হজ ইসলামের পঞ্চ স্তম্ভের অন্যতম এবং গুরুত্বপূর্ণ ইবাদত। হজ কেবল শারীরিক ইবাদত নয়, বরং তা আত্মিক পরিশুদ্ধি, উম্মাহর ঐক্য ও আল্লাহর নৈকট্য লাভের মাধ্যম। পৃথিবীর সব ধর্ম আর জাতি-গোষ্ঠীর মধ্যে হজ এক নজিরবিহীন ইবাদত। মহান আল্লাহ বলেন, “মানুষের মধ্যে যার সেখানে যাওয়ার সামর্থ্য আছে, আল্লাহর উদ্দেশ্যে এই ঘরের হজ করা তার অবশ্য কর্তব্য।” (সুরা আল-ইমরান, আয়াত : ৯৭)

হজ মুমিনের এমন আধ্যাত্মিক সফর, যা মানুষকে পৃথিবীর যাবতীয় সম্পর্ক ও ব্যস্ততা থেকে বিচ্ছিন্ন করে আল্লাহর নিকটতর করে দেয়। হজের রুহানি সফরে মুমিনের মন-মস্তিস্কেও নানা পরিবর্তনের সূচনা হয়, তার ভেতর ও বাইরে ইতিবাচক পরিবর্তন ঘটে। এই পরিবর্তনের প্রতি ইঙ্গিত দিয়ে মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন, “যে ব্যক্তি আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য হজ করল এবং সে কাউকে গালমন্দ করল না, পাপাচার করল না, সে নবজাতকের মতো নিষ্পাপ হয়ে ফিরে এলো।” (সহিহ বুখারি, হাদিস : ১৫২১)

উল্লিখিত হাদিস থেকে জানা যায়, হজের মূল উদ্দেশ্য বাহ্যিক পাপ পরিহার করার মাধ্যমে আত্মিক পবিত্রতা অর্জন করা। পূর্বসূরি আলেমরা বলতেন, হজযাত্রীর দায়িত্ব হলো নিজের অতীত আমলগুলোর হিসাব করা এবং অতীত ভুলের জন্য আল্লাহর কাছে ক্ষমা চাওয়া। আর পাপমুক্তির দৃঢ় আকাঙ্ক্ষা থেকে ভবিষ্যতে পাপমুক্ত জীবনের অঙ্গীকার করা।

হজের ফরজ কাজ তিনটি: ইহরাম বাঁধা, আরাফার ময়দানে অবস্থান করা এবং তাওয়াফে জিয়ারাত করা। হজের ওয়াজিব হলো ছয়টি : মুজদালিফায় অবস্থান করা, সাফা-মারওয়ায় সাত চক্কর দেওয়া, রমি করা (শয়তানকে পাথর মারা), (তামাত্তু ও কিরান হজকারীর জন্য) কোরবানি করা, মাথা মুণ্ডানো এবং তাওয়াফে বিদা (মক্কাবাসী ছাড়া)। হজের প্রধান প্রধান বিধানগুলোতে আধ্যাত্মিকতা ও পরিশুদ্ধ জীবনের সুস্পষ্ট বার্তা রয়েছে। 

একজন হজযাত্রীর প্রথম কাজ ইহরাম বাধা। ইহরাম হলো হজের নিয়তে তালবিয়া পাঠ করা এবং সেলাইবিহীন সাদা কাপড় পরিধান করা। কাফন সদৃশ এই কাপড় স্মরণ করিয়ে দেয় কবরের জীবনকে। এই কাপড় পার্থিব জীবনকে জৌলুসমুক্ত করে হজযাত্রীকে এমন এক কাতারে শামিল করে যেখানে ধনী ও দরিদ্র, নেতা ও কর্মী, শাসক ও প্রজার মধ্যে কোনো পার্থক্য নেই। ইহরামের কাপড় মুসলিম জাতির ঐক্যের প্রতীকও বটে।

হজের নিয়ত করার পর থেকে হাজিরা তালবিয়া পাঠ করেন। তারা বলেন, “লাব্বাইক আল্লাহুম্মা লাব্বাইক, ইন্নাল হামদা ওয়ান্নিমাতা লাকা ওয়াল মুলক, লা শারিকালাক” (আমি হাজির হে আল্লাহ আমি হাজির, নিশ্চয়ই সব প্রশংসা ও অনুগ্রহ আপনার এবং যাবতীয় রাজত্বও আপনার। আপনার কোনো শরিক নেই)। এটা কোনো সাধারণ ধ্বনি নয়, এটা আল্লাহর আনুগত্যে জীবন যাপনের অঙ্গীকার। এটা হলো আল্লাহর জন্য, আল্লাহর দ্বীনের জন্য আত্মত্যাগ ও আত্মোত্সর্গের জন্য প্রস্তুত থাকার ঘোষণা। হজযাত্রী এই ধ্বনি অন্তরে বপন করে পুরো জীবনের জন্যই। 

হজের অন্যতম প্রধান আমল কাবাঘর তাওয়াফ করা। তাওয়াফ আল্লাহপ্রেমে মাতওয়ারা হওয়ার আমল। পৃথিবী সৃষ্টির বহু পূর্বে আসমানে ফেরেশতারা বায়তুল মামুরে তাওয়াফের আমল শুরু করে। আল্লাহ অনুগ্রহ করে মানবজাতিকে তার সুযোগ দিয়েছেন। মানুষ আল্লাহর ঘর তাওয়াফ করে আল্লাহর প্রতি তীব্র ভালোবাসা ও আকর্ষণ প্রকাশ করে- যেন মহান আল্লাহর পবিত্রতম সত্ত্বাকে আবর্তন করে সে কাবাপ্রাঙ্গণে চক্কর খাচ্ছে।

আরাফার ময়দানে সারা পৃথিবী থেকে আগত হাজিরা সমবেত হয়। তারা সমবেত হয়ে আল্লাহর ক্ষমা, দয়া ও অনুগ্রহ কামনা করে। ঠিক যেমন কিয়ামতের দিন মানুষ তার জীবনের যাবতীয় কর্মকাণ্ডের জন্য আল্লাহর দরবারে লজ্জিত হয়ে ক্ষমা প্রার্থনা করবে। হাদিসের বর্ণনা মতে, আরাফার ময়দানে পৃথিবীর সব নবী-রাসুলের আগমন ঘটেছে এবং কিয়ামতের দিন এখানেই সবচেয়ে বেশি মানুষ সমবেত হবে। তাই আরাফার ময়দান একইসঙ্গে নবী-রাসুলদের আধ্যাত্মিক সৌরভ এবং পরকালের চিন্তাকে জাগ্রত করে। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, “আরাফাতই (এখানে অবস্থান) হজ, আরাফাতই হজ, আরাফাতই হজ।' (সুনানে তিরমিজি, হাদিস : ২৯৭৫)

আরাফার দিন মুসলিম জাতির জন্য অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ দিন। কেননা বিদায় হজের সময় মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আরাফায় অবস্থানের সময় ইসলাম পূর্ণ হওয়ার ঘোষণা আসে। আল্লাহ বলেন, “আজ আমি তোমাদের জন্য তোমাদের দ্বীনকে পরিপূর্ণ করলাম, তোমাদের প্রতি আমার নেয়ামতগুলোকে পূর্ণতা দান করলাম এবং ইসলামকে তোমাদের দ্বীন হিসেবে মনোনীত করলাম।” (সুরা মায়িদা, আয়াত : ৩)

আরাফার ময়দানে অবস্থানের সময় মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তার ঐতিহাসিক বিদায় হজের ভাষণ দেন। তিনি সেখানে ইসলাম ও ইসলামী জীবনব্যবস্থার মূল বক্তব্য তুলে ধরেছিলেন। তিনি সাম্য, সম্প্রীতি, ভ্রাতৃত্ব, ইনসাফ, শ্রমিকের অধিকার, নারীর অধিকার, সুদের ভয়াবহতা ও জাহেলি প্রথা প্রত্যাখ্যাত হওয়ার ঘোষণা দেন। ঐতিহাসিক এই ভাষণ সম্পর্কে ইমাম গাজ্জালি (রহ.

)  বলেন, “বিদায় হজের ভাষণ হলো ইসলামের নৈতিকতার পরিপূর্ণ রূপ। এতে মানবতার যে শিক্ষা দেওয়া হয়েছে, তা চিরন্তন ও বিশ্বজনীন।” আর ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনের নেতা ও জাতির পিতা মহাত্মা গান্ধী বলেন, “আমি ইসলাম সম্পর্কে জানার জন্য পবিত্র কোরআন ও হজরতের বিদায় হজের ভাষণ পড়েছি। আমি এমন কোনো বক্তৃতা খুঁজে পাইনি যেখানে মানবাধিকারের এমন সংক্ষপ্তি, স্পষ্ট ও নিরপেক্ষ ব্যাখ্যা করা হয়েছে।”

মুজদালিফায় রাত কাটানো ওয়াজিব। এই রাতটি মুমিনকে শেখায় তার রাতগুলো কেমন হওয়া উচিত; মুজদালিফার অবস্থান তাকে জীবনের বাস্তবতা শেখায়। এখানে অবস্থানের জন্য হাজি যেমন খুব আরামদায়ক কোনো ব্যবস্থার খোঁজ করে না, কোনো রকম ব্যবস্থাতে সে সন্তুষ্ট থাকে, তেমন মুমিন তার পার্থিব জীবনে ভোগ-বিলাসিতার পেছনে ছুটবে না। তার জীবন হবে মুসাফিরের মতোই। পাশাপাশি মুজদালিফার রাত এই শিক্ষাও দেয় যে, পার্থিব ব্যস্ততা ও ক্লান্তি মানুষকে আল্লাহবিমুখ করে না। 

মিনায় অবস্থানের সময় হাজিরা শয়তানকে পাথর নিক্ষেপ করে। এর মাধ্যমে সে শয়তানের যাবতীয় কুমন্ত্রণা, প্রতারণা ও ধোঁকাকে প্রত্যাখ্যান করে। এর মাধ্যমে সে নিজের কুপ্রবৃত্তি, মন্দ অভ্যাস ও পাপ প্রবণতার বিরুদ্ধেও যুদ্ধ ঘোষণা করে। হজ শেষে পশু কোরবানি করে হাজিরা তার পশুপ্রবৃত্তিকে জবাই করে থাকে। এর মাধ্যমে সে পার্থিব জীবনের যাবতীয় মোহ-মায়া ত্যাগের প্রত্যয় গ্রহণ করে।

মক্কায় হজের সব কার্যক্রম শেষ করে হাজিরা পবিত্র হৃদয় ও মন নিয়ে হাজির হয় মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর রওজায়। নবীজির রওজায় হাজির হয়ে তারা মূলত ‘কালেমা তাইয়্যিবার’ দাবিকে পূর্ণতা দেয়। কেমন যেন মক্কার অংশটুকু ছিল ‘লা ইলাহা ইল্লাহ’-এর দাবি, আর রওজায় সালাম বিনিময় করা ‘মুহাম্মাদুর রাসুলুল্লাহ’-এর দাবি। কেননা মুমিন বিশ্বাস করে নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর প্রতি ভালোবাসা ছাড়া তার ঈমান অপূর্ণ ও খণ্ডিত।

আল্লাহ সবাইকে জীবনে একবারের জন্য হলেও হজ করার তাওফিক দিন। আমিন। 

লেখক: মুহাদ্দিস, সাঈদিয়া উম্মেহানী মহিলা মাদরাসা, ভাটারা, ঢাকা।

ঢাকা/শাহেদ

উৎস: Risingbd

কীওয়ার্ড: চ কর চ কর ব দ য় হজ র অবস থ ন র ন র জন য হজয ত র জ বন র আল ল হ র সময় ইসল ম ইহর ম

এছাড়াও পড়ুন:

‘বাইসাইকেল থিভস’-এর সেই শিশুশিল্পী মারা গেছেন

ভিত্তোরিও দে সিকার ক্ল্যাসিক সিনেমা ‘বাইসাইকেল থিভস’-এর শিশু তারকা এনজো স্তাইওলা মারা গেছেন। গত বুধবার ইতালিকর দৈনিক লা রেপুব্লিক প্রথম স্তাইওলার মৃত্যুর খবর জানায়। পরে অভিনেতার মৃত্যুর খবর প্রকাশ করে দ্য হলিউড রিপোর্টারসহ বেশ কয়েকটি গণমাধ্যম। তাঁর বয়স হয়েছিল ৮৫ বছর।
‘বাইসাইকেল থিভস’ সিনেমায় স্তাইওলার বাবার চরিত্রে অভিনয় করেন লামবের্তো মাজ্জোরানি। সিনেমায় দেখা যায়, কর্মহীন বাবা তাঁর ছেলেকে নিয়ে চুরি হওয়া সাইকেল খুঁজে বেড়ান রোমের রাস্তায়। ওই সাইকেল ছাড়া তাঁর কাজ করার উপায় নেই, ছেলেকে খাওয়ানোরও উপায় নেই। চুরি হওয়া সাইকেল যেন একেবারে ভেঙে দেয় বাবার বুক। হতাশায় ক্লান্ত হয়ে একসময় তিনিও একটি সাইকেল চুরি করেন, কিন্তু ধরা পড়ে যান পথচারীদের হাতে। তারা তাঁকে ছেড়ে দিলেও ছেলের সামনে অপমানিত হন তিনি। এই সিনেমাই চিরতরে চলচ্চিত্র ইতিহাসে অমর করে রাখে ছোট্ট এনজো স্তাইওলাকে।

১৯৩৯ সালের ১৫ নভেম্বর রোমে জন্মগ্রহণ করেন স্তাইওলা। ২০২৩ সালের জুলাইয়ে এক সাক্ষাৎকারে তিনি প্রথমবার ভিত্তরিও দে সিকোর সঙ্গে দেখা হওয়ার স্মৃতি ভাগাভাগি করেন।

‘বাইসাইকেল থিভস’-এর দৃশ্য। আইএমডিবি

সম্পর্কিত নিবন্ধ