আমাদের শাসকশ্রেণি নিজেরা পুঁজিবাদী বিশ্বের সেবক ও কর্মচারী। ওই যে সৎ ও যোগ্য হিসেবে আবির্ভূত হতে চাচ্ছেন তারা, এই সেবা ও কর্মনির্বাহের কাজটা তারা খুবই ভালোভাবে করতে পারবেন এমনটা ভাবা খুবই সংগত। কেননা এরা চিরকালই সুবোধ ছিলেন। দুষ্ট ছেলেরা যখন আন্দোলন করেছে, জেল খেটেছে, যুদ্ধে গেছে তারা তখন ঘরের দরজা বন্ধ করে পড়াশোনা করেছেন। ফলে পরীক্ষার ফলটা ভালো হয়েছে, চাকরি ও পেশায় উপযুক্ত স্থান পেয়েছেন, আনুগত্য ও কর্মদক্ষতা দেখিয়ে সুনাম অর্জন করেছেন। এখন ঋণদান নামক সেবা প্রতিষ্ঠান খুলে বসেছেন, কিন্তু মোটেই টায়ার্ড হননি; এখন চেষ্টা করছেন নির্বাচনে জিতে আগের মতো আর ড্রাইভারের আসনে থাকবেন না, খোদ মালিকদের একজন হয়ে যাবেন। এবং সততা ও যোগ্যতার সঙ্গে পুঁজিবাদের এবং সাম্রাজ্যবাদী প্রভুদের সেবা করতে থাকবেন। এই কাজ রাজনীতিকরাও করেন, কিন্তু অতটা সততা ও যোগ্যতার সঙ্গে করতে পারেন না; আর পারেন না বলেই তো সৎ ও যোগ্যদের আজ এত বেশি প্রয়োজন।

এরা নির্বাচনে জয়ী হবেন এমন স্বপ্নকে আসলে তাই দুঃস্বপ্নই বলতে হবে, দেশের কথা ভাবলে। তবে নির্বাচন যদি না হয় বা কোনো তৃতীয় শক্তির দরকার দেখা দেয় তাহলে লোক তো লাগবে। এদের তখন চাহিবা মাত্র পাওয়া যাবে। ছেলেবেলায় বয় স্কাউট বন্ধুদের দেখতাম বাহুতে ব্যাজ ধারণ করতে, তাতে লেখা থাকত– ‘রেডি’ অর্থাৎ প্রস্তুত থেকো; মানুষের বিপদ দেখলেই ঝাঁপিয়ে পড়তে হবে এটা জেনে এরাও হয়তো ওই রকমই বয় স্কাউট বাহিনী হিসেবে তৈরি থাকবেন, প্রয়োজন হলেই ঝাঁপিয়ে পড়বেন। 


এই উপলক্ষে নির্বাচন জিনিসটার দিকেও ফিরে তাকানো যেতে পারে। বর্তমানে এটি একটি পঞ্চবার্ষিক উৎসব বটে। তামাশাও বলা চলে। হইচই, হট্টগোল, মিটিং-মিছিল চলতে থাকে, টাকার স্রোত বহমান রয়, নানা রঙের ছবি ও বিজ্ঞাপনে এলাকা ছেয়ে যায়। হয়তো সরকার বদলায়, কিন্তু তাতে জনগণের কোনো লাভ হয় না। রাষ্ট্রের মালিকানা তাদের হাতে আসে না।
অতীতে জনবিক্ষোভকে তুঙ্গে পৌঁছতে আমরা দেখেছি এবং প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই দেখেছি নির্বাচনের মধ্য দিয়ে সেই বিক্ষোভের সাময়িক প্রশমন এবং বিপন্ন রাষ্ট্রব্যবস্থার সংরক্ষণ। ১৯৪৫-৪৬-এ অখণ্ড বঙ্গে একটা পরিস্থিতি গড়ে উঠছিল, যাকে বলা যায় প্রায়-বৈপ্লবিক। তখন এলো ছেচল্লিশের নির্বাচন। নির্বাচনে কংগ্রেস ও লীগ, দুই পক্ষ দু’দিক থেকে বিজয়ী হয়ে এলো, তাদের মধ্যে বাধল দাঙ্গা এবং পরিণামে ভাগ হয়ে গেল দেশ। ১৯৫২ সালে পূর্ববঙ্গের মানুষ একটা অভ্যুত্থান ঘটিয়ে ফেলেছিল; তখন এলো চুয়ান্নর নির্বাচন, জয়ী হলো যুক্তফ্রন্ট। নির্বাচনের পরে কোনো প্রতিপক্ষ ছিল না, তাই যুক্তফ্রন্ট নিজেই দু’ভাগ হয়ে দক্ষযজ্ঞ পরিস্থিতি শুরু করে দিল, পরিণতিতে পাওয়া গেল সামরিক শাসন। অভ্যুত্থান ঘটেছে ১৯৬৯-এ; এলো সত্তরের নির্বাচন। নির্বাচন শেষে দেখা দিল হানাদারদের গণহত্যা অভিযান। এরশাদবিরোধী অভ্যুত্থানের পরেও একই ঘটনা দেখা গেছে, নির্বাচন এসেছে, জনতা শান্ত হয়েছে। কিন্তু জনজীবনে তেমন কোনো পরিবর্তন ঘটেনি। তারপর একের পর এক নির্বাচন হচ্ছে, সরকার বদলাচ্ছে, কিন্তু তাতে রাষ্ট্র যে জনগণের হবে তেমন ঘটনা ঘটছে না। বরঞ্চ যাতে না ঘটে, রাষ্ট্র যাতে শাসকশ্রেণির হাতেই থাকে, তারই বন্দোবস্ত করা হচ্ছে।

সৎ ও যোগ্য লোকের শাসন চাই– এই আওয়াজ প্রথমে শোনা গিয়েছে জামায়াতে ইসলামীর কণ্ঠে। তখন তাদের জোর ছিল না; তারা যেহেতু চিহ্নিত ছিল যুদ্ধাপরাধী হিসেবে, তাই কিছুটা নিচু গলাতেই কথা বলত। ভাবখানা এ রকমের যে তারাই যোগ্য, পূতপবিত্র, কেননা ধর্মীয়। তাদের হাত যে মানুষের রক্তে রঞ্জিত, সেটা ভুলে যেত। অন্য কোনো ধ্বনি তোলা তাদের পক্ষে সম্ভবও ছিল না। কেননা তারা গণতন্ত্রে বিশ্বাস করে না, মানুষের রুটিরুজির পক্ষে যে দাবি তুলবে তাও পারে না, কারণ ওসব দাবি একেবারেই ইহজাগতিক। এগুলোর কথা সমাজতন্ত্রীরা বলতে পারে, জামায়াতীদের পক্ষে বলাটা পাপাচার। জামায়াতীরা দেশের শাসকশ্রেণির কাছ থেকে নানা প্রকারের প্রশ্রয় পেয়েছে, এখন ক্ষমতার অংশীদার হতে চাচ্ছে। 
আমাদের ভদ্রসমাজের বন্ধুরা ইসলামী শাসন চান না, তারা চান সৎ ও যোগ্য মানুষদের সংসদীয় শাসনব্যবস্থা। তারা চান রাষ্ট্র যেমন আছে তেমনি থাকুক, থাকুক আমলাতন্ত্রী ও পুঁজিবাদী, করতে থাকুক বিশ্ব পুঁজিবাদের আজ্ঞামত আচরণ, এখন যেমন করছে। তবে রাষ্ট্রীয় কাজের মধ্যে আসুক সততা ও যোগ্যতা। অর্থাৎ আরও দক্ষতার সঙ্গে চলুক জননিপীড়ন এবং দেশের সম্পদ বিদেশিদের হাতে তুলে দেওয়ার কাজ।

কিন্তু জনগণ কী করবে? তাদের তো নিজস্ব কোনো দল নেই। বুর্জোয়া দল কোনোটাই তাদের মিত্র নয়, শত্রু বটে; এবার সঙ্গে আবার যুক্ত হয়েছে ভদ্রসমাজ, যারা চায় জনগণের বিরোধী যে পক্ষ অর্থাৎ দেশের শাসকশ্রেণি তাদের দুর্নীতিবাজ, দুর্বৃত্ত ইত্যাদি বলে চিহ্নিত হয়ে যাওয়া অংশটিকে পেছন ঠেলে দিয়ে ভদ্র চেহারার মানুষেরা সামনে আসুন, ভদ্রবেশে অভদ্র কাজ করার জন্য।
সৎ ও যোগ্য ব্যক্তিরা নিজেরাই একটি রাজনৈতিক দল খাড়া করার কাজ ইতোমধ্যে করেছেন। কিন্তু দল গড়ায় বিঘ্ন রয়েছে। তা হলে উদ্দেশ্য, লক্ষ্য, কর্মসূচি ইত্যাদি প্রকাশ করতে হবে এবং সেগুলো প্রকাশ পেলে জনগণ যে তাদের প্রতি সবিশেষ আকৃষ্ট হবে এমনটা আশা করা দুষ্কর। তার চেয়ে ভালো এসব জিনিস প্রচ্ছন্ন রেখে নিজেদের ব্যক্তিগত দ্যুতিকে সামনে আনা, মানুষকে ধারণা দেওয়া যে তাদের কাজের চেয়ে তারা মহৎ।

নির্বাচন আসবে, নির্বাচন যাবে, কিন্তু প্রশ্ন হলো, যে রাষ্ট্র জনগণ প্রতিষ্ঠা করেছে, সে রাষ্ট্রের কর্তব্য জনগণের হাতে আসবে কিনা। নির্বাচিত মানুষেরা জনগণের কাছ থেকে ভোট নেবেন এবং সর্বশক্তি দিয়ে চেষ্টা করবেন রাষ্ট্রকে জনগণের বিরুদ্ধে ব্যবহার করে নিজেদের স্বার্থসিদ্ধি করতে।
বাংলাদেশে যা প্রয়োজন তা হলো, একটি মৌলিক সামাজিক পরিবর্তন; যাকে বিপ্লবই বলা চলে। পুকুরের পানি যদি দূষিত হয়ে পড়ে, তবে তাতে মাছ বাঁচে কী করে? পুকুরে দরকার নতুন পানির। সমাজ বদলানোর পথে প্রধান প্রতিপক্ষ কে? নিঃসন্দেহে দেশের শাসকশ্রেণি। নির্বাচন হচ্ছে ক্ষমতার ভাগাভাগি নিয়ে শাসকশ্রেণির বিভিন্ন অংশের ভেতর একটা যুদ্ধ। খেলাও বলা যায়। সেই খেলায় জনগণ অংশ নেয়; কেননা খেলা জিনিসটা সব সময়ই উপভোগ্য বটে, উত্তেজকও বৈকি। তাতে আমরা যোগ দেব নিশ্চয়ই, কিন্তু আশা করব না যে, ওই খেলা জনগণের মুক্তি আনবে। মুক্তির পথটা ভিন্ন। সেটা আন্দোলনের। সেই আন্দোলনের, যেটি হবে একই সঙ্গে দেশপ্রেমিক ও গণতান্ত্রিক।
ইতোমধ্যে ছেলেখেলা চলবে, কোনোটা টিকবে তিন দিন, কোনোটা ৯ দিন, কিন্তু খেলোয়াড়রা থামবে না, খেলতেই থাকবে, যতক্ষণ না সমাজ ও রাষ্ট্র পরিবর্তনের আন্দোলন জোরদার হচ্ছে, আলো না ফুটলে অন্ধকার তো থাকবেই, থাকছেই। 

সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী: ইমেরিটাস অধ্যাপক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
 

.

উৎস: Samakal

কীওয়ার্ড: র জন ত সৎ ও য গ য জনগণ র

এছাড়াও পড়ুন:

বিএনপির ৩১ দফা বাস্তবায়নের লক্ষ্যে রূপগঞ্জে লিফলেট বিতরণ 

আওয়ামীলীগ দেশের মানুষের অধিকার হনন করেছে। তাই, দেশে এক গণবিপ্লবের সৃষ্টি হয়েছে। ২৪এর গণঅভ্যুত্থানের মাধ্যমে আওয়ামীলীগ এ দেশ থেকে বিতারিত হয়েছে বলে মন্তব্য করেছেন কেন্দ্রীয় যুবদলের সাবেক যুগ্ম সম্পাদক ও রূপগঞ্জ আসনের বিএনপির মনোনয়ন প্রত্যাশী মোহাম্মদ দুলাল হোসেন। 

বৃহস্পতিবার বিকেলে নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জের ভোলাব ইউনিয়নের আতলাপুর বাজার এলাকায় বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের ঘোষিত রাষ্ট্র কাঠামো মেরামতের ৩১ দফা বাস্তবায়নের লক্ষ্যে লিফলেট বিতরণকালে মোহাম্মদ দুলাল হোসেন এসব কথা বলেন। 

লিফলেট বিতরণকালে উপস্থিত ছিলেন স্থানীয় সাধারণ মানুষ, বিএনপি-যুবদলসহ অঙ্গ-সহযোগী সংগঠনের নেতাকর্মীরা। 

মোহাম্মদ দুলাল হোসেন আরও বলেন, “গত ১৭ বছর ধরে এ দেশের জনগণ একদলীয় শাসন ও ফ্যাসিবাদের শিকার হয়ে জিম্মি হয়ে ছিল। মানুষের বাকস্বাধীনতা, গণতন্ত্র ও ভোটাধিকার হরণ করা হয়েছিল। কিন্তু ২০২৪ সালের গণজাগরণের মধ্য দিয়ে জনগণ আবারও তাদের অধিকার পুনরুদ্ধার করতে পেরেছে। এখন সময় এসেছে মানুষের ভোটাধিকার ফিরিয়ে দেওয়ার, একটি সত্যিকার গণতান্ত্রিক সরকার প্রতিষ্ঠার।”

তিনি আরও বলেন, “তারেক রহমানের ৩১ দফা দেশের পুনর্গঠনের পথনির্দেশনা। এই দফাগুলোতে অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধার, বিচার বিভাগের স্বাধীনতা, মানবাধিকার, দুর্নীতিমুক্ত প্রশাসন ও গণমাধ্যমের স্বাধীনতা নিশ্চিত করার রূপরেখা দেওয়া হয়েছে। এ লক্ষ্যে সবাইকে ঐক্যবদ্ধভাবে এগিয়ে আসতে হবে।”

এসময় স্থানীয় যুবদল ও ছাত্রদল নেতৃবৃন্দও লিফলেট বিতরণে অংশগ্রহণ করেন। তারা সাধারণ মানুষকে বিএনপির পক্ষ থেকে আশ্বস্ত করেন যে, দেশকে সঠিক পথে এগিয়ে নিতে তারা রাজনৈতিকভাবে প্রস্তুত এবং জনগণের পাশে থাকবে।

স্থানীয়রা জানান, তারা দীর্ঘদিন ধরে নিপীড়ন-নির্যাতনের শিকার। একটি সত্যিকারের গণতান্ত্রিক সরকার প্রতিষ্ঠা এবং নাগরিক অধিকার ফিরিয়ে আনার প্রত্যাশা করছেন তারা। এ ধরনের লিফলেট বিতরণ কার্যক্রমে জনগণ আরও বেশি সচেতন হবে বলে আশাবাদ ব্যক্ত করেন তারা।

প্রসঙ্গত, বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান চলতি বছরের শুরুতে ৩১ দফা কর্মসূচি ঘোষণা করেন, যেখানে রাষ্ট্র সংস্কার ও জনগণের অধিকার পুনঃপ্রতিষ্ঠার লক্ষ্য তুলে ধরা হয়।
 

সম্পর্কিত নিবন্ধ

  • ইসির প্রতিটি কাজে জবাবদিহি থাকতে হবে
  • জুলাই সনদে আমাদের যে সম্মতি সেটি আইনের ঊর্ধ্বে: সালাহউদ্দিন
  • সন্ত্রাস, চাঁদাবাজ ও মাদকমুক্ত বন্দর গড়তে চাই : সাখাওয়াত
  • বিএনপির ৩১ দফা বাস্তবায়নের লক্ষ্যে রূপগঞ্জে লিফলেট বিতরণ 
  • জুলাই আন্দোলনকে মুক্তিযুদ্ধের সঙ্গে জড়াবেন না: টুকু
  • সবাই অপেক্ষা করছে একটা নির্বাচনের জন্য
  • সরকারের ভুল সিদ্ধান্তে দেশে ফ্যাসিবাদ, উগ্রবাদ মাথাচাড়া দিতে পারে: তারেক রহমান
  • সরকারের একটি অংশ অপকৌশলের আশ্রয় নিচ্ছে: তারেক রহমান
  • ট্রাম্পের প্রতি মার্কিন জনগণের সমর্থন ৪০ শতাংশে ঠেকেছে
  • জাতিসংঘে সম্মেলনের ফাঁকে বাংলাদেশ-পাকিস্তান বৈঠক, ফিলিস্তিন ইস্যুতে উদ্বেগ