সকাল ৮টা ৪০ মিনিট। বুক সমান পানি ঠেলে স্কুলে যাচ্ছিলেন শিক্ষক মানিক তালুকদার। মনের কষ্টে নিজেই হাতে থাকা মোবাইল ফোনের ক্যামেরায় ছবি তুলেছেন হাসি মুখে। এ যেন নিজেকেই নিজে অভিমানে তিরস্কার করা।
এমন কষ্ট চেপে পেশাজীবন কাটিয়ে দিচ্ছেন তাহিরপুরের রামসিংহপুর গ্রামের বাসিন্দা, দুর্লভপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক মানিক তালুকদার। বিদ্যালয়ে যাওয়ার এমন দৃশ্য নিজের ফেসবুক আইডিতে মঙ্গলবার সকালে পোস্ট করেন তিনি। এ নিয়ে সমকালের সঙ্গে যোগাযোগ করেন উপজেলার শিক্ষক সমিতির সাধারণ সম্পাদক গোলাম সরোয়ার লিটন। তিনি বলেন, পাশাপাশি উপজেলা, একই ধরনের প্রাকৃতিক পরিবেশ; কিন্তু সরকারের দুই ধরনের আইন বিদ্যমান। পাশের উপজেলার শিক্ষক কষ্ট করে বিদ্যালয়ে গেলে আলাদা ভাতা পাবেন; কিন্তু মানিক তালুকদার পাবেন না– এটা দুঃখজনক।
সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক মানিক তালুকদারের কাছে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘টাঙ্গুয়ার হাওরপাড়ের রামসিংহপুরে বাড়ি আমার। ডেপুটেশনে পদায়ন করা হয়েছে দুর্লভপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে। বাড়ি থেকে দুর্লভপুরের দূরত্ব মাত্র এক কিলোমিটার। বছরের আট মাস বিদ্যালয়ে যেতে হলে হাতে চালিত নৌকা নিয়ে যেতে হয়। তাও আবার একা বেয়ে যাওয়া (চালিয়ে যাওয়া) সম্ভব নয়। সে ক্ষেত্রে প্রতিদিন খরচ কমপক্ষে ৫০০ টাকা। বাকি চার মাস মোটরসাইকেলে বা হেঁটে যাওয়া যায়।
মঙ্গলবার নৌকার ব্যবস্থা না করতে পারায় বুক ও গলা সমান পানি ঠেলে বিদ্যালয়ে যেতে হয়েছে। এই পথে ট্রলারের কোনো ব্যবস্থা নেই। এই শিক্ষকের আক্ষেপ, উপজেলার হাওরাঞ্চলের বিদ্যালয় হিসেবে গেজেট জারি হয়েছে। পাশের ধর্মপাশা উপজেলায়ও গেজেট জারি হয়েছে। তারা হাওর ভাতা পান, এই প্রতিষ্ঠানের শিক্ষকরা পান না।
কিশোরগঞ্জের নিকলি উপজেলার শেতরা উত্তরপাড়া আহম্মদ আলী সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক রেজোয়ানুল হক বলেন, বছরে সাত মাস নৌকায় এক ঘণ্টার পথ পার হয়ে বিদ্যালয়ে যান। আসার সময়ও একই অবস্থা। জীবনের ঝুঁকি নিয়ে যাতায়াত। একই পরিস্থিতি মোকাবিলা করে অন্য উপজেলার শিক্ষক-কর্মচারীরা হাওর ভাতা পাচ্ছেন। তারা পাচ্ছেন না।
সুনামগঞ্জের তাহিরপুর উপজেলা প্রাথমিক শিক্ষক সমিতির সাধারণ সম্পাদক গোলাম সরোয়ার লিটন বলেন, সোমবারও গণমাধ্যমে দেখেছি হাওর-দ্বীপ এবং চর উপজেলার প্রাথমিক শিক্ষা বিভাগের কর্মকর্তা, কর্মচারীদের ভাতার জন্য ৭ কোটি ৫১ লাখ ৫৯ হাজার ৬০০ টাকা অতিরিক্ত বরাদ্দ দেওয়ার জন্য অনুরোধ জানানো হয়েছে। এখানেও গেজেটভুক্ত ২৩ উপজেলার মধ্যে সাত উপজেলার কোনো উল্লেখ নেই। এটা বৈষম্য। আগের সরকারের সময় এমপিদের সুপারিশে স্বজনপ্রীতি হয়েছে, এখন সেটি দূর হবে– এমন প্রত্যাশা সবার।
জানা যায়, দেশের ২৩টি উপজেলাকে হাওর-দ্বীপ ও চর উপজেলা ঘোষণা করে সরকারি চাকরিজীবীরা বেতনের সঙ্গে বেতন গ্রেড অনুযায়ী ১ হাজার ৬৫০ থেকে ৫ হাজার টাকা পর্যন্ত হাওর ভাতা পাচ্ছেন। ওই ২৩টি উপজেলার মধ্যে সাতটি উপজেলায় কর্মরত সরকারি চাকরিজীবী স্থানীয় বাসিন্দারা হাওর ভাতা পাচ্ছেন না। অন্য ১৬ উপজেলার তারা ভাতা পাচ্ছেন।
২০১৯ সালের ৫ মে অর্থ মন্ত্রণালয়ের অর্থ বিভাগ দেশের ১৬টি উপজেলাকে হাওর, দ্বীপ ও চর উপজেলা হিসেবে প্রজ্ঞাপন জারি করে। এতে সুনামগঞ্জের ধর্মপাশা, শাল্লা, দোয়ারাবাজার, কিশোরগঞ্জের ইটনা, মিঠামইন, অষ্টগ্রাম, নেত্রকোনার খালিয়াজুরী, হবিগঞ্জের আজমিরীগঞ্জ, চট্টগামের সন্দ্বীপ, কক্সবাজারের কুতুবদিয়া, নোয়াখালীর হাতিয়া, সিরাজগঞ্জের চৌহালি, কুড়িগ্রামের রৌমারি, চর রাজিবপুর, পটুয়াখালীর রাঙাবালি ও ভোলার মনপুরাকে অন্তর্ভুক্ত করা হয়।
দ্বিতীয় ধাপে ২০২২ সালের ২৬ জানুয়ারি আরেক প্রজ্ঞাপনে সুনামগঞ্জের তাহিরপুর, জামালগঞ্জ, মধ্যনগর, বিশ্বম্ভরপুর, কিশোরগঞ্জের নিকলী, নেত্রকোনার মদন ও হবিগঞ্জের লাখাই উপজেলাকে হাওর উপজেলা হিসেবে অন্তর্ভুক্ত করা হয়। অর্থ মন্ত্রণালয়ের অর্থ বিভাগ কর্তৃক দ্বিতীয় ধাপে অন্তর্ভুক্ত সাতটি উপজেলার প্রজ্ঞাপনে ‘স্থানীয় বাসিন্দাগণ নিজ উপজেলায় কর্মরত থাকাকালীন এই ভাতা প্রাপ্য হইবেন না’– এমন বাক্য লেখা রয়েছে। অথচ শিক্ষক ও স্বাস্থ্যকর্মীরা সবাই স্থানীয় বাসিন্দা হিসেবে নিজ উপজেলায় সরকারি চাকরির সুযোগ পান।
নোয়ানগর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক শেখর রায় বলেন, নিশ্চয়ই কারও ভুলের শিকার হচ্ছেন শিক্ষক-কর্মচারীরা। সুনামগঞ্জ জেলা প্রাথমিক শিক্ষা অফিসে কর্মরত এক কর্মকর্তা জানান, ২০১৯ সালের ৫ মে অর্থ মন্ত্রণালয়ের অর্থ বিভাগ দেশের ১৬টি উপজেলাকে হাওর, দ্বীপ ও চর উপজেলা হিসেবে প্রজ্ঞাপন জারি করে। ওই প্রজ্ঞাপনে স্থানীয়রা হাওর ভাতা পাবেন না– এমন বাক্য উল্লেখ করা ছিল না।
সুনামগঞ্জ জেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তা মোহন লাল দাস বলেন, গেজেটভুক্ত হয়েছে, সেসব উপজেলার সব শিক্ষক-কর্মচারী যাতে ভাতা পান সে বিষয়টি কর্তৃপক্ষের বিবেচনায় রয়েছে।
.উৎস: Samakal
কীওয়ার্ড: স ন মগঞ জ উপজ ল র শ স ন মগঞ জ হ ওর ভ ত উপজ ল য় উপজ ল ক র উপজ ল র সরক র
এছাড়াও পড়ুন:
২২ অনাথ কাশ্মীরি শিশুর পড়াশোনার দায়িত্ব নিলেন রাহুল গান্ধী
অপারেশন সিঁদুর চলাকালীন পাকিস্তানি গোলায় ভারত–নিয়ন্ত্রিত জম্মু–কাশ্মীরে যাঁরা নিহত হয়েছিলেন, তাঁদের পরিবারের ২২ অনাথ শিশুর লেখাপড়ার পুরো দায়িত্ব নিয়েছেন কংগ্রেস নেতা রাহুল গান্ধী। ওই শিশুরা পুঞ্চ জেলার সীমান্তবর্তী এলাকার বাসিন্দা।
স্কুলের গণ্ডি পেরিয়ে কলেজে উঠে স্নাতক হওয়া পর্যন্ত ওই শিশুদের পড়াশোনার সব খরচ রাহুল গান্ধী বহন করবেন। সেই খরচের প্রথম কিস্তির টাকা বুধবার ওই পড়ুয়াদের স্কুলে পৌঁছে যাবে বলে জানিয়েছেন জম্মু–কাশ্মীরের কংগ্রেস সভাপতি তারিক হামিদ কাররা।
পেহেলগামে গত ২২ এপ্রিল পর্যটকদের ওপর সশস্ত্র হামলা চালিয়েছিল কয়েকজন জঙ্গি। সেই হামলায় নিহত হয়েছিলেন মোট ২৬ জন পর্যটক। প্রত্যাঘাতের জন্য ভারত শুরু করে অপারেশন সিঁদুর। চার দিনের সেই লড়াইয়ের সময় জম্মুর সীমান্তবর্তী এলাকায় প্রবল গোলাবর্ষণ করে পাকিস্তান। সেই হামলায় মারা গিয়েছিলেন ২৭ জন গ্রামবাসী। আহত হয়েছিলেন ৭০ জনের বেশি। যাঁরা নিহত হয়েছিলেন, ওই ২২ শিশু ওইসব পরিবারেরই সন্তান। তাদের কেউ বাবা, কেউ মা, কেউ–বা দুজনকেই হারিয়েছে। কারও পরিবারের একমাত্র কর্মক্ষম ব্যক্তি নিহত হয়েছেন।
রাহুল গত মে মাসে ওইসব এলাকায় গিয়েছিলেন। ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারদের সঙ্গে দেখা করেছিলেন। অনাথ শিশুদের স্কুলেও গিয়েছিলেন। ওই সময় তিনি দলীয় নেতাদের নির্দেশ দিয়েছিলেন অনাথ শিশুদের তালিকা তৈরি করতে। সরকারি নথির সঙ্গে সেই নাম মিলিয়ে ২২ জনের চূড়ান্ত তালিকা প্রস্তুত হয়। পুঞ্চ জেলা সফরের সময় রাহুল তাঁর ইচ্ছার কথা জানিয়ে বলেছিলেন, ওই শিশুদের স্নাতক স্তর পর্যন্ত পড়াশোনার সব খরচ তিনি দেবেন।
পাকিস্তানের গোলার আঘাতে মারা গিয়েছিলেন ১২ বছরের দুই যমজ ভাই–বোন জাইন আলি ও উরবা ফতিমা। রাহুল তাঁদের স্কুলে গিয়েছিলেন। সেই স্কুলের পড়ুয়াদের সঙ্গে দেখা করেছিলেন। তাঁদের বলেছিলেন, তোমরা তোমাদের বন্ধুদের হারিয়েছ। সে জন্য তোমাদের মন খারাপ। ওই মৃত্যু আমাকেও দুঃখ দিয়েছে। তোমাদের দুঃখ আমি বুঝি। কিন্তু তোমাদের জন্য আমি গর্বিত। তোমরা ভয়কে জয় করেছ। রাহুল ওই শিশুদের বলেছিলেন, ভয়কে জয় করতে হবে। সুদিন আসবে। সব আবার স্বাভাবিক হবে।
ওই ২২ জনের জন্য বছরে কত খরচ হবে প্রদেশ কংগ্রেস নেতৃত্ব তা জানাননি।