ষ পর্যন্ত নেই। ফলে এ ধরনের প্রতিষ্ঠানে পড়ুয়ারা—বাংলা বা ইংরেজি মাধ্যমে—কোনো পাঠদানেই উপকৃত হচ্ছে না।

অন্য একটি ধারায় রয়েছে মূলত আরবি ভাষার পুস্তকনির্ভর মাদ্রাসা। তৎকালীন ভারতবর্ষে কলকাতা মাদ্রাসাসহ বিভিন্ন মাদ্রাসা স্থাপন করা হয়েছিল মুসলমান সম্প্রদায়কে আধুনিক শিক্ষার সঙ্গে যুক্ত করার জন্য। পাশাপাশি এসব মাদ্রাসায় ইংরেজরা সে সময় ফারসি ভাষায় প্রচলিত ভারতীয় আইন-কানুন ও অন্যান্য বিষয়ে শিক্ষা নিত। ফলে তৎকালীন মাদ্রাসাগুলোর শিক্ষা, ভবন, পাঠক্রম, উপকরণ—সবই ছিল অত্যন্ত উন্নত মানের। কিন্তু পরবর্তী সময়ে অনেক মাদ্রাসাই যে ঐতিহ্য ধরে রাখতে পারেনি। বর্তমানে বাংলাদেশের মাদ্রাসাগুলোর মধ্যেও নানা ধারার শিক্ষাদানের পদ্ধতি প্রচলিত রয়েছে। সরকারি পৃষ্ঠপোষণার মাদ্রাসাগুলোতে ভবন ইত্যাদির সুবিধা থাকলেও শিক্ষক ও শিক্ষাদানের অবস্থা অনেক সময় সরকারি স্কুলগুলোর মতোই। বেসরকারি মাদ্রাসাগুলোর আর্থিক ভিত্তি অনেকটা স্বয়ংসম্পূর্ণ। তবে সেখানকার পাঠক্রম ও পাঠদান এবং পাঠাতিরেক শিক্ষা বাইরের মানুষের কাছে অস্পষ্ট। তার চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে মাদ্রাসাগুলোয় মাতৃভাষায় শিক্ষাদানের ক্ষেত্রে দক্ষ শিক্ষকের অভাব ও অনীহা।

২১ ফেব্রুয়ারিকে ‘আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস’ ঘোষণার ফলে আমাদের ওপর আরও একটি নতুন দায়িত্ব অর্পিত হয়েছে। মাতৃভাষা বাংলার সঙ্গে বাংলাদেশের আদিবাসীদের মাতৃভাষার স্বীকৃতিদান এবং সম্ভবমতো সেসব ভাষায় শিক্ষাদানের ব্যবস্থা করা।

উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোয় মাতৃভাষায় শিক্ষাদানের চিত্র আরও নাজুক। গত শতকের ষাটের দশকে এবং বাংলাদেশের স্বাধীনতা–পরবর্তীকালে বিশ্ববিদ্যালয় স্তরে বাংলা ভাষায় শিক্ষাদানের যে উৎসাহ, উদ্যোগ ও প্রয়োগ দেখা গিয়েছিল, গত চার দশকে তা প্রায় বিলুপ্তির পথে। প্রধানত বাংলা ভাষায় বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে পাঠ্যপুস্তকের অভাবের কথা সামনে এনে তাঁরা মাতৃভাষায় শিক্ষাদানের থেকে সরে গেছেন। অথচ চীন, জাপান বা কোরিয়া মাতৃভাষাতেই উচ্চতর বিজ্ঞান, প্রকৌশল, চিকিৎসাবিদ্যা ইত্যাদি পড়াচ্ছে। আমাদের অতীতেও এ ধরনের উদাহরণ বিরল নয়। উচ্চতর শিক্ষায় হালনাগাদ জ্ঞানসম্পন্ন পাঠ্যপুস্তক রচনার জন্য প্রয়োজন বিশ্বের অন্য কোনো প্রধান ভাষায় রচিত পাঠ্যপুস্তক আত্মস্থ করা এবং তা মাতৃভাষায় সুচারুরূপে উপস্থাপন করা। এর জন্য অপরিহার্য মাতৃভাষা বাংলা ভাষার ওপর দখল, ইংরেজি বা অন্য কোনো বিদেশি ভাষাদক্ষতার সঙ্গে রপ্ত করা এবং সঙ্গে নিষ্ঠা ও পরিশ্রম। তাহলেই বাংলা ভাষায় উচ্চতর পাঠ্যপুস্তক রচনা সম্ভব।

সর্বস্তরে বাংলা ভাষা প্রচলনে আরেকটি বড় প্রতিবন্ধকতা আমাদের মানসিকতা। ১৯৬০-৭০-এর দশকে আমাদের সমাজ বাংলা ভাষার প্রচলনে যে দৃঢ়তা ও আন্তরিকতা দেখিয়েছিল, তার মধ্যে বর্তমানে ভাটার টান স্পষ্ট। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শতবর্ষ উপলক্ষে যে প্রদর্শনী হয়েছিল, তাতে বাংলা বিভাগ ছাড়া আর কোনো বিভাগ বা ইনস্টিটিউটের নামফলক বাংলা ভাষায় লেখা হয়নি, এমন শুনেছি। দৈনন্দিন জীবনে অথবা ছোটখাটো পত্রবিনিময়ে দুজন বাঙালি অন্য ভাষা ব্যবহার করছে, এমন হীনম্মন্য আচরণের উদাহরণ সুখকর নয়। সেনানিবাসগুলোয় অথবা পুলিশ লাইনে যদি সব চিহ্ন ও নির্দেশ বাংলায় লেখা যায়, গাড়ির নম্বর যদি বাংলায় লেখা যায়, তাহলে অন্যত্র এর ব্যবহার অসম্ভব হওয়ার কোনো কারণ নেই। বাংলা ভাষা সব বিবেচনাতেই বিশ্বের একটি শ্রেষ্ঠ ভাষা এবং উচ্চতর বিজ্ঞানচর্চা থেকে শুরু করে দৈনন্দিন জীবনের সবকিছুই বাংলা ভাষায় করা সম্ভব।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সামনে উত্তাল ছাত্র–জনতা, ২১ ফেব্রুয়ারি ১৯৫২

উৎস: Prothomalo

কীওয়ার্ড: র জন ত ক ব যবস থ আম দ র র জন য হয় ছ ল ক জ বন কর ছ ল ধরন র সরক র

এছাড়াও পড়ুন:

চাঁদাবাজ রিয়াদের তাণ্ডবে অতিষ্ঠ মিশনপাড়া

নারায়ণগঞ্জ শহরের প্রাণকেন্দ্র মিশনপাড়ায় চাঁদাবাজি, দখলবাজি, হুমকি ও হয়রানিমূলক মামলার ভয়ঙ্কর এক চক্রের বিরুদ্ধে ফুঁসে উঠেছেন সাধারণ মানুষ।

স্থানীয়দের ভাষ্য অনুযায়ী, রিয়াদ  দীর্ঘদিন ধরেই এলাকার বাসিন্দাদের ওপর নির্যাতন চালিয়ে যাচ্ছেন। নির্মাণকাজ থেকে শুরু করে দোকান বসানো পর্যন্ত সবকিছুতেই চাঁদা দাবি করেন তিনি ও তাঁর অনুসারীরা।

চাঁদা না দিলে থেমে যায় কাজ, চলে হামলা, পরে দেওয়া হয় সাজানো মামলা। অথচ তাঁর বিরুদ্ধে একাধিক মামলা ও গ্রেপ্তারি পরোয়ানা থাকা সত্ত্বেও প্রশাসন রয়েছে রহস্যজনকভাবে নীরব।

স্থানীয়রা বলছেন, রিয়াদ নিজে কোনো রাজনৈতিক আদর্শের লোক না হলেও, একাধিক প্রভাবশালী রাজনৈতিক নেতার সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক গড়ে তুলে এবং মোটা অঙ্কের টাকা দিয়ে তাঁদের ব্যবহার করেন নিজের স্বার্থে।

রাজনৈতিক ছত্রচ্ছায়ায় রিয়াদ এতটাই দাপটের সঙ্গে চলাফেরা করেন যে, থানায় একাধিক অভিযোগের পরও তাঁর বিরুদ্ধে কার্যকর কোনো পদক্ষেপ নেওয়া হয়নি।

বিশ্বস্ত সূত্রে জানা গেছে, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে শিক্ষার্থী হত্যার ঘটনায় দায়ের হওয়া মামলার অন্যতম আসামিও এই রিয়াদ। সেইসঙ্গে নারায়ণগঞ্জ সদর মডেল থানায় তাঁর নামে একাধিক চাঁদাবাজি ও সন্ত্রাসী কার্যক্রমের মামলা রয়েছে।

এমনকি তাঁর নামে গ্রেপ্তারি পরোয়ানাও জারি হয়েছে বলে জানা যায়। কিন্তু তারপরও তিনি দিব্যি এলাকায় ঘুরে বেড়াচ্ছেন, আদায় করে চলেছেন চাঁদা, দখল করে নিচ্ছেন জমি, দোকান।

মিশনপাড়ায় বর্তমানে যেসব ভবন নির্মাণাধীন রয়েছে, তার মধ্যে প্রায় প্রতিটির কাজেই বাধা দেওয়া হয়েছে রিয়াদের পক্ষ থেকে এমন অভিযোগ করেছেন একাধিক ভুক্তভোগী। নাম প্রকাশ না করার শর্তে এক বাড়ির মালিক বলেন, “আমরা পরিবার নিয়ে এখানে থাকি।

নিজের পৈতৃক জমিতে ভবন নির্মাণ করছি। হঠাৎ একদিন ৪-৫ জন যুবক এসে জানায়, বসের অনুমতি ছাড়া কাজ হবে না। পরে রিয়াদ নিজেই ফোন করে ৫ লাখ টাকা দাবি করে। না দিলে মালামাল ফেলে দেওয়া, শ্রমিকদের মারধরের হুমকি দেয়।”

এই অভিজ্ঞতা শুধু একজনের নয়। অন্তত ৮-১০ জন ভবন মালিক এবং কয়েকজন ঠিকাদার একই ধরনের ভোগান্তির কথা জানিয়েছেন। তাঁদের ভাষ্য, রিয়াদের নেতৃত্বে একটি সংঘবদ্ধ চক্র নিয়মিতভাবে ১ থেকে ১০ লাখ টাকা পর্যন্ত চাঁদা দাবি করে। কেউ না মানলে থেমে যায় কাজ, চলে হামলা-মামলা আর হয়রানির স্বীকারে।

মিশনপাড়ার বাসিন্দারা অভিযোগ করেন, রিয়াদ এলাকায় একটি ভয়ঙ্কর ‘মিনি মাফিয়া নেটওয়ার্ক’ গড়ে তুলেছেন। ভবন নির্মাণ, দোকান বসানো, এমনকি ফুটপাতে ব্যবসা করতেও তাঁকে চাঁদা দিতে হয়। অন্যথায় চলতে থাকে ভয় দেখানো, ভাঙচুর, এমনকি জীবননাশের হুমকি। অনেকেই বলেন, তাঁরা যেন জিম্মি হয়ে পড়েছেন রিয়াদ ও তাঁর চক্রের হাতে।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক ভুক্তভোগী বলেন, “আমার পৈতৃক জমিতে ভবন করতে গিয়ে বিপদে পড়েছি। ৫ লাখ টাকা চাঁদা দাবি করেছে। না দিলে শ্রমিকদের মারধর করবে বলে হুমকি দিয়েছে। থানায় গিয়ে অভিযোগ করলাম, কিন্তু কিছুই হয়নি। বরং রিয়াদ খবর পেয়ে হুমকি দিয়ে চাঁদার পরিমান বাড়িয়ে দিচ্ছে।”

একজন ঠিকাদার বলেন, “ভবন নির্মাণ করতে গিয়ে আমাদের এখন বেশি খরচ হয় রিয়াদকে সামলাতে। কোনো আইন-শৃঙ্খলা নেই। যে যেখানে ইচ্ছা চাঁদা চাচ্ছে, না দিলে মামলা, মারধর। কোথাও নালিশ করতে পারি না, বরং নালিশ করলেই বিপদ আরও বাড়ে।”

আরেকজন ঠিকাদার বলেন, “রিয়াদ এখন এলাকাবাসীর গলার কাঁটা। কাজ শুরু করলেই তার লোকজন এসে বলে, বসের অনুমতি লাগবে। চাঁদা না দিলে মালামাল উধাও, শ্রমিক পালায়, পরে থানায় গিয়ে দেখি আমার নামে নাকি মারামারির মামলা!”

ভুক্তভোগীরা জানান, শুধু ভীতি ও চাঁদাবাজি নয়, রিয়াদ ও তাঁর সহযোগীরা একটি সংঘবদ্ধ আইনি হয়রানির চক্রও তৈরি করেছেন। কেউ তাঁদের বিরুদ্ধে মুখ খুললে বা চাঁদা দিতে অস্বীকৃতি জানালে উল্টো তাঁদের বিরুদ্ধে সাজানো মামলা দিয়ে হয়রানি করা হয়। পরবর্তীতে সেই মামলা আপোষে নিষ্পত্তির জন্য আবারও দাবি করা হয় মোটা অঙ্কের টাকা।

এলাকাবাসীর অভিযোগ, রিয়াদের এতোসব অপরাধ কর্মকাণ্ড সত্ত্বেও প্রশাসনের পক্ষ থেকে কোনো দৃশ্যমান ব্যবস্থা না নেওয়ায় মানুষের মনে প্রশ্নের জন্ম নিয়েছে, কেন এই নীরবতা? তাঁর নামে একাধিক মামলা ও ওয়ারেন্ট থাকার পরও কীভাবে তিনি খোলা হাওয়ায় ঘুরে বেড়ান? পুলিশ কি ইচ্ছাকৃতভাবে তাঁকে আড়াল করছে?

এ বিষয়ে নারায়ণগঞ্জ সদর মডেল থানার এক কর্মকর্তার সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, “আমরা অভিযোগ পেয়েছি। বিষয়টি তদন্তাধীন। অপরাধী হলে আইন অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়া হবে।”
তবে এলাকাবাসীর দাবি ভিন্ন।

তাঁরা বলছেন, শুধু অভিযোগ নয়, ভিডিও প্রমাণ, অডিও ক্লিপস, এমনকি লিখিত অভিযোগ দিয়েও প্রতিকার পাননি তাঁরা। বরং অভিযোগ জানানোর পর হুমকির মাত্রা বেড়ে যায়। অনেকে ভয়ে এলাকা ছেড়ে চলে গেছেন বা কাজ বন্ধ রেখেছেন।

রিয়াদের বিরুদ্ধে এইসব অভিযোগ নিয়ে কথা বলতে গেলে তিনি নিজেকে নির্দোষ দাবি করেন এবং সমস্ত অভিযোগ অস্বীকার করেন। এরপর আর কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি।

স্থানীয় কাউন্সিলর ও রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের কাছেও বহুবার গেছেন এলাকাবাসী। কিন্তু কেউই কার্যকর কোনো পদক্ষেপ নিতে এগিয়ে আসেননি। বরং অনেকে অভিযোগ করেন, রিয়াদ একটি প্রভাবশালী রাজনৈতিক গ্রুপের ‘অঘোষিত কার্যকর্তা’ হিসেবে কাজ করেন, এবং সেই পরিচয়ের কারণেই তাঁকে ঘিরে রয়েছে এক ধরনের অদৃশ্য নিরাপত্তা।

মিশনপাড়ার এই অবস্থা এখন পুরো নারায়ণগঞ্জ শহরের নিরাপত্তা ও সুশাসনের জন্য ভয়ঙ্কর এক সংকেত হয়ে উঠেছে। নাগরিক সমাজের প্রশ্ন , যদি প্রমাণ থাকা সত্ত্বেও একাধিক মামলার আসামিকে গ্রেপ্তার না করা হয়, তবে আইনের শাসন কোথায়? 

সচেতন মহলের দাবি, এই পরিস্থিতি চলতে থাকলে রিয়াদ ও তাঁর চক্র আরও শক্তিশালী হয়ে উঠবে। তখন শুধু মিশনপাড়া নয়, নারায়ণগঞ্জ শহরের প্রতিটি প্রান্তেই গড়ে উঠবে এমন চাঁদাবাজ সিন্ডিকেট।

এখনই সময় রিয়াদের বিরুদ্ধে শক্ত অবস্থান নেওয়ার, নয়তো ঘটতে পারে ভয়ংকর অপ্রীতিকর কোন ঘটনা। আক্রান্ত হতে পারে ভুক্তভোগীরা।
 

সম্পর্কিত নিবন্ধ

  • চাঁদাবাজ রিয়াদের তাণ্ডবে অতিষ্ঠ মিশনপাড়া
  • পুতিন এমন কিছু চান, যা তিনি কখনোই পাবেন না