প্রতিটি সকাল শুরু হয় এক পরিচিত কণ্ঠের ডাক কিংবা শাসনে– যিনি চুপচাপ দায়িত্বের পাহাড় বয়ে বেড়ান, রুক্ষ স্বরে আমাদের জাগিয়ে তোলেন, তাড়াহুড়ো করে স্কুলে পাঠান। আমরা তাঁকে বলি ‘বাবা’। তাঁর চোখে-মুখে থাকে গাম্ভীর্য; কণ্ঠে থাকে কর্তব্যবোধের দৃঢ়তা। অনেক সময় তাঁকে মনে হয় কঠিন, অপ্রকাশ্য, যেন এক জীবন্ত দেয়াল– যার ওপারে আমরা পৌঁছাতে পারি না। অথচ এ মানুষটিই আমাদের জীবনের প্রথম নিরাপত্তার বর্ম, যিনি দিনশেষে সবার অলক্ষ্যে নিঃশব্দ ভালোবাসা ছড়িয়ে যান।
ছোটবেলায় আবেগ মানেই ‘মা’। কাঁদলে যিনি বুকে টেনে নেন, আদর করেন, আবদার শুনে নরম হয়ে যান– তাঁকে ভালোবাসা বোঝাতে কোনো সংকোচ হয় না। কিন্তু বাবা? তাঁকে ভালোবাসা বলা যেন কোনো নিষিদ্ধ চিঠি লেখার মতো। কেন এমন হয়? কেন বাবার চোখে জল মানে দুর্বলতা? কেন তাঁর মুখে ‘আমি ভালোবাসি’ শুনতে পাওয়া প্রায় অসম্ভব?
এর পেছনে আছে সমাজ ব্যবস্থা; যা শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে ‘পুরুষ’ নামক পরিচয়টিকে এক কঠোর কাঠামোয় আটকে রেখেছে। ছোটবেলায় যে ছেলেটি মায়ের পাশে রান্নাঘরে দাঁড়াতে চেয়েছিল, তাঁকে বলা হয়, ‘তুই ছেলে, এগুলো তোর কাজ না।’ যে কিশোর ক্লাসে হেরে গিয়ে কাঁদতে চেয়েছিল, তাঁকে শিখিয়ে দেওয়া হয়– ‘ছেলে হয়ে কাঁদিস কেন?’ এভাবেই একেকটা কোমল হৃদয় পাথর হয়ে যায়, একেকটা প্রাণবন্ত মানুষ হয়ে ওঠে নিঃশব্দ এক ‘পুরুষ’, যিনি পরে হন একজন ‘বাবা’- শক্ত, সংবেদনশূন্য, দায়িত্ববদ্ধ।
এই মানুষটিই প্রতিদিন সকাল থেকে রাত পর্যন্ত সংসারের জন্য লড়াই করেন। অফিসে মাথা নত করেন, রাস্তায় ঘাম ঝরান, দোকানে গিয়ে সন্তানের জন্য নতুন জামা কেনেন, অথচ নিজের পোশাকটা পুরোনো হয়েই পড়ে থাকে। তিনি হয়তো কখনও মুখ ফুটে বলেন না, ‘আমি ক্লান্ত’; কিন্তু তাঁর চোখের নিচের কালি, হাঁটার ধীরতা, নিঃশব্দ দীর্ঘশ্বাসগুলো বলে দেয় সবটুকু।
সমাজ তাঁকে শিখিয়েছে– ‘তুমি পুরুষ, তোমার ব্যথা নেই, তোমার দুঃখ নেই।’ অথচ তিনিও মানুষ। তাঁরও চোখে জল আসে, বুক চেপে ধরে কষ্ট জমে থাকে, গভীর রাতে সন্তানের পড়া দেখে চুপিচুপি দীর্ঘশ্বাস ফেলেন। সমাজ তাঁকে সেই স্বস্তির জায়গাটা দেয়নি, যেখানে তিনি নিঃসংকোচে বলতে পারেন, ‘আমিও কাঁদি’, ‘আমিও ভালোবাসি’।
আমরা বাবাকে ভয় করি, কারণ তাঁকে আবেগ প্রকাশ করতে দেখিনি। আমরা তাঁর কাছে আবদার করতে ভয় পাই, কারণ শিখে গেছি– ‘বাবা রেগে যাবেন।’ অথচ হয়তো তিনিই সবচেয়ে বেশি অপেক্ষা করেন সন্তানের একটি আদরের ছোঁয়ার জন্য। হয়তো তাঁর বুক ভরে যায় সন্তানের ছোট্ট একটি ‘ধন্যবাদ’ শোনে। এই মানুষটিই রাত জেগে সন্তানের জন্য ওষুধ আনেন, স্কুলে ভর্তি করাতে ভিড় ঠেলে লাইনে দাঁড়ান, বাইরে থেকে ফিরতে দেরি হলে মায়ের কাছে বারবার জানতে চান– ‘ও এসেছে?’
পিতৃতন্ত্র শুধু নারীর নয়, পুরুষেরও কারাগার। এই কাঠামো পুরুষকে আবেগহীন, কঠোর, একতরফা দায়িত্বপ্রবণ রোবটে পরিণত করে। তারা ভুলে যান– সন্তানের কাছে সবচেয়ে বড় উপহার হতে পারে কিছু প্রাণবন্ত সময়, কিছু গল্প, কিছু অনুভবের প্রকাশ।
আমরা যদি নতুন প্রজন্মের মধ্যে এই দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন ঘটাতে পারি; যেখানে ছেলেরা কাঁদতে পারবে, বলতে পারবে ‘আমি ভালোবাসি’; বাবারা সন্তানের সঙ্গে খেলা করবে, রান্নাঘরে গিয়ে মায়ের পাশে দাঁড়াবে– তবে হয়তো একদিন বাবাদের মুখেও ফুটে উঠবে সেই উষ্ণতা, যেটি এতদিন সমাজ ছেঁটে ফেলেছিল।
শিশুর জীবনে প্রথম নায়ক তাঁর বাবা। সেই নায়কের চরিত্র যেন শুধু কঠোরতা দিয়ে গড়া না হয়; বরং তাঁর মধ্যে থাকুক সহানুভূতি, অনুভূতি, গভীর ভালোবাসা প্রকাশের সাহস। বাবা যেন শুধু ছায়ার মতো না থাকেন, তিনি যেন হন আলো– যে আলো সাহস দেয়, ভালোবাসায় ভরিয়ে দেয়।
এই বাবা দিবসে আসুন আমরা বাবাদের সেই জায়গাটা দিই– যেখানে তারা কাঁদতে পারেন, হাসতে পারেন, ভালোবাসতে পারেন। বাবা যেন একজন নিঃশব্দ সহযোদ্ধা না হয়ে হন একজন প্রকাশ্য ভালোবাসার মানুষ। আসুন, পিতৃতন্ত্রের তৈরি এই শৃঙ্খল ভেঙে বাবাদের ফিরিয়ে দিই তাদের মানবিকতা। ভালোবাসার ভাষায় উজ্জীবিত হোক বাবারা। v
উৎস: Samakal
কীওয়ার্ড: ভ ল ব স দ বস প রক শ র জন য
এছাড়াও পড়ুন:
৫০ শয্যার থানচি হাসপাতাল চলছে একজন চিকিৎসকে
বান্দরবানের থানচি উপজেলার প্রায় ৩০ হাজার মানুষের একমাত্র ভরসার জায়গা ৫০ শয্যার উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স। দীর্ঘদিন ধরে চিকিৎসক, নার্স ও প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতির সংকটে এই হাসপাতাল কার্যত অচল হয়ে পড়েছে। বর্তমানে পুরো হাসপাতাল চালাচ্ছেন মাত্র একজন চিকিৎসক। গত পাঁচবছরে চিকিৎসাধীন ও রেফার্ড করা ২৪ জন রোগী মারা গেছেন।
হাসপাতাল সূত্র জানায়, ১৯৯৫ সালে ৩১ শয্যার থানচি স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স যাত্রা শুরু করে। পরে এটি ৫০ শয্যায় উন্নীত হয়। এই উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ১২ জন চিকিৎসক থাকার কথা থাকলেও কর্মরত আছেন মাত্র দুইজন। তাদের মধ্যে একজন ব্লাড ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে দীর্ঘদিন চিকিৎসাধীন। এ কারণে রোগীদের সেবা দিতে পারছেন না। ১৮ জন নার্স পদে রয়েছেন মাত্র চারজন। চারজন মিডওয়াইফ থাকার কথা, নেই একজনও।
আরো পড়ুন:
ফরিদপুরে পাগলা ঘোড়ার কামড়ে আহত ২০
বক্তব্য দেওয়ার সময় অসুস্থ হয়ে পড়লেন কাদের সিদ্দিকী
প্রাথমিক থেকে শুরু করে জরুরি চিকিৎসার জন্য এই হাসপাতালে ছুটে যান পাহাড়ি ও বাঙালিরা। তাদের অভিযোগ, হাসপাতালটি ৫০ শয্যায় উন্নীত হলেও আধুনিক চিকিৎসা সুবিধা যোগ হয়নি। প্রয়োজনীয় সংখ্যক চিকিৎসক না থাকায় গর্ভবতী নারী, শিশু ও বৃদ্ধ রোগীরা সবচেয়ে বেশি ভোগান্তিতে পড়ছেন।
দুর্গম এলাকার রোগীরা অনেক সময় নদীপথ কিংবা পাহাড়ি রাস্তা পাড়ি দিয়ে হাসপাতালে এলেও কাঙ্ক্ষিত চিকিৎসা সেবা পান না। বরং তাদের বান্দরবান সদর হাসপাতালে রেফার্ড করা হয়। অনেক সময় বান্দরবানে যাওয়ার পথে রোগীরা মারা যান। এ কারণে জরুরি ভিত্তিতে চিকিৎসক, নার্স ও প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি সরবরাহের দাবি জানিয়েছেন তারা।
হাসপাতালের পরিসংখ্যানবীদ পঙ্কজ বড়ুয়া জানান, ২০২০ থেকে ২০২৫ সাল পর্যন্ত এখানে ভর্তি হয়েছেন ৫ হাজার ১৯৮ জন রোগী। এর মধ্যে ৪৫৬ জনকে রেফার্ড করা হয় বান্দরবান সদর হাসপাতালে। হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা গেছেন ১৭ জন রোগী।
থানচি উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের অ্যাম্বুলেন্স চালক মংক্যসিং মারমা বলেন, “২০১৯ সালে চাকরিতে যোগদান করার পর থেকে অন্তত সাতজন রেফার্ড করা রোগী মাঝপথে আমার গাড়িতেই মারা গেছেন।”
শৈসাই মং মারমা তিন বছর আগে বিনা চিকিৎসায় তার মাকে মারা যেতে দেখেছেন। তিনি জানান, তার মা শৈমেপ্রু মারমা (৩৪) অন্তঃসত্ত্বা ছিলেন। ২০২২ সালের ১৪ নভেম্বর হঠাৎ তিনি অচেতন হয়ে পড়েন। রেমাক্রী বাজার থেকে নদীপথে থানচি স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে নিয়ে যান মাকে। কিছুক্ষণের মধ্যেই তাকে জেলা সদর হাসপাতালে রেফার্ড করা হয়। ভাড়া গাড়িতে জেলা হাসপাতালে যাওয়ার সময় চিম্বুক বারো মাইল এলাকায় তার মা মারা যান।
লেংরু ম্রো নামে চার সন্তানের মা হারিয়েছেন স্বামীকে। তিনি জানান, তার স্বামী রেং য়ুং ম্রো (৪৫) কিডনি জটিলতা নিয়ে থানচি হাসপাতালে যান। সঙ্গে সঙ্গে সেখান থেকে তাকে বান্দরবান সদর হাসপাতালে রেফার্ড করা হয়। থানচি থেকে বান্দরবান যাওয়ার মাঝপথে মারা যান তার স্বামী।
স্থানীয় বাসিন্দা মংমে মারমা বলেন, “হাসপাতালে চিকিৎসক, ওষুধ ও যন্ত্রপাতির সংকট দীর্ঘদিন ধরেই চলছে। বিশেষজ্ঞ ডাক্তার বদলি হলেও অনেকেই থানচিতে যোগ দেন না, ডিপুটেশনে থেকে যান সদর হাসপাতালে। ফলে এ অঞ্চলের পাহাড়ি ও বাঙালি প্রায় ৩০ হাজার মানুষ স্বাস্থ্যসেবা থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন।”
রিয়েং ম্রো নামে অপর বাসিন্দা বলেন, “পাহাড়ে বসবাসকারীদের অধিকাংশ গরিব। জেলা সদর হাসপাতালে রোগী নিয়ে যাওয়া ব্যয়বহুল ও কষ্টকর। রেমাক্রি, বড় মোদক, তিন্দু থেকে থানচি সদরে রোগী আনতেই অনেক টাকা খরচ হয়ে যায়। এরপর আবার বান্দরবান সদর হাসপাতালে রেফার্ড করলে সাধারণ মানুষ কীভাবে চিকিৎসা করাবে?”
থানচি উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা (ইউএইচএফপিও) ডা. মো. ওয়াহিদুজ্জামান মুরাদ বলেন, “বর্তমানে হাসপাতালে আমিসহ দুইজন চিকিৎসক রয়েছেন। একজন ব্লাড ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে দীর্ঘদিন ধরে চিকিৎসাধীন। তিন রোগীদের সেবা দিতে পারছেন না। ফলে পুরো হাসপাতাল পরিচালনার দায়িত্ব আমাকে একাই সামলাতে হচ্ছে।”
তিনি আরো বলেন, “জনবল ও সরঞ্জাম সংকটের কারণে গুরুতর রোগীদের রেফার্ড করা ছাড়া উপায় থাকে না। দীর্ঘ পথের কারণে অনেকেই জীবিত অবস্থায় সদর হাসপাতালে পৌঁছাতে পারেন না।”
বান্দরবান জেলা সিভিল সার্জন ডা. মোহাম্মদ শাহীন হোসাইন চৌধুরী বলেন, “শুধু বান্দরবান নয়, পুরো তিন পার্বত্য জেলাতেই চিকিৎসক সংকট তীব্র আকার ধারণ করেছে। নতুন করে ৪৮তম বিসিএসের ডাক্তার পদায়ন না হওয়া পর্যন্ত এই সংকট পুরোপুরি সমাধান করা সম্ভব হচ্ছে না। তারপরও বিভাগীয় প্রধানকে বিষয়টি চিঠির মাধ্যমে জানানো হয়েছে। ইতোমধ্যে চট্টগ্রাম মেডিক্যাল কলেজের আট-দশজন চিকিৎসককে বান্দরবানে বদলি করার জন্য প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি।”
ঢাকা/মাসুদ