রংপুর মেডিকেলে টাকা ছাড়া নড়ে না কেউ, অতিষ্ঠ রোগী
Published: 5th, July 2025 GMT
হৃদরোগে আক্রান্ত সংকটাপন্ন বাবাকে রংপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে এসেছেন গোলাম রাব্বানী। জরুরি বিভাগের সামনে এসে তাড়াহুড়া করে ভর্তির টিকিট কাটলেন। কাছেই দাঁড়িয়ে অন্তত পাঁচ যুবক। প্রত্যেকের হাতে স্ট্রেচার ট্রলি। কিন্তু কেউ রোগীকে তুলছেন না। সংশ্লিষ্ট ওয়ার্ডে নিয়ে যেতে প্রত্যেকে দাবি করেন ৫০০ টাকা। নীলফামারীর কিশোরগঞ্জ থেকে আসা গোলাম রাব্বানী শেষ পর্যন্ত ৩০০ টাকা দিতে রাজি হয়ে বাবাকে ওয়ার্ডে নিয়ে যান।
রংপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে এমন ঘটনা নতুন নয়। রোগী ভর্তি থেকে শুরু করে মৃত্যুর পর লাশ বের করা পর্যন্ত প্রতিটি ক্ষেত্রে অতিরিক্ত টাকা গুনতে হয়। বছরের পর বছর এভাবে সিন্ডিটেকের দৌরাত্ম্যে অতিষ্ঠ রোগী ও তাদের সঙ্গে আসা স্বজন। হাসপাতালের কাউন্টারে নাম ও রোগ লেখানোর পর্ব শেষ করে ভর্তি ফি ২৫ টাকার পরিবর্তে নেওয়া হয় ৫০ থেকে ১০০ টাকা। বাড়তি টাকা দিতে না চাইলে রোগীকে ফেলে রাখা হয় বাইরে। মিটমাট হলেই কেবল ট্রলিতে তোলা হয়। রংপুর বিভাগের ২ কোটি মানুষের চিকিৎসার ভরসাস্থল এই হাসপাতালের এমন লাগামছাড়া অনিয়ম-দুর্নীতির বিরুদ্ধে পদক্ষেপ নেই কর্তৃপক্ষের।
অভিযোগ রয়েছে, এতদিন হাসপাতালটি ছিল শুধু চতুর্থ শ্রেণি কর্মচারী ইউনিয়নের সিন্ডিকেটের দখলে। ২০২৪ সালের ৫ আগস্টের পর তাদের সঙ্গে বাইরের কিছু মানুষ যোগ দিয়েছে। যুবদলের কয়েক নেতার প্রশ্রয়ে সিন্ডিকেট বেপরোয়া হয়ে উঠেছে।
সম্প্রতি হাসপাতালের প্রধান ফটকের সামনে দেখা যায়, অ্যাম্বুলেন্সে মায়ের লাশ নিয়ে উঠেছেন পীরগাছা উপজেলার আজিজার রহমান। পাশে পড়ে ছিল ওয়ার্ড থেকে লাশ বহন করে আনা স্ট্রেচার। এটি বহন করে আনা আয়া টাকা ছাড়া নড়বেন না। এদিকে ভাড়ার চেয়ে বেশি দাবি করে বসেন অ্যাম্বুলেন্স চালক। এত বাধা পেরিয়ে কী করে মায়ের লাশ নিয়ে বাড়ি ফিরবেন– এ নিয়ে ভাবছিলেন শোকে স্তব্ধ আজিজার। পরে আয়াকে ২০০ টাকা দেন, আর অ্যাম্বুলেন্স চালককে সাড়ে ৩ হাজার টাকায় রাজি করিয়ে মুক্তি পান। স্ট্রেচার নিয়ে ফেরার সময় প্রশ্ন করলে রাশেদা বেগম নামের ওই আয়া বলেন, ‘খুশি হয়ে ২০০ টাকা দিল লাশের লোক।’
আজিজার রহমান বলেন, ‘হাসপাতালে আসার পর থেকে পদে পদে খরচ করেছি। ঠিকমতো চিকিৎসা না পেয়ে মা মারা গেলেন। শেষে লাশ নিয়েও শুরু হলো ব্যবসা। বেড থেকে স্ট্রেচারে তুলতে ২ হাজার টাকা নেন হাসপাতালের লোক।’
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, দীর্ঘদিন ধরে কর্মচারী সিন্ডিকেটের হোতা ছিলেন হাসপাতালের চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারী ইউনিয়নের সভাপতি শাহিনুর রহমান শাহিন ও সাধারণ সম্পাদক আশিকুর রহমান নয়ন। তাদের পৃষ্ঠপোষকতায় দালালচক্রের অর্ধশতাধিক সদস্য কাজ করেন। নানা অপকর্মের কারণে সাময়িক বরখাস্ত খুনের মামলার আসামি নয়ন এখন আত্মগোপনে। বর্তমানে সিন্ডিকেটে যুক্ত হয়েছেন হাসপাতালের ভেতর ও বাইরের অনেকেই।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক কয়েক সাধারণ কর্মচারী জানান, আত্মগোপনে থাকলেও নয়ন সিন্ডিকেটের নেপথ্যে রয়েছেন। আউটসোর্সিংয়ে কাজ করে সিন্ডিকেটে রয়েছেন তাঁর ভগ্নিপতি রতন ও ফুফাতো ভাই মুকুল। আরও রয়েছেন ওয়ার্ড মাস্টার হাসান ও মানিক। আছেন কর্মচারী ইউনিয়নের প্রয়াত সাধারণ সম্পাদক আব্রাহাম লিংকনের বড় ভাই নগরীর ধাপ এলাকার রায়হান এবং রাহাত। বর্তমানে এই সিন্ডিকেটের পাশে যুবদলের কয়েক নেতা।
এ বিষয়ে রংপুর মহানগর যুবদলের আহ্বায়ক নুরুন্নবী চৌধুরী মিলন বলেন, ‘আমার জানামতে, মেডিকেলের সিন্ডিকেটে যুবদলের কেউ নেই। তবে দলের কেউ ওই সব সিন্ডিকেটে যুক্ত থাকলে তাদের বিরুদ্ধে সাংগঠনিক ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’
জানতে চাইলে চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারী ইউনিয়নের সভাপতি শাহিন এ কাজে জড়িত থাকার কথা অস্বীকার করেন। ওয়ার্ড মাস্টার মানিক সিন্ডিকেটে যুক্ত নন দাবি করে বলেন, ‘সিন্ডিকেট আছে, তবে আগের তুলনায় তাদের দৌরাত্ম্য কমেছে।’
সিন্ডিকেটের হয়রানি থেকে বাদ যায়নি চিকিৎসক পরিবারও। রংপুর মেডিকেল কলেজের অর্থোসার্জারি বিভাগের জুনিয়র কনসালট্যান্ট এ বি এম রাশেদুল আমীর জানান, চিকিৎসার জন্য তাঁর মাকে হাসপাতালে নিয়ে যান পরিবারের সদস্যরা। রোগী ভর্তি ফি ২৫ টাকার জায়গায় দাবি করা হয় ৫০ টাকা। আইসিইউতে তাঁর ব্যক্তিগত সহকারীর কাছে জোর করে ২০০ টাকা নেন কর্মরত দুই ব্যক্তি। ‘চিকিৎসকের মা’ পরিচয় দিলেও তারা ছাড় দেননি। এ বিষয়ে হাসপাতালের পরিচালকের কাছে লিখিত অভিযোগ দিয়েছেন ডা.
বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. তুহিন ওয়াদুদ বলেন, হাসপাতালটির চিকিৎসক, কর্মকর্তা-কর্মচারী নিয়োগ, ওষুধ, খাদ্য ও নির্মাণকাজের ঠিকাদারিসহ নানা বিষয়ে অনিয়মের খবর গণমাধ্যমে এলেও প্রতিকার মিলছে না।
জানতে চাইলে হাসপাতালের পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল আশিকুর রহমান বলেন, ‘সমস্যা অনেক। দীর্ঘদিনের ধরে চলে আসা সব সমস্যার সমাধান তো চাইলেই সম্ভব নয়। সিন্ডিকেট নেই বলব না, তবে তাদের দৌরাত্ম্য আগের চেয়ে অনেক কমানো গেছে।’
উৎস: Samakal
এছাড়াও পড়ুন:
২০২৫ সালের প্রথম ছয় মাসের মানবাধিকার পরিস্থিতি হতাশাজনক
চলতি বছরের প্রথম ছয় মাসের মানবাধিকার পরিস্থিতি হতাশাজনক বলে এক পর্যবেক্ষণ জানিয়েছে হিউম্যান রাইটস সাপোর্ট সোসাইটি (এইচআরএসএস)। এ সময়ের বিভিন্ন ঘটনায় মানবাধিকার পরিস্থিতি নিয়ে উদ্বেগ সৃষ্টি করেছে বলে জানিয়েছে সংগঠনটি। সোমবার এইচআরএসএসের নির্বাহী পরিচালক ইজাজুল ইসলামের পাঠানো এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে এ কথা বলা হয়েছে।
এতে বলা হয়, ‘স্বাধীনতার ৫৩ বছর পরেও বাংলাদেশে সাম্য, মানবিক মর্যাদা, সামাজিক সুবিচার, মানবাধিকার ও গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হয়নি। দেশের মানুষ এখনও স্বাধীনতার প্রকৃত সুফল পায়নি। স্বাধীনতার পর ২০২৪ সালে মানবাধিকার পরিস্থিতি ছিল সবচেয়ে ভীতিকর ও চরম উদ্বেগজনক। গত আগস্টের ছাত্র-জনতার গণ-অভ্যুত্থানে শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর নোবেল বিজয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার দেশের দায়িত্ব গ্রহণ করেন। ছাত্র-জনতার মাঝে স্বাধীনতার প্রকৃত স্বাদ আস্বাদনের আকাঙ্খা সৃষ্টি হলেও তার প্রতিফলন মূলত ঘটেনি। অন্তর্বর্তীকালীন সরকার ও সংশ্লিষ্টরা এ চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় সফলতা দেখাতে পারেনি। ২০২৫ সালের প্রথম ছয় মাসেও মানবাধিকার পরিস্থিতির প্রকৃত অবস্থা হতাশাজনক। নতুন বছরে মানবাধিকার পরিস্থিতির সার্বিক উন্নয়নের প্রত্যাশা থাকলেও মানবাধিকার লঙ্ঘনের পূর্বের ধারা অব্যাহত থাকার পাশাপাশি এতে নতুন কিছু বিষয়ও যুক্ত হয়েছে। রমজান মাসে বিগত বছরগুলোর তুলনায় দ্রব্যমূল্য ও দুই ঈদযাত্রা কিছুটা স্বস্তিদায়ক হলেও আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতির আশানুরূপ উন্নতি হয়নি। ’
বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, ‘২০২৫ সালের প্রথম ছয় মাসের মানবাধিকার পরিস্থিতি পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, রাজনৈতিক সহিংসতায় মৃত্যু, গণপিটুনিতে নির্যাতন ও হত্যা, নারী নিপীড়ন ও ধর্ষণ, শিশু নির্যাতন ও সাংবাদিকদের ওপর হামলা বৃদ্ধি পেয়েছে। বাক স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর হেফাজতে ও নির্যাতনে মৃত্যু, শ্রমিকদের ওপর হামলা, সংখ্যালঘু নির্যাতন, মাজারে হামলা ও ভাঙচুর, কারাগারে মৃত্যু, সভা-সমাবেশে বাধা প্রদান, আন্দোলনরত বেসরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকদের ওপর পুলিশের হামলার মতো ঘটনা ঘটেছে। এ সময় চাঁদাবাজি, চুরি, ছিনতাই, ডাকাতি ও হত্যাসহ বেশ কিছু সামাজিক অপরাধ ঘটেছে যা জনমনে ভয় ও আতঙ্ক তৈরি করেছে। শেখ হাসিনার বক্তব্য নিষিদ্ধঘোষিত সংগঠন ছাত্রলীগের ভার্চ্যুয়াল অনুষ্ঠানে প্রচারের ঘোষণাকে কেন্দ্র করে বিক্ষুব্ধ ছাত্র-জনতা ৫, ৬ ও ৭ ফেব্রুয়ারি রাজধানীর ধানমন্ডির ৩২ নম্বরে অবস্থিত শেখ মুজিবুর রহমানের বাড়ি, শেখ হাসিনার বাসভবন সুধা সদন এবং সারা দেশে বিভিন্ন স্থানে আওয়ামী লীগের অফিস ও নেতাদের বাড়িঘরে হামলা, ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগ করে। জামায়াত নেতা এ টি এম আজহারের রায় ঘোষণার পর বাম ছাত্র সংগঠনগুলোর মোর্চা গণতান্ত্রিক ছাত্র জোটের সাথে শাহবাগ বিরোধী ঐক্যের উত্তেজনা ও সংঘর্ষের ঘটনা ঘটেছে। গত ১২ মে বাংলাদেশের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তী সরকার গত বছরের আগস্টে ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ এবং এর অঙ্গ, সহযোগী ও ভ্রাতৃপ্রতিম সব সংগঠনের কর্মকাণ্ড নিষিদ্ধ ঘোষণা করেছে।’
এতে আরও বলা হয়েছে, ‘দেশের বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ছাত্র সংগঠনগুলোর মধ্যে উত্তেজনা ও সংঘর্ষ শিক্ষার্থীদের মনে আতঙ্ক সৃষ্টি করেছে। রাজধানীতে বিভিন্ন দাবি আদায়ে রাস্তা বন্ধ করে জনদুর্ভোগ সৃষ্টি করা হয়েছে। আদালত ও কারা ফটকে রাজনৈতিক নেতা-কর্মীদের ওপর হামলা; থানা ও পুলিশের ওপর হামলা করে রাজনৈতিক সংশ্লিষ্টদের আসামি ছিনিয়ে নেওয়ার কয়েকটি ঘটনা ঘটেছে, যেখানে রাজনৈতিক সংগঠনের নেতাকর্মীদের সংশ্লিষ্টতার অভিযোগ রয়েছে । দেশে সন্ত্রাসবাদ দমন, আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির উন্নয়ন ও সন্ত্রাসীদের আইনের আওতায় আনতে যৌথ বাহিনীর সমন্বয়ে ‘অপারেশন ডেভিল হান্ট’ নামে ও বিশেষ অভিযানে বেশ কিছু অনিয়মের অভিযোগ উঠেছে। এছাড়া, ভারত সীমান্তে সংঘর্ষ, উত্তেজনা, বিএসএফের আন্তর্জাতিক আইন লঙ্ঘন করে বেড়া নির্মাণ, উসকানি, বাংলাভাষী মানুষদেরকে পুশইন করা, এমনকি নিরীহ বাংলাদেশিকে হত্যা, আহত ও গ্রেপ্তার এবং মিয়ানমারের আরাকান আর্মি কতৃক বাংলাদেশি জাহাজ আটক, সীমান্তে গুলি, মাইন ও মর্টারশেল বিস্ফোরণের মত বিভিন্ন ঘটনা মানবাধিকার পরিস্থিতির বিষয়ে উদ্বেগ সৃষ্টি করেছে।’