বাংলা নববর্ষে এ দেশের সব সম্প্রদায়, গোষ্ঠী ও জাতির উত্তরাধিকার। আমরা শহরে ইদানীং সাম্প্রদায়িকতা ঘেঁষা নানান বিরুদ্ধ আলাপ করি বৈশাখ ঘিরে। যার ছোঁয়া এখন গ্রামেগঞ্জেও লেগেছে

বাংলাদেশের প্রথিতযশা ভাস্কর ও চিত্রশিল্পীদের অন্যতম হামিদুজ্জামান খান। শিল্পে অবদানের জন্য ২০০৬ সালে একুশে পদকে ভূষিত হন। সম্প্রতি নববর্ষ উপলক্ষে সমকালের সঙ্গে এক আলাপে নিজ শৈশব, শিল্প-সংস্কৃতি ও সংস্কৃতিকে ঘিরে নিজ রাজনীতিভাবনা তুলে ধরেছেন। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন সমকালের জ্যেষ্ঠ সহসম্পাদক হামিম কামাল

সমকাল : কেমন আছেন স্যার? নববর্ষের শুভেচ্ছা আপনাকে।

হামিদুজ্জামান খান : ভালো আছি, ধন্যবাদ! আপনাকেও নববর্ষের শুভেচ্ছা। 

সমকাল : নববর্ষ, বৈশাখী মেলাকে ঘিরে ছোটবেলার কোন স্মৃতি সবচেয়ে বেশি মনে পড়ে?

হামিদুজ্জামান খান : আমার জন্ম কিশোরগঞ্জে, সেখানেই বর্ণিল শৈশব। শৈশবের রূপ ও রঙের অনেকখানি ধরা আছে আমার যাপিত বৈশাখী মেলাগুলোয়। দুটো মেলা হতো। বাড়ি থেকে একটু দূরের মেলা ছিল তুলনামূলক বড়। ভাইদের নিয়ে সেখানে যেতাম। আহা, আমাদের স্বপ্নের মেলা। পরবর্তী জীবনে আরও অনেক মেলা দেখেছি। পৃথিবীর নানান জায়গায় অনেক উৎসবের অংশ হয়েছি। কিন্তু শৈশবের সেই মেলার মতো আনন্দ কি আর কোথাও পেয়েছি? সুখস্মৃতিগুলো মনে পড়ে। ঘুরে ঘুরে দেখেছি কত রঙের মানুষ, মাটির-কাঠের হাজারো রকমের খেলনা, মিষ্টিজাতীয় অজস্র মজার খাবার। আমার সারা বছরের অপেক্ষার অমূল্য রত্ন ওসব। একটিমাত্র শব্দে সেই মেলাকে ব্যাখ্যা করা যায়। খাঁটি। 

সমকাল : প্রতিবছর নববর্ষে কোনো না কোনো বিতর্ক স্থান করে নেয়। এর প্রীতির বার্তা আমরা কতটা গ্রহণ করতে পারছি?

হামিদুজ্জামান খান : পৃথিবীর অনেক জাতিগোষ্ঠীর নিজস্ব সন নেই। নিজস্ব বর্ষ যে কত গৌরবের! বাংলা নববর্ষে এ দেশের সব সম্প্রদায়, গোষ্ঠী ও জাতির উত্তরাধিকার। আমরা শহরে ইদানীং সাম্প্রদায়িকতা ঘেঁষা নানান বিরুদ্ধ আলাপ করি বৈশাখ ঘিরে। যার ছোঁয়া এখন গ্রামে-গঞ্জেও লেগেছে। হয়তো আমাদের তখন মনে পড়ে না, গ্রামে-গঞ্জে কত অজস্র পেশাজীবী মানুষ রয়েছে, যারা এই মেলার জন্য অপেক্ষা করে থাকে। এর আয় দিয়ে চলে। গ্রামের কৃষক থেকে শুরু করে শ্রমজীবী নানান শ্রেণি-পেশার মানুষ গোঁড়ামি বোঝে না। একটু মাটিঘেঁষা আনন্দ খোঁজে। তাদের কাছে আজও নববর্ষ, বৈশাখী মেলা ভীষণ অপেক্ষার। দুটো মেলার কথা বলছিলাম শুরুতে। বড়টি হতো বাড়ি থেকে দূরে, আর ছোটটি ছিল বাড়ির পাশেই। ছোটটিও ভীষণ আপন। ছিমছাম, সুন্দর। কতকিছু কিনেছি! ছোট ছোট হস্তশিল্প, মোটিফ, মাটি কাঠের পুতুল, প্রতিকৃতি! সেসব যে কত বড় শিল্পকর্ম ছিল, তখন না বুঝলেও এখন বুঝতে পারি। ওই মোটিফ ও প্রতিকৃতিগুলো আমার সারাজীবনের কাজের প্রেরণা। যে মানুষগুলো ওই শিল্পের সঙ্গে জড়িত, তারা কিন্তু সংখ্যায় তখন অনেক ছিলেন। উৎসবগুলোয় প্রাণের প্রবাহ ছিল। কারণ উৎসব তখন প্রকৃত অর্থেই সবার ছিল। সবাই এর আনন্দের ভাগ পেয়েছে। উৎসব কিন্তু আজও সবারই আছে। নববর্ষের আনন্দযজ্ঞে কারও নিমন্ত্রণপত্র কেড়ে নেওয়া হয়নি। কিন্তু সেই নিমন্ত্রণ এখন কজন গ্রহণ করছেন? বিভেদের রাজনীতি থেকে সরে এসে, আমরা যদি সেই তৃণমূলের শিল্পীদের দিকে, মানুষগুলোর দিকে তাকাই, এই নববর্ষ, বৈশালী মেলা আরও ভিন্ন আলোয় দেখতে পাব। সম্প্রীতি ও দরদমাখা রূপ নিয়ে নববর্ষ আমাদের সামনে ধরা দেবে। বৈশাখী উৎসব সবার। 

সমকাল : আপনার স্মৃতিতে গ্রামীণ মেলা। শহরে এসে কী দেখতে পেলেন। নববর্ষের উপস্থাপন কেমন এখানে?

হামিদুজ্জামান খান : যখন ঢাকায় এলাম, আমার গ্রামীণ সেই মেলার এক ধরনের দুর্বল অনুকরণ চোখে পড়ল। আমরা গ্রামের ছেলে। আমাদের চোখ তো আর ফাঁকি দিতে পারবে না। দেখি, কী কাণ্ড, মেলায় কোথায় সেই খাঁটির আধিপত্য? হ্যাঁ, বহু দূর থেকে অনেক পেশাজীবী এসেছেন, শহরের মেলায় অংশ নিতে। কিছুটা হয়তো পেতেন তারা শ্রমের মর্যাদা। কারণ শহরে মানুষের হাতে টাকা আছে। কিন্তু মেলার প্রাণের সঙ্গে যাদের পরিচয়, শহরের মেলা তাদের ভালো লাগার কথা নয়। উপরন্তু সময় যত গড়াতে থাকল, মেলা ছেয়ে গেল তত প্লাস্টিক পণ্যে। এখন গ্রামের মেলাগুলো দেখেও আর চিনতে পারি না। প্লাস্টিকে ঠাসা। ভিনদেশি পুতুল আর জড়যন্ত্রের শোভাবস্তু দেখে তো মন ভরে না। প্রশ্ন জাগে, কেন আমরা এমন হতে দিলাম? আমরা কি পারতাম না আমাদের শিল্পধারা, স্বকীয়তা রক্ষা করতে? দেশীয় শিল্পীদের রক্ষা করতে? স্বকীয়তা রক্ষা করতে হবে। শিল্পীদের রক্ষা করতে হবে। ঢাকায় আমাকে ও আইভিকে দু-দণ্ড শান্তি দেয় চারুকলার বৈশাখী মেলা। গত প্রায় কুড়ি বছর ধরে হচ্ছে এ মেলা। চারুকলার ছাত্র-শিক্ষকদের চোখজুড়ানো শিল্পকর্ম তো থাকেই, সেইসঙ্গে নানান দেশ থেকে শিল্পীরা আসেন তাদের সেরা কাজগুলো নিয়ে। আমার নিজ জেলা কিশোরগঞ্জের শিল্পীরা আসেন, খুব ভালো লাগে। দেশের নানান প্রান্তের শিল্পীরা আসেন। ওনারা তত্ত্ব বোঝেন না, কিন্তু শিল্প বোঝেন। উৎকৃষ্ট শিল্প তারা চিনতে পারেন। কিন্তু নিজের ক্ষমতা তারা চিনতে পারেন না। সিলেটের শীতলপাটি বিছিয়ে নিরাসক্ত মুখে বসে থাকেন শিল্পী। তিনি কি জানেন তাঁর ওই শিল্পকর্ম বিশ্বের সম্পদ? একবার এক ব্রিটিশ শিল্পীর সঙ্গে এ নিয়ে ছোট আলাপ হয়েছিল। ভদ্রলোকের নাম মনে নেই, কিন্তু কথাগুলো স্পষ্ট স্মরণে আছে। কোনো এক শিল্পসভায় তাঁকে কথা বলার জন্য আমন্ত্রণ জানানো হয়েছিল। ব্রিটিশ ভদ্রলোক তাঁর স্বাভাবিক পোশাক স্যুট কোট পরে এলেন। এসে তো বাংলাদেশের গরমে হাঁসফাঁস করা ছাড়া আর উপায় নেই। তাঁর জন্য পাঞ্জাবি-পাজামা আনানো হলো। তিনি পরলেন। পরে সামনে এসে হাঁফ ছেড়ে বললেন, আহ, এখন শান্তি লাগছে। সেই ভদ্রলোক বলেছিলেন, তোমাদের তৃণমূলের একজন শিল্পীও যে নকশা করেন, কল্পনাতীত। নিভৃত গ্রামের কোনো এক নারী একটি পিঠার ওপর যে মোটিফ তৈরি করেন, বিশ্বমানের। ভদ্রলোক বিমোহিত। তাঁর ভাষ্য অনুযায়ী, ওটা ছিল তাঁর জন্য বিরল অভিজ্ঞতা। 

সমকাল : দেশীয় উৎসবের সর্বজনীনতা রক্ষায় রাজনীতিকদের ভূমিকা কেমন হতে পারে?

হামিদুজ্জামান খান : নিজস্ব শিল্প, সংস্কৃতি, কৃষ্টি সম্বন্ধে আমাদের জানতে হবে। এরপর জাতি, সম্প্রদায় নির্বিশেষে এর প্রতি শ্রদ্ধার মনোভাব গড়ে তুলতে হবে। কাজটা রাজনীতিকরা করতে পারেন। সম্প্রীতির জন্য সদিচ্ছা প্রয়োজন। রাজনীতিকদের সদিচ্ছা সম্প্রীতিময় বর্ষবরণ উপহার দিতে পারে। তারা যদি অন্তর দিয়ে দেশের মানুষের ভেতর ক্রমশ এমন শিক্ষাব্যবস্থা ও সামাজিক বোঝাপড়া তৈরির উদ্যোগ নেন যেখানে সবাই সবাইর স্বকীয়তা ও বৈপরীত্যগুলো শ্রদ্ধা করবে, উৎসবে নিজ নিজ জায়গা থেকে অংশ নেবে, তাহলে কিন্তু ক্রমশ আমাদের আত্মপরিচয় স্পষ্ট হবে। বাইরেও আমাদের ভাবমূর্তি উজ্জ্বলতর হবে। আমি আহ্বান জানাব, সরকার যেন আমাদের দেশীয় শিল্পকে বাঁচিয়ে রাখার ও বিকশিত হতে দেওয়ার উপযুক্ত পরিবেশ ও মানসিকতা তৈরিতে ভূমিকা রাখেন। সব সম্প্রদায় ও মতবাদের মানুষকেও আহ্বান জানাব, যে সংস্কৃতি একেবারেই আমাদের নিজস্ব, আমাদের মাটির সঙ্গে সম্পর্কিত, তাকে যেন আমরা পরিত্যাগ না করি, তার সম্প্রীতির বার্তা যেন আমরা গ্রহণ করি। 

সমকাল : আমাদের সময় দেওয়ার জন্য আপনাকে অজস্র ধন্যবাদ।

হামিদুজ্জামান খান : সমকালকেও ধন্যবাদ।

 

.

উৎস: Samakal

কীওয়ার্ড: নববর ষ র আম দ র র জন ত র জন য আনন দ সমক ল

এছাড়াও পড়ুন:

এবারও কলকাতা আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবে নেই বাংলাদেশ

দ্বিতীয় বছরের মত কলকাতা আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবে বাংলাদেশের কোনো সিনেমাা বা তথ্যচিত্র দেখানো হচ্ছে না। সম্প্রতি কলকাতা আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসব কমিটির তরফে সংবাদ সম্মেলন করে বিষয়টি জানানো হয়ছে। পরবর্তীতে কমিটির তরফে তাদের নির্দিষ্ট ওয়েবসাইটে যে ছবি তালিকা প্রকাশ করা হয়েছে তাতে কোন ক্যাটাগরিতেই বাংলাদেশি সিনেমার নাম উল্লেখ নেই। 

মূলত ভিসা জটিলতা এবং রাজনৈতিক কারণেই এই চলচ্চিত্র উৎসবে বাংলাদেশের উপস্থিতি থাকছে না। 

বিষয়টি নিয়ে গত বছরই উদ্বেগ প্রকাশ করেছিলেন কলকাতা আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবের চেয়ারপার্সন পরিচালক গৌতম ঘোষ। সেসময় তাকে বলতে শোনা গিয়েছিল, “এবারের পরিস্থিতি ভিন্ন। সেদেশে ভিসা সমস্যা রয়েছে। আর বাংলাদেশের চলমান রাজনৈতিক পরিস্থিতির কারণে স্বাভাবিক পরিস্থিতি ফিরে আসতে অনেকটা সময় লাগবে। স্বাভাবিকভাবেই এই অবস্থায় চলচ্চিত্র উৎসবের তালিকায় বাংলাদেশের কোনো ছবি নেই। আমরা আশা করব চলচ্চিত্র উৎসবের পরবর্তী এডিশনের (৩১ তম) আগে প্রতিবেশী দেশের পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়ে যাবে।”

কিন্তু এক বছরের বেশি সময় পেরিয়ে গেলেও অবস্থার যে কোনো পরিবর্তন হয়নি তা চলচ্চিত্র উৎসবে বাংলাদেশের অনুপস্থিতির ঘটনাটাই পরিষ্কার। 

যদিও কলকাতা আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবের জুরি কমিটির এক সদস্য  বলেছেন, “আন্তর্জাতিক বিভাগে বাংলাদেশ থেকে শুধুমাত্র একটি ছবি জমা দেওয়া হয়েছিল। তানভীর চৌধুরীর ‘কাফ্ফারাহ’। কিন্তু দুঃখের বিষয় এটি আমাদের কাঙ্ক্ষিত মানদণ্ড পূরণ করতে পারেনি। ফলে চলচ্চিত্র উৎসবে এই ছবিটি জায়গা পায়নি।”

চলতি বছরের ৬ নভেম্বর থেকে শুরু হতে চলেছে ৩১ তম কলকাতা আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসব। এক সপ্তাহব্যাপী এই উৎসব চলবে আগামী ১৩ নভেম্বর পর্যন্ত। এই উৎসবে ৩৯ টি দেশের ২১৫ টি ছবি দেখানো হবে। ভারত ছাড়াও অংশগ্রহণকারী দেশগুলোর মধ্যে রয়েছে যুক্তরাষ্ট্র, ফ্রান্স, জার্মানি, পোল্যান্ড, বেলজিয়াম, ইতালি, ব্রাজিল, মরক্কো, অস্ট্রিয়া, তুরস্ক, বলিভিয়া, গুয়েতেমালা, শ্রীলংকা, চীন, জাপান, ইরান, সিঙ্গাপুর, তাইওয়ান, ফিলিস্তিন, ইরাক, সৌদি আরব, মিশর, সুদান, লেবানন।

সুচরিতা/শাহেদ

সম্পর্কিত নিবন্ধ

  • এবারও কলকাতা আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবে নেই বাংলাদেশ
  • ভালো ফলনের আশায় গাছকে খাওয়ান তাঁরা
  • টগি ফান ওয়ার্ল্ডে উদযাপিত হলো হ্যালোইন উৎসব
  • উদ্ভাবন–আনন্দে বিজ্ঞান উৎসব
  • নবীনদের নতুন চিন্তার ঝলক
  • বিজ্ঞান উৎসব উদ্বোধন করল রোবট নাও
  • ‘ফাতেমা রানীর তীর্থোৎসবে’ আলোয় ভাসল গারো পাহাড়
  • টোকিওতে জমেছে আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসব
  • সন্ধ্যা নদীর দুকূলে উৎসবের ঢেউ, উজিরপুরে নৌকাবাইচে মাতলেন হাজারো মানুষ
  • রাঙামাটি রাজবন বিহারে দুদিনের কঠিন চীবর দানোৎসব শুরু