সরকারব্যবস্থায় কেন্দ্রের আধিপত্য ও প্রান্তের নীরবতা
Published: 4th, November 2025 GMT
জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের পর বাংলাদেশের সমাজ-রাজনীতির সামনে প্রধান প্রশ্নটা কে ক্ষমতায় আসবে তা নয়, বরং রাষ্ট্রের কাঠামো কেমন হবে—এই প্রশ্নই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। যে ক্ষমতার ভারসাম্য এত দিন ঢাকার কেন্দ্রভূমিতে আটকে ছিল, এখন সেটিকে নতুনভাবে কল্পনা করার সময় এসেছে।
কেমন হবে সেই নতুন কাঠামো? সেখানে কেন্দ্র ও প্রান্তের সম্পর্ক কীভাবে পুনর্গঠিত হবে? এই কাঠামোয় সাধারণ মানুষ, বিশেষ করে প্রান্তিক ও গ্রামীণ জনগণ, কীভাবে নিজের অভিজ্ঞতা, প্রয়োজন ও চাহিদার জন্য জায়গা তৈরি করবে? গণতন্ত্র যদি কেবল ভোটের মধ্যে সীমাবদ্ধ না থেকে জীবনের প্রতিদিনের বাস্তবতায় প্রভাব ফেলতে চায়, তবে এই প্রশ্নগুলোর উত্তর খুঁজতেই হবে। স্থানীয় সরকারব্যবস্থার মৌলিক সংস্কারের মধ্য দিয়ে এই প্রশ্নগুলোর যৌক্তিক উত্তর খুঁজে পাওয়া সম্ভব।
নামেই বিকেন্দ্রীকরণবাংলাদেশের উন্নয়ন–কাহিনি প্রায়ই কেন্দ্রের সাফল্যের গল্পে আটকে থাকে। ঢাকামুখী অর্থনীতি, নীতি, প্রশাসন ও ক্ষমতার একচেটিয়া প্রবাহই এ দেশের রাজনীতির স্থায়ী বৈশিষ্ট্য। এই কাঠামোতে গ্রাম, উপজেলা, ইউনিয়ন থাকে সিদ্ধান্তের বাইরে। বস্তুত বাংলাদেশে কেন্দ্র ও প্রান্তের মধ্যকার প্রকট বৈষম্য টিকে আছে কেন্দ্রের তুলনায় ক্ষমতাহীন এবং কেন্দ্রের ওপরে নির্ভরশীল বৈষম্যমূলক স্থানীয় সরকারব্যবস্থার মাধ্যমে।
বাংলাদেশের স্থানীয় সরকারব্যবস্থা একধরনের ঐতিহাসিক বৈষম্যের মধ্যে গড়ে উঠেছে। এটি নামেই ‘বিকেন্দ্রীকৃত’, বাস্তবে কেন্দ্রীয় নিয়ন্ত্রণের দীর্ঘ ছায়ায় আবদ্ধ। গ্রামীণ ইউনিয়ন পরিষদ, যা সবচেয়ে পুরোনো ও জনগণের সবচেয়ে কাছের প্রতিষ্ঠান—আজ কার্যত মন্ত্রণালয়ের এক্সটেনশন অফিস। তাদের বাজেট, প্রকল্প, এমনকি কর্মচারী নিয়োগও নির্ধারিত হয় ঢাকায়।
শহরের সিটি করপোরেশন ও পৌরসভাগুলো তুলনামূলকভাবে বেশি আর্থিক ও প্রশাসনিক স্বাধীনতা ভোগ করে এবং তাদের সিদ্ধান্ত দ্রুত বাস্তবায়িত হয়। কারণ, তারা কেন্দ্রীয় নেটওয়ার্কের অংশ। উদাহরণস্বরূপ—ঢাকায় একজন নাগরিকের জন্য যে পরিমাণ রাজস্ব ব্যয় হয়, তা একটি গ্রামীণ ইউনিয়ন পরিষদের মানুষের জন্য ব্যয়ের চেয়ে বহুগুণ বেশি। অথচ এখনো প্রায় ৭০ শতাংশ মানুষ বাস করে গ্রামে, যেখানে সন্তানের জন্মনিবন্ধন থেকে শুরু করে বয়স্ক ভাতা বা আশ্রয় প্রকল্প—সবকিছুতেই ইউনিয়ন পরিষদের ওপর নির্ভর করে। কিন্তু ইউনিয়ন পরিষদের হাতে বাজেট, কর্মী, প্রযুক্তি বা নীতিনির্ধারণের ক্ষমতা প্রায় নেই বললেই চলে।
এই কাঠামো কেবল প্রশাসনিক নয়, রাজনৈতিক ক্ষমতারও প্রতিফলন, যেখানে সিদ্ধান্ত নেওয়ার অধিকার কিছু গোষ্ঠীর হাতে কেন্দ্রীভূত, প্রান্তিক মানুষের বাস্তব অভিজ্ঞতা ও চাহিদা রয়ে যায় প্রান্তেই।
উপজেলা, ইউনিয়ন ও জেলা পরিষদের প্রতিনিধিরা নির্বাচিত হলেও তাঁদের বাস্তব ক্ষমতা সীমিত। বাজেট, উন্নয়ন প্রকল্প বা প্রশাসনিক সিদ্ধান্তের চাবিকাঠি থাকে কেন্দ্রীয় আমলাতন্ত্রের হাতে। ফলে প্রান্তিক জনগণ স্থানীয় সরকারের মাধ্যমে নিজেদের প্রয়োজন ও অভিজ্ঞতা রাষ্ট্রীয় নীতিতে প্রতিফলিত করতে পারেন না। এ কারণেই উন্নয়ন পরিকল্পনা অনেক সময় মানুষের বাস্তবতার সঙ্গে মেলে না; যেখানে রাস্তা আছে, সেখানে আবার রাস্তা হয়, আর যেখানে বন্যা প্রতিরোধ বাঁধ দরকার, সেখানে বরাদ্দ মেলে না।
রাজনৈতিক অর্থনীতির বাস্তবতাএই অন্যায্য ও অসম কাঠামো কেবল প্রশাসনিক ব্যর্থতা নয়; বরং একটি রাজনৈতিক অর্থনৈতিক বিন্যাস, যেখানে ক্ষমতা, সম্পদ ও প্রভাব কিছু এলিট গোষ্ঠীর হাতে কেন্দ্রীভূত। নয়া মার্ক্সবাদী বিশ্লেষণে রাষ্ট্রকে দেখা হয় এলিট শ্রেণির স্বার্থরক্ষাকারী যন্ত্র হিসেবে। বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে এই শ্রেণি কেবল অর্থনৈতিক নয়, প্রশাসনিক ও রাজনৈতিকও বটে, যারা ক্ষমতার কেন্দ্রে অবস্থান করে রাষ্ট্রীয় সম্পদ বণ্টনের নিয়ম নির্ধারণ করে।
কেন্দ্রীকৃত কাঠামো মানে ক্ষমতা সীমিত মানুষের হাতে। সিদ্ধান্ত হয় ঢাকায়, কিন্তু তার প্রভাব পড়ে প্রত্যন্ত গ্রামের মানুষের জীবনে। এই ‘এলিট ক্যাপচার’–এর ফলে স্থানীয় মানুষ, বিশেষ করে নারী, দরিদ্র ও প্রান্তিক গোষ্ঠীগুলো নীতিনির্ধারণ থেকে ছিটকে যায়। ইউনিয়ন পরিষদ, পৌরসভা ও জেলা পরিষদ নির্বাচনের মাধ্যমে যেসব প্রতিনিধিত্বমূলক কাঠামো তৈরি হয়, তা প্রকৃত অর্থে অংশগ্রহণমূলক হতে পারে না। কারণ, সিদ্ধান্তের বাস্তব ক্ষমতা তাদের হাতে নেই। ফলে গণতন্ত্র কেবল ভোটের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকে, নাগরিক অংশগ্রহণ হয়ে যায় প্রতীকী। স্থানীয় পর্যায়ের রাজনৈতিক জীবনে যে নৈরাজ্য, দুর্নীতি বা হীনম্মন্যতা দেখা যায়, তা এই কাঠামোগত অক্ষমতারই প্রতিফলন।
এখন প্রশ্ন হলো কেন এই অসম কাঠামো এত দিন টিকে আছে? উত্তর লুকিয়ে আছে রাজনৈতিক অর্থনীতির যুক্তিতে। কেন্দ্রীয় ক্ষমতা ও সম্পদ নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে একটি পারস্পরিক নির্ভরতার চক্র তৈরি হয়েছে। রাজনীতিকেরা নিয়ন্ত্রণে রাখতে চান প্রশাসন ও সম্পদ, আমলারা চান নীতি ও প্রক্রিয়ার মালিকানা। উভয় পক্ষই এই কেন্দ্রীকরণ থেকে লাভবান। কেন্দ্রীয় সরকার ও প্রশাসনের জন্য এই বৈষম্য আসলে একটি ‘ইনসেনটিভ স্ট্রাকচার’ এবং এখানেই নিয়ন্ত্রণ, নিয়োগ, প্রকল্প ও সম্পদ বণ্টনের সুযোগ। বিকেন্দ্রীকরণ মানে এই নিয়ন্ত্রণ হারানো। ক্ষমতাসীন গোষ্ঠীর স্বার্থ এই কেন্দ্রীভূত কাঠামো টিকিয়ে রাখার মধ্যেই নিহিত। ফলে সংস্কারের প্রস্তাব যতই থাকুক, বাস্তবায়িত হয় না। বাস্তবে বিকেন্দ্রীকরণ মানে রাজনৈতিক দল, আমলাতন্ত্র ও অর্থনৈতিক অভিজাত শ্রেণির মধ্যকার স্বার্থের শৃঙ্খল ভাঙা। তা সম্ভব হয়নি। এটাই স্থানীয় সরকারব্যবস্থা সংস্কারের মূল রাজনৈতিক বাধা।
প্রান্তিক মানুষের সেবা পাওয়ার কথা ইউনিয়ন পরিষদে। বরিশাল সদরের শায়েস্তাবাদ ইউপি কার্যালয়.উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: স থ ন য় সরক র এই ক ঠ ম র জন ত ক প রকল প ক ষমত র র জন য
এছাড়াও পড়ুন:
‘জাহানারার অভিযোগ ভিত্তিহীন, কল্পিত এবং সত্যতার কোনো অংশে মিল নেই
বাংলাদেশ জাতীয় নারী দলের ক্রিকেটার জাহানারা আলম অস্ট্রেলিয়াতে থিতু হয়েছেন। সিডনিতে খেলার পাশাপাশি কোচিংয়েও হাত পাকাচ্ছেন। এরই মধ্যে ক্রিকেট অস্ট্রেলিয়া থেকে লেভেল ২ কোচিং কোর্স সম্পন্ন করেছেন। যা নিঃসন্দেহে নারী ক্রিকেটের জন্য বিরাট খবর।
কিন্তু হঠ্যাৎ তাকে নিয়ে আলোচনার কারণ বাংলাদেশের ক্রিকেট। সম্প্রতি দৈনিক কালের কণ্ঠকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে জাতীয় দলের অধিনায়ক নিগার সুলতানা জ্যোতির বিরুদ্ধে দলে আধিপত্য বিস্তার, সিন্ডিকেট তৈরি, ক্রিকেটারদের মারধর করা, জুনিয়র ক্রিকেটারদের ব্যক্তিগত কাজে ব্যবহার করাসহ নানা অভিযোগ করেছেন। ড্রেসিং রুমে ভয়ের পরিবেশ বিরাজ করছে এবং নানা শঙ্কায় অনেকে মুখ খুলতে পারছেন না বলেও দাবি করেন তিনি। একই সঙ্গে তাকে পরিকল্পিতভাবে বাদ দেওয়া এবং তীর্যক মন্তব্য ও অভিযোগ করেছেন নির্বাচক, অধিনায়ক, স্টাফদের নিয়ে।
তার দেওয়া সাক্ষাৎকার নজরে এসেছে বাংলাদেশে ক্রিকেট বোর্ডের (বিসিবি)। যা কোনোভাবেই ভালোভাবে নেয়নি বিসিবি। জাহানারার বক্তব্য প্রত্যাহার করে বিসিবি সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে জানিয়েছে, জাহানারার সব অভিযোগ ভিত্তিহীন, কল্পিত এবং সত্যতার কোনো অংশে মিল নেই। বোর্ডের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, নারী দল যখন আন্তর্জাতিক স্তরে প্রশংসনীয় অগ্রগতি এবং একতার পরিচয় দিচ্ছে, তখন এমন হানিকর মন্তব্য করা অত্যন্ত দুঃখজনক।
ক্রিকেট বোর্ডের মতে, এই মন্তব্যগুলো সময়োপযোগী নয়, সুপরিকল্পিত এবং বোঝা যায় যে এর উদ্দেশ্য নারী দলের মনোবল ও আত্মবিশ্বাস ক্ষুণ্ন করা। বিসিবি উল্লেখ করেছে, বর্তমানে বাংলাদেশ ক্রিকেটের পরিকল্পনা ও কার্যক্রমে যে ব্যক্তি অংশগ্রহণ করছে না, তিনি জনসমক্ষে বিভ্রান্তিমূলক বক্তব্য দেওয়া অবাঞ্চিত এবং দুঃখজনক।
ওই সাক্ষাৎকারে জাহানারা বলেছেন, “যদি মনে করে কাউকে ‘সাইজ’ করতে হবে, তখন জ্যোতির সঙ্গে আলোচনা করে। জ্যোতির আবার আলাদা একটি গ্রুপ। ওর সঙ্গে আছে পিংকি (ফারজানা হক) ও ইশমা (তানজিম)। রাবেয়া ওর ডান হাত। এখন সুমাইয়াও যোগ হয়েছে। এই হচ্ছে জ্যোতির প্যানেল। এরা যে কী করতে পারে, আপনার কোনো ধারণাই নেই। পুরো ক্রিকেটটাকে এরা ধ্বংস করে দিচ্ছে। ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য সুন্দর পরিবেশটা ওরা রাখছে না। ‘’
তিনি আরো বলেছেন, ‘‘সিলেটে প্রচণ্ড গরমের মধ্যে ৩০ থেকে ৪০ মিনিটের ফিটনেস সেশন করার পর কেউ যখন ঠিকমতো হাঁটতেও পারছে না, তখন দেখি এক জুনিয়র জ্যোতির কিটব্যাগ টেনে এক মাঠ থেকে আরেক মাঠে নিচ্ছে। জুনিয়ররাই সব সময় ওর কিটব্যাগ টানে। কতবার যে জ্যোতিকে বলতে শুনেছি, ‘এই বসে আছিস কেন? যা আমার ব্যাগ নামা।’ জুনিয়ররা আসলে করতে বাধ্য, কিছু করার নেই। সিলেটেরই আরেকটি ঘটনা বলি। দুটি ড্রেসিংরুমের একটি জুনিয়রদের জন্য বরাদ্দ। জ্যোতিকে দেখলাম, ওটায় গিয়ে জুনিয়রদের দিয়ে মাথা টেপাচ্ছে, চুলে তেল দেওয়াচ্ছে।’’
নির্বাচকদের নিয়ে জাহানারার দাবি, ‘‘বাংলাদেশ গেমসের ফাইনালের পর থেকে শুরু হয় আমার সঙ্গে মঞ্জু ভাইয়ের (নারী দলের সাবেক নির্বাচক ও ম্যানেজার মঞ্জুরুল ইসলাম) দুর্ব্যবহার, অপমান ও টিজিং। তখন থেকে মঞ্জু ভাই ও তৌহিদ ভাই (বিসিবির নারী ক্রিকেট বিভাগের সাবেক ইনচার্জ প্রয়াত তৌহিদুর রহমান) আমার ফোন ধরতেন না। উনারা দুজন আমাকে নিয়মিত অপমান করতে শুরু করেন। তাঁরা চাইছিলেন আমি যেন হারিয়ে যাই। ২০২৩ সাল পর্যন্ত ওভাবেই চলছিল। বিকেএসপিতে দল নির্বাচনের অনুশীলন ম্যাচে গিয়ে দেখি আমার সব সুযোগ-সুবিধা বন্ধ। পরে জানতে পারি, মঞ্জু ভাই ও তৌহিদ ভাইয়ের সরাসরি নির্দেশনা ছিল আমাকে কিছু না দেওয়ার। যে সফরে বাদ পড়লাম, তার আগে থেকে জ্যোতিও আমার সঙ্গে কথা বলে না।’’
বিসিবি সরাসরি এমন বিষয় প্রত্যাখ্যান করেছে, ‘‘বিসিবি স্পষ্ট করতে চায়, নারী জাতীয় দলের নেতৃত্ব, খেলোয়াড় ও ব্যবস্থাপনায় বোর্ডের পূর্ণ বিশ্বাস ও আস্থা রয়েছে। বোর্ড কোনো প্রমাণ খুঁজে পায়নি যা এই দাবিগুলোর সমর্থন করে। দল ও এর কর্মীদের পেছনে দৃঢ়ভাবে দাঁড়িয়েছে। এখন পর্যন্ত জাহানারার করা অভিযোগের কোনো প্রমাণ পাওয়া যায়নি এবং বোর্ড দৃঢ়ভাবে দলের পক্ষেই রয়েছে।’’
 
   
ঢাকা/ইয়াসিন