বড় ঝুঁকিতে পোশাক খাতের সফট সিকিউরিটি
Published: 20th, March 2025 GMT
রাষ্ট্রের নিরাপত্তা বা স্টেট সিকিউরিটি নিয়ে যখন আমরা চিন্তা করি, তখন আমাদের মনের অজান্তেই ভেসে ওঠে বড়সড় সামরিক ট্যাংক, মিসাইল, যুদ্ধজাহাজ কিংবা অস্ত্র হাতে দাঁড়ানো কোনো নির্ভীক মুখের প্রতিচ্ছবি। আধুনিক যুগে হার্ড সিকিউরিটির কঠোর-কঠিন অবয়বের বাইরেও সফট সিকিউরিটির একটি কোমল চিত্র রয়েছে, যার নেপথ্যে রয়েছে অর্থনৈতিক নিরাপত্তা, পরিবেশগত নিরাপত্তা, সাইবার নিরাপত্তা, জনস্বাস্থ্য নিরাপত্তা ও সামাজিক নিরাপত্তার মতো বিষয়।
প্রতিদিনকার সীমান্তপাহারা, যুদ্ধকালীন বা জরুরি পরিস্থিতির উদ্ভবে হার্ড সিকিউরিটির প্রয়োজন হয়। মিডিয়াগুলো বড় করে সেসব ঘটনাপ্রবাহ কভার করে। যার কারণে মানুষ এসব বিষয়ে আরও বেশি সচেতন হন এবং বিভিন্ন স্কেলে নিজেদের সম্পৃক্ত করেন।
কিন্তু সফট সিকিউরিটি মানুষের প্রতিদিনকার বিষয়। কথায় আছে, যেটি মানুষের প্রতিদিনের জীবনের অংশ হয়ে যায়, সেসব বিষয় খুব সহজেই নজর এড়িয়ে যায়। যার কারণে বাংলাদেশ রাষ্ট্র কিংবা জনগণ দেশের সীমান্তে কোনো বাংলাদেশি হত্যা কিংবা অন্য কোনো রাষ্ট্রের কোনো এক মন্তব্য বা বাহাস নিয়ে যতটা বেশি শোরগোল ফেলে, সফট সিকিউরিটি প্রশ্নগুলোতে ততটা সরব নয়।
বাংলাদেশের অর্থনীতি নিয়ে নানা ধরনের ব্যাখ্যা ইতিবাচক-নেতিবাচক ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ, দোষারোপ, দুর্নীতি-স্বজনপ্রীতির অভিযোগ, ভুলনীতি, নীতির অস্থায়িত্ব কিংবা ভুল সিস্টেমের মতো অভিযোগ-অনুযোগ রয়েছে। কিন্তু বাস্তবতা যদি চিন্তা করেন, বাংলাদেশের অর্থনীতি এখন মোটাদাগে তিনটি খাতের ওপর নির্ভরশীল। প্রথমত, তৈরি পোশাক খাত যা রপ্তানি আয়ের বৃহৎ অংশের জোগানদাতা। দ্বিতীয়ত, কৃষি খাত যেখানে মোট জনশক্তির প্রায় ৪০-৪৫ শতাংশ মানুষ নিয়োজিত। এর বাইরে রয়েছে প্রবাসী বাংলাদেশিরা; যাঁরা সৌদি আরব, আমিরাত, মালয়েশিয়া, ইউরোপ, যুক্তরাষ্ট্র বা যুক্তরাজ্যের মতো দেশগুলোতে থেকে আয় করে বাংলাদেশে রেমিট্যান্স পাঠান।
বাংলাদেশের অর্থনীতিতে সার্ভিস, আইসিটি, শিল্প ও নির্মাণ খাত গুরুত্বপূর্ণ হলেও এই খাতগুলোর যতটা প্রসার হওয়ার কথা ছিল, আমরা সেই তুলনায় অনেক পিছিয়ে আছি।
তৈরি পোশাক আমাদের রপ্তানি আয়ের বড় একটি খাত হলেও আমাদের বাজার মূলত যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা ও ইউরোপের মধ্যে সীমাবদ্ধ। যদিও আমরা জাপান, অস্ট্রেলিয়া বা লাতিন আমেরিকার কোনো কোনো দেশের বাজারও ধরতে চেষ্টা করছি।
এখন প্রশ্ন হলো, আমরা কত দিন এই সেক্টরের ওপর নির্ভর করে এগোতে পারব? কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (এআই) বা ব্লকচেইন প্রযুক্তির এই যুগে নিত্যনতুন প্রযুক্তির উন্নয়ন হচ্ছে। যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা বা ইউরোপের বড় বড় ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠান বা গ্রুপ যেহেতু অনেক কম দামে বাংলাদেশ থেকে তৈরি পোশাক নিয়ে অনেক বেশি লাভ করতে পারে, তাই তারা সাত সমুদ্র তেরো নদী পার হয়ে হলেও বাংলাদেশে আসছে।
কিন্তু যদি তারা প্রযুক্তির উন্নয়নের মাধ্যমে নিজেদের দেশে কিংবা তাদের কাছাকাছি কোনো দেশে এমন পণ্য পায়, লাভ-ক্ষতির বিবেচনায় যদি লাভের অংশ একই থাকে, তাহলে কি তারা বাংলাদেশ থেকে পণ্য নেবে? সম্ভবত নেবে না। কারণ, যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট হিসেবে দায়িত্ব নেওয়ার পর ডোনাল্ড ট্রাম্প যেভাবে ট্রাম্প ট্যারিফ যুদ্ধ শুরু করেছেন, তাতে স্বল্প মেয়াদে বাংলাদেশ লাভবান হওয়ার সুযোগ থাকলেও দীর্ঘ মেয়াদে এই সেক্টর নিয়ে আমাদের বিস্তৃতভাবে ভাবার ও বিকল্প ব্যবস্থা তৈরি করার বিষয়ে সতর্ক ও মনোযোগী হতে হবে।
এখানে ভিয়েতনাম, চীন, ভারতের মতো শক্তিশালী প্রতিদ্বন্দ্বী আছে। সে কারণে এই খাতকে আরও বেশি অটোমেশন করে প্রোডাকটিভিটি বাড়ানো, নতুন নতুন প্রযুক্তি সংযোজন করা, পণ্য ও বাজার বহুমুখীকরণ এবং ভবিষ্যতের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলার জন্য প্রস্তুতি নেওয়ার এখনই উপযুক্ত সময়।
বাংলাদেশে পোশাক খাতের আরেকটি বড় চ্যালেঞ্জ হলো নিয়মিত বিদ্যুৎ ও গ্যাস সরবরাহ নিশ্চিত করা। গাজীপুরে আমার কর্মকালে দেখেছি, শিল্পপ্রতিষ্ঠানগুলোতে বিদ্যুৎ ও গ্যাসের অভাবে তাদের উৎপাদন ব্যাহত হয়। ফলে শিপমেন্ট বিলম্ব ও বাতিল হয়ে যাওয়ার মতো ঘটনা ঘটে। এ কারণে কখনো কাজ না করিয়ে শ্রমিকদের ছুটি দিতে হয়, আবার কখনো অতিরিক্ত কাজ করাতে হয়। আবার এ দুটিই পরিস্থিতিই শ্রমিক অসন্তোষকে উসকে দেয়। এ কারণে এই খাতে সাসটেইনেবিলিটি নিশ্চিত করতে আমাদের বিকল্প বিদ্যুৎ ও জ্বালানি উৎস নিয়ে ভাবা প্রয়োজন।বিভিন্ন হিসাবে কিছুটা ভিন্নতা থাকলেও বাংলাদেশের তৈরি পোশাক খাতে ৫০ লাখের বেশি শ্রমিক রয়েছেন। এ ছাড়া এ খাত ঘিরে আরও কিছু নির্ভরশীল খাত গড়ে উঠেছে, যেখানে যুক্ত শ্রমিকের সংখ্যাটাও প্রায় এর সমান।
যদি মোটাদাগে আপনি ধরেন, তৈরি পোশাক ও তার নির্ভরশীল খাতে মিলিয়ে এক কোটি শ্রমিক থাকেন এবং তাঁদের পরিবারে অন্তত চারজন করেও সদস্য হিসাব করেন, তাহলে কেবল এই খাতের সঙ্গে বাংলাদেশের কমপক্ষে চার কোটি মানুষের প্রতিদিনকার জীবন প্রত্যক্ষভাবে যুক্ত। পরোক্ষ প্রভাব চিন্তা করলে সেই সংখ্যা আরও বাড়বে। সে হিসাবে এই খাতে যেকোনো ধরনের আকস্মিক বিপর্যয় বাংলাদেশের জন্য সবচেয়ে বড় নিরাপত্তাঝুঁকি হিসেবে আবির্ভূত হবে। এটি শুধু অর্থনৈতিক চাপ তৈরি করে সফট সিকিউরিটি থ্রেটই তৈরি করবে না; বরং দীর্ঘ মেয়াদে হার্ড সিকিউরিটির প্রশ্নেও অনেক বড় প্রভাব ফেলবে।
আমদানি–নির্ভরতা এই খাতের বড় একটি চ্যালেঞ্জ হলেও সেটি নিয়ে খুব বেশি আলোচনা করা হয় না। বাংলাদেশে আমরা এমন এক পোশাক খাতে তৈরি করেছি, যেখানে যাবতীয় মেশিনারিজ, যন্ত্রপাতি, কাঁচামালের ৮০-৮৫ শতাংশই বিদেশ থেকে আমদানি করতে হয়। বিশ্বায়নের এই যুগে বৈদেশিক আমদানি খুবই স্বাভাবিক একটি বিষয় হলেও তা বাংলাদেশের জন্য খুবই বড় ধরনের দুর্বলতা হিসেবে রয়ে গেছে।
পত্রিকার প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০১৯-২০ অর্থবছরে বাংলাদেশের পোশাক খাতে বছরে ৭৩-৭৪ লাখ বেল তুলার চাহিদা ছিল, কিন্তু বাংলাদেশে উৎপাদন ছিল মাত্র ১ লাখ ৭১ হাজার বেল। ফলে ঘাটতি মোকাবিলায় বাংলাদেশকে ৭১ লাখ বেল তুলা আমদানি করতে হয়েছে। এই আমদানির ১৯ শতাংশই এসেছে ভারত থেকে। মালি থেকে আসে ১৩ শতাংশ এবং যুক্তরাষ্ট্র থেকে ১২ শতাংশ। এখন যদি কোনো কারণে ভারত কিংবা মালিতে তুলা উৎপাদন ব্যাহত হয় কিংবা তারা যদি বাংলাদেশের তুলা রপ্তানিতে কোনো ধরনের নিষেধাজ্ঞা বা বৈষম্যমূলক নীতি গ্রহণ করে, তাহলে এটি প্রত্যক্ষভাবেই বাংলাদেশের পোশাক খাতকে নেতিবাচকভাবে প্রভাবিত করবে।
প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প বর্তমানে যেসব উদ্যোগ নিচ্ছেন, সেসব উদ্যোগের বিষয়ে তাঁকে যে অন্যান্য দেশ অনুসরণ করবে না, সেই নিশ্চয়তা দেবে কে? এ ছাড়া বৈশ্বিক আঞ্চলিক রাজনীতির অংশ হিসেবে বাংলাদেশের পরিবর্তিত রাজনৈতিক অবস্থায় এমন আশঙ্কা অমূলক নয়।
যদি আপনি মেশিনারিজ বা যন্ত্রপাতিকে বিবেচনায় নেন, তাহলেও আপনি চীনের ওপরে নির্ভরশীলতা দেখতে পাবেন। যদি কোনো খাতের টেকসই উন্নতি চিন্তা করেন, তাহলে এত বড় খাতকে পুরোপুরি পরনির্ভরশীল করে কখনোই দীর্ঘমেয়াদি টিকে থাকা সম্ভব নয়। হতে হবে আত্মনির্ভরশীল। পুরোটা না পারলেও সেক্টরের বহুলাংশের নিয়ন্ত্রণ আপনার হাতে থাকা জরুরি। কাজেই বাংলাদেশের তৈরি পোশাক খাতকে টেকসই ও শক্তিশালীকরণের সঙ্গে কৃষি, শিল্প, শিক্ষা ও প্রযুক্তি খাত ঘনিষ্ঠভাবে জড়িত।
পোশাক খাতের কাঁচামালের সরবরাহ নিশ্চিত করতে কৃষি উৎপাদনকে বাড়াতে হবে। আমাদের এমন সব কৃষিপণ্য উৎপাদনের দিকে নজর দিতে হবে, যেটির সঙ্গে শিল্পের প্রত্যক্ষ সম্পর্ক রয়েছে।
অন্যদিকে মেশিনারিজ ও যন্ত্রপাতির আমদানি–নির্ভরতা কমাতেও শিল্প ও প্রযুক্তি খাতকে এগিয়ে নিতে হবে। এসব মেশিনারিজ ও যন্ত্রাংশ কীভাবে বাংলাদেশে বানানো যায়, সেটিও আমাদের ভাবতে হবে।
কৃষি, শিল্প ও প্রযুক্তি খাতের এই প্রবাহকে ঠিক রাখতে এ–সংক্রান্ত শিক্ষা ও গবেষণা খাততে এগিয়ে নিতে হবে। এ জন্য আমাদের দেশের বিশ্ববিদ্যালয় ও গবেষণাপ্রতিষ্ঠানগুলোর সঙ্গে শিল্পপ্রতিষ্ঠানের সরাসরি সংযোগ ঘটানো জরুরি।
দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্যি, স্বাধীনতার এত বছর পরও আমরা সঠিকভাবে সেটি করতে পারিনি। অথচ এটি করা গেলে নিশ্চিতভাবে তা বাংলাদেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর গ্লোবাল র্যাঙ্কিং বাড়তেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে।
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর তথ্যমতে, ২০২৪ সালের ১ জানুয়ারি পর্যন্ত বাংলাদেশের জনসংখ্যা ১৭ কোটি ৩৫ লাখ ২ হাজার জন এবং জনসংখ্যার ভিত্তিতে বাংলাদেশ পৃথিবীর অষ্টম বৃহত্তম দেশ।
অবাক ব্যাপার হলেও সত্যি, বাংলাদেশের পোশাক–সংশ্লিষ্ট বাজারে ভারত, পাকিস্তান বা চীনের মতো দেশগুলোর কাপড় ও পোশাকের চাহিদা বিপুল। বৈধ ও অবৈধভাবে বিভিন্ন দেশের পোশাক ও কাপড় এখানে পাওয়া যায়। আপনি যদি এই বাজারের ভলিউম হিসাব করেন এবং মানুষের ক্রয়ক্ষমতার ক্রমবৃদ্ধিকে বিবেচনা করেন, তাহলে বাংলাদেশ নিজেই বড় তৈরি পোশাকের বড় একটি বাজার। এ জন্য আমাদের পোশাক খাতের কিছু অংশকে বাংলাদেশের বাজারমুখী করা প্রয়োজন।
বাংলাদেশে পোশাক খাতের আরেকটি বড় চ্যালেঞ্জ হলো নিয়মিত বিদ্যুৎ ও গ্যাস সরবরাহ নিশ্চিত করা। গাজীপুরে আমার কর্মকালে দেখেছি, শিল্পপ্রতিষ্ঠানগুলোতে বিদ্যুৎ ও গ্যাসের অভাবে তাদের উৎপাদন ব্যাহত হয়। ফলে শিপমেন্ট বিলম্ব ও বাতিল হয়ে যাওয়ার মতো ঘটনা ঘটে।
এ কারণে কখনো কাজ না করিয়ে শ্রমিকদের ছুটি দিতে হয়, আবার কখনো অতিরিক্ত কাজ করাতে হয়। আবার এ দুটিই পরিস্থিতিই শ্রমিক অসন্তোষকে উসকে দেয়। এ কারণে এই খাতে সাসটেইনেবিলিটি নিশ্চিত করতে আমাদের বিকল্প বিদ্যুৎ ও জ্বালানি উৎস নিয়ে ভাবা প্রয়োজন।
উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, কিছু বড় প্রতিষ্ঠান সৌরবিদ্যুৎ বা নিজেদের ব্যবস্থাপনায় বিকল্প বিদ্যুৎ উৎপাদনের দিকে ঝুঁকছে। কারণ, বাংলাদেশে গড়ে বছরে ৩০০-৩২০ দিন সৌরবিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য সূর্যের আলো পাওয়া সম্ভব। তাই বাংলাদেশের শিল্প খাতে কীভাবে সৌরবিদ্যুৎকে ব্যবহার করা যায়, সেদিকেও নজর দেওয়া প্রয়োজন।
যদিও বাংলাদেশ কাতারসহ মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশ থেকে এনএলজি আমদানি করে গ্যাসের চাহিদা পূরণ করতে চেষ্টা করছে। কিন্তু বাংলাদেশের ঢাকা, গাজীপুর, নারায়ণগঞ্জ, চট্টগ্রামের মতো এলাকাগুলোতে যে পরিমাণ বর্জ্য উৎপাদিত হয়, সেগুলো থেকে গ্যাস বা বিদ্যুৎ উৎপাদনের ব্যবস্থা নেওয়া হলে এটি শুধু গ্যাস-বিদ্যুতের চাহিদাই মেটাবে না; বরং তা পরিবেশ সুরক্ষায় বহুমাত্রিক প্রভাব রাখবে।
বাংলাদেশের সফট সিকিউরিটি নিশ্চিত করতে অর্থনৈতিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে বিদ্যমান বাস্তবতায় পোশাক খাত সবচেয়ে শক্তিশালী দিক। কিন্তু যদি এই সেক্টরকে যদি টেকসই না করা যায়, তাহলে এটিই হতে পারে দেশের সবচেয়ে দুর্বলতম দিক। কেননা, এই সেক্টরের যেকোনো ধরনের অভিঘাত বা অন্তর্ঘাত শুধু বাংলাদেশের অর্থনীতিকেই বিপর্যস্ত করবে না; বরং বৃহৎ আকারে তা বাংলাদেশের রাজনৈতিক কাঠামো ও ব্যক্তিমানুষ পর্যায়েও ব্যাপকভাবে প্রভাবিত করবে।
মো.
ইমরান আহম্মেদ পিপিএম, অতিরিক্ত পুলিশ সুপার, বাংলাদেশ পুলিশ; বর্তমানে যুক্তরাজ্যের ইউনিভার্সিটি অব ওয়ারউইকের পলিটিকস অ্যান্ড ইন্টারন্যাশনাল স্টাডিজ বিভাগের পিএইচডি গবেষক।
ই–মেইল: [email protected]
উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: ন শ চ ত করত ন শ চ ত কর ন র ভরশ ল ব কল প ব আম দ র ব এই খ ত র জন য ব যবস ধরন র আমদ ন উৎপ দ
এছাড়াও পড়ুন:
‘ভোল পাল্টে’ সক্রিয় কিশোর গ্যাং, অতিষ্ঠ বাসিন্দারা
লক্ষ্মীপুরের রায়পুর উপজেলার চর আবাবিল ইউনিয়নের উদমারা এলাকায় কিশোর গ্যাংয়ের উৎপাতে অতিষ্ঠ বাসিন্দারা। এলাকায় নারীদের উত্ত্যক্ত করা, মাদক সেবন, মারামারি, খুনসহ বিভিন্ন ধরনের অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড পরিচালনার অভিযোগ রয়েছে কিশোর গ্যাংয়ের এসব সদস্যদের বিরুদ্ধে।
স্থানীয় বাসিন্দারা জানিয়েছেন, গত বছরের ৫ আগস্টের আগে আওয়ামী লীগের কয়েকজন নেতার ছত্রচ্ছায়ায় কিশোর গ্যাংয়ের সদস্যরা অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড পরিচালনা করত। তবে এখন ভোল পাল্টে স্থানীয় বিএনপি নেতা-কর্মীদের সঙ্গে ভিড়েছে তারা।
সম্প্রতি এলাকাটিতে কিশোর গ্যাংয়ের হামলায় আহত হয়ে চিকিৎসাধীন জাহাঙ্গীর আলম (৫২) নামের এক ব্যক্তির মৃত্যু হয়েছে। জাহাঙ্গীর আলম স্থানীয় মসজিদ কমিটির সভাপতি ছিলেন। মসজিদের পাশে জুয়ার আসর বসানো ও মাদক সেবনে বাধা দেওয়াকে কেন্দ্র করে তাঁর ওপর হামলার অভিযোগ রয়েছে কিশোর গ্যাংয়ের সদস্যদের বিরুদ্ধে। গত ৩ এপ্রিল তাঁর ওপর হামলা করা হয়। এরপর গত শনিবার তিনি ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান।
স্থানীয় বাসিন্দা ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, কিশোর গ্যাংয়ের নেতৃত্বে রয়েছেন কয়েকজন স্থানীয় তরুণ। ওই তরুণেরা রাজনীতিতে যুক্ত থাকায় মিছিল-সমাবেশে কিশোরদের ব্যবহার করে আসছেন। ফলে স্থানীয় কিছু রাজনৈতিক নেতাও এসব কিশোরকে অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডে প্রশ্রয় দেন।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে কয়েকজন স্থানীয় বাসিন্দা বলেন, আগে এলাকায় কিশোর গ্যাংয়ের নিয়ন্ত্রণ ছিল চর আবাবিল ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক তাজুল ইসলাম ও ২ নম্বর ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের সভাপতি ছিদ্দিক সর্দারের হাতে। তাঁরা এসব কিশোরকে আশ্রয়-প্রশ্রয় দিতেন। গত বছরের ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর ওই কিশোরেরা ভোল পাল্টে বিএনপির কর্মসূচিতে সক্রিয় হচ্ছে। আবদুর রহিম নামে স্থানীয় এক ব্যক্তি এসব তরুণকে নতুন করে আশ্রয়–প্রশ্রয় দিচ্ছেন। রহিম ইউনিয়ন বিএনপির রাজনীতিতে সক্রিয় হলেও তাঁর পদপদবি নেই।
জাহাঙ্গীর আলম খুনের ঘটনায় আবদুর রহিমকেও আসামি করা হয়। মামলার পর তিনি আত্মগোপনে রয়েছেন। মুঠোফোনে তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘কিশোর গ্যাংয়ের সদস্যদের আমি প্রশ্রয় দিচ্ছি—এমন অভিযোগ প্রায় করা হচ্ছে। তবে এসব অভিযোগ সত্য নয়। আমাকে হয়রানির উদ্দেশ্যে মামলায় জড়ানো হয়েছে।’
ইউনিয়নের ২ নম্বর ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের সভাপতি ছিদ্দিক সর্দার বলেন, ‘কিশোর গ্যাংকে আমি কখনো প্রশ্রয় দিইনি। তারা (কিশোর গ্যাংয়ের সদস্যরা) আমার সঙ্গে ঘনিষ্ঠ হওয়ার চেষ্টা করত।’ ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক তাজুল ইসলাম আত্মগোপনে থাকায় তাঁর বক্তব্য জানা সম্ভব হয়নি।
জানতে চাইলে রায়পুর উপজেলা বিএনপির আহ্বায়ক জেড এম নাজমুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, বিএনপির দলীয় কোনো নেতা-কর্মী কিশোর গ্যাংয়ের সদস্যদের প্রশ্রয় দিলে তাঁদের বিরুদ্ধে সাংগঠনিক ব্যবস্থা নেওয়া হবে। কোনো নেতা-কর্মীর অপকর্মের দায় দল নেবে না।
জাহাঙ্গীর আলমের ওপর হামলার ঘটনায় গত ৭ এপ্রিল লক্ষ্মীপুরের সিনিয়র জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে ৯ জনের নাম উল্লেখ ও ২০ জনকে অজ্ঞাতনামা আসামি করে মামলার আবেদন করেন তাঁর স্ত্রী রাজিয়া বেগম। আদালত রায়পুর থানাকে মামলাটি গ্রহণের নির্দেশ দেন। মামলার এজাহারে অভিযোগ করা হয়, মসজিদের আশপাশে জুয়ার আসর ও মাদক সেবন করত কিশোর গ্যাংয়ের সদস্যরা। এসব বিষয়ের প্রতিবাদ করাকে কেন্দ্র করে সাব্বির হোসেন, জুবায়ের হোসেনসহ কয়েকজনের নেতৃত্বে ৮–১০ জন কিশোর গ্যাংয়ের সদস্য জাহাঙ্গীর আলমের ওপর হামলা করেছেন। নিহত জাহাঙ্গীর আলমের মেয়ে শারমিন আক্তার প্রথম আলোকে বলেন, মামলার পর আতঙ্কে দিন কাটছে তাঁর পরিবারের সদস্যদের। স্থানীয় কিশোর গ্যাংয়ের সদস্যরা মামলা প্রত্যাহারের জন্য হুমকি দিয়ে আসছে।
জানতে চাইলে রায়পুর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা মো. নিজাম উদ্দিন ভূঁইয়া বলেন, কিশোর অপরাধীদের বিরুদ্ধে পুলিশের ধারাবাহিক অভিযান অব্যাহত রয়েছে। এরই মধ্যে বেশ কয়েকজনের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে।
লক্ষ্মীপুর সরকারি ডিগ্রি কলেজের সাবেক অধ্যক্ষ মাঈন উদ্দিন পাঠান বলেন, কিশোর-তরুণদের খেলাধুলা, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড থেকে ফিরিয়ে আনতে হবে। তাদের ফেরাতে না পারলে অপরাধ আরও বেড়ে যাবে। কেউ যাতে অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডে কিশোরদের ব্যবহার করতে না পারে, সে বিষয়ে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীসহ সবাইকে তৎপর থাকতে হবে।