‘আমি মায়ের একমাত্র সন্তান। বাবা নেই। মা কাজ করে অনেক কষ্টে আমাকে এমএ পাস করিয়েছেন। মা আমার সঙ্গে থাকেন। চাকরিটা চলে গেলে আমার স্বামী কি আমার মাকে দেখবেন!’ কথাগুলো বলার সময় চোখ দিয়ে টপটপ করে পানি পড়ছিল মনিরা আক্তারের। তিনি সরকারের ‘তথ্য আপা প্রকল্পের’ তথ্যসেবা সহকারী হিসেবে কাজ করেন লালমনিরহাটের আদিতমারী উপজেলায়। এই মনিরা এখন চাকরি হারানোর শঙ্কায়।

মনিরার মতোই চাকরি হারানোর শঙ্কায় কুমিল্লার মেঘনা উপজেলার তথ্যসেবা কর্মকর্তা মুক্তা আক্তার। তিনি বলেন, ২০২২ সাল থেকে তাঁর স্বামীর ক্যানসার। সংসারের বড় দায়িত্ব এখন তাঁর ওপর। মা–ও অনেক অসুস্থ, মাসে ছয় হাজার টাকার ওষুধ লাগে। বলতে বলতে মুক্তার গলা ধরে আসে, ‘চাকরিটা চলে গেলে মায়ের চিকিৎসা কীভাবে করব! মাকে বলেছি, মা, চাকরি না থাকলে তোমাকে হয়তো ভাইয়ের ওখানে রেখে আসতে হবে। মাকে বলেছি, মা, ক্ষমা করে দিয়ো।’

মনিরা, মুক্তাসহ তথ্য আপা প্রকল্পের প্রায় ১৫০ জন কর্মী রাজধানীর জাতীয় প্রেসক্লাবের সামনে তিন দিন ধরে ‘আমরণ অনশন’ কর্মসূচি পালন করছেন। আসছে জুন মাসে প্রকল্পের দ্বিতীয় পর্যায়ের মেয়াদ শেষ হচ্ছে। তাই চাকরি হারানোর শঙ্কা তাঁদের। এই কর্মীদের দাবি, নতুন প্রকল্পে আউটসোর্সিংয়ের মাধ্যমে জনবল নিয়োগ না দিয়ে তাঁদের চাকরি বহাল রাখতে হবে।

মহিলা ও শিশুবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের অধীন জাতীয় মহিলা সংস্থার বাস্তবায়ন করা এ প্রকল্পের পুরো নাম ‘তথ্য আপা: ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ার লক্ষ্যে তথ্য যোগাযোগ প্রযুক্তির মাধ্যমে মহিলাদের ক্ষমতায়ন’। জুলাই অভ্যুত্থানের পর অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নিয়ে প্রকল্পের নাম পরিবর্তন করে। গত বছরের সেপ্টেম্বরে প্রকল্পের নতুন নাম হয় ‘তথ্য আপা: তথ্য যোগাযোগ প্রযুক্তির মাধ্যমে নারীদের ক্ষমতায়ন প্রকল্প (২য় পর্যায়) (২য় সংশোধিত)’।

প্রকল্পের কর্মীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেল, ২২ মে প্রকল্পের তৃতীয় পর্যায়ের কার্যক্রম এবং উন্নয়ন প্রকল্প প্রস্তাব (ডিপিপি) যাচাই–বাছাই করার লক্ষ্যে আলোচনা করার জন্য মন্ত্রণালয়ে একটি সভা অনুষ্ঠিত হওয়ার নোটিশ জারি হলে কর্মীদের মধ্যে অসন্তোষ দেখা দেয়। সরকারের নীতিমালা অনুযায়ী, নতুন প্রকল্প এলে তাতে আউটসোর্সিংয়ের মাধ্যমে জনবল নিয়োগ হবে। তাঁদের নতুন করে পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে চাকরি পেতে হবে। তাঁরা বারবার পরীক্ষার মধ্য দিয়ে যেতে চান না। এর আগে তাঁরা তিন ধাপে পরীক্ষা দিয়েই প্রকল্পে নিয়োগ পেয়েছিলেন।

আজ শুক্রবার দুপুরে প্রেসক্লাবের সামনে অনশনকারী মনিরা ও মুক্তা ছাড়াও বেশ কয়েকজনের সঙ্গে কথা হয় এই প্রতিবেদকের। তখন ঝিরঝির বৃষ্টি পড়ছিল। প্রেসক্লাবের প্রবেশদ্বারের বাইরে ফুটপাতে শামিয়ানা টাঙিয়ে ২৮ মে থেকে সেখানে অবস্থান নিয়েছেন তাঁরা। রাতেও সেখানে থাকেন। গতকাল বৃহস্পতিবার তুমুল বৃষ্টির মধ্যে রাজধানীর বিভিন্ন রাস্তা পানিতে ডুবে গিয়েছিল। প্রেসক্লাবের সামনের অবস্থাও ছিল বেহাল। এমন দুর্যোগপূর্ণ আবহাওয়ার মধ্যেও গতকাল দিন-রাত ছিলেন তাঁরা। একেকজনের কষ্টের গল্প একেক রকম। তাঁরা জানালেন, তিন দিন ধরে প্রেসক্লাবের সামনে অবস্থান করলেও মন্ত্রণালয় থেকে কেউ তাঁদের দেখতে আসেননি। কেউ যোগাযোগ করেননি।

টাঙ্গাইলের মধুপুর উপজেলার তথ্যসেবা সহকারী আয়শা আক্তার একাকী মা। তাঁর ৯ বছরের সন্তান রয়েছে। তিনি বলেন, ‘চাকরিটা না থাকলে সন্তানকে নিয়ে চলতে পারব না।’

হবিগঞ্জের শায়েস্তাগঞ্জ উপজেলা তথ্যসেবা সহকারী রাশেদা বেগম বলেন, পরিবারে তিনিই একমাত্র উপার্জনক্ষম। অন্যের বাড়িতে কাজ করে এসএসসি–এইচএসসি পাস করেন। পরে এমএ পাস করেন। ক্ষোভ নিয়ে তিনি বলেন, ‘জুলাই গণ–অভ্যুত্থানে শায়েস্তাগঞ্জে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের মুখপাত্র ছিলাম। এখন উল্টো আওয়ামী লীগের ট্যাগ দেওয়া হচ্ছে। নারীর অধিকার নিয়ে কাজ করি, এখন নিজেরাই অধিকারবঞ্চিত হচ্ছি।’

প্রকল্প পরিচালক ও জাতীয় মহিলা সংস্থার যুগ্ম সচিব শাহনাজ বেগম পবিত্র হজ পালনের উদ্দেশ্যে সৌদি আরবে রয়েছেন। উপপ্রকল্প পরিচালক (প্রশাসন ও অর্থ) যুগ্ম সচিব এস এম নাজিমুল ইসলামের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে প্রথম আলোকে তিনি বলেন, প্রকল্প পরিচালকই এ নিয়ে কথা বলতে পারেন। প্রকল্প কর্মকর্তার ছুটিতে থাকাকালীন তিনি শুধু প্রশাসনিক কিছু দায়িত্ব পালন করছেন।

জাতীয় প্রেসক্লাবের সামনে ‘তথ্য আপা প্রকল্পের’ কর্মীরা আমরণ অনশন কর্মসূচি পালন করছেন। ৩০ মে ২০২৫, ঢাকা.

উৎস: Prothomalo

কীওয়ার্ড: প রকল প প প রকল প র ন প রকল প ক জ কর চ কর ট উপজ ল

এছাড়াও পড়ুন:

ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের সুনজর কখন পড়বে

চট্টগ্রামের রাউজান উপজেলার নোয়াপাড়া ইউনিয়নে দ্বিতল ভবনবিশিষ্ট একটি মা ও শিশু কল্যাণকেন্দ্রে ওষুধ নেই, চিকিৎসক নেই, বিদ্যুৎ–সংযোগ নেই। ফলে তেমন একটা রোগীও নেই। এই ‘নাই নাই’ হাসপাতালটির নাম মাস্টারদা সূর্য সেন মা ও শিশু কল্যাণকেন্দ্র। এভাবে কি একটা হাসপাতাল চলতে পারে? প্রত্যন্ত অঞ্চল পর্যন্ত মানুষের দোরগোড়ায় স্বাস্থ্যসেবা নিয়ে যাওয়ার এমন নমুনা আমাদের হতাশ করে। দেশজুড়ে এ রকম আরও চিত্র আমরা দেখতে পাই, যা আমাদের স্বাস্থ্য খাত নিয়ে ইতিবাচক কোনো বার্তা দেয় না।

প্রথম আলোর প্রতিবেদন জানাচ্ছে, ১৯৭৫ সালে প্রতিষ্ঠিত এবং ২০০৩ সালে চালু হওয়া এই ১০ শয্যার হাসপাতালটির মূল সমস্যা জনবলসংকট। ১৬টি পদের ১টিতেও স্থায়ী জনবল পদায়ন করা হয়নি। অন্য হাসপাতাল থেকে প্রেষণে এসে মাত্র তিনজন কর্মচারী (একজন উপসহকারী কমিউনিটি মেডিকেল অফিসার, একজন মিডওয়াইফ ও একজন আয়া) সপ্তাহে কয়েক দিন করে দায়িত্ব পালন করেন। এটি একটি জরুরি প্রসূতিসেবাকেন্দ্র, যা ২৪ ঘণ্টা চালু থাকার কথা। কিন্তু বিদ্যুৎ নেই, ডাক্তার নেই এবং প্রয়োজনীয় জনবলের অভাবে এর কার্যক্রম এখন প্রায় স্থবির।

হাসপাতালের বিদ্যুৎ বিল বকেয়া থাকায় প্রায় তিন মাস ধরে বিদ্যুৎ–সংযোগ বিচ্ছিন্ন। ফলে পানীয় জলের ব্যবস্থাও নেই। বিনা মূল্যের ওষুধ সরবরাহ বন্ধ রয়েছে প্রায় ছয় মাস ধরে। এ পরিস্থিতিতে একজন রোগী কীভাবে এখানে স্বাস্থ্যসেবা নিতে আসবেন? যেখানে হাসপাতালের বাইরের সাইনবোর্ডে জরুরি প্রসূতিসেবার জন্য ২৪ ঘণ্টা খোলা থাকার কথা লেখা, সেখানে মূল ফটকে তালা ঝোলানো। এটি জনগণের সঙ্গে একধরনের প্রতারণা। হাসপাতালটি চালু না থাকায় মা ও শিশুদের স্বাস্থ্যসেবার জন্য স্থানীয় বেসরকারি হাসপাতাল বা চট্টগ্রাম শহরে দৌড়াদৌড়ি করতে হয়। এতে সময় ও অর্থ—দুটোরই অপচয় তো বটেই, চরম ভোগান্তিরও শিকার হতে হয় মানুষকে।

যে মিডওয়াইফরা এখানে কাজ করছেন, তাঁরা জানান, এখন মাসে মাত্র চার-পাঁচজন প্রসূতি সেবা নিতে আসেন, যেখানে আগে শতাধিক প্রসূতি সেবা পেতেন। নিরাপত্তা প্রহরীরা দুই বছর ধরে বেতন পাচ্ছেন না। তবু নিয়মিত বেতন পাওয়ার আশায় তাঁরা এখনো কাজ করে যাচ্ছেন। এ অসহনীয় দুর্ভোগের কারণ হলো সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের চরম উদাসীনতা। উপজেলা পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা জানান, তাঁরা বারবার ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে জনবলসংকটের কথা জানিয়েছেন, কিন্তু কোনো সুরাহা হয়নি।

একটি মা ও শিশু কল্যাণকেন্দ্রের স্বাভাবিক কার্যক্রম চালু রাখতে কেন ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের কাছে বারবার ধরনা দিতে হবে? জনবল নিয়োগ, কর্মচারীদের বকেয়া বেতন পরিশোধ, বিদ্যুতের ব্যবস্থা কার্যকর করা—সব ধরনের সংকট দূর করতে হাসপাতালটির দিকে আন্তরিক মনোযোগ দেওয়া হবে, সেটিই আমাদের প্রত্যাশা।

সম্পর্কিত নিবন্ধ

  • জনবল নিয়োগ দিচ্ছে বাংলাদেশ নৌবাহিনী, পদ ৪৩০
  • হাতে ভোট গণনাসহ ছাত্রদলের ৬ দাবি, স্বচ্ছ ব্যালট বাক্সে ভোট গ্রহণের সিদ্ধান্ত
  • ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের সুনজর কখন পড়বে
  • যে হাসপাতালে চিকিৎসক, ওষুধ, বিদ্যুৎ–সংযোগ কিছুই নেই