Prothomalo:
2025-11-04@12:25:25 GMT

একুশের মুখোমুখি আমরা

Published: 21st, February 2025 GMT

প্রতিবছরের মতো আবার আমাদের মুখোমুখি একুশে ফেব্রুয়ারি; অথবা বলা যায়, একুশে ফেব্রুয়ারির মুখোমুখি আমরা। বাংলা ভাষার অধিকার প্রতিষ্ঠার স্মারক একুশে ফেব্রুয়ারি—এই কথার মধ্যে একটা কূটাভাস বা আপাতবিরোধ আছে। তার পেছনে যে প্রশ্ন, স্মারকটি ৮ ফাল্গুন নয় কেন? এ প্রসঙ্গে বলা যায়, বাংলাদেশ এমনকি বৃহত্তর ভারতবর্ষে বা এশিয়া-আফ্রিকার বহু দেশে খ্রিষ্টীয় সালটি অধিকতর ব্যবহৃত ও পরিচিত। ফলে চেয়ার, টেবিল, মিনিট, মাইলের মতো জানুয়ারি, ফেব্রুয়ারি ইত্যাদি বাংলায় আত্তীকৃত হয়ে গেছে। ভাষা ও সংস্কৃতির রূপ-রূপান্তরের ক্ষেত্রে এটিই স্বাভাবিক। জাতীয়তাবোধে উজ্জীবিত বাঙালি যে একই সঙ্গে আন্তর্জাতিক, একুশে ফেব্রুয়ারি পালন তার উজ্জ্বল উদাহরণ।

দেশভাগের পর পাকিস্তানের অধিবাসীদের মধ্যে উর্দুভাষীর সংখ্যা ছিল ৩ শতাংশের কম। বাংলা, পাঞ্জাবি, সিন্ধি, এমনকি বেলুচি ও পাখতুনভাষীও তার চেয়ে বেশি ছিল। মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ উর্দুকে ‘অনলি স্টেট ল্যাঙ্গুয়েজ’ ঘোষণা করেছিলেন ইংরেজি ভাষায় প্রদত্ত ভাষণে। পাকিস্তানের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী লিয়াকত আলী খানের মতো ভারতত্যাগী মোহাজির বা খাজা নাজিমউদ্দিনের মতো জনবিচ্ছিন্ন তথাকথিত নবাবরাই পাকিস্তানের শাসকদের মধ্যে উর্দুতে কথা বলতেন। তবু সেদিনের বাঙালি বাংলা ভাষার প্রতিষ্ঠা চেয়েছিল পাকিস্তানের ‘অন্যতম রাষ্ট্রভাষা’ হিসেবে; একমাত্র রাষ্ট্রভাষা হিসেবে নয়। তাই একুশে উৎসারিত যে বাঙালি জাতীয়তাবাদ, তা অন্য জাতি বা জাতীয়তাবাদের বিরোধী কোনো উগ্র জাত্যভিমান নয়; বরং উদার গণতান্ত্রিক জাতীয়তাবাদ।

সম্প্রতি ‘বৈষম্য’ কথাটি বাংলাদেশের রাজনৈতিক জীবনে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ শব্দ হিসেবে উচ্চারিত হচ্ছে। বায়ান্নর ভাষা আন্দোলন, ছেষট্টির স্বায়ত্তশাসনের দাবি, উনসত্তরের গণ-অভ্যুত্থান, ১৯৭১ সালের রক্তক্ষয়ী স্বাধীনতাযুদ্ধ—সবই প্রকৃতপক্ষে বৈষম্যের বিরুদ্ধে গণ-প্রতিরোধ। বায়ান্নর ভাষা আন্দোলন বাংলা ভাষার প্রতি বৈষম্যের বিরুদ্ধে, ছেষট্টির আন্দোলন পূর্ব বাংলার প্রতি পাকিস্তানি শাসকদের বৈষম্যের বিরুদ্ধে, উনসত্তরের গণ-অভ্যুত্থান রাজনৈতিক জীবনে বাঙালিদের দাবিয়ে রাখার বিরুদ্ধে জনরায় বললে ভুল হয় না। ১৯৭১-এর অসহযোগ আন্দোলন এবং সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধ এই বৈষম্যের বিরুদ্ধেই পরিচালিত হয়েছিল। পরাস্ত করেছিল আত্মগর্বী শক্তিশালী পাকিস্তানি বাহিনীকে। তাই ২০২৪ সালের বৈষম্যবিরোধী ছাত্র–জনতার গণ-অভ্যুত্থান পূর্ব বাংলা ও বাংলাদেশের সব গণ-আন্দোলনের থেকে বিচ্ছিন্ন কিছু নয়।

আগস্ট ২০২৪-এর পর আমরা এখন আরও অর্ধবছর পেরিয়ে গেছি। এই আন্দোলন সম্পর্কে বহু তথ্য ও তত্ত্ব এখন পরিচিত। এতে অংশ নিয়েছিল বিপুলসংখ্যক রাজনৈতিক ও সামাজিক শক্তি, যাদের মতাদর্শ এক নয়; বরং কোনো কোনো ক্ষেত্রে পরস্পরবিরোধী। তাদের ঐক্যের ভিত্তি ছিল বৈষম্যের অবসান। জীবনযাপনের ক্ষেত্রে এই বৈষম্য সৃষ্টি হয়েছিল দুর্নীতি ও অন্যান্য অনাচারের মাধ্যমে একদল মানুষের বিপুল পরিমাণ সম্পদ কুক্ষিগত ও ভোগ-বিলাস করার ফলে। সামাজিক জীবনে একদল মানুষের প্রতিপত্তি ও নিপীড়ন অন্যদের বৈষম্যের শিকারে পরিণত করেছিল। এই প্রতিপত্তিশালীদের মধ্যে রাজনৈতিক কুশীলবদের সঙ্গে সমান মাত্রায়, এমনকি কখনো অধিক মাত্রায় ক্ষমতাবান হয়েছিল একদল সামরিক বেসামরিক আমলা ও ব্যবসায়ী। পরিণতিতে সাধারণ মানুষ ক্ষিপ্ত হয়েছিল এবং একটি বৈষম্যহীন সমাজ কামনা করেছিল।

বাংলাদেশের বর্তমান রাজনৈতিক জীবনে ‘বৈষম্য’-এর পরে জনপ্রিয় শব্দ ‘সংস্কার’। সম্প্রতি সরকার পরিবর্তনের পর অনেকে প্রথমে বাংলাদেশের সংবিধান, রাষ্ট্রনীতি, মুক্তিযুদ্ধের পরম্পরা, নির্বাচন ব্যবস্থা সবটাই নাকচ করার পক্ষে বলেছিলেন। পরে আবার তা সংস্কারের পথে গেছে। প্রকৃতপক্ষে ১৯৭২-এর সংবিধানের আলোকে বাংলাদেশে রাষ্ট্রীয়ভাবে বৈষম্য সৃষ্টির কোনো সুযোগ নেই; সংকট সৃষ্টি হয়েছে তা মান্য না করা বা তার অপপ্রয়োগের ফলে। বাংলাদেশের সংবিধানে বলা হয়েছে: ১৯.

(১) সকল নাগরিকের জন্য সুযোগের সমতা নিশ্চিত করিতে রাষ্ট্র সচেষ্ট হইবেন। (২) মানুষে মানুষে সামাজিক ও অর্থনৈতিক অসাম্য বিলোপ করিবার জন্য, নাগরিকদের মধ্যে সম্পদের সুষম বণ্টন নিশ্চিত করিবার জন্য এবং প্রজাতন্ত্রের সর্বত্র অর্থনৈতিক উন্নয়নের সমান স্তর অর্জনের উদ্দেশ্যে সুষম সুযোগ-সুবিধাদান নিশ্চিত করিবার জন্য রাষ্ট্র কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করিবেন। ২০. (২) রাষ্ট্র এমন অবস্থা সৃষ্টির চেষ্টা করিবেন, যেখানে সাধারণ নীতি হিসাবে কোনো ব্যক্তি অনুপার্জিত আয় ভোগ করিতে সমর্থ হইবেন না। ২৭. সকল নাগরিক আইনের দৃষ্টিতে সমান এবং আইনের সমান আশ্রয়লাভের অধিকারী।

সংবিধানের এসব ধারা-উপধারা থেকে স্পষ্ট যে গত অর্ধশতকে বাংলাদেশের রাষ্ট্রব্যবস্থায় কর্তৃত্ব করতে গিয়ে যাঁরাই ‘বৈষম্য’ করেছেন, তাঁরা সবাই ’৭২-এর সংবিধান লঙ্ঘন করেছেন।

বাংলাদেশে বর্তমান সরকার দায়িত্ব গ্রহণের পর অনেক ক্ষেত্রে বৈষম্য নিরোধ এবং সংস্কারের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। দুঃখের বিষয়, শিক্ষা ও শিক্ষার ভাষানীতি সংস্কারের কোনো প্রয়াস আমাদের চোখে পড়েনি। এখানেই একুশের চেতনার সঙ্গে আমাদের বোঝাপড়ার প্রশ্নটি সামনে আসে।

একুশের মূলকথা ছিল সর্বস্তরে বাংলা ভাষার প্রচলন। নিঃসন্দেহে এর প্রধান জায়গাটি হচ্ছে শিক্ষা। আমরা কি বাংলাদেশের সর্বস্তরের শিক্ষা মাতৃভাষায় প্রদান করতে পারছি? এর স্পষ্ট উত্তর, না। বাংলাদেশে বর্তমানে প্রাথমিক ও উচ্চমাধ্যমিক স্তরে তিন ধরনের শিক্ষাদান প্রচলিত রয়েছে। সরকারি প্রাথমিক, মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানসমূহে মূলত বাংলায় পাঠদান করা হয়। এসব প্রতিষ্ঠানে অধিকাংশ ক্ষেত্রেই পাঠদান দুর্বল, শিক্ষকদের দক্ষতা ও নৈতিকতা প্রশ্নবিদ্ধ এবং শ্রেণিকক্ষসহ শিক্ষা উপকরণ অপর্যাপ্ত। এর বিপরীতে বড়-ছোট নগরগুলোতে রয়েছে উন্নত মানের স্কুল, যেখানে ইংরেজিতে পাঠদান করা হয়। এখানে আর্থিক সংগতিসম্পন্ন পরিবারের ছেলেমেয়েরা পড়ে। এদের অধিকাংশ প্রতিষ্ঠানেই শিক্ষকেরা দক্ষ এবং পরিশ্রমী, শিক্ষার্থীরাও মানসম্পন্ন। তবে এ ধরনের মডেলের অনুকরণে শহরতলি ও মফস্‌সলে গড়ে উঠেছে কিছু ‘কিন্ডার গার্ডেন’, যেখানে ইংরেজিতে পাঠদান করা হলেও যোগ্য শিক্ষক, এমনকি যথাযথ শ্রেণিকক্ষ পর্যন্ত নেই। ফলে এ ধরনের প্রতিষ্ঠানে পড়ুয়ারা—বাংলা বা ইংরেজি মাধ্যমে—কোনো পাঠদানেই উপকৃত হচ্ছে না।

অন্য একটি ধারায় রয়েছে মূলত আরবি ভাষার পুস্তকনির্ভর মাদ্রাসা। তৎকালীন ভারতবর্ষে কলকাতা মাদ্রাসাসহ বিভিন্ন মাদ্রাসা স্থাপন করা হয়েছিল মুসলমান সম্প্রদায়কে আধুনিক শিক্ষার সঙ্গে যুক্ত করার জন্য। পাশাপাশি এসব মাদ্রাসায় ইংরেজরা সে সময় ফারসি ভাষায় প্রচলিত ভারতীয় আইন-কানুন ও অন্যান্য বিষয়ে শিক্ষা নিত। ফলে তৎকালীন মাদ্রাসাগুলোর শিক্ষা, ভবন, পাঠক্রম, উপকরণ—সবই ছিল অত্যন্ত উন্নত মানের। কিন্তু পরবর্তী সময়ে অনেক মাদ্রাসাই যে ঐতিহ্য ধরে রাখতে পারেনি। বর্তমানে বাংলাদেশের মাদ্রাসাগুলোর মধ্যেও নানা ধারার শিক্ষাদানের পদ্ধতি প্রচলিত রয়েছে। সরকারি পৃষ্ঠপোষণার মাদ্রাসাগুলোতে ভবন ইত্যাদির সুবিধা থাকলেও শিক্ষক ও শিক্ষাদানের অবস্থা অনেক সময় সরকারি স্কুলগুলোর মতোই। বেসরকারি মাদ্রাসাগুলোর আর্থিক ভিত্তি অনেকটা স্বয়ংসম্পূর্ণ। তবে সেখানকার পাঠক্রম ও পাঠদান এবং পাঠাতিরেক শিক্ষা বাইরের মানুষের কাছে অস্পষ্ট। তার চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে মাদ্রাসাগুলোয় মাতৃভাষায় শিক্ষাদানের ক্ষেত্রে দক্ষ শিক্ষকের অভাব ও অনীহা।

২১ ফেব্রুয়ারিকে ‘আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস’ ঘোষণার ফলে আমাদের ওপর আরও একটি নতুন দায়িত্ব অর্পিত হয়েছে। মাতৃভাষা বাংলার সঙ্গে বাংলাদেশের আদিবাসীদের মাতৃভাষার স্বীকৃতিদান এবং সম্ভবমতো সেসব ভাষায় শিক্ষাদানের ব্যবস্থা করা।

উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোয় মাতৃভাষায় শিক্ষাদানের চিত্র আরও নাজুক। গত শতকের ষাটের দশকে এবং বাংলাদেশের স্বাধীনতা–পরবর্তীকালে বিশ্ববিদ্যালয় স্তরে বাংলা ভাষায় শিক্ষাদানের যে উৎসাহ, উদ্যোগ ও প্রয়োগ দেখা গিয়েছিল, গত চার দশকে তা প্রায় বিলুপ্তির পথে। প্রধানত বাংলা ভাষায় বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে পাঠ্যপুস্তকের অভাবের কথা সামনে এনে তাঁরা মাতৃভাষায় শিক্ষাদানের থেকে সরে গেছেন। অথচ চীন, জাপান বা কোরিয়া মাতৃভাষাতেই উচ্চতর বিজ্ঞান, প্রকৌশল, চিকিৎসাবিদ্যা ইত্যাদি পড়াচ্ছে। আমাদের অতীতেও এ ধরনের উদাহরণ বিরল নয়। উচ্চতর শিক্ষায় হালনাগাদ জ্ঞানসম্পন্ন পাঠ্যপুস্তক রচনার জন্য প্রয়োজন বিশ্বের অন্য কোনো প্রধান ভাষায় রচিত পাঠ্যপুস্তক আত্মস্থ করা এবং তা মাতৃভাষায় সুচারুরূপে উপস্থাপন করা। এর জন্য অপরিহার্য মাতৃভাষা বাংলা ভাষার ওপর দখল, ইংরেজি বা অন্য কোনো বিদেশি ভাষাদক্ষতার সঙ্গে রপ্ত করা এবং সঙ্গে নিষ্ঠা ও পরিশ্রম। তাহলেই বাংলা ভাষায় উচ্চতর পাঠ্যপুস্তক রচনা সম্ভব।

সর্বস্তরে বাংলা ভাষা প্রচলনে আরেকটি বড় প্রতিবন্ধকতা আমাদের মানসিকতা। ১৯৬০-৭০-এর দশকে আমাদের সমাজ বাংলা ভাষার প্রচলনে যে দৃঢ়তা ও আন্তরিকতা দেখিয়েছিল, তার মধ্যে বর্তমানে ভাটার টান স্পষ্ট। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শতবর্ষ উপলক্ষে যে প্রদর্শনী হয়েছিল, তাতে বাংলা বিভাগ ছাড়া আর কোনো বিভাগ বা ইনস্টিটিউটের নামফলক বাংলা ভাষায় লেখা হয়নি, এমন শুনেছি। দৈনন্দিন জীবনে অথবা ছোটখাটো পত্রবিনিময়ে দুজন বাঙালি অন্য ভাষা ব্যবহার করছে, এমন হীনম্মন্য আচরণের উদাহরণ সুখকর নয়। সেনানিবাসগুলোয় অথবা পুলিশ লাইনে যদি সব চিহ্ন ও নির্দেশ বাংলায় লেখা যায়, গাড়ির নম্বর যদি বাংলায় লেখা যায়, তাহলে অন্যত্র এর ব্যবহার অসম্ভব হওয়ার কোনো কারণ নেই। বাংলা ভাষা সব বিবেচনাতেই বিশ্বের একটি শ্রেষ্ঠ ভাষা এবং উচ্চতর বিজ্ঞানচর্চা থেকে শুরু করে দৈনন্দিন জীবনের সবকিছুই বাংলা ভাষায় করা সম্ভব।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সামনে উত্তাল ছাত্র–জনতা, ২১ ফেব্রুয়ারি ১৯৫২

উৎস: Prothomalo

কীওয়ার্ড: র জন ত ক ব যবস থ আম দ র র জন য হয় ছ ল ক জ বন কর ছ ল ধরন র সরক র

এছাড়াও পড়ুন:

কৃষি বিবর্তনের গল্প বলে যে জাদুঘর

বাংলাদেশের ইতিহাস, সংস্কৃতি ও অর্থনীতির মূলে রয়েছে কৃষি। এই কৃষির বিবর্তনের গল্প, এর সঙ্গে জড়িয়ে থাকা মানুষের জীবন, প্রযুক্তির বিকাশ এবং গ্রামীণ সমাজের ঐতিহ্য যেন এক অমূল্য উত্তরাধিকার।

সময়ের প্রবাহে অনেক কিছুই হারিয়ে যাচ্ছে, ভুলে যাচ্ছে নতুন প্রজন্ম। সেই হারানো ঐতিহ্যকে সংরক্ষণ ও তুলে ধরার প্রয়াসেই গড়ে উঠেছে দেশের প্রথম কৃষি জাদুঘর, বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের (বাকৃবি) কৃষি জাদুঘর।

আরো পড়ুন:

জাপানের এনইএফ বৃত্তি পেলেন বাকৃবির ২০ শিক্ষার্থী

গোপনে বাকৃবি ছাত্রীদের ব্যক্তিগত মুহূর্তের ছবি তুলে সাবেক ছাত্রকে দিতেন আরেক ছাত্রী

বিশ্ববিদ্যালয়ের দক্ষিণ-পূর্ব প্রান্তে, বাংলাদেশ পরমাণু গবেষণা ইনস্টিটিউটের (বিনা) ঠিক সামনেই সবুজ দেবদারু গাছে ঘেরা এক মনোরম পরিবেশে দাঁড়িয়ে আছে এই কৃষি জাদুঘর। প্রকৃতির কোলে যেন কৃষির ইতিহাস কথা বলে এখানে।

২০০২ সালের ২৪ জানুয়ারি তৎকালীন উপাচার্য অধ্যাপক মু. মুস্তাফিজুর রহমানের হাত ধরে জাদুঘরটির ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করা হয়, যার মূল স্বপ্নদ্রষ্টা ছিলেন সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ হোসেন। পরবর্তীতে ২০০৩ সালের ১৫ সেপ্টেম্বর উপাচার্য অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ আমিরুল ইসলাম এর উদ্বোধন করেন।

নানা প্রতিবন্ধকতা ও জনবল সংকটের কারণে কিছুদিন বন্ধ থাকলেও, ২০০৭ সালের ৩০ জুন উপাচার্য অধ্যাপক ড. মোশাররফ হোসাইন মিঞাঁ এটি পুনরায় দর্শনার্থীদের জন্য উন্মুক্ত করেন। সেই থেকে আজ পর্যন্ত এটি দেশের কৃষি ঐতিহ্য, সংস্কৃতি ও প্রযুক্তির এক জীবন্ত সংগ্রহশালা হিসেবে পরিচিত।

৫ একর জায়গা জুড়ে নির্মিত এই অষ্টভুজ আকৃতির ভবনটি স্থাপত্যগত দিক থেকেও দারুণ দৃষ্টিনন্দন। প্রবেশদ্বার পেরিয়ে ঢুকতেই চোখে পড়ে রঙিন মাছের অ্যাকুয়ারিয়াম, পাশে প্রাচীন সাতটি খনার বচন। প্রবেশমুখের ঠিক পরেই দুটি অফিস কক্ষ, আর একটু ভেতরে এগোলেই দেখা যায় একটি ছাদহীন বৃত্তাকার বাগান, যা প্রাকৃতিক আলোর ছোঁয়ায় উজ্জ্বল। সেই বাগানের চারপাশেই রয়েছে সংরক্ষণশালার বিভিন্ন কক্ষ। প্রতিটি কক্ষই যেন কৃষির একেকটি অধ্যায়।

জাদুঘরের সবচেয়ে আকর্ষণীয় অংশ হলো বীজ সংগ্রহশালা। এখানে রয়েছে ধান, গম, ভুট্টা, তিসি, চিনাবাদাম, কাউনধান, ফ্রেঞ্চ বিন, ফাবা বিনসহ নানা ফল ও সবজির বীজ। দেখা মেলে বিরল প্রজাতির তৈকর ফলের বীজ, যা একসময় আচার ও জেলি তৈরিতে ব্যবহৃত হতো। রয়েছে বহুল পরিচিত ভ্যান্না বীজ, যার তৈল দিয়ে কসমেটিক ও ঔষধি পণ্য তৈরি হয়।

মাটির নানা প্রকার নমুনা, প্রাকৃতিক ও কৃত্রিম সার, এমনকি পাহাড়ি চাষাবাদের মডেলও স্থান পেয়েছে এখানে।

শিক্ষার্থীদের গবেষণা ও দর্শনার্থীদের শিক্ষার জন্য প্রদর্শিত হয়েছে বিভিন্ন ফসল রোগের চিত্র, আক্রান্ত বীজ, ও ব্যাকটেরিয়ার নমুনা। এ অংশের এক বিশেষ আকর্ষণ আড়াই কেজি ওজনের এক বিশাল মিষ্টি আলু, যা দর্শনার্থীদের বিশেষ আগ্রহের কেন্দ্রবিন্দু হয়ে উঠেছে।

জাদুঘরের আরেক অংশ যেন এক ক্ষুদ্র প্রাণিবিজ্ঞান জাদুঘর। এখানে প্রদর্শিত আছে বুনো মহিষ, হরিণের শিং, গরু, অজগর ও গোখরা সাপের কংকাল। রয়েছে সংরক্ষিত কালো মেটো ইঁদুর, ধারাই সাপ, এবং কচ্ছপের খোল ও কঙ্কাল।

উপরে তাকালে দেখা যায় এক বিশাল প্রিজার্ভড শকুন, সে যেন আকাশে ডানা মেলে উড়ছে। রয়েছে প্লাটিপাসের কংকালও, যা এক বিরল প্রাণীর বাস্তব নিদর্শন। প্রতিটি নমুনাই যেন দর্শনার্থীকে স্মরণ করিয়ে দেয়, কৃষি কেবল ফসল বা জমির নয়, এটি প্রকৃতি ও প্রাণের সঙ্গে গভীরভাবে যুক্ত।

গ্রামীণ জীবনের বৈচিত্র্যও এখানে তুলে ধরা হয়েছে অত্যন্ত যত্নের সঙ্গে। এক কক্ষে সাজানো আছে ঢেকি, কুলা, পানের ডাবর, হুকা, হারিকেন, কুপি বাতি, গরুর গাড়ির মডেল, এমনকি মাছ ধরার পুরোনো যন্ত্রও। রয়েছে তবলা, বেহালা, আদুরী, ক্রাম ও নাতকসহ বিভিন্ন দেশীয় বাদ্যযন্ত্র।

এক পাশে দেখা যায় ‘গিলা’, যা একসময় বর-কনের গোসল অনুষ্ঠানে ব্যবহৃত হতো। এখনকার তরুণ প্রজন্ম হয়তো নামটিও জানে না, অথচ এটি ছিল গ্রামীণ সংস্কৃতির এক অপরিহার্য অংশ।

আরো রয়েছে কৃষকের বসতবাড়ির পূর্ণাঙ্গ মডেল, যা দেখতে যেন একেবারে বাস্তব কৃষকের ঘর। এখানে দেখা যায় কৃষকের হালচাষের দৃশ্য, রান্নাঘর, ধান রাখার গোলা, গরুর খোঁয়াড় এবং গৃহিণীর সাজানো রান্নার জায়গা। যেন একবারে গ্রামের জীবনচিত্র ফুটে উঠেছে দেয়াল আর মডেলের মধ্যে।

প্রযুক্তির ধারাবাহিকতা রক্ষার জন্য জাদুঘরে স্থান পেয়েছে পুরনো মাইক্রো কম্পিউটার, ডট প্রিন্টার, পাওয়ার টিলার, ধান মাড়াইয়ের আধুনিক যন্ত্র, ঘাণি, ডিঙি নৌকা, কাঁঠের তৈরি গরুর গাড়ি, তালগাছের কুন্দা ও উপজাতিদের পোশাক। এক পাশে ঝুলছে হরিণের চামড়া, অন্য পাশে সাজানো উপজাতীয় কৃষি উপকরণ, যা দেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে সংগ্রহ করা হয়েছে।

এই উপকরণগুলো কেবল প্রযুক্তির বিবর্তনের ইতিহাস নয়, বরং কৃষির সঙ্গে মানুষের সংস্কৃতি ও জীবনধারার মেলবন্ধনের প্রতীক।

জাদুঘরের আরেক বিশেষ প্রদর্শনী হলো প্রাচীন থেকে আধুনিক সময়ের মুদ্রার সংগ্রহ। ব্রিটিশ আমল থেকে শুরু করে স্বাধীন বাংলাদেশের মুদ্রা এখানে প্রদর্শিত হচ্ছে ইতিহাসের সাক্ষী হয়ে। এগুলো দেখে কৃষিনির্ভর অর্থনীতির বিকাশ ও সামাজিক পরিবর্তনের চিত্র স্পষ্ট হয়ে ওঠে।

জাদুঘরের প্রতিটি কোণ যেন বলে, কৃষিই বাংলাদেশের প্রাণ। এখানকার প্রতিটি উপকরণ, প্রতিটি মডেল, প্রতিটি নমুনা কৃষির বিকাশ ও মানুষের সংগ্রামের গল্প বহন করে। দর্শনার্থীরা এখানে এসে কৃষির অতীত ঐতিহ্য থেকে বর্তমান প্রযুক্তির রূপান্তর পর্যন্ত এক নজরে দেখতে পান।

বাকৃবি উপাচার্য অধ্যাপক ড. এ কে ফজলুল হক ভূঁইয়া বলেন, “এটি দেশের প্রথম এবং সবচেয়ে উপকরণসমৃদ্ধ কৃষি জাদুঘর। বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ ইতোমধ্যে এটিকে দোতলা ভবনে রূপান্তরের পরিকল্পনা নিয়েছে, যেখানে কৃষি ভিত্তিক ১৪টি জেলার ঐতিহ্যবাহী কৃষি উপকরণ সংরক্ষণ ও প্রদর্শনের ব্যবস্থা থাকবে।”

তিনি আরো বলেন, “দর্শনার্থীদের সুবিধার জন্য ভবিষ্যতে টিকিট ব্যবস্থা চালুর কথাও ভাবা হচ্ছে, যা বিশ্ববিদ্যালয়ের অভ্যন্তরীণ আয় বৃদ্ধিতে সহায়ক হবে এবং জাদুঘরের রক্ষণাবেক্ষণেও ভূমিকা রাখবে।”

এই কৃষি জাদুঘর শুধু কৃষি উপকরণের প্রদর্শনী নয়, বরং এটি বাংলাদেশের কৃষি সভ্যতার ইতিহাস, সংস্কৃতি, প্রযুক্তি ও মানুষের সম্পর্কের এক সজীব দলিল। শহরের কোলাহল আর কংক্রিটের ভিড় থেকে বেরিয়ে কেউ যদি এখানে আসে, তবে মুহূর্তেই যেন হারিয়ে যায় মাটির গন্ধে, কৃষকের ঘামে, বাংলার গ্রামীণ জীবনের সহজ সরল সৌন্দর্যে।

জাদুঘরটি সকাল ৯টা থেকে বিকেল ৫টা পর্যন্ত দর্শনার্থীদের জন্য খোলা থাকে এবং প্রতি শনিবার বন্ধ থাকে। সময় সুযোগে একবার ঘুরে গেলে দেখা মিলবে বাংলাদেশের কৃষির হাজার বছরের গল্প, যা মাটি, ঘাম, বীজ আর ঐতিহ্যের বন্ধনে গাঁথা এক অনবদ্য ইতিহাস।

ঢাকা/মেহেদী

সম্পর্কিত নিবন্ধ

  • কৃষি বিবর্তনের গল্প বলে যে জাদুঘর
  • ব্রেন ক্যানসারের যে ৭টি লক্ষণ আমরা সাধারণ ভেবে এড়িয়ে যাই