দীর্ঘদিন ধরে একটি শিক্ষা বোর্ডের অধীনে এইচএসসি ইংরেজি পরীক্ষার পরীক্ষক হিসেবে দায়িত্ব পালন করছি। বোর্ডের নাম প্রকাশ না করলেও সাম্প্রতিক উত্তরপত্র মূল্যায়নের অভিজ্ঞতা গভীর উদ্বেগের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। সহকর্মী পরীক্ষকদের সঙ্গে আলোচনা করেও একই চিত্র উঠে এসেছে, অধিকাংশ শিক্ষার্থীর উত্তরপত্র হতাশাজনক এবং শিক্ষার মানের অবনতি একটি উদ্বেগজনক পর্যায়ে পৌঁছেছে।

অধিকাংশ ক্ষেত্রে উত্তরপত্রের দিকে তাকালেই প্রথম যে বিষয়টি চোখে পড়ে, তা হলো অর্থহীন ও অসংলগ্ন লেখা। সঠিক বাক্য গঠন ও মৌলিক ব্যাকরণ কোনোটিরই উপস্থিতি নেই। Subject–Verb Agreement, Tense, Preposition, এমনকি Part of Speech—এসব প্রাথমিক বিষয়েও ভুলের ছড়াছড়ি। বানান ভুল এত বেশি যে তা পড়তে গিয়ে পরীক্ষকদের মাথা ঘুরে যায়। অনেক সময় মনে হয়, তারা যেন কখনো কলেজে যায়নি, কোনো বই কেনেনি। কারণ, তারা জানেই না কীভাবে প্রশ্নের উত্তর দিতে হয়। এমনকি একটি পূর্ণাঙ্গ বাক্যও সঠিকভাবে লিখতে পারে না। ই–মেইল, চিঠি, দরখাস্ত বা অনুচ্ছেদ লেখার মৌলিক নিয়ম সম্পর্কেও তাদের কোনো ধারণা নেই। কখনো কখনো ৫০টি খাতার পুরো একটি বান্ডিলেই এ ধরনের হতাশাজনক পারফরম্যান্স দেখা যায়। মনে হয়, শিক্ষার্থীরা ইংরেজিকে বোঝার পরিবর্তে শুধু পরীক্ষার আগে মুখস্থ করার জন্য একটি তুচ্ছ বা সহজ বিষয় হিসেবে দেখছে, যা নিয়ে পরিকল্পনামাফিক বা গঠনমূলকভাবে পড়াশোনা করার প্রয়োজন নেই।

প্রস্তুতির অভাবও এক বড় কারণ। অনেক শিক্ষার্থী পাঠ্যবই সম্পূর্ণ করে না, মডেল টেস্ট বা লেখার অনুশীলন তো দূরের কথা। পরীক্ষার হলে এসে তারা যেন নতুন করে প্রশ্নের সঙ্গে পরিচিত হয়। অবাক করার মতো কেউ কেউ পুরো প্রশ্নপত্র হুবহু নকল করে উত্তরপত্রে লিখে দেয়—ধারণা, কিছু না কিছু নম্বর পাওয়া যাবে।

হাতের লেখা আরেকটি বড় সমস্যা। এমন অপাঠ্য ও অস্পষ্ট হাতের লেখা যে পরীক্ষককে পড়তে গিয়ে অনুমান করতে হয়। পাঠযোগ্য হাতের লেখার চর্চা তাদের একেবারেই নেই। এর ফলে ন্যায্য মূল্যায়ন করাও কঠিন হয়ে পড়ে। সবচেয়ে ভয়াবহ দিক হলো, শিক্ষার্থীদের মানসিকতা। তারা মনে করে, উত্তরপত্রে যেভাবেই হোক কিছু লিখে দিলেই নম্বর পাওয়া যাবে। বিষয়টি বোঝার বা সঠিক উত্তর দেওয়ার প্রয়োজনীয়তা তারা অনুভব করে না। ফলে উত্তরপত্রে অপ্রাসঙ্গিক গল্প, এলোমেলো বাক্য কিংবা মুখস্থ করা যেকোনো অংশ লিখে ভরে দেয়। এই মানসিকতা দিন দিন বেড়েই চলেছে।

ফলাফলও তাই ভয়াবহ, অনেক শিক্ষার্থী ইংরেজি পরীক্ষায় ১০ শতাংশের কম নম্বর পাচ্ছে। যেটি আগে ব্যতিক্রম ছিল, এখন সেটিই যেন সাধারণ চিত্র হয়ে দাঁড়িয়েছে। সহকর্মী পরীক্ষকেরাও একবাক্যে বলছেন, এই প্রবণতা ক্রমেই বিস্তার লাভ করছে।

এর পেছনে মূলত কয়েকটি কারণ কাজ করছে। প্রথমত, প্রাথমিক ও মাধ্যমিক স্তরে দুর্বল ভিত্তি, যেখানে ইংরেজি শেখানো হয় পরীক্ষাভিত্তিক মুখস্থের মাধ্যমে। দ্বিতীয়ত, শিক্ষার্থীর উদাসীনতা ও প্রযুক্তির অপব্যবহার। তৃতীয়ত, পরিবার ও সমাজের অবহেলা।

আরও পড়ুনচীনের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো কি আসলেই বিশ্বের সেরা১২ আগস্ট ২০২৫

এর সঙ্গে আরও একটি বিপজ্জনক সংস্কৃতি গড়ে উঠেছে শিক্ষায় উদাসীন এক শ্রেণির শিক্ষার্থী, যারা কলেজে যায় পড়াশোনার জন্য নয়; বরং ঘোরাফেরা ও সময় নষ্টের জন্য। তারা প্রায়ই শ্রেণিকক্ষে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করে এবং শেখার পরিবেশ নষ্ট করে। টেস্ট পরীক্ষায় বা চূড়ান্ত পরীক্ষার ফরম পূরণের আগে তারা ফেল করলেও নানা চাপ সৃষ্টি করে কলেজ কর্তৃপক্ষকে চূড়ান্ত পরীক্ষায় অংশ নেওয়ার সুযোগ দিতে বাধ্য করে। নানা পরিস্থিতিতে কর্তৃপক্ষও তাদের সেই সুযোগ দেয়। ফলে সামগ্রিকভাবে প্রতিষ্ঠানের ফলাফল ধ্বংসের মুখে পড়ে।

এই চিত্র কেবল একটি বোর্ডের নয়; বরং সমগ্র শিক্ষাব্যবস্থার জন্য এক গুরুতর সতর্কবার্তা। যদি এখনই সচেতন ও কার্যকর উদ্যোগ না নেওয়া হয়, তবে আগামী প্রজন্মের একটি বড় অংশ আন্তর্জাতিক যোগাযোগ, উচ্চশিক্ষা ও কর্মক্ষেত্রে প্রতিযোগিতায় একেবারেই পিছিয়ে পড়বে। ইংরেজি কেবল একটি বিষয় নয়, এটি বৈশ্বিক জ্ঞানের দরজা খোলার চাবি। দেশের অভ্যন্তরীণ চাকরির বাজারে ভালো পদে নিয়োগ পাওয়ার জন্য ইংরেজি পড়া, লেখা ও বলার দক্ষতা প্রায় অপরিহার্য। বহুজাতিক প্রতিষ্ঠান, বিদেশি বিনিয়োগকারী সংস্থা, এমনকি ফ্রিল্যান্সিং ও অনলাইন মার্কেটপ্লেসেও ইংরেজি দক্ষতা ছাড়া টিকে থাকা অত্যন্ত কঠিন। বিদেশে উচ্চশিক্ষা, স্কলারশিপ, গবেষণা কিংবা পেশাগত সুযোগ লাভের ক্ষেত্রেও ইংরেজির দক্ষতা এক অনস্বীকার্য যোগ্যতা হিসেবে গণ্য হয়।

আরও পড়ুনঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ৪টি বিষয়ে মাস্টার্স প্রোগ্রাম, জিপিএ–২.

৫ হলেই আবেদন০৯ আগস্ট ২০২৫

দুর্ভাগ্যজনকভাবে কমবেশি একই অবস্থা অন্য বিষয়েও দেখা যাচ্ছে। গণিত, বিজ্ঞান, এমনকি মাতৃভাষা বাংলায়ও অনেক শিক্ষার্থী প্রাথমিক জ্ঞান ও সঠিক প্রস্তুতির অভাবে পিছিয়ে পড়ছে। কিছু শিক্ষার্থী আছে, যারা মনোযোগ দিয়ে পড়াশোনা করে এবং ভালো ফল অর্জন করে, কিন্তু তাদের সংখ্যা দিন দিন কমছে। বিপুলসংখ্যক শিক্ষার্থী সঠিক শিক্ষার গুরুত্ব সম্পর্কে একেবারেই উদাসীন। তারা বোঝে না যে মজবুত শিক্ষাগত ভিত্তি ছাড়া ভবিষ্যতে কর্মক্ষেত্র ও জীবনের প্রতিযোগিতায় মারাত্মকভাবে পিছিয়ে পড়বে।

*লেখক: শুভাশীষ দাশ, প্রভাষক, ইংরেজি, সরকারি ইকবাল মেমোরিয়াল কলেজ, ফেনী

আরও পড়ুনএসএসসিতে ফলাফল পুনর্নিরীক্ষণ: ঢাকা বোর্ডে নতুন জিপিএ-৫ পেল ২৮৬, ফেল থেকে পাস ২৯৩১০ আগস্ট ২০২৫

উৎস: Prothomalo

কীওয়ার্ড: পর ক ষ র পর ক ষ য র জন য

এছাড়াও পড়ুন:

পুরুষোত্তম শ্রীকৃষ্ণ

শ্রীকৃষ্ণ বিষ্ণুর অষ্টম অবতার। তাকে স্বয়ং ভগবান এবং বিষ্ণুর পূর্ণাবতারও মনে করা হয়। গীতায় বলা হয়েছে যে, অধর্ম ও দুর্জনের বিনাশ এবং ধর্ম ও সজ্জনের রক্ষার জন্য যুগে যুগে পৃথিবীতে তার আগমন ঘটে। পৃথিবীর ভারমোচন তার প্রাথমিক দায়িত্ব হলেও একজন মর্তজীবী মানুষ হিসেবে রাজনীতি, সমাজ, সংসার ইত্যাদি ক্ষেত্রেও তাকে কর্তব্য পালন করতে দেখা যায়। কৃষ্ণের উল্লেখ প্রথম পাওয়া যায় বৈদিক সাহিত্যে।

ঋগ্‌বেদে একাধিকবার কৃষ্ণের উল্লেখ আছে। সেখানে তিনি ইন্দ্রবিরোধী একজন অনার্য যোদ্ধা হিসেবে চিত্রিত হয়েছেন। কোথাও তাকে ঋষি, এমনকি অসুরও বলা হয়েছে। ছান্দোগ্যোপনিষদ্ এবং কৌষিতকীব্রাহ্মণে কৃষ্ণকে দেবকীপুত্র বলা হয়েছে। তার গুরু ছিলেন ঘোর-আঙ্গিরস।

কারও কারও মতে, ‘‘এই কৃষ্ণই পৌরাণিক যুগে বাসুদেব কৃষ্ণে পরিণত হয়েছেন।’’ পুরুষের মধ্যে উত্তম যিনি, তিনিই পুরুষোত্তম। শ্রীকৃষ্ণকে পুরুষোত্তম বলা হয়। পুরুষোত্তম তত্ত্বে তিন পুরুষের কথা বলা হয়েছে—ক্ষর পুরুষ, অক্ষর পুরুষ ও উত্তম পুরুষ বা পুরুষোত্তম।

আরো পড়ুন:

খালেদা জিয়ার ৮০তম জন্মবার্ষিকী, নয়াপল্টনের কার্যালয়ে দোয়া মাহফিল

আজ হুমায়ুন ফরীদির জন্মদিন

শ্রীকৃষ্ণ বলেছেন, ‘‘ক্ষর পুরুষ সর্বভূত, অক্ষর কূটস্থ পুরুষ, আমি ক্ষরের অতীত এবং অক্ষর থেকেও উত্তম, এই জন্যই আমি পুরুষোত্তম।’ ’

শাস্ত্রজ্ঞ পণ্ডিতেরা পুরুষোত্তম শব্দের বিভিন্ন ব্যাখ্যা দিয়েছেন। শ্রীঅরবিন্দের ব্যাখ্যা হলো, ক্ষর হচ্ছে সচল পরিণাম—আত্মার বহুভূত বহুরূপে যে পরিণাম, তাকেই ক্ষর পুরুষ বলা হচ্ছে। এখানে পুরুষ বলতে ভগবানের বহুরূপ বুঝিয়েছেন—পুরুষ এই প্রকৃতি থেকে আলাদা নয়, প্রকৃতির অন্তর্গত। অক্ষর হচ্ছে অচল, অপরিণামী, নীরব, নিষ্ক্রিয় পুরুষ—এটা ভগবানের এক রূপ, প্রকৃতির সাক্ষী; কিন্তু প্রকৃতি ও তার কাজ থেকে এই পুরুষ মুক্ত।

পরমেশ্বর, পরব্রহ্ম, পরম পুরুষই উত্তম, পরিণামী বহুত্ব ও অপরিণামী একত্ব—এই দুই-ই উত্তমের। তার প্রকৃতির, তার শক্তির বিরাট ক্রিয়ার বলে, তার ইচ্ছা ও প্রভাবের বশেই তিনি নিজেকে সংসারে ব্যক্ত করেছেন। আবার আরও মহান নীরবতার দ্বারা নিজেকে স্বতন্ত্র নির্লিপ্ত রেখেছেন।

গীতায় পুরুষোত্তম যেমন সম, শান্ত, নির্গুণ, অনন্ত, অখিল আত্মা, আবার তিনিই গুণপালক, গুণধারক, প্রকৃতি বা কর্মের প্রেরয়িতা, যজ্ঞ তপস্যার ভোক্তা, সর্বলোক মহেশ্বর।

সুতরাং সর্বভূতাত্মৈক্য-জ্ঞানই পুরুষোত্তম-জ্ঞান, সর্বভূতে ভালোবাসাও সর্বশরণে আত্মসমর্পণই পুরুষোত্তমে ভক্তি এবং সর্বলোক সংগ্রহার্থ নিষ্কাম কর্ম পুরুষোত্তমেরই কর্ম—এই জ্ঞান, ভক্তি ও কর্মের মিলন দিয়ে আত্মা সর্বোচ্চ ঐশ্বরিক অবস্থায় প্রতিষ্ঠিত হয়, যিনি একই কালে অনন্ত-আধ্যাত্মিক শান্তি এবং অনন্ত বিশ্বব্যাপী কর্ম উভয়েরই অধীশ্বর, সেই পুরুষোত্তমের মধ্যে বাস করেন। প্রেম আর বিরহের চিরন্তন রূপ নিয়ে যে কয়টি উপাখ্যান বিশ্বসাহিত্যে অমরত্ব লাভ করেছে, রাধা-কৃষ্ণের প্রেমকাহিনী তার মধ্যে অন্যতম। মধ্যযুগের বাংলা সাহিত্যে বিশাল একটি জায়গা দখল করে আছে এই প্রেমকাহিনী। শ্রীকৃষ্ণকীর্তন কাব্য দিয়ে শুরু, তারপর অজস্র পদাবলী রচিত হয়েছে এ প্রেমকাহিনী নিয়ে। এমনকি রাধা-কৃষ্ণের এ প্রণয়লীলা থেকে উদ্ভব হয়েছিল আলাদা ধর্ম-দর্শন। উদ্ভব ঘটেছিল বৈষ্ণব ধর্মমত ও সাহিত্য। এসব সাহিত্য বোষ্টমীরা গ্রামে গ্রামে গিয়ে পড়ে শোনাত সাধারণ মানুষদের। প্রাচীনতম বাংলা সাহিত্যের নিদর্শন পাই চর্যাপদে, দশম শতাব্দীতে।

বাংলা সাহিত্যের পরবর্তী নিদর্শন পাওয়া যাবে বড়ু চণ্ডীদাস রচিত ‘শ্রীকৃষ্ণকীর্তন’-এ, যা রচিত হয়েছিল দ্বাদশ শতাব্দীতে। বাংলা ভাষায় শ্রীকৃষ্ণকে নিয়ে সুদীর্ঘ একটি কাব্য রচিত হয়েছিল, এতে শ্রীকৃষ্ণের জনপ্রিয়তা বাঙালির মধ্যে যে কতখানি ছিল, তা বোঝা যায়। তবে এ গ্রন্থেরও আগে বাঙালি কবি জয়দেব রাধাকৃষ্ণকে নিয়ে ‘গীতগোবিন্দ’ রচনা করেন, যার ভাষা ছিল সংস্কৃত। এ সবেরই উপজীব্য ছিল রাধা-কৃষ্ণের প্রেমকাহিনি, যা মূলত ভগবত পুরাণবাহিত। বড়ু চণ্ডীদাসের রচনা আধুনিক যুগেও আমাদের হূদয়ে আবেদন সঞ্চারী। রাধা গৃহে রন্ধনকাজে ব্যস্ত, এমন সময় শ্রীকৃষ্ণের বাঁশি শুনে রাধার আকুল উচ্চারণ ‘কে না বাঁশি বায় (বাজায়) ... বাঁশির শবদে মোর আউলাইলো রান্ধন।’ এ যেন আজকের বাঙালির মুখের ভাষা!

বৈষ্ণবধর্ম অতি প্রাচীন হলেও ষোড়শ শতাব্দীতে বাংলাদেশে শ্রীচৈতন্যের আবির্ভাব ও বৈষ্ণবধর্ম  প্রচার কেবল বাংলায় নয়, উড়িষ্যা ও উত্তর ভারতেও ব্যাপ্ত হয়ে পড়ে। এর ফলে রাধাকৃষ্ণকেন্দ্রিক সাহিত্য, যাকে বৈষ্ণব পদাবলী  বলে, তা প্রবল গতিময়তা লাভ করে।

ঢাকা/লিপি

সম্পর্কিত নিবন্ধ

  • পুরুষোত্তম শ্রীকৃষ্ণ
  • সোনারগাঁ অডিটোরিয়াম সংস্কারের নামে অর্থ লোপাটের অভিযোগ
  • ঘোষণার এক মাস পরও মাস্কের ‘আমেরিকা পার্টি’র দেখা নেই
  • ফেনী পুলিশ লাইন্সে সহকর্মীর বঁটির কোপে আনসার সদস্য আহত 
  • উপহার দেওয়া সম্পর্কে ইসলাম