ডিজিটাল মাধ্যমে বন্যার পূর্বাভাস প্রান্তিক কৃষকের কতটা উপকারে আসে
Published: 4th, June 2025 GMT
কুড়িগ্রামে আগাম বন্যার পূর্বাভাসের অভাবে ভারী বৃষ্টি ও উজানের ঢলে নিম্নাঞ্চল প্লাবিত হয়ে কৃষকের ফসলের ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। বন্যার আগাম পূর্বাভাস না জানায় সময়মতো ফসল তুলতে না পেরে প্রায় ৩০০ হেক্টর বোরো ধান, তিল, ভুট্টা, বাদাম ও বিভিন্ন ধরনের শাকসবজির খেত পানিতে নিমজ্জিত হয়েছে। সঠিক সময়ে পূর্বাভাস পেলে লোকসান কিছুটা কমত বলে কৃষকেরা জানান।
ভারী বৃষ্টি ও উজানের ঢলে বন্যা হতে পারে বলে ১৯ মে থেকে নিজেদের ওয়েবসাইট, পত্র-পত্রিকা ও ডিজিটাল মাধ্যমে পানি উন্নয়ন বোর্ড, কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর, জেলা ত্রাণ ও পুনর্বাসন কার্যালয় প্রচার চালিয়েছে। ডিজিটাল মাধ্যমে বন্যার পূর্বাভাস প্রচারে সাধারণ মানুষের উপকারে আসার কথা বলা হলেও, প্রয়োজনীয় প্রযুক্তিজ্ঞানের অভাব, ডিজিটাল যন্ত্রপাতি ব্যবহারের ক্ষেত্রে সীমাবদ্ধতা, ইন্টারনেট সংযোগের অভাবে এসব সেবা সাধারণ মানুষের উপকারে আসে কম।
জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর সূত্রে জানা যায়, এ বছর জেলার রাজারহাট উপজেলায় ১৭৫ হেক্টর আর উলিপুরে ২৩০ হেক্টর জমিতে বাদাম চাষ হয়েছে। চলতি মৌসুমে উজানের ঢল ও ভারী বৃষ্টিতে ৩০০ হেক্টর ফসলি খেত নিমজ্জিত হয়েছে। এখনো ৬৪ হেক্টর চিনাবাদাম ও ১ হেক্টর তিল পানিতে নিমজ্জিত রয়েছে।
উজানের ঢলে নদ-নদীর পানি বেড়ে কুড়িগ্রামের ৩০০ হেক্টর ফসলি জমি পানিতে নিমজ্জিত হওয়ার পর রাজারহাট, কুড়িগ্রাম সদর ও উলিপুর উপজেলার অনেক কৃষকের সঙ্গে কথা হয়। কৃষকেরা বন্যার পূর্বাভাস সম্পর্কে তাঁদের কেউ কোনো তথ্য জানান না বলে জানান। বন্যায় ক্ষয়ক্ষতির পর কৃষি বিভাগ থেকে তাঁদের ফসলের ক্ষয়ক্ষতির জন্য অনুদানের বিষয়েও অনেকেই জানেন না। আধুনিক যুগে এসেও জমিতে ফসল চাষের পর প্রকৃতির ওপর ভরসা করে তাঁদের থাকতে হয়। এ ছাড়া চরাঞ্চলে কৃষি কর্মকর্তাদের সহজে পাওয়া না যাওয়ায় নিজেদের অভিজ্ঞতা ও প্রাকৃতিক দুর্যোগের সঙ্গেই লড়াই করে এখনো প্রান্তিক কৃষকদের চাষাবাদ করতে হচ্ছে।
উলিপুর উপজেলার সাহেবের আলগা ইউনিয়নের মাঝের আলগার চরের কৃষক আবদুল মমিন বলেন, ‘উজানের ঢলে ব্রহ্মপুত্র নদের পানি বেড়ে চিনা, তিল ও বাদাম ডুবে গেছে। উজানে ভারী বৃষ্টি হয়ে ঢল নামবে জানা থাকলে আধা পাকা বাদাম ও তিল আগেই উঠাতাম। এতে লোকসান কিছুটা কম হতো। পানিতে ডুবে সব শেষ হয়ে গেছে।’
এক প্রশ্নের জবাবে আবদুল মমিন বলেন, ‘আমরা কৃষক মানুষ, টাচ ফোন চালাইবার পারি না। সরকার কোনে (কোথায়) বন্যার পূর্বাভাস দেয়, হেইডা তো আমরা দেখপার পাই না। নদীপাড়ের কৃষকের জন্য মাইকিং করে বন্যার পানি বাড়ার ঘোষণা দিলে উপকার হইল হয়।’
রাজারহাট উপজেলার চর গতিয়াশাম গ্রামের কৃষক রুহুল আমীন জানান, তিস্তা নদীর চরে তিনি ৫০ শতক জমিতে বাদাম চাষ করেছেন। বৃষ্টি শুরু হওয়ার পর পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো) প্রকৌশলী নদী পরিদর্শন করতে এসে বন্যার কথা বলেছিলেন। কাঁচা–পাকা মিলিয়ে ৩০ শতক জমির বাদাম তুলেছেন। বাকি বাদামখেত ডুবে গেছে। প্রতিটি ইউনিয়নের বড় বড় বাজারে বন্যার পূর্বাভাস নিয়ে মাইকিং করলে আর ইউনিয়ন পর্যায়ে ডিজিটাল বোর্ডের মাধ্যমে আবহাওয়ার তথ্য দিলে ক্ষতি কম হতো বলে তিনি মনে করেন।
কুড়িগ্রামের নদ-নদী অববাহিকার নিম্নাঞ্চল প্লাবিত হয়ে আগাম বন্যার সার্বিক বিষয়ে রিভারাইন পিপলের পরিচালক অধ্যাপক তুহিন ওয়াদুদ প্রথম আলোকে জানান, তিস্তা নদীর উজানে সিকিমে ভারী বৃষ্টিপাত হলে ওই ঢলের পানি কুড়িগ্রাম পৌঁছাতে বেশ কয়েক দিন সময় লাগে। অন্তত তিন দিন আগে কৃষককে বন্যার পূর্বাভাস জানাতে পারলে ক্ষতি কমে যেত। তিনি আরও বলেন, ‘বাংলাদেশের বন্যা ও আবহাওয়া পূর্বাভাসব্যবস্থাকে ঢেলে সাজাতে হবে। ডিজিটাল মাধ্যমে যে ধরনের পূর্বাভাস আমরা দিই, তাতে দুর্যোগপ্রবণ এলাকার কৃষকের তেমন উপকারে আসে না। বন্যার আগাম সতর্কতার জন্য প্রান্তিক কৃষকদের উপযোগী করে প্রচার–প্রচারণা চালাতে হবে।’
জেলা ত্রাণ ও পুনর্বাসন কর্মকর্তা মো.
কুড়িগ্রাম কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপপরিচালক (শস্য) মো. আসাদুজ্জামান প্রথম আলোকে বলেন, কৃষকদের বন্যা ও প্রাকৃতিক দুর্যোগে আগাম ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য ইউনিয়ন ও ওয়ার্ড পর্যায়ে কমিটি রয়েছে। বন্যার পূর্বাভাস থাকলে ওই কমিটি সেটি জানিয়ে দেয়। এ ছাড়া ওয়েবসাইটে বন্যা ও প্রাকৃতিক দুর্যোগের বিষয়ে প্রচারণা চালিয়ে থাকেন তাঁরা।
উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: বন য র প র ব ভ স র জন য উপক র উপজ ল র ফসল
এছাড়াও পড়ুন:
হনুমান কি পর্বত কাঁধে করে উড়ে এসেছিলেন?
হিন্দু ধর্মগ্রন্থ রামায়ণের এক বিশিষ্ট অধ্যায়ে উঠে আসে এক অলৌকিক ঘটনার কথা। রাম-রাবণের মহাযুদ্ধে শ্রীরামচন্দ্রের ভাই লক্ষ্মণ অচেতন হয়ে পড়লে, তাঁকে জীবিত রাখতে প্রয়োজন হয় একটি বিশেষ ভেষজ উদ্ভিদের—সঞ্জীবনী বুটি। আয়ুর্বেদাচার্য সুষেণের পরামর্শে হনুমান ছুটে যান হিমালয়ের পাদদেশে গন্ধমাদন পর্বতে।
রামায়ণে বর্ণিত আছে, নির্দিষ্ট গাছটি শনাক্ত করতে না পারায় হনুমান পুরো গন্ধমাদন বা দ্রোণগিরি পর্বতটাই তুলে কাঁধে নিয়ে পা বাড়ান লঙ্কার উদ্দেশে। বিশ্বাস করা হয় যে তিনি দীর্ঘ আকাশপথ পাড়ি দেন এই পাহাড় বহন করে। পথিমধ্যে তিনি কিছু স্থানে বিশ্রামও নেন; যেসব স্থান আজও ‘হনুমান টোক’, ‘হনুমান চট’, ‘হনুমান ধারা’ নামে পরিচিত।
নির্দিষ্ট গাছটি শনাক্ত করতে না পারায় হনুমান পুরো গন্ধমাদন বা দ্রোণগিরি পর্বতটাই তুলে কাঁধে নিয়ে পা বাড়ান লঙ্কার উদ্দেশে।পৌরাণিক গ্রন্থগুলোয় সব ঘটনা রূপকভাবে লেখা আছে। এককথায় পুরাণের মধ্যে সবকিছু গোলমাল পাকিয়ে আছে। গোলটা ফেলে মালটা বের করতে পারলে পৃথিবীর অনেক কল্যাণ হয়। এই ঘটনার রূপকতা ব্যাখ্যা করতে একটা গল্পের উল্লেখ করছি।
আরও পড়ুনভারতের আদিতম মহাকাব্য রামায়ণ১১ ফেব্রুয়ারি ২০২৩বাড়িতে ২০০ মানুষকে নিমন্ত্রণ করে এক ব্যক্তি বাজারে গিয়ে অনেক বাজার করেছেন। ফেরার সময় তিনি নিজের সাইকেলের দুই হ্যান্ডলে দুটো ব্যাগ ঝুলিয়েছেন, পেছনে দুটো ব্যাগ ঝোলানো, ক্যারিয়ারে একটা বস্তা বাঁধা। জায়গা না পেয়ে নিজের দুই কাঁধে দুটো ব্যাগ ঝুলিয়ে বাজার থেকে বাড়ির উদ্দেশে যাওয়ার পথে রাস্তায় এক লোক তাঁকে দেখে বললেন ‘কী হে ভাই, তুমি তো দেখি পুরা বাজার উঠিয়ে নিয়ে এসেছ!’ এর মানে কিন্তু এই নয় যে সেই ব্যক্তি পুরো বাজার উঠিয়ে নিয়ে এসেছেন।
তিনি আসলে অনেক বাজার করেছেন। হনুমানের ক্ষেত্রেও একই রকম ঘটেছিল।
রামভক্ত হনুমান ছিলেন যোগী পুরুষ। তিনি যোগবলে অনেক অলৌকিক শক্তি অর্জন করেছিলেন। তিনি যোগবলে নিজের আকার এত ছোট করে ফেলতে পারতেন যে তাঁকে খালি চোখে দেখা কষ্টকর হয়ে যেত। আবার তিনি ইচ্ছা করলে যোগবলে নিজের আকার অনেক বড় করে ফেলতে পারতেন। আর তিনি ছিলেন অত্যন্ত শক্তিশালী।
‘কী হে ভাই, তুমি তো দেখি পুরা বাজার উঠিয়ে নিয়ে এসেছ!’ এর মানে কিন্তু এই নয় যে সেই ব্যক্তি পুরো বাজার উঠিয়ে নিয়ে এসেছেন। তিনি আসলে অনেক বাজার করেছেন।তিনি আসলে ‘সঞ্জীবনী বুটি’ চিনতে না পেরে যোগবলে নিজের শরীরটা অনেক বড় করে সামনে যত ধরনের বৃক্ষ ও লতাপাতা পেয়েছিলেন, সেই সবকিছু সংগ্রহ করে বিশাল এক বোঝা বানিয়ে নিজের পিঠের ওপর তুলে যখন অতি দ্রুত এক পাহাড় থেকে অন্য পাহাড়ে লাফ দিচ্ছিলেন, তখন সেই বিশালদেহী হনুমানকে দেখে মনে হচ্ছিল যেন গোটা পাহাড়টাই পিঠে তুলে নিয়ে লাফাচ্ছেন।
আরও পড়ুনদুর্গাপূজার কাহিনি২০ অক্টোবর ২০২৩হনুমানের এই অসাধারণ কীর্তিকে অনেকেই অলৌকিক বলেই ভাবেন। কিন্তু অলৌকিকতা ছাপিয়ে এটা তাঁর গুরুর প্রতি শ্রদ্ধা এবং গুরুর আদেশের প্রতি দৃঢ় সংকল্পের প্রতীক। ভারতের হিমাচল, উত্তরাখন্ড, মধ্যপ্রদেশ এমনকি বাংলাদেশের মহেশখালীর আদিনাথ ধামসহ কিছু স্থানে এই ঘটনার স্মৃতি বহন করে, এমন লোককথা এখনো প্রচলিত।
একটি পাহাড় কাঁধে বহন করে উড়ে যাওয়া প্রকৃতির নিয়মের বাইরে। আর অবতার, মহাপুরুষ বা প্রেরিত পুরুষেরা কখনো প্রকৃতির নিয়মের বাইরে যান না। রামায়ণের এ ঘটনাকে মূলত রূপক বা প্রতীকী ঘটনা হিসেবেই বিবেচনা করেন হিন্দুধর্মীয় অবতার-মহাপুরুষেরা। আর পৃথিবীতে অলৌকিক বলে কিছু নেই।
রামায়ণের এ ঘটনাকে মূলত রূপক বা প্রতীকী ঘটনা হিসেবেই বিবেচনা করেন হিন্দুধর্মীয় অবতার-মহাপুরুষেরা। আর পৃথিবীতে অলৌকিক বলে কিছু নেই।মনে করেন, একজন যোগী পুরুষ নদীর তীর থেকে যোগবলে অদৃশ্য হয়ে নদীর মধ্যে ভেসে উঠলেন। আমি দেখতে পাচ্ছি না, জানতে পারছি না যে তিনি কীভাবে গিয়েছেন, তাই আমার কাছে অলৌকিক। আর ওই যোগী জানেন যে তিনি কীভাবে গিয়েছেন, তাই তাঁর কাছে লৌকিক।
যুগের পর যুগ ধরে লাখ লাখ ভক্তের হৃদয়ে এই ঘটনা গুরুর প্রতি শিষ্যের ভালোবাসা এবং নিজেকে গুরুর প্রতি সম্যকভাবে ন্যস্ত করার এক আস্থা ও অনুপ্রেরণার গল্প হয়ে রয়েছে। হনুমানের এই গাথা তাঁর ভক্তিমূলক চরিত্রকে যেমন সমৃদ্ধ করে, তেমনি মানবজাতির দুর্দম সাহস ও আত্মত্যাগের কথাও মনে করিয়ে দেয়।
তথ্যসূত্র: ১. বাল্মীকি রামায়ণ. ২. কৃত্তিবাসী রামায়ণ, ৩. শ্রীশ্রী ঠাকুর অনুকূলচন্দ্র কথিত ‘আলোচনা প্রসঙ্গে’ গ্রন্থ, ৪. মহেশখালীর আদিনাথ ধাম অঞ্চলের লোককথা।
পার্থ দেব বর্মন: গবেষক, সৎসঙ্গ রিসার্চ সেন্টার
আরও পড়ুনরামচন্দ্র, বিষ্ণুর অবতার কিন্তু মানবিক১৫ ফেব্রুয়ারি ২০২৩