হাসপাতালের দ্বিতল ভবন। ভেতরে ঢুকতেই দেখা গেল, ভবনজুড়ে সুনসান নীরবতা। বৈদ্যুতিক বাতি ও পাখা বন্ধ রয়েছে। কোথাও কোনো রোগী নেই। দোতলায় রোগীদের ওয়ার্ড, অস্ত্রোপচার কক্ষে তালা দেওয়া। নিচতলার একটি কক্ষে একজন মিডওয়াইফ (ধাত্রী) এবং বারান্দায় একজন প্রহরী চুপচাপ বসে সময় কাটাচ্ছেন।

গত রোববার এমন চিত্র দেখা যায় চট্টগ্রামের রাউজান উপজেলার নোয়াপাড়া ইউনিয়নে অবস্থিত মাস্টারদা সূর্য সেন মা ও শিশু কল্যাণ কেন্দ্রে। নানা সংকটে সেবা না পেয়ে এখন অনেকটাই রোগীশূন্য ১০ শয্যার হাসপাতালটি।

উপজেলা স্বাস্থ্য বিভাগ সূত্রে জানা গেছে, হাসপাতালটিতে বিদ্যুৎ-সংযোগ বিচ্ছিন্ন প্রায় তিন মাস ধরে। বিল বকেয়া থাকার কারণে সংযোগ বিচ্ছিন্ন করেছে পল্লী বিদ্যুৎ কর্তৃপক্ষ। হাসপাতালটিতে ১৬ জন জনবল থাকার কথা থাকলেও একজনকেও পদায়ন করা হয়নি। অন্য হাসপাতাল থেকে এসে সপ্তাহে কয়েক দিন করে একজন উপসহকারী কমিউনিটি মেডিকেল অফিসার, একজন মিডওয়াইফ এবং একজন আয়া দায়িত্ব পালন করেন। চুক্তিভিত্তিক দুজন প্রহরী নিয়োগ করা হলেও তাঁদের বেতন দেওয়া হচ্ছে না প্রায় দুই বছর। এ ছাড়া হাসপাতালে বিনা মূল্যের ওষুধ সরবরাহ বন্ধ রয়েছে প্রায় ছয় মাস। ফলে হাসপাতালটিতে রোগীদের স্বাস্থ্যসেবা না পেয়ে ফিরতে হচ্ছে।

সরেজমিনে দেখা যায়, ভারতবর্ষের ব্রিটিশবিরোধী স্বাধীনতা আন্দোলনের অন্যতম নেতা সূর্য সেনের বাস্তুভিটায় নির্মিত হয়েছে হাসপাতালটি। সূর্য সেন পল্লির এই হাসপাতাল ভবনটির বাইরে সীমানাপ্রাচীরের সঙ্গে লাগানো একটি সাইনবোর্ড, তাতে লেখা—জরুরি প্রসূতিসেবার জন্য কেন্দ্র দিন-রাত ২৪ ঘণ্টা খোলা থাকে। ভবনের নিচতলায় সেমিনার কক্ষ, ওষুধ বিতরণকক্ষ, মেডিকেল অফিসারের কক্ষসহ সর্বমোট ১১টি কক্ষ। এর মধ্যে একটি কক্ষে কেবল একজন মিডওয়াইফকে দেখা গেলেও বাকিগুলো ফাঁকা পড়ে থাকতে দেখা যায়। দ্বিতীয় তলায় অস্ত্রোপচার কক্ষ, লেবার রুম, কর্তব্যরত চিকিৎসকদের কক্ষ এবং রোগীদের ওয়ার্ড থাকলেও দোতলার মূল ফটকেই তালা ঝোলানো। নিচে অ্যাম্বুলেন্স রাখার ঘরটিতেও কোনো অ্যাম্বুলেন্স দেখা যায়নি।
উপজেলা স্বাস্থ্য পরিবার কল্যাণ কেন্দ্রের কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, মা ও শিশু কল্যাণ কেন্দ্রটি চালু হয় ২০০৩ সালে।

কর্মকর্তারা জানান, হাসপাতালটিতে দীর্ঘদিন ধরে জনবল নিয়োগ না দেওয়ায় অনেক চিকিৎসা সরঞ্জাম নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। চালুর পর থেকে এই মা ও শিশু কেন্দ্রে প্রতিদিন শতাধিক মানুষ চিকিৎসাসেবা নিতেন। তবে সেবা ব্যাহত হওয়ায় কয়েক মাস ধরে রোগী একেবারেই কমে গেছে। হাসপাতালটির প্রায় ৬০ হাজার টাকা বিদ্যুৎ বিল বকেয়া রয়েছে। এ কারণে গত ১৮ জুন সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে দেয় পল্লী বিদ্যুৎ কর্তৃপক্ষ।

এখানে ২ জন মেডিকেল অফিসার, ৪ জন পরিবার কল্যাণ পরিদর্শিকা, ২ জন নারী সহকারী চিকিৎসক, ২ জন মিডওয়াইফ, ১ জন অ্যাম্বুলেন্স চালকসহ মোট ১৬ জন কর্মরত থাকার কথা। তবে দুই দশকের বেশি সময় পার হলেও কাউকে পদায়ন করা হয়নি। বর্তমানে পান্না রানী পাল নামের একজন উপসহকারী কমিউনিটি মেডিকেল অফিসার সপ্তাহে তিন দিন এখানে অতিরিক্ত দায়িত্ব পালন করেন। তিনি কর্মরত রয়েছেন বাগোয়ান স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কেন্দ্রে। মিডওয়াইফ পদে থাকা নিলুফা আকতারও প্রেষণে দায়িত্ব পালন করছেন। তাঁর কর্মস্থল চন্দনাইশ উপজেলার দোহাজারীতে। আয়া পদে থাকা রত্না ধর সপ্তাহে তিন দিন দায়িত্ব পালন করেন। তাঁর কর্মস্থল উপজেলার গহিরা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কেন্দ্রে। হাসপাতালে দুজন নিরাপত্তা প্রহরী চুক্তিভিত্তিক কাজ করেন। তাঁরা হলেন মুহাম্মদ মোজাম্মেল ও  মুহাম্মদ মনসুর।

কর্মকর্তারা জানান, হাসপাতালটিতে দীর্ঘ দিন ধরে জনবল নিয়োগ না দেওয়ায় অনেক চিকিৎসা সরঞ্জাম নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। চালুর পর থেকে এই মা ও শিশু কেন্দ্রে প্রতিদিন শতাধিক মানুষ চিকিৎসাসেবা নিতেন। তবে সেবা ব্যাহত হওয়ায় কয়েক মাস ধরে রোগী একেবারেই কমে গেছে। হাসপাতালটির প্রায় ৬০ হাজার টাকা বিদ্যুৎ বিল বকেয়া রয়েছে। এ কারণে গত ১৮ জুন সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে দেয় পল্লী বিদ্যুৎ কর্তৃপক্ষ।
হাসপাতালটিতে কথা হয় মিডওয়াইফ নিলুফা আকতারের সঙ্গে। ২৪ ঘণ্টা প্রসূতিদের সেবার কথা বাইরে লেখা থাকলেও বিদ্যুৎ না থাকায় বেলা ২টার পর মা ও শিশু কেন্দ্রটি বন্ধ রাখতে হচ্ছে বলে জানান তিনি। নিলুফা বলেন, এখন মাসে চার থেকে পাঁচজন প্রসূতি এখানে প্রসব সেবা নেন। আগে এটি অনেক বেশি ছিল। ৫০ থেকে ৬০ জন প্রসূতি নানা ধরনের সেবা নিতে আসতেন। তিনি বলেন, তিন মাস বিদ্যুৎ-সংযোগ বিচ্ছিন্ন রয়েছে। এতে পানির কলটিও চালানো সম্ভব হচ্ছে না। হাসপাতালে দুর্ভোগের শেষ নেই।

মা ও শিশুকল্যাণ কেন্দ্রটি পুরোদমে চালানোর জন্য ১৬টি পদেই জনবল পদায়ন করতে হবে। তবে এখন পর্যন্ত একজনকেও পদায়ন করা হয়নি। জনবল না থাকার বিষয়টি জানিয়ে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় ও অধিদপ্তরে বারবার চিঠি দেওয়া হচ্ছে। এর পরও কাউকে পদায়ন করা হচ্ছে না।প্রিয়াঙ্কা চৌধুরী, পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা (অতিরিক্ত দায়িত্ব),  রাউজান উপজেলা

নিরাপত্তা প্রহরী মো.

মুহাম্মদ মোজাম্মেল প্রথম আলোকে বলেন, দুই বছর ধরে বেতন-ভাতা বন্ধ থাকায় পরিবার-পরিজন নিয়ে কষ্টে দিন কাটছে তাঁর। তবু বেতন-ভাতা নিয়মিত হবে এখনো সেই আশায় রোজ দায়িত্ব পালন করে যাচ্ছেন।

হাসপাতাল ভবনের দ্বিতীয় তলায় অস্ত্রোপচার কক্ষ, লেবার রুম, রোগীদের ওয়ার্ড থাকলেও দোতলার মূল ফটকেই তালা ঝোলানো রয়েছে। গত রোববার দুপুরে তোলা

উৎস: Prothomalo

কীওয়ার্ড: ম ড ক ল অফ স র কল য ণ ক ন দ র পর ব র পর কর মকর ত থ কল ও প রস ত জন ম ড প রহর উপজ ল

এছাড়াও পড়ুন:

মহানবী (সা.)–এর ইন্তেকালের পরে শাসন নিয়ে যা ঘটেছে

মহানবী হজরত মুহাম্মদ (সা.)-এর সিরাত বা জীবনী শুধু ইসলামের ইতিহাসের একটি অধ্যায় নয়, বরং এটি একটি স্বতন্ত্র জ্ঞানশাখা, যার কেন্দ্রে রয়েছেন তিনি এবং তাঁর যুগের ঘটনাবলি, মূল্যবোধ, নীতি, মুজিজা এবং সম্পর্ক।

নবীজির সিরাত প্রতিষ্ঠিত কোরআন, হাদিস এবং সাহাবিদের জীবনাচরণের আলোকে। তবে এই জীবনী নিয়ে বিভিন্ন সময়ে ভ্রান্ত ব্যাখ্যা এবং তথ্য বিকৃতির ঘটনা ঘটেছে, যা ইসলামের প্রকৃত চিত্রকে ক্ষতিগ্রস্ত করেছে।

প্রামাণিক উৎস

মহানবী (সা.)–এর জীবন সম্পর্কে অধ্যয়নের সবচেয়ে প্রামাণিক উৎস হলো কোরআন মাজিদ। কোরআনে তাঁর জীবনের বিভিন্ন পর্যায়, তাঁর রিসালাত, হিজরত, যুদ্ধ এবং তাঁর মানবিক গুণাবলি সম্পর্কে বিস্তারিত বর্ণনা রয়েছে। উদাহরণস্বরূপ, সুরা মুহাম্মদে তাঁর নাম উল্লেখ করা হয়েছে (আয়াত: ২)।

সুরা আলে ইমরানেও এসেছে (আয়াত: ১৪৪), সুরা আহজাবে তাঁকে ‘খাতামুন নাবিয়্যিন’ বা নবীদের সিলমোহর (মানে শেষ নবী) বলা হয়ে (আয়াত: ৪০) এবং সুরা ফাতহে তাঁকে বলা হয়েছে ‘আল্লাহর রাসুল’ (আয়াত: ২৯)।

মহানবীর সিরাত নিয়ে কিছু ব্যাখ্যা ও রচনা ঐতিহাসিক সত্য থেকে বিচ্যুত হয়েছে, যা ইসলামের প্রকৃত চিত্রকে বিকৃত করেছে। এই বিকৃতিগুলো ইচ্ছায় বা অনিচ্ছায় হয়েছে, কখনো অতিরঞ্জিত বর্ণনা বা ভুল ব্যাখ্যার মাধ্যমে প্রকাশ পেয়েছে।

এ ছাড়া চরিত্র, কাজ, অবস্থান সম্পর্কে বহু আয়াত আছে কোরআনে।

হাদিস গ্রন্থগুলোও সিরাতের একটি গুরুত্বপূর্ণ উৎস। ইমাম মালিকের মুয়াত্তা, সহিহ বুখারি, সহিহ মুসলিম, সুনানে আবু দাউদ, সুনানে ইবনে মাজা, সুনানে তিরমিজি এবং সুনানে নাসাইতে তাঁর বাণী, কাজ ও সম্মতির বিস্তারিত বিবরণ রয়েছে এবং সিরাতের বিভিন্ন দিক তুলে ধরা হয়েছে।

এই গ্রন্থগুলোর সনদ (বর্ণনা পরম্পরা ও বিষয়বস্তু যাচাইয়ের জন্য মুহাদ্দিসগণ কঠোর মানদণ্ড প্রয়োগ করেছেন, যা ‘জার্‌হ ও তাদিল’ নামে পরিচিত।

এ ছাড়া ইবনে ইসহাকের সিরাতু রাসুলিল্লাহ সিরাতের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ গ্রন্থগুলোর একটি, ইবনে হিশাম, যার একটি সংক্ষিপ্ত সংস্করণ প্রকাশ করেছেন এবং আস-সুহাইলি তা নিয়ে আর-রওদুল উনুফ নামে একটি ব্যাখ্যা রচনা করেছেন।

এ ছাড়া ইবনে শিহাব জুহরি ও মুসা ইবনে উকবার মাগাজি মহানবী (সা.) রাসুলুল্লাহর নির্ভরযোগ্য জীবনীগ্রন্থ। কাজি ইয়াজের আশ-শিফা বি তা’রিফ হুকুকিল মুস্তফা তাঁর গুণাবলি ও অধিকারের ওপর বিশদ আলোচনা করেছে, যা পূর্ব ও পশ্চিমের পণ্ডিতদের কাছে ব্যাপকভাবে সমাদৃত।

আরও পড়ুনমহানবী হজরত মুহাম্মদ (সা.)–এর জীবনী রচনার হাজার বছর১১ নভেম্বর ২০২০ভ্রান্ত ব্যাখ্যা ও তথ্য বিকৃতি

মহানবীর সিরাত নিয়ে কিছু ব্যাখ্যা ও রচনা ঐতিহাসিক সত্য থেকে বিচ্যুত হয়েছে, যা ইসলামের প্রকৃত চিত্রকে বিকৃত করেছে। এই বিকৃতিগুলো ইচ্ছায় বা অনিচ্ছায় হয়েছে, কখনো অতিরঞ্জিত বর্ণনা বা ভুল ব্যাখ্যার মাধ্যমে প্রকাশ পেয়েছে।

মহানবীর মৃত্যুর পূর্বে তাঁর অসুস্থতার লক্ষণ প্রকাশ পায় হজ্জাতুল বিদা বা বিদায় হজের সময়। তিনি আরাফাতে দাঁড়িয়ে বলেন, ‘আমার কাছ থেকে তোমাদের হজের রীতি গ্রহণ করো। কারণ, এ বছরের পর আমি হয়তো আর হজ করতে পারব না।’ (সহিহ মুসলিম, হাদিস: ১,২৯৭)

সুরা নাসর অবতীর্ণ হলে তিনি বলেন, ‘এটি আমার মৃত্যুর ঘোষণা।’ (ইবনে কাসির, আল-বিদায়া ওয়ান নিহায়া, ৫/২০৮, দারুল ফিকর, বৈরুত, ১৯৮৮)

আমি এখনো খায়বারে খাওয়া বিষাক্ত খাবারের যন্ত্রণা অনুভব করছি, এখন এর সময় এসেছে যে আমার শিরা ছিঁড়ে যাবে।সহিহ বুখারি, হাদিস: ৪৪২৮

রাসুল (সা.) মসজিদে দাঁড়িয়ে বলেন, ‘আল্লাহ তাঁর একজন বান্দাকে দুনিয়া ও আল্লাহর নৈকট্যের মধ্যে পছন্দ করতে বলেছেন, আর সেই বান্দা আল্লাহর নৈকট্য পছন্দ করেছেন।’ (সহিহ বুখারি, হাদিস: ৬,৫০৪)

তাঁর অসুস্থতার সময় তিনি আয়েশা (রা.)-এর ঘরে থাকতে পছন্দ করেন। আয়েশা বলেন, ‘তিনি জান্নাতুল বাকি (কবরস্থান) থেকে ফিরে এসে আমাকে মাথাব্যথায় কাতর দেখে বললেন, “বরং আমি বলি, হায় আমার মাথা”!’ (মুহাম্মদ ইবনে ইসহাক, সিরাতু রাসুলিল্লাহ, পৃ. ৬৭৮, দারুল মা’রিফা, বৈরুত, ১৯৭৮)

তিনি তীব্র জ্বরে ভুগছিলেন এবং বলেন, ‘আমি এখনো খায়বারে খাওয়া বিষাক্ত খাবারের যন্ত্রণা অনুভব করছি, এখন এর সময় এসেছে যে আমার শ ছিঁড়ে যাবে’ (সহিহ আল-বুখারি, হাদিস: ৪৪২৮)। তিনি নির্দেশ দেন সাতটি মশকের পানি তাঁর ওপর ঢালার জন্য, যা তাঁর জ্বর কমাতে সাহায্য করে। (ইবনে হিশাম, সিরাতুন নবী, ২/৬৪২, দারুল কুতুবিল ইলমিয়া, বৈরুত, ১৯৯৮)

১১ হিজরির ১২ রবিউল আউয়াল, সোমবার (৭ জুন, ৬৩২ খ্রিষ্টাব্দ) তিনি মৃত্যুবরণ করেন। মৃত্যুর পূর্বে তিনি আয়েশা (রা.)–এর ঘর থেকে মসজিদে উঁকি দিয়ে মুসল্লিদের দিকে তাকিয়ে হাসেন এবং বলেন, ‘হে আল্লাহ, আমাকে মৃত্যুর যন্ত্রণায় সাহায্য করো।’ (আবু বকর আল-বাইহাকি, দালাইলুন নুবুওয়া, ৭/২৪৪, দারুল কুতুবিল ইলমিয়া, বৈরুত, ১৯৮৫)

তাঁর মৃত্যুর পর আবু বকর (রা.) ঘোষণা দেন, ‘যে মুহাম্মদের ইবাদত করত, সে জানুক, মুহাম্মদ মারা গেছেন। আর যে আল্লাহর ইবাদত করে, সে জানুক আল্লাহ চিরজীবী, তিনি মরেন না।’ (সহিহ বুখারি, হাদিস: ১২৪১)

আরও পড়ুননবীজি (সা.)–র কোন জীবনী পড়বেন২১ ফেব্রুয়ারি ২০২৫খিলাফতের প্রতিষ্ঠা: সাকিফা বনু সায়েদা

মহানবী (সা.)–এর মৃত্যুর পর ‘সাকিফা বনু সায়েদা’য় সাহাবিরা খিলাফত নির্বাচনের জন্য সমবেত হন। আনসাররা সাদ ইবন উবাদার নেতৃত্বে দাবি করেন যে তারা ইসলামের প্রথম দিন থেকে রাসুলকে সমর্থন করেছেন, তাই তাদের মধ্য থেকে আমির নির্বাচিত হওয়া উচিত।

আবু বকর (রা.) মুহাজিরদের পক্ষে বলেন, ‘কুরাইশরা ইসলামে প্রথম ইমান এনেছে এবং তারা আরবের মধ্যে সবচেয়ে সম্মানিত গোত্র। আমি তোমাদের জন্য উমর বা আবু উবাইদাহর মধ্যে একজনকে প্রস্তাব করছি।’ (ইবনে হিশাম, সিরাতুন নবী, ২/৫৬, দারুল কুতুবিল ইলমিয়া, বৈরুত, ১৯৯৮)

আনসাররা প্রস্তাব করেন, ‘একজন আমির মুহাজিরদের থেকে এবং একজন আনসারদের থেকে হবে।’ তবে এই প্রস্তাব ঐক্য রক্ষার জন্য প্রত্যাখ্যাত হয়। উমর ইবনে খাত্তাব আবু বকরের হাত ধরে বায়আত করেন এবং আনসাররাও তাঁকে সমর্থন দেন। (সহিহ বুখারি, হাদিস: ৬,৮৩০)

আমি তোমাদের নেতা নির্বাচিত হয়েছি, কিন্তু আমি তোমাদের মধ্যে সর্বোৎকৃষ্ট নই। যদি ভালো করি, আমাকে সাহায্য করো; আর যদি ভুল করি, আমাকে সংশোধন করো।হজরত আবু বকর (রা.)

পরদিন মসজিদে সাধারণ বায়আত অনুষ্ঠিত হয়। আবু বকর (রা.) বলেন, ‘আমি তোমাদের নেতা নির্বাচিত হয়েছি, কিন্তু আমি তোমাদের মধ্যে সর্বোৎকৃষ্ট নই। আমি যদি ভালো করি, আমাকে সাহায্য করো; আর যদি ভুল করি, আমাকে সংশোধন করো।’ (ইবনে হিশাম, সিরাতুন নবী, ২/৬৫৮, দারুল কুতুবিল ইলমিয়া, বৈরুত, ১৯৯৮)

কয়েকজন সাহাবি, যেমন আলী (রা.) এবং জুবাইর ইবন আওয়াম, ফাতিমা (রা.)-এর ঘরে মহানবীর দাফনের প্রস্তুতি নিয়ে ব্যস্ত ছিলেন, তাই সাকিফায় উপস্থিত ছিলেন না। কেউ কেউ মনে করেন, খিলাফতের জন্য আলী (রা.) বা আব্বাস ইবন আবদুল মুত্তালিব উপযুক্ত ছিলেন।

তবে মহানবী কাউকে স্পষ্টভাবে খলিফা মনোনয়ন করেননি। তিনি বলেছিলেন, ‘আমাকে কাগজ দাও, আমি তোমাদের জন্য এমন কিছু লিখে দেব, যার পর তোমরা পথভ্রষ্ট হবে না।’ কিন্তু উমর বলেন, ‘নবীজি এখন প্রবল যন্ত্রণায় ভুগছেন, (তাকে বিরক্ত করব না) আমাদের জন্য কোরআনই যথেষ্ট।’ (সহিহ বুখারি, হাদিস: ১১৪)।

রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠায় মহানবীর ভূমিকা

‘আবু বকর (রা.) ইসলামি রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন’ বলে হালা ওয়ার্দি যে দাবি করেছেন, তা ঐতিহাসিক তথ্যের সঙ্গে অসংগতিপূর্ণ।

মহানবী (সা.) নিজেই ইসলামি রাষ্ট্রের ভিত্তি স্থাপন করেন। তিনি মদিনায় একটি জাতি গঠন করেন, যারা কোরআনের নির্দেশনা অনুসরণ করে ঐক্যবদ্ধ হয়। কোরআনে বলা হয়েছে, ‘তোমরা সবাই আল্লাহর রজ্জুকে দৃঢ়ভাবে ধরো এবং বিচ্ছিন্ন হোয়ো না।’ (সুরা আলে ইমরান, আয়াত: ১০৩)

তিনি মদিনা সনদ প্রণয়ন করেন, যা মুসলিম ও অমুসলিমদের মধ্যে সম্পর্ক ব্যাখ্যা করে। (ইবনে হিশাম, সিরাতুন নবী, ১/৫০১, দারুল কুতুবিল ইলমিয়া, বৈরুত, ১৯৯৮)

তিনি বিভিন্ন গোত্রের সঙ্গে চুক্তি, যুদ্ধে নেতৃত্ব এবং রাষ্ট্রদূত প্রেরণের মাধ্যমে রাষ্ট্রের কাঠামো গড়ে তোলেন। যেমন রোমের সম্রাট হেরাক্লিয়াস, পারস্যের কিসরা এবং মিসরের মুকাউকিসের কাছে পত্র প্রেরণ করেন, যা তাঁর রাষ্ট্রের সার্বভৌমত্বের প্রতীক। (ইবনে কাসির, আল-বিদায়া ওয়ান নিহায়া, ৪/২৬৯, দারুল ফিকর, বৈরুত, ১৯৮৮)

তিনি রাষ্ট্র পরিচালনায় ন্যায়বিচার ও শুরার নীতি প্রয়োগ করেন। কোরআনে বলা হয়েছে, ‘মানুষের মধ্যে ন্যায়বিচারের সঙ্গে রায় দাও।’ (সুরা সাদ, আয়াত: ২৬)

মহানবী (সা.) বলেছেন, ‘যদি ফাতিমা বিনতে মুহাম্মদ চুরি করত, আমি তার হাত কেটে দিতাম।’ (সহিহ বুখারি, হাদিস: ৬,৭৮৭)।

তিনি শুরার বাস্তবায়ন করেন, কেননা কোরআন বলেছে, ‘তাদের সঙ্গে পরামর্শ করো।’ (সুরা আলে ইমরান, আয়াত: ১৫৯)

তিনি বলেন, ‘আমি একজন মানুষ। ধর্মীয় বিষয়ে আমার নির্দেশ গ্রহণ করো, কিন্তু পার্থিব বিষয়ে তোমরা আমার চেয়ে বেশি জানো।’ (সহিহ মুসলিম, হাদিস: ২,৩৬৩)

হালা ওয়ার্দির গ্রন্থের মতো অনেক গ্রন্থ বাজারে পাওয়া যায়, যা ঐতিহাসিক তথ্যের অপব্যাখ্যা করে এবং তাঁর মৃত্যু ও খিলাফত নিয়ে ভ্রান্ত ধারণা প্রচার করে।শেষ কথা

মহানবীর ‘সিরাত’ ইসলামের ইতিহাস ও মূল্যবোধের একটি জীবন্ত দলিল। কোরআন, হাদিস এবং প্রামাণিক সিরাত গ্রন্থগুলো তাঁর জীবনের সঠিক চিত্র তুলে ধরেছে। তবে হালা ওয়ার্দির গ্রন্থের মতো অনেক গ্রন্থ বাজারে পাওয়া যায়, যা ঐতিহাসিক তথ্যের অপব্যাখ্যা করে এবং তাঁর মৃত্যু ও খিলাফত নিয়ে ভ্রান্ত ধারণা প্রচার করে।

মহানবী (সা.) ইসলামি রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন, যিনি ন্যায়বিচার, শুরা এবং ঐক্যের ভিত্তিতে এটি গড়ে তুলেছিলেন। তাঁর মৃত্যু ও খিলাফত নির্বাচনের ঘটনাগুলো তাঁর প্রতিষ্ঠিত রাষ্ট্রের ধারাবাহিকতা নিশ্চিত করেছে। এই সিরাত আমাদের শিক্ষা দেয় যে সত্য ও ন্যায়ের পথে অবিচল থাকা এবং ঐক্যের মাধ্যমে সমাজ গঠন করা সম্ভব।

সূত্র: আল-মালুম আন আল-জাদওয়াল আত-তারিখি লি-সিরাতির রাসুল

আরও পড়ুনমহানবী (সা.)–এর জন্মকালের অলৌকিক ঘটনাবলি১৯ ঘণ্টা আগে

সম্পর্কিত নিবন্ধ

  • গাজায় ২৬ হাজার শিশু তীব্র অপুষ্টির শিকার: জাতিসংঘ
  • হাতে ভোট গণনাসহ ছাত্রদলের ৬ দাবি, স্বচ্ছ ব্যালট বাক্সে ভোট গ্রহণের সিদ্ধান্ত
  • গ্রাহকের কাছে পেয়ারা খেতে চায় জনতা ব্যাংকের কর্মকর্তা
  • গল্পটা এই ক্লাসরুম থেকেই শুরু: ইরফান সাজ্জাদ
  • রাশিয়ায় এক বাঙালি বিপ্লবীর খোঁজে
  • ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের সুনজর কখন পড়বে
  • আপনার এত সাহস হয় কী করে, সাংবাদিককে নায়িকা
  • দুবাইয়ে বিকৃত যৌন ব্যবসা চক্রের প্রধানকে চিহ্নিত করল বিবিসির এক অনুসন্ধান
  • মহানবী (সা.)–এর ইন্তেকালের পরে শাসন নিয়ে যা ঘটেছে