আমাদের শাসকশ্রেণি নিজেরা পুঁজিবাদী বিশ্বের সেবক ও কর্মচারী। ওই যে সৎ ও যোগ্য হিসেবে আবির্ভূত হতে চাচ্ছেন তারা, এই সেবা ও কর্মনির্বাহের কাজটা তারা খুবই ভালোভাবে করতে পারবেন এমনটা ভাবা খুবই সংগত। কেননা এরা চিরকালই সুবোধ ছিলেন। দুষ্ট ছেলেরা যখন আন্দোলন করেছে, জেল খেটেছে, যুদ্ধে গেছে তারা তখন ঘরের দরজা বন্ধ করে পড়াশোনা করেছেন। ফলে পরীক্ষার ফলটা ভালো হয়েছে, চাকরি ও পেশায় উপযুক্ত স্থান পেয়েছেন, আনুগত্য ও কর্মদক্ষতা দেখিয়ে সুনাম অর্জন করেছেন। এখন ঋণদান নামক সেবা প্রতিষ্ঠান খুলে বসেছেন, কিন্তু মোটেই টায়ার্ড হননি; এখন চেষ্টা করছেন নির্বাচনে জিতে আগের মতো আর ড্রাইভারের আসনে থাকবেন না, খোদ মালিকদের একজন হয়ে যাবেন। এবং সততা ও যোগ্যতার সঙ্গে পুঁজিবাদের এবং সাম্রাজ্যবাদী প্রভুদের সেবা করতে থাকবেন। এই কাজ রাজনীতিকরাও করেন, কিন্তু অতটা সততা ও যোগ্যতার সঙ্গে করতে পারেন না; আর পারেন না বলেই তো সৎ ও যোগ্যদের আজ এত বেশি প্রয়োজন।
এরা নির্বাচনে জয়ী হবেন এমন স্বপ্নকে আসলে তাই দুঃস্বপ্নই বলতে হবে, দেশের কথা ভাবলে। তবে নির্বাচন যদি না হয় বা কোনো তৃতীয় শক্তির দরকার দেখা দেয় তাহলে লোক তো লাগবে। এদের তখন চাহিবা মাত্র পাওয়া যাবে। ছেলেবেলায় বয় স্কাউট বন্ধুদের দেখতাম বাহুতে ব্যাজ ধারণ করতে, তাতে লেখা থাকত– ‘রেডি’ অর্থাৎ প্রস্তুত থেকো; মানুষের বিপদ দেখলেই ঝাঁপিয়ে পড়তে হবে এটা জেনে এরাও হয়তো ওই রকমই বয় স্কাউট বাহিনী হিসেবে তৈরি থাকবেন, প্রয়োজন হলেই ঝাঁপিয়ে পড়বেন।
২
এই উপলক্ষে নির্বাচন জিনিসটার দিকেও ফিরে তাকানো যেতে পারে। বর্তমানে এটি একটি পঞ্চবার্ষিক উৎসব বটে। তামাশাও বলা চলে। হইচই, হট্টগোল, মিটিং-মিছিল চলতে থাকে, টাকার স্রোত বহমান রয়, নানা রঙের ছবি ও বিজ্ঞাপনে এলাকা ছেয়ে যায়। হয়তো সরকার বদলায়, কিন্তু তাতে জনগণের কোনো লাভ হয় না। রাষ্ট্রের মালিকানা তাদের হাতে আসে না।
অতীতে জনবিক্ষোভকে তুঙ্গে পৌঁছতে আমরা দেখেছি এবং প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই দেখেছি নির্বাচনের মধ্য দিয়ে সেই বিক্ষোভের সাময়িক প্রশমন এবং বিপন্ন রাষ্ট্রব্যবস্থার সংরক্ষণ। ১৯৪৫-৪৬-এ অখণ্ড বঙ্গে একটা পরিস্থিতি গড়ে উঠছিল, যাকে বলা যায় প্রায়-বৈপ্লবিক। তখন এলো ছেচল্লিশের নির্বাচন। নির্বাচনে কংগ্রেস ও লীগ, দুই পক্ষ দু’দিক থেকে বিজয়ী হয়ে এলো, তাদের মধ্যে বাধল দাঙ্গা এবং পরিণামে ভাগ হয়ে গেল দেশ। ১৯৫২ সালে পূর্ববঙ্গের মানুষ একটা অভ্যুত্থান ঘটিয়ে ফেলেছিল; তখন এলো চুয়ান্নর নির্বাচন, জয়ী হলো যুক্তফ্রন্ট। নির্বাচনের পরে কোনো প্রতিপক্ষ ছিল না, তাই যুক্তফ্রন্ট নিজেই দু’ভাগ হয়ে দক্ষযজ্ঞ পরিস্থিতি শুরু করে দিল, পরিণতিতে পাওয়া গেল সামরিক শাসন। অভ্যুত্থান ঘটেছে ১৯৬৯-এ; এলো সত্তরের নির্বাচন। নির্বাচন শেষে দেখা দিল হানাদারদের গণহত্যা অভিযান। এরশাদবিরোধী অভ্যুত্থানের পরেও একই ঘটনা দেখা গেছে, নির্বাচন এসেছে, জনতা শান্ত হয়েছে। কিন্তু জনজীবনে তেমন কোনো পরিবর্তন ঘটেনি। তারপর একের পর এক নির্বাচন হচ্ছে, সরকার বদলাচ্ছে, কিন্তু তাতে রাষ্ট্র যে জনগণের হবে তেমন ঘটনা ঘটছে না। বরঞ্চ যাতে না ঘটে, রাষ্ট্র যাতে শাসকশ্রেণির হাতেই থাকে, তারই বন্দোবস্ত করা হচ্ছে।
সৎ ও যোগ্য লোকের শাসন চাই– এই আওয়াজ প্রথমে শোনা গিয়েছে জামায়াতে ইসলামীর কণ্ঠে। তখন তাদের জোর ছিল না; তারা যেহেতু চিহ্নিত ছিল যুদ্ধাপরাধী হিসেবে, তাই কিছুটা নিচু গলাতেই কথা বলত। ভাবখানা এ রকমের যে তারাই যোগ্য, পূতপবিত্র, কেননা ধর্মীয়। তাদের হাত যে মানুষের রক্তে রঞ্জিত, সেটা ভুলে যেত। অন্য কোনো ধ্বনি তোলা তাদের পক্ষে সম্ভবও ছিল না। কেননা তারা গণতন্ত্রে বিশ্বাস করে না, মানুষের রুটিরুজির পক্ষে যে দাবি তুলবে তাও পারে না, কারণ ওসব দাবি একেবারেই ইহজাগতিক। এগুলোর কথা সমাজতন্ত্রীরা বলতে পারে, জামায়াতীদের পক্ষে বলাটা পাপাচার। জামায়াতীরা দেশের শাসকশ্রেণির কাছ থেকে নানা প্রকারের প্রশ্রয় পেয়েছে, এখন ক্ষমতার অংশীদার হতে চাচ্ছে।
আমাদের ভদ্রসমাজের বন্ধুরা ইসলামী শাসন চান না, তারা চান সৎ ও যোগ্য মানুষদের সংসদীয় শাসনব্যবস্থা। তারা চান রাষ্ট্র যেমন আছে তেমনি থাকুক, থাকুক আমলাতন্ত্রী ও পুঁজিবাদী, করতে থাকুক বিশ্ব পুঁজিবাদের আজ্ঞামত আচরণ, এখন যেমন করছে। তবে রাষ্ট্রীয় কাজের মধ্যে আসুক সততা ও যোগ্যতা। অর্থাৎ আরও দক্ষতার সঙ্গে চলুক জননিপীড়ন এবং দেশের সম্পদ বিদেশিদের হাতে তুলে দেওয়ার কাজ।
কিন্তু জনগণ কী করবে? তাদের তো নিজস্ব কোনো দল নেই। বুর্জোয়া দল কোনোটাই তাদের মিত্র নয়, শত্রু বটে; এবার সঙ্গে আবার যুক্ত হয়েছে ভদ্রসমাজ, যারা চায় জনগণের বিরোধী যে পক্ষ অর্থাৎ দেশের শাসকশ্রেণি তাদের দুর্নীতিবাজ, দুর্বৃত্ত ইত্যাদি বলে চিহ্নিত হয়ে যাওয়া অংশটিকে পেছন ঠেলে দিয়ে ভদ্র চেহারার মানুষেরা সামনে আসুন, ভদ্রবেশে অভদ্র কাজ করার জন্য।
সৎ ও যোগ্য ব্যক্তিরা নিজেরাই একটি রাজনৈতিক দল খাড়া করার কাজ ইতোমধ্যে করেছেন। কিন্তু দল গড়ায় বিঘ্ন রয়েছে। তা হলে উদ্দেশ্য, লক্ষ্য, কর্মসূচি ইত্যাদি প্রকাশ করতে হবে এবং সেগুলো প্রকাশ পেলে জনগণ যে তাদের প্রতি সবিশেষ আকৃষ্ট হবে এমনটা আশা করা দুষ্কর। তার চেয়ে ভালো এসব জিনিস প্রচ্ছন্ন রেখে নিজেদের ব্যক্তিগত দ্যুতিকে সামনে আনা, মানুষকে ধারণা দেওয়া যে তাদের কাজের চেয়ে তারা মহৎ।
নির্বাচন আসবে, নির্বাচন যাবে, কিন্তু প্রশ্ন হলো, যে রাষ্ট্র জনগণ প্রতিষ্ঠা করেছে, সে রাষ্ট্রের কর্তব্য জনগণের হাতে আসবে কিনা। নির্বাচিত মানুষেরা জনগণের কাছ থেকে ভোট নেবেন এবং সর্বশক্তি দিয়ে চেষ্টা করবেন রাষ্ট্রকে জনগণের বিরুদ্ধে ব্যবহার করে নিজেদের স্বার্থসিদ্ধি করতে।
বাংলাদেশে যা প্রয়োজন তা হলো, একটি মৌলিক সামাজিক পরিবর্তন; যাকে বিপ্লবই বলা চলে। পুকুরের পানি যদি দূষিত হয়ে পড়ে, তবে তাতে মাছ বাঁচে কী করে? পুকুরে দরকার নতুন পানির। সমাজ বদলানোর পথে প্রধান প্রতিপক্ষ কে? নিঃসন্দেহে দেশের শাসকশ্রেণি। নির্বাচন হচ্ছে ক্ষমতার ভাগাভাগি নিয়ে শাসকশ্রেণির বিভিন্ন অংশের ভেতর একটা যুদ্ধ। খেলাও বলা যায়। সেই খেলায় জনগণ অংশ নেয়; কেননা খেলা জিনিসটা সব সময়ই উপভোগ্য বটে, উত্তেজকও বৈকি। তাতে আমরা যোগ দেব নিশ্চয়ই, কিন্তু আশা করব না যে, ওই খেলা জনগণের মুক্তি আনবে। মুক্তির পথটা ভিন্ন। সেটা আন্দোলনের। সেই আন্দোলনের, যেটি হবে একই সঙ্গে দেশপ্রেমিক ও গণতান্ত্রিক।
ইতোমধ্যে ছেলেখেলা চলবে, কোনোটা টিকবে তিন দিন, কোনোটা ৯ দিন, কিন্তু খেলোয়াড়রা থামবে না, খেলতেই থাকবে, যতক্ষণ না সমাজ ও রাষ্ট্র পরিবর্তনের আন্দোলন জোরদার হচ্ছে, আলো না ফুটলে অন্ধকার তো থাকবেই, থাকছেই।
সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী: ইমেরিটাস অধ্যাপক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
উৎস: Samakal
কীওয়ার্ড: র জন ত সৎ ও য গ য জনগণ র
এছাড়াও পড়ুন:
সংসদে সংরক্ষিত আসন, না তৃণমূল রাজনীতিতে অংশগ্রহণের সুযোগ?
সম্প্রতি জাতীয় নাগরিক পার্টি-এনসিপির শীর্ষস্থানীয় এক নেতার একটি ভিডিও ক্লিপ অনেকেরই দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে। সেখানে তাঁকে বলতে শোনা যায়, বর্তমান সংবিধানে নারীদের জন্য সংরক্ষিত আসনের বলে প্রভাবশালী রাজনৈতিক নেতা ও অন্যান্য ক্ষমতাধর ব্যক্তির মেয়ে, স্ত্রী, খালা, ফুফু এবং গায়িকা মমতাজের মতো নারীরা সংসদ সদস্য হয়ে যান।
তাই তাঁর দল এনসিপি সংবিধান সংস্কার কমিশনের সুপারিশের সঙ্গে একমত হয়ে বর্তমান সংবিধানের আনুপাতিক প্রতিনিধিত্বশীল ব্যবস্থার পরিবর্তে জনগণের প্রত্যক্ষ ভোটে ১০০ জন নারী সংসদ সদস্য নির্বাচনের সুপারিশকে সমর্থন করে।
সংবিধান সংস্কার কমিশনের মতো নারীবিষয়ক সংস্কার কমিশনও বলেছে, বর্তমান সাংবিধানিক বিধানে নারীর ক্ষমতায়ন হয় না।
নারীবিষয়ক সংস্কার কমিশনের সুপারিশে বলা হয়েছে, ১০০টি নয়, বর্তমান ৩০০ সাধারণ আসনের বিপরীতে নারীদের জন্য একটি করে আসন সংরক্ষিত থাকবে। এই ৩০০ আসন থেকে নারীরা জনগণের প্রত্যক্ষ ভোটে নির্বাচিত হবেন।
অর্থাৎ জাতীয় সংসদের নিম্নকক্ষের আসন সংখ্যা হবে ৬০০। এর মধ্যে ৩০০ হবে সাধারণ আসন, যেখানে নারী ও পুরুষ সবাই প্রতিযোগিতা করতে পারবেন। এ ছাড়াও নারীরা সংরক্ষিত ৩০০ আসনে নিজেদের মধ্যে প্রতিযোগিতা করে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হবেন।
নির্মোহভাবে বলতে গেলে, সংরক্ষিত নারী আসন নিয়ে যে সমালোচনা হচ্ছে, সেটি যুক্তিসম্মত। নির্বাহী বিভাগকে জবাবদিহি করার পরিবর্তে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বন্দনা করে সংসদে গান গাইলে সংরক্ষিত মহিলা আসনের বিধান নিয়ে প্রশ্ন ওঠাই স্বাভাবিক।
তবে ব্যতিক্রমও রয়েছে। একাদশ সংসদে সংরক্ষিত আসন থেকে নির্বাচিত বিএনপির সংসদ সদস্য রুমিন ফারহানা একাই তাঁর খুবই তথ্যসমৃদ্ধ, সুনির্দিষ্ট বক্তব্যের মাধ্যমে আওয়ামী লীগ সরকারের চেহারা উন্মোচন করে সংসদে বক্তব্য রাখতেন। আইন প্রণয়নেও তিনি প্রতিটি ধারা অনুসারে আলোচনা করে যথার্থ আইনপ্রণেতার মতোই ভূমিকা পালন করতেন।
সত্যি বলতে, সংরক্ষিত আসন থেকে নির্বাচিত সংসদ সদস্যদের খুব বেশি সম্মান প্রদর্শন করেন না দলীয় নেতারাও। এর প্রধান কারণ স্থানীয় রাজনীতিতে তাদের তেমন কোনো অবস্থান না থাকা।
অভিজ্ঞতার কথা বলি। পেশাগত কারণেই সরকার পতনের আগ পর্যন্ত সংসদের স্পিকার ড. শিরীন শারমিন চৌধুরীকে কাছে থেকে দেখার সুযোগ হয়েছে আমার। ২০১৩ সালে প্রথমবারের মতো স্পিকার নির্বাচিত হওয়ার সময় আওয়ামী লীগের মধ্যেই বড় সমালোচনা ছিল– জনগণের প্রত্যক্ষ ভোটে নির্বাচিত না হয়ে নির্বাচিত সংসদের স্পিকার হন কীভাবে! তবে তৎকালীন বিরোধী দল বিএনপি কখনও এ ব্যাপারে আপত্তিকর কিছু বলেনি। বলতে গেলে সহযোগিতা করেছে।
২০১৪ সালে দশম সংসদে তিনি সংরক্ষিত আসন থেকে পুনরায় সংসদ সদস্য হলে আবার স্পিকার নির্বাচিত হন। কিন্তু ২০১৮ সালে রংপুরের পীরগঞ্জ আসন থেকে সরাসরি ভোটে নির্বাচিত হওয়ার পর পুনরায় স্পিকার নির্বাচিত হলে তাঁর মধ্যে আমি উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন লক্ষ্য করি। তিনি প্রায়ই বলতেন, ‘আমি কিন্তু সংরক্ষিত আসনের সংসদ সদস্য নই। আমি জনগণের ভোটে নির্বাচিত!’ তিনি বেশ কর্তৃত্বশীলভাবেই কথাটি বলতেন।
সন্দেহ নেই, জনগণের ভোটে নির্বাচিত একজন জনপ্রতিনিধির কর্তৃত্ব ও বৈধতা অনেক বেশি। কিন্তু রাজনীতির একটি বড় দ্বান্দ্বিকতা হলো, তাত্ত্বিক যুক্তি ও আবেগের মাধ্যমে রাজনীতির সীমারেখা নির্ধারণ করা যায় না। বাস্তবতার আলোকে তত্ত্বকে অন্তর্ভুক্ত করে রাজনীতি পরিচালনা করতে হয়।
অধ্যাপক আব্দুর রাজ্জাকের লেখা ‘পলিটিক্যাল পার্টিজ ইন ইন্ডিয়া’ বইয়ের শুরুতেই বলা হয়েছে, সাপ যেভাবে এঁকেবেঁকে চলে, রাজনৈতিক দল পরিচালনা করতে হলে তার চাইতেও বেশি জটিলভাবে চলতে হয়।
এখন সংবিধান সংস্কার কমিশন অথবা নারীবিষয়ক সংস্কার কমিশনের প্রতিবেদন অনুযায়ী নারীদের জন্য সংরক্ষিত আসন নির্ধারণ করে জনগণের প্রত্যক্ষ ভোটের মাধ্যমে নির্বাচনের ব্যবস্থায় রাজনীতির সেই জটিল ক্ষেত্রে নতুন সমস্যা দেখা দিতে পারে।
প্রথমত, প্রতিটি নির্বাচনী এলাকায় দু’জন নির্বাচিত এমপি থাকবেন। একটি নির্বাচনী আসনে একই পদের ও মর্যাদার দু’জন জনপ্রতিনিধি থাকতে পারেন না। সে ক্ষেত্রে চলে আসবে দ্বৈত প্রতিনিধিত্ব এবং দ্বৈত শাসন, যা বাস্তবিক ও তাত্ত্বিক দু’ভাবেই বাস্তবায়নযোগ্য নয়।
দ্বিতীয়ত, দুই এমপি এবং তাদের সমর্থকদের মধ্যে তৃণমূলে শুরু হবে মারামারি, সংঘাত, খুনোখুনি। সাধারণ আসন থেকে নির্বাচিত এমপি বলবেন, ‘আমি তো সবার সঙ্গে প্রতিযোগিতা করে জিতেছি; আমার অবস্থান ওপরে। আমার কথাই সব।’ অন্যদিকে সংরক্ষিত নারী আসন থেকে নির্বাচিত এমপি বলবেন, ‘আমিও জনগণের প্রত্যক্ষ ভোটে নির্বাচিত। আমিও কম কীসে?
কারণ সংবিধান সংস্কার কমিশনের সুপারিশ অনুযায়ী, ১০০ আসন চালু হলে একটি সাধারণ আসনে গড় ভোটার সংখ্যা পাঁচ লাখ হলে সংরক্ষিত নারী আসনে হবে ১৫ লাখ। এই ১৫ লাখ ভোটারের জন্য তাঁকে অনেক বেশি টাকা খরচ করতে হবে, সময় দিতে হবে ও পরিশ্রম করতে হবে। এবং এই বিধান নারীদের প্রতি বৈষম্যমূলক হবে না!
দুই এমপির টানাপোড়েনে দোটানায় পড়ে যাবে প্রশাসনসহ সরকারি দপ্তরগুলো। দেখা যাবে, কোন এমপি তোয়ালে-ঢাকা চেয়ারে বসলেন আর কোন এমপি বসলেন না; কে ডানে বসলেন, কে বামে; কার নাম আগে বলা হলো এবং কার নাম পরে; কে আগে বক্তৃতা দিলেন আর কে পরে– এই নিয়ে স্থানীয় পর্যায়ে শুরু হবে মারামারি। তুচ্ছ বিষয় নিয়ে সংসদ সদস্যরা কেমন আচরণ করেন, এর একটি অভিজ্ঞতা উল্লেখ করি। দশম সংসদের ঘটনা।
আমি স্পিকার শিরীন শারমিনের টেবিলের সামনের চেয়ারে বসে কথা বলছিলাম। এর মধ্যেই মেহেরপুর সদর আসনের এমপি ফরহাদ হোসেন প্রবেশ করে আমার পাশেই বসলেন। তিনি মেহেরপুরের রাজনীতি নিয়ে কথা বলার এক পর্যায়ে বললেন, ‘আপা, আমি ডিসি চেঞ্জ করে দিলাম। বেয়াদব কোথাকার!’
তাঁর এ মন্তব্য শুনে স্পিকার আপা জিজ্ঞেস করলেন, ‘কেন, কী হয়েছে? কী বেয়াদবি করেছে ডিসি?’ জবাবে ফরহাদ হোসেন বললেন, ‘কত বড় বেয়াদব! স্টেজে আমি প্রধান অতিথি। আমার চেয়ারে তোয়ালে নাই। আর তাঁর চেয়ারে তোয়ালে!’
ফরহাদ হোসেনের জবাব শুনে তিনি অনেকটা বিরক্ত হয়ে তাঁর কথার জবাব না দিয়ে আর্দালি জামালকে বললেন, ‘স্যারকে কফি দাও’ এবং তিনি আমার সঙ্গে কথা বলতে শুরু করলেন।
সংরক্ষিত নারী আসন নিয়ে আরেকটি বড় সমস্যা হবে স্থানীয় পর্যায়ে উন্নয়ন কার্যক্রম, দরপত্র, সরকারি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে চাকরি ও কোম্পানি নিয়োগ এবং বিভিন্ন বরাদ্দ ভাগাভাগিকে কেন্দ্র করে। দুই এমপিই চাইবেন নির্বাচনী এলাকার যেখানে তাঁর ভোট অথবা সমর্থন বেশি, সেখানে উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়ন করতে। সেখানকার মানুষকে বেশি চাকরি দিতে।
সরকারি-বেসরকারি কোনো নিয়োগ হলে দুই এমপি আলাদা তালিকা নিয়ে হাজির হবেন। এক এমপি বলবেন, ‘আমার ওই ইউনিয়নে রাস্তা বানাতে হবে, ভবন বানাতে হবে, মেরামত করতে হবে।’ আরেক এমপি বলবেন, ‘ওখানে হবে না। আমার ইউনিয়নে হবে।’ কারণ, এসব উন্নয়ন প্রকল্পের মাধ্যমেই স্থানীয় পর্যায়ে রাজনীতি নিয়ন্ত্রিত হয়।
স্থানীয় পুকুর, খাল, জলাশয় লিজ নিয়ে বেধে যাবে দুই এমপির গ্রুপের মধ্যে মারামারি, হানাহানি। এ ছাড়াও স্থানীয় পুলিশ পড়ে যাবে বিপদে। এক এমপি বলবেন, ‘ওকে ধরো, ওকে ছাড়ো।’ আরেক এমপি বলবেন, ‘ধরতে পারবে না, ছাড়তে পারবে না।’
স্থানীয় পর্যায়ের সামান্য এই সম্পদ নিয়ে কাড়াকাড়িই বাস্তবতা।
এসব হালুয়া-রুটির ভাগাভাগির জন্যই এমপিদের হয়ে রাজনৈতিক কর্মীরা খুনোখুনি করে, মোটরসাইকেল মহড়া দেয়, মিছিল-সমাবেশ করে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে একে অপরের চরিত্র হনন এবং অপতথ্য প্রচারে জীবন বিনিয়োগ করে। এটিই এদের পেশা। এসব রাজনৈতিক নেতাকর্মী বছরের পর বছর নেতা-নেত্রীর প্রতি আনুগত্য দেখায়।
এ অবস্থা থেকে মুক্তির জন্য এমপিদের উন্নয়ন কর্মকাণ্ড থেকে দূরে রাখতে হবে। কিন্তু সেটি সম্ভব কিনা, সে ব্যাপারে চিন্তা করতে হবে।
আমার ক্ষুদ্র অভিজ্ঞতায় বলে, এমপিদের উন্নয়ন কর্মকাণ্ড থেকে দূরে রাখা সম্ভব নয়। কারণ বাংলাদেশের জনগণ এমপিদের আইনপ্রণেতা হিসেবে দেখে না। তারা এমপিদের দেখে ‘এজেন্ট অব ডেভেলপমেন্ট’ অর্থাৎ উন্নয়ন কর্মকাণ্ডের প্রতিনিধি হিসেবে। অনেক ক্ষেত্রেই স্থানীয় সরকার ব্যবস্থা কিছু দুর্বৃত্তের হাতে চলে যাওয়ার কারণেই হয়তো মানুষ এমপিদের উন্নয়ন কাজে দেখতে চায়।
একজন এমপি আইনপ্রণেতা হিসেবে সংসদে যতই সক্রিয় থাকুন, তিনি যদি রাস্তাঘাট, ব্রিজ-কালভার্ট তৈরি অথবা মেরামত না করতে পারেন তাহলে জনগণ তাঁকে ভোট দেয় না।
আবার স্থানীয় পর্যায়ে কাজ না করলে অনেক সময় দলও তাঁকে পরে মনোনয়ন দেয় না। উদাহরণ হিসেবে বলা যায় নীলফামারীর এমপি কর্নেল (অব.) মারুফ সাকলান ও নড়াইলের এস কে আবু বাকেরের কথা। নবম সংসদে এই দুই আওয়ামী লীগদলীয় এমপি সবচেয়ে বেশি হাজির থেকেছেন। সংসদীয় কাজে তাদের অংশগ্রহণ দেখা যেত। কিন্তু পরবর্তী নির্বাচনে ওই দু’জন মনোনয়নই পাননি।
শরীয়তপুর জেলার নড়িয়া আসনের এমপি এবং আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার আসামি কর্নেল (অব.) শওকত আলী সংসদের ডেপুটি স্পিকার ছিলেন। সংসদ সদস্য হিসেবে তিনি সংসদীয় কাজে অনেক সিরিয়াস ছিলেন। কিন্তু তাঁর এলাকার মানুষদের জিজ্ঞেস করলে বলতেন, ‘তিনি লোক ভালো, কিন্তু কোনো কাজ করেননি। তিনি ভোট পাবেন না।’
তাহলে কি নারীরা সংসদ সদস্য হবেন না? অবশ্যই হবেন। তবে রাজনৈতিক ক্ষমতায়নের জন্য নারীদের রাজনীতিতে আসার সুযোগ করে দিতে হবে। তৃণমূলে নারীদের রাজনীতিতে প্রবেশ সীমিত
করে সংরক্ষিত আসনের মাধ্যমে সংসদে নির্বাচিত করে আনলে লাভ হওয়ার সম্ভাবনা খুবই কম।
রাজনীতিতে নারীদের সুযোগ নিশ্চিতকরণ বিষয়ে আলোচনার আগে জানতে হবে নারীরা কেন রাজনীতিতে আসতে চান না।
প্রথম সমস্যা হলো রাজনীতির নামে স্থানীয় পর্যায়ে গুন্ডামি, সহিংসতা ও বিভিন্ন ধরনের নোংরামি। নারীর শারীরিক ও সামাজিক নিরাপত্তার অভাব ও অসম্মানের আশঙ্কা।
কোনো নারী রাজনীতি করতে আগ্রহী হলে প্রথম বাধা আসে পরিবার থেকেই। তারা মনে করেন, মেয়ে রাজনীতি করলে সমাজের মানুষ ভালোভাবে নেবে না। বিভিন্ন স্থানে বিভিন্ন সময় যেতে হবে এবং সেখানে তাঁর মেয়ের নিরাপত্তা হুমকির মুখে পড়তে পারে। এমন হলে সেই মেয়ের ভালো বিয়ের সম্বন্ধ আসবে না।
স্থানীয় পর্যায়ে রাজনীতির আরেকটি বাস্তবতা হলো, পুরুষরা যতটুকু পেশিশক্তি দেখাতে পারেন, নারীরা সেটি পারেন না। এ ছাড়া কোনো নারী রাজনীতিতে এগিয়ে গেলে তাঁকে বিভিন্ন বিশেষণ দিয়ে নারীবিদ্বেষ ছড়ানো হয়। সমাজে খুব মুখরোচকভাবে বিভিন্ন বিষয় প্রচার করা হয়। বর্তমান সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ও অপতথ্য প্রচারের যুগে নারীরা আরও বেশি করে বিদ্বেষের শিকার হবেন।
তাই বলে তো বসে থাকা যাবে না। নারীদের রাজনীতিতে আনতে হবে। সুযোগ করে দিতে হবে। এ জন্য দরকার রাজনৈতিক নেতৃত্বের উদার দৃষ্টিভঙ্গি। রাজনীতিতে সহিংসতা ও গুন্ডামির সংস্কৃতি বন্ধ করতে হবে। এ জন্য রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে দরকার মতৈক্য। আর এটি শুরু করা যেতে পারে কলেজ ছাত্র সংসদ নির্বাচনের মাধ্যমে। সরকারিভাবে প্রতিটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ছাত্র সংসদ নির্বাচনে অর্ধেক সংখ্যক ছাত্র এবং অর্ধেক সংখ্যক ছাত্রী প্রতিনিধি নির্বাচনের ব্যবস্থা করতে হবে।
এ ছাড়া ইউনিয়ন ও উপজেলা পর্যায়ে মেয়েদের সংশ্লিষ্ট করতে হবে। একই সঙ্গে রাজনৈতিক দলের নেতৃত্ব নির্ধারণ করতে হবে গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় কর্মীদের ভোটের মাধ্যমে। এভাবে তৃণমূল থেকে নেতৃত্ব উঠে আসবে। এই প্রক্রিয়ায় কয়েক বছরের মধ্যেই তারা জেলা পর্যায়ে এবং কেন্দ্রীয়ভাবেই রাজনীতিতে চলে আসবেন।
নারীদের অর্থবহ ক্ষমতায়নে সংসদে সংরক্ষিত আসনের ব্যবস্থা করে সুফল পাওয়ার সম্ভাবনা খুব কম। নারীর ক্ষমতায়ন প্রক্রিয়া শুরু করতে হবে স্থানীয় পর্যায় থেকে; ওপর থেকে নিচের দিকে নয়। মূলধারার রাজনীতিতে নারীদের সংখ্যা বৃদ্ধি না করে শুধু সংসদে সংরক্ষিত আসন নিশ্চিত করে তেমন লাভ হবে না।
কামরান জেরা চৌধুরী: সাংবাদিক