অভ্যুত্থানের পর বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় কেন ব্রাত্য
Published: 1st, August 2025 GMT
বাংলাদেশ হলো আত্মমুগ্ধ ব্যক্তিদের (নার্সিসিস্টদের) দেশ। এ জনপদের মানুষের স্বাভাবিক প্রবণতার মধ্যে তাই ‘নার্সিসিস্ট পারসোনালিটি ডিজঅর্ডার’ (এনপিডি) থাকাটা অসম্ভব কিছু নয়। মনোবিজ্ঞানীরা অবশ্য একাডেমিকভাবে এ প্রবণতার ব্যাপারে ভালো বলতে পারবেন। তবে জুলাই অভ্যুত্থানকে মানদণ্ড ধরলে এ মুহূর্তে বাংলাদেশকে ‘নার্সিসিস্টদের দেশ’ বললে অত্যুক্তি হবে না!
জুলাই অভ্যুত্থানকে নানা রঙে অতিরঞ্জিত করা হয়েছে। জাতিগতভাবে এটিও সম্ভবত আমাদের সাধারণ প্রবণতা। যে কারণে এই গণ-অভ্যুত্থানকে কখনো ‘দ্বিতীয় স্বাধীনতা’, অধিকাংশ ক্ষেত্রেই ‘বিপ্লব’, কখনোবা ‘মেটিকিউলাস ডিজাইন’ কিংবা ‘মাস্টারমাইন্ড তত্ত্ব’ দিয়ে আবরণ পরানো হয়েছে। এটা হয়েছে নিজেকে অধিপতিশীল ভাবার কারণে কিংবা নিজের সময়কে বৃহৎ ইতিহাসের নিক্তিতে অনেক বড় করে দেখার আরোপিত ভ্রান্তি থেকে।
একটা গণ-অভ্যুত্থান যে ‘মেটিকিউলাস’ কিংবা একক ভরকেন্দ্রিক হতে পারে না এবং সর্বোপরি গণ-অভ্যুত্থানকে অর্গানিক উপায়ে বিপ্লবে রূপান্তর করতে যে ‘উৎপাদন পদ্ধতি’ (মোড অব প্রোডাকশন) ও ‘উৎপাদন সম্পর্ক’ (রিলেশনস অব প্রোডাকশন) পরিবর্তন অনিবার্য, এটা ক্রিটিক্যালি পাঠ না করেই গণ-অভ্যুত্থানে আপামর শ্রেণির অবদানকে খাটো করে দেখেছেন হালের অধিপতিশীলরা।
আমি যা করেছি, সেটিই মহীয়ান, বাদ বাকি সব ‘অপর’—এই প্রবণতা থেকেই জন্ম হয় ফ্যাসিবাদের; আধিপত্যবাদী বয়ানের। এই মননের অন্তরেই ঘুমিয়ে থাকে নার্সিজম; অর্থাৎ নার্সিজম খোদ নিজেই এমন একটি ব্যক্তিকেন্দ্রিক ভরকেন্দ্র সৃষ্টিকারী, যা অধিকতর সংকটের মুখোমুখি করে ফেলে সমাজ, রাষ্ট্র ও রাজনীতিকে।
অভ্যুত্থান–উত্তর প্রথমবর্ষের মধ্যেই তার দিক উন্মোচন হতে শুরু করেছে, যা অভ্যুত্থানের প্রকৃত স্পিরিটকেই প্রশ্নবিদ্ধ করে তুলেছে। ব্যক্তিকেন্দ্রিক-গোষ্ঠীকেন্দ্রিক বয়ান ও ক্ষমতাচর্চা তো জুলাইয়ের স্পিরিট নয়!
পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর ক্যাম্পাসকেন্দ্রিক নড়াচড়ায় যখন কোনো কিছুই টলানো যাচ্ছিল না, তখন বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর শিক্ষার্থীদের মহাসড়ক দখলের প্রত্যাঘাত, জীবনবাজি রাখা, শহীদ হওয়া ছিল ঐতিহাসিক ও অভূতপূর্ব বড় ঘটনা।অতীতের নিক্তিতে চব্বিশের ঐতিহাসিক অবস্থানচব্বিশের গুরুত্ব–বীরত্ব নিঃসন্দেহে নানামাত্রিকভাবে অভূতপূর্ব। তবে এই বীরত্বকে সাতচল্লিশ ও একাত্তরের পর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক ঘটনা হিসেবে দেখার নিক্তিটিও ‘অভূতপূর্বভাবে’ বিপজ্জনক! এই বয়ান কয়েকটি দুর্দান্ত ঐতিহাসিক লড়াইকে একবারে নাকচ করে দিয়েছে। তার মধ্যে উনসত্তর ও নব্বইয়ের গণ-অভ্যুত্থান অন্যতম।
আশির দশকে প্রায় দশকব্যাপী আন্দোলনে ছাত্রসংগঠনগুলো একত্র হয়ে ১০ দফা দিয়েছিল। সেসব দাবির মধ্যে রাষ্ট্রব্যবস্থা, শিক্ষাব্যবস্থা ও সর্বোপরি শ্রেণিবৈষম্য দূরীকরণে উৎপাদন সম্পর্ক বদলের তৎপরতা ছিল। উনসত্তরের গণ-অভ্যুত্থান ছয় ছফাকে বিস্তৃত করে ছাত্রসমাজের যে ১১ দফার ওপর দাঁড়িয়েছিল, তার কাছাকাছি দূরদর্শী রাজনৈতিক এজেন্ডা এর আগে-পরে বলতে গেলে তৈরিই হয়নি।
নতুন রাষ্ট্রপ্রকল্পের স্বপ্নে বিভোর শিক্ষার্থীদের আটষট্টি-উনসত্তরের ১১ দফার মধ্যে তিন–চতুর্থাংশ দাবি ছিল শ্রমজীবী শ্রেণির প্রশ্নে, যেগুলো উৎপাদন সম্পর্ক পরিবর্তন ও সামাজিক বিপ্লবের আকাঙ্ক্ষাকে তুলে ধরেছিল। আর প্রথম দফাতেই ছিল শিক্ষার আশু সংস্কারকল্পে হামুদুর রাহমান শিক্ষা কমিশন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ সব বিশ্ববিদ্যালয় আইন বাতিল ও শিক্ষার্থীদের মাসিক ফি কমানোর দাবি। আশ্চর্যই বৈকি, বর্তমানের শক্তিশালীদের বয়ানে উনসত্তর নিয়ে কোনো কথাই নেই!
এরও আগে দুর্দান্ত দূরদর্শী ছিল যুক্তফ্রন্টের নির্বাচনকেন্দ্রিক ২১ দফা, যার প্রথম আটটির মধ্যে সাতটিই ছিল কোনো না কোনোভাবে কৃষক-শ্রমিক-মেহনতি মানুষের অধিকার রক্ষার্থে। ৯ থেকে ১১ পর্যন্ত তিনটি দফা ছিল শিক্ষা ও উচ্চশিক্ষার সংস্কার প্রশ্নে।
পূর্ববঙ্গে মুসলিম লীগের নিপীড়নমূলক স্বেচ্ছাচারী শাসনের বিরুদ্ধে যুক্তফ্রন্টের ওই ২১ দফা হয়ে উঠেছিল সত্যিকার অর্থেই জনগণের জন্য মুক্তির মেনিফেস্টো। তবে সেটা ছিল রাজনীতিকদের ভূমিকায় ঋদ্ধ আর আমাদের এই আলোচনা শিক্ষার্থীদের ভূমিকা বিচারে সীমাবদ্ধ।
চব্বিশের ‘৯ দফা’ কি মনে থাকবেসময়ের জীবিত সন্তান হিসেবে নিজেদের সময়কে আমরা যতই বীরত্ববাচক বলি না কেন, চব্বিশের ৯ দফা পূর্ববর্তী সময়গুলোর দাবি-দফার তুলনায় বরং অনেক বিবর্ণ-ম্রিয়মাণ। এগুলো দিয়ে অতীতের ধারাবাহিকতাকেও স্পর্শ করা যায় না, আবার ভবিষ্যতের রাজনৈতিক গতিপথও নির্ধারণ করা যায় না। তা ছাড়া একাত্তরের পর সবচেয়ে বৃহদাকার হত্যাকাণ্ড ও জুলুমের পর ‘প্রধানমন্ত্রীর ক্ষমা চাওয়া’র মতো নিরীহ দাবি যেখানে সর্বাগ্রে অলংকৃত হয়, সেই দাবিনামা আন্দোলনের নেতারা স্বভাবতই ভুলে যেতে চাইবেন, এ আর আশ্চর্য কী!
বস্তুত, চব্বিশের যে ৯ দফা, তার কটিই–বা মনে রেখেছেন খোদ নেতারা কিংবা সাধারণ মানুষ? এগুলো কি নতুন রাষ্ট্রব্যবস্থা কিংবা রাজনৈতিক বন্দোবস্তের দিশা দিতে পারে? অনিবার্যভাবেই না।
এই ৯ দফার প্রতিটিই ইস্যুভিত্তিক ও চব্বিশের আন্দোলনকেন্দ্রিক। ভবিষ্যতের রাষ্ট্র ও রাজনীতি পরিবর্তনের আকাঙ্ক্ষা এই দাবিগুলোতে স্থান পাওয়ার যোগ্যই বিবেচিত হয়নি; কিংবা দাবিদাওয়ার প্রণেতারা সম্ভবত অতীতের ছাত্রনেতাদের মতো দূরদৃষ্টি দিয়ে ভাবেনইনি বিষয়গুলো।
চব্বিশের ‘ব্রাত্যকরণ প্রকল্প’চব্বিশের জুলাইয়ের ‘৩৬ দিন’ ছিল বিপুল সম্ভাবনা ও অসামান্য বীরত্বময়। জুলুমের অপর পৃষ্ঠে একটা অসাধারণ সম্ভাবনাময় সময়ের জন্ম দিয়েছিল চব্বিশের জুলাই। কিন্তু সালতামামিতেই প্রশ্নটা আসবে, সেই সম্ভাবনাকে কি রক্ষা করা গেল? দঙ্গলবাজি ও মবতন্ত্রের বাড়বাড়ন্ত কি গণতান্ত্রিক আকাঙ্ক্ষার সঙ্গে প্রতারণা করেনি?
নানা শ্রেণি–পেশা, জাতি–ধর্ম–বর্ণ–গোত্রের বিপুল প্রান্তিক মানুষ কীভাবে শুধু সংখ্যাগুরু ও ক্ষমতাবানের অহমিকার বলি হয়ে গেল অভ্যুত্থানের পর, সেই প্রশ্নের জবাব তো সরকার ও অভ্যুত্থানের নেতৃত্বকে দিতে হবে। অভ্যুত্থানের এক বছর হয়ে গেলেও ন্যূনতম কোনো ভাবনা-ভাবনান্তর প্রান্তজনদের জন্য বরাদ্দ নেই। উল্টো জাতিগত ও ধর্মীয় সংখ্যালঘু এবং নারীরা অভ্যুত্থানের পর আরও কোণঠাসা হয়েছেন।
সত্যের খাতিরে স্বীকার করে নেওয়া ভালো যে শিক্ষাব্যবস্থার ভয়ংকর দার্শনিক সমস্যা থেকে উদ্ভূত রাষ্ট্রীয় কর্মসংস্থানব্যবস্থা সংস্কারের আন্দোলনটির দর্শনগত সীমা খুবই সংকুচিত। যে কারণে দাবিদাওয়ায় নেই কৃষক-শ্রমিকের কথা; অথচ সরকারি গেজেটভুক্ত ৮৪৪ জনের মধ্যে সর্বোচ্চ ২৮৪ জন সাধারণ শ্রমজীবী ও ১২০ জন ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী নিহত হয়েছেন (দৈনিক প্রথম আলো, ২০ জুলাই, ২০২৫)।
এই যে সমাজের কিছু গুরুত্বপূর্ণ বর্গকে অপর ও ব্রাত্য করার প্রকল্প, তাদের ভূমিকার স্বীকৃতি লোপাট করা, এগুলো কি বৈষম্যবিরোধী অবস্থান?
আরও নেই শিক্ষা ও উচ্চশিক্ষাব্যবস্থা পরিবর্তনের কোনো রূপরেখা; কথা নেই অভূতপূর্ব সাড়া দেওয়া বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়, অধিভুক্ত কলেজ ও অপরাপর শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোর—যাদের শহীদের সংখ্যা পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের তুলনায় কয়েক গুণ বেশি। বিশেষত, বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা ঝাঁপিয়ে না পড়লে অভ্যুত্থান আদৌ সফল হতো কি না, তা নিয়ে যথেষ্ট সংশয় আছে। অথচ সেই বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ই আজ ব্রাত্য!
বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের ঐতিহাসিক ভূমিকাঐতিহাসিকভাবেই বাংলাদেশে বড়দের পাঠশালায় ‘কোমলমতি’ ভাবা হয় বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থীদের। নামের সংক্ষিপ্ত রূপটিও (বেবি) কী আশ্চর্যজনক আক্ষরিক সার্থকতায় ভাস্বর! অবস্থাপন্নদের সন্তান, রাজনীতি-সমাজবিমুখ, দেশ নিয়ে ভাবনাহীন, বিদেশে এক পা দেওয়া, সারাক্ষণ শুধু সিজি সিজি (সিজিপিএ) জপা, পশ-জোস-বস করপোরেট কালচার সিনড্রোম, ফাস্ট ফুড, আপেল ও ব্রয়লার খাওয়া এবং সর্বোপরি, ‘আই হেট পলিটিকস’—কোমলমতি, তথা বেবি অভিধা দেওয়ার জন্য এর চেয়ে বেশি আর কী প্রয়োজন! বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের এভাবে দেখার প্রবণতা ‘প্রাচীন প্রস্তর যুগ’ থেকেই চলে আসছে। অথচ তাঁরাই আন্দোলনের মোড় ঘুরিয়ে দিলেন!
আন্দোলনের একপর্যায়ে গত বছরের ১৬ জুলাই রাতে ইউজিসি একযোগে সব পাবলিক ও প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ এবং শিক্ষার্থীদের আবাসিক হল ছাড়ার এখতিয়ার-বহির্ভূত আদেশ দেয়। পরদিন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অপরাজেয় বাংলার পাদদেশে নিপীড়নবিরোধী শিক্ষক সমাবেশ থেকে ছাত্র হত্যাকাণ্ড ও বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধের আদেশের নিন্দা ও প্রতিবাদ জানায় বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক নেটওয়ার্ক, যেখানে বিভিন্ন বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের বহু শিক্ষক অংশ নেন। শিক্ষকদের এই প্রতিবাদী অবস্থান বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের মধ্যে এক পরোক্ষ দাবানলের সৃষ্টি করে।
হল বন্ধ হয়ে যাওয়ায় ১৮ জুলাই, যে সময় পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের বেশির ভাগ শিক্ষার্থী উপায়ন্তর না পেয়ে শহর ছেড়ে যাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন, ঠিক সেই সময় রাষ্ট্র ও সরকারকে প্রত্যাঘাত করেন বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা। বিশেষত ঢাকার রামপুরা থেকে উত্তরা পর্যন্ত পুরো প্রগতি সরণি ও কুড়িল বিশ্বরোড রণক্ষেত্রে পরিণত হয়।
রাজধানীর বসুন্ধরা আবাসিক এলাকায় বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের বিক্ষোভ মিছিল। ২ আগস্ট শুক্রবার, ২০২৪.উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: ন ব সরক র র জন ত ক ব যবস থ প রবণত প বল ক ত তর র রকল প অবস থ
এছাড়াও পড়ুন:
প্রতিবেশী দেশগুলো অস্থির, ভারত এখন কী করবে
দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশগুলোতে অস্থিতিশীলতা নতুন কিছু নয়। তবে এখন যে অস্থিরতা এ অঞ্চলে চলছে তা ভারতের প্রতিবেশী দেশগুলোর পাশাপাশি ভারতকে আগের চেয়ে বেশি ঝুঁকির মুখে ফেলছে।
সাম্প্রতিক নেপালের সহিংস অস্থিরতা তারই উদাহরণ। শুধু নেপালের ঘটনা নয়। ভারতের পূর্বদিকে বাংলাদেশে ২০২৪ সালে যে টানাপোড়েন শুরু হয়েছিল এবং তার জের ধরে সেখানে সরকার পতন হয়েছিল; সেই সংকটের মীমাংসা এখনও হয়নি।
অন্যদিকে ভারতের দক্ষিণ-পূর্বে থাইল্যান্ড নতুন করে অশান্ত হয়ে উঠেছে। কারণ সেখানে আদালতের রায়ে প্রধানমন্ত্রীকে পদচ্যুত করা হয়েছে ও সম্প্রতি কম্বোডিয়ার সঙ্গে সীমান্তে তাদের একাধিক সংঘর্ষ হয়েছে।
আর্মড কনফ্লিক্ট লোকেশন অ্যান্ড ইভেন্ট ডেটা প্রকল্পের হিসাব অনুযায়ী, ২০২১ সালের সামরিক অভ্যুত্থানের পর থেকে মিয়ানমারের গৃহযুদ্ধে অন্তত ৮০ হাজার মানুষ নিহত হয়েছে। এর মধ্যে সাধারণ নাগরিকের পাশাপাশি যোদ্ধারাও আছেন।
আরও পড়ুনভারত ও চীনের টানাটানিতে পড়েছে নেপাল৩১ জুলাই ২০২০ভারতের পশ্চিমে পাকিস্তান এখনও অতীতের ‘ভূতদের’ সঙ্গে লড়াই করছে। উগ্র ইসলামপন্থী গোষ্ঠী, দুর্বল অর্থনীতি আর অকার্যকর শাসনব্যবস্থা পাকিস্তানকে অস্থির করে রেখেছে। ভারতের দক্ষিণে শ্রীলঙ্কা তিন বছর আগে প্রেসিডেন্টকে সরানোর পর আপাত শান্ত হয়েছে। কিন্তু দেশটির অর্থনীতি এখনো ঘুরে দাঁড়াতে পারেনি। আর উত্তরে চীনের আঞ্চলিক প্রভাব বিস্তারের প্রচেষ্টাও এই অস্থিরতার বড় কারণ হয়ে আছে।
ভারতের জন্য এসব সংকট মোটেও দূরের কোনো ব্যাপার নয়। বাংলাদেশের ঘটনাপ্রবাহ ইতিমধ্যেই পূর্ব ভারতের রাজ্যগুলোতে অস্বস্তি তৈরি করছে। পাকিস্তানের সীমান্তপারের সন্ত্রাসের হুমকি এ গ্রীষ্মে কাশ্মীরে প্রায় যুদ্ধ বাঁধিয়ে ফেলেছিল। আর এখন নেপালের অস্থির রাজনীতি চীনের জন্য নতুন করে হস্তক্ষেপের সুযোগ করে দিয়েছে। এত বড় এক অস্থিরতার বলয়কে উপেক্ষা করার সুযোগ নেই।
এখন কীভাবে এই ধাক্কাগুলো সামলানো যায় এবং কীভাবে গোটা অঞ্চলে স্থিতিশীলতা আনা যায়, সেটিই ভারতের নেতৃত্বের সামনে মূল প্রশ্ন হয়ে দেখা দিয়েছে।
সাদা চোখে থাইল্যান্ডের রাজনৈতিক অস্থিরতা আর কম্বোডিয়ার সঙ্গে সীমান্ত সংঘর্ষকে ততটা গুরুতর মনে নাও হতে পারে। কিন্তু ভারত তার ‘অ্যাক্ট ইস্ট’ নীতির অধীনে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার আসিয়ানভুক্ত ১০ দেশ ও তাদের ৬০ কোটিরও বেশি মানুষের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ অর্থনৈতিক ও কৌশলগত সম্পর্ক গড়ছে।নেপাল দিয়েই শুরু করা যাক। দেশটি দুই দশক আগে দীর্ঘ মাওবাদী বিদ্রোহের অবসান ঘটাতে যে উচ্চাভিলাষী সংবিধান প্রণয়ন করেছিল, তা টিকিয়ে রাখতেই তারা হিমশিম খাচ্ছে। রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলো দুর্বল, বিতর্কিত ও ভঙ্গুর অবস্থায় আছে। পক্ষপাত, দুর্নীতি আর রাজনৈতিক নেতৃত্বের ব্যর্থতার কারণে স্থিতিশীলতার আশা বারবার ভেঙে পড়েছে। সম্প্রতি যেসব ভয়াবহ সহিংসতা ঘটেছে, তা আসলে এই গভীর অস্থিরতার লক্ষণ।
বাংলাদেশে শেখ হাসিনার পতনের পর থেকে যে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার ক্ষমতায় আছে, তারা আইনশৃঙ্খলা ঠিক রাখতে বা মানবাধিকারের সুরক্ষা দিতে ব্যর্থ হচ্ছে। যে অর্থনীতি কয়েক দশক ধরে বাংলাদেশের সাফল্যের গল্প ছিল, দেশের রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা ও মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের কড়া শুল্কনীতির কারণে সেটিও এখন টালমাটাল।
আরও পড়ুনভারত ‘তুমি রিয়েলিটি মাইন্যে ন্যাও’০৪ ডিসেম্বর ২০২৪সাদা চোখে থাইল্যান্ডের রাজনৈতিক অস্থিরতা আর কম্বোডিয়ার সঙ্গে সীমান্ত সংঘর্ষকে ততটা গুরুতর মনে নাও হতে পারে। কিন্তু ভারত তার ‘অ্যাক্ট ইস্ট’ নীতির অধীনে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার আসিয়ানভুক্ত ১০ দেশ ও তাদের ৬০ কোটিরও বেশি মানুষের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ অর্থনৈতিক ও কৌশলগত সম্পর্ক গড়ছে।
এই অঞ্চলের যে কোনো অশান্তি সেই প্রচেষ্টাকে জটিল করে তুলবে। তাছাড়া থাইল্যান্ড বহুদিন ধরে দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার মধ্যে সেতুবন্ধনের কাজ করেছে। যদি এর প্রতিষ্ঠানগুলো দুর্বল হয় কিংবা বা মালয়েশিয়ার প্রধানমন্ত্রী আনোয়ার ইব্রাহিমের শান্তি-প্রচেষ্টা সত্ত্বেও কম্বোডিয়ার সঙ্গে থাইল্যান্ডের বিরোধ আরও বেড়ে যায়, তাহলে ভারতের ইন্দো-প্যাসিফিক করিডরের স্বপ্নই ভেঙে পড়তে পারে।
পাকিস্তানকে ‘চিরকালীন সংকটে থাকা দেশ’ বলা হয়তো কঠিন শোনায়, কিন্তু দুঃখজনকভাবে এটিই বাস্তবতা। সেখানে বারবার বেসামরিক সরকারকে দুর্বল করা হয়েছে। যেমন, ২০২২ সালে ইমরান খানের নির্বাচিত সরকার সেনাবাহিনীর ইশারায় ক্ষমতাচ্যুত হয়েছে। রাজনীতি রক্তক্ষয়ী খেলায় পরিণত হলে চরমপন্থীরা মাথা তোলে, আর নাজুক অর্থনীতি সেই প্রবণতাকে আরও বাড়িয়ে দেয়। পাকিস্তানে সেটিই দেখা গেছে।
আরও পড়ুননেপালের গণ–অভ্যুত্থান ভারতের মাথাব্যথা বাড়াল১২ সেপ্টেম্বর ২০২৫ভারতের দৃষ্টিতে পাকিস্তানের এই সংকট শুধু অভ্যন্তরীণ নয়। এগুলো প্রায়ই কাশ্মীর সীমান্ত পেরিয়ে সন্ত্রাস ছড়ায়, আঞ্চলিক শান্তির সম্ভাবনা নষ্ট করে, এমনকি পারমাণবিক সংঘাতের শঙ্কাও তৈরি করে। ভারত যখন বাইরের দিকে তাকাতে চায়, এই স্থায়ী অস্থিতিশীলতা তখন ভারতকে উপমহাদেশের দাবার ছকে আটকে রাখে। এর সঙ্গে পাকিস্তান-চীন জোট মিলে পরিস্থিতিকে আরও জটিল করে তুলছে। এটি নিকট ভবিষ্যতে বদলানোর সম্ভাবনা কম।
এসব ঘটনা মিলিয়ে যে বড় প্রবণতা স্পষ্ট হচ্ছে, তা হলো: ভারতের চারপাশে গণতন্ত্র পিছিয়ে পড়েছে। প্রতিবেশি দেশগুলোতে সংবিধান বারবার বদলানো হচ্ছে এবং রাজনৈতিক প্রভাব খাটিয়ে আদালতকে ব্যবহার হচ্ছে। দুর্বলতার সুযোগ নিয়ে অনেক সেনাপ্রধান রাজনীতিতে হস্তক্ষেপ করছেন। রাজনৈতিক নেতাদের কখনো কারাগারে পাঠানো হচ্ছে, কখনো নির্বাসনে ঠেলে দেওয়া হচ্ছে।
বিশ্বের সবচেয়ে বড় গণতন্ত্র হিসেবে ভারতের জন্য এ প্রবণতা মোকাবিলা করা জরুরি। আর এখন আরও দৃঢ় আঞ্চলিক কৌশল ছাড়া উপায় নেই। বাস্তবে পাকিস্তান ছাড়া দক্ষিণ এশিয়ার বেশিরভাগ দেশে সংকট দেখা দিলে ভারতই প্রথম ভরসা। তবে যখন কোনো দেশ মনে করে তাদের ভারতের সাহায্য দরকার নেই, তখন তারা ভারতের নিরাপত্তা উদ্বেগকেও গুরুত্ব দেয় না।
আরও পড়ুননেপালের অভ্যুত্থান নিয়ে ভারতীয় মিডিয়া যেভাবে মিথ্যা বয়ান হাজির করছে১৩ সেপ্টেম্বর ২০২৫ভারতের চারপাশের অশান্ত পরিস্থিতিই যথেষ্ট কঠিন। তার ওপর বৈশ্বিক প্রেক্ষাপট আরও অনিশ্চয়তা যোগ করছে। ট্রাম্পের দক্ষিণ এশিয়া নীতি এতটাই খামখেয়ালি যে, ছোট দেশগুলো এখন নিরাপদ থাকতে বিকল্প পথ খুঁজছে। জাপান ও দক্ষিণ কোরিয়ায় পর্যন্ত প্রশ্ন উঠছে—চীন যখন শক্তি প্রদর্শন করছে আর মার্কিন নিরাপত্তার ছাতার বিশ্বাসযোগ্যতা প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে পড়ছে, তখন কি তাদের পারমাণবিক অস্ত্র অর্জনের পথে হাঁটা উচিত না?
ভারত যদিও এ ঝড়ের মুখে দৃঢ় থেকেছে, তবুও আঞ্চলিক টানাপোড়েন আর ট্রাম্পসৃষ্ট অস্থিরতা ভারতের বহুদিনের কৌশলগত স্বায়ত্তশাসন ধরে রাখাকে কঠিন করে তুলছে। এখন ভারতের কাজ শুধু যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সম্পর্ক গভীর করা নয়, বরং সম্পর্কের কৌশলগত, প্রযুক্তিগত ও অর্থনৈতিক মূল ভিত্তি ধরে রাখা। পাশাপাশি আচমকা মার্কিন নীতি পরিবর্তনের ধাক্কা সামলানোর প্রস্তুতি নেওয়াও দরকার।
ভারত দক্ষিণ এশিয়ায় আধিপত্য চায় না। তার লক্ষ্য হলো এমন একটি অন্তর্ভুক্তিমূলক, নীতিনির্ভর ও সংযুক্ত অঞ্চল গড়ে তোলা যেখানে অতীতের বারবারের সংকট সরে যাবে এবং সে জায়গায় ভবিষ্যতের দীর্ঘস্থায়ী স্থিতিশীলতা প্রতিষ্ঠিত হবে।
নিরুপমা রাও ভারতের সাবেক পররাষ্ট্রসচিব এবং চীন ও যুক্তরাষ্ট্রে ভারতের সাবেক রাষ্ট্রদূত
সত্ত্ব: প্রজেক্ট সিন্ডিকেট। ইংরেজি থেকে সংক্ষেপিত অনুবাদ: সারফুদ্দিন আহমেদ