হেমন্তের সকাল। হালকা কুয়াশার চাদরে ঢাকা শীতল প্রকৃতি দেখে সঠিক সময় ঠাহর করা একটু মুশকিল। তবে ঘড়ির কাঁটা বলছে সাড়ে ছয়টা। কাউয়াদীঘি হাওরপারের ওয়াপদা-কাশিমপুর হাটের কাছাকাছি যেতেই এক ব্যক্তির সঙ্গে দেখা। নানা প্রসঙ্গে শেষে তিনি এই প্রতিবেদককে খবর দিলেন, ‘হাটে একটু খিয়াল করবেন। জাল দিয়ে হাওরে পাখি শিকার করা হচ্ছে। হাটে এসব পাখি বিক্রি করে অনেকেই।’

তবে সেদিন মৌলভীবাজারের রাজনগর উপজেলার ফতেহপুর ইউনিয়নের ওই হাটে গিয়ে বিক্রির জন্য আনা কোনো পাখির দেখা পাওয়া যায়নি। একাধিক সূত্র জানায়, মৌসুমের এ সময়ে পরিযায়ীসহ দেশি পাখির শিকার বাড়ে। আর এসবের অধিকাংশই বিক্রি হয় চুপিসারে।

ওয়াপদা-কাশিমপুর হাটটি পড়েছে ফতেহপুর ইউনিয়নের কাউয়াদীঘি হাওর ও কুশিয়ারা নদীর তীরে। ২৮ নভেম্বর সকালে হাট থেকে ফেরার পথে হাওরপারের কাশিমপুর এলাকার মাঠে পাখি শিকারের জন্য পাতা জালের ফাঁদ দেখা গেছে। অনেকগুলো খুঁটিতে বাঁধা অবস্থায় এসব জাল পেতে রাখা হয়েছে। রাতের বেলা যখন হাওরের এক স্থান থেকে অন্য স্থানে পাখিরা ঝাঁক বেঁধে উড়ে বেড়ায়, তখন এসব জালে আটকা পড়ে এগুলো। এরপর এসব পাখি স্থানীয় বাজারে বা লুকিয়ে নির্দিষ্ট কয়েকজনের কাছে বিক্রি করা হয়।

স্থানীয়ভাবে জানা গেছে, জালের পাশাপাশি বন্দুক বা এয়ারগান ব্যবহার করেও হাওরে পাখি শিকার করা হচ্ছে। মৌলভীবাজার সদর ও রাজনগর উপজেলার কাউয়াদীঘি হাওরপারের কিছু এলাকায় মাঝেমধ্যেই এমন শিকার চলে। হাওরপারের অনেক বাড়িতে সাদা বক, পানকৌড়িসহ স্থানীয় ও পরিযায়ী পাখি আশ্রয় নেয়; সকাল হলে তারা দলে দলে হাওর ও মাঠের দিকে উড়ে যায়, বিকেলে ফিরে আসে। রাতের অন্ধকারে কিছু শিকারি টর্চের আলো ফেলে বন্দুক দিয়ে এসব পাখিই শিকার করে। কোনো কোনো বাড়ির লোকজন বাধা দিলেও সবার পক্ষে তা সম্ভব হয় না।

স্থানীয় কয়েকজন বাসিন্দা জানান, এখনো শীত তীব্র হয়নি, কিন্তু পরিযায়ী পাখি আসা শুরু করতেই শিকারিদের তৎপরতা বেড়েছে। হাকালুকি, কাউয়াদীঘি ও হাইল হাওর এলাকায় খেতের ধারে ও বিলের পাশে জাল পেতে রাখা হচ্ছে। রাতের অন্ধকারে এসব জাল চোখে না পড়ায় পাখি আটকা পড়ে; সকালে পেশাদার শিকারিরা তা নির্দিষ্ট ক্রেতার কাছে বিক্রি করে। হাকালুকি হাওরে প্রায় প্রতি শীতেই বিষটোপ ব্যবহার করে পাখি শিকারের ঘটনাও ঘটে।

সম্প্রতি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে কয়েকজন শিকারির হাত থেকে পাখি উদ্ধার ও অবমুক্ত করার ছবি-ভিডিও শেয়ার করেছেন। ২ ডিসেম্বর একজন দুটি কালেম পাখি এবং ১৩ নভেম্বর চারজন মিলে চারটি সরালি হাঁস অবমুক্ত করেছেন—এমন দৃশ্য প্রকাশ্যে এসেছে। তবে অধিকাংশ শিকারই গোপনে হওয়ায় ঘটনা খুব কমই জানা যায়। শীত বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে পরিযায়ী পাখি বাড়ে, সেই সঙ্গে বাড়ে শিকারও।

হাওরপারের অনেক বাড়িতে সাদা বক, পানকৌড়িসহ স্থানীয় ও পরিযায়ী পাখি আশ্রয় নেয়; সকাল হলে তারা দলে দলে হাওর ও মাঠের দিকে উড়ে যায়, বিকেলে ফিরে আসে। রাতের অন্ধকারে কিছু শিকারি টর্চের আলো ফেলে বন্দুক দিয়ে এসব পাখিই শিকার করে।

রোববার পরিবেশকর্মী তুহিন জুবায়ের তাঁর ফেসবুক আইডিতে শ্রীমঙ্গলের মীর্জাপুরে শাপলা বিলের একটি ভিডিও প্রকাশ করে লিখেছেন, হাওরাঞ্চলে এখনো নিয়মিত পাখি শিকার হয়। ভিডিওতে দেখা গেছে—নৌকার ভেতর শাপলার পাশে বাঁধা দুটি সাদা বক, আর তরুণ এক শিকারির হাতে শাপলার আঁটির সঙ্গে ঝুলছে আরেকটি বক।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে তুহিন জুবায়ের বলেন, পাখি পরিবেশের অন্যতম অংশ। পরিযায়ী পাখি জলজ পরিবেশকে সুস্থ রাখতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। পাখি শিকার নিষিদ্ধ, অথচ এই আইন কার্যকর করতে প্রচার, প্রয়োগ যতটা দরকার, তাতে ঘাটতি আছে। জীববৈচিত্র্য ও হাওর রক্ষায় প্রশাসন ও স্থানীয় পর্যায়ে কঠোর নজরদারি নিশ্চিত করা জরুরি।

নিজেদের জনবলসংকটের কথা স্বীকার করেছেন বন্য প্রাণী ব্যবস্থাপনা ও প্রকৃতি সংরক্ষণ বিভাগ, সিলেটের বিভাগীয় বন কর্মকর্তা আবুল কালাম। তিনি জানান, বিভিন্ন হাট-বাজারে অভিযান চলছে, পাখি উদ্ধার ও অবমুক্ত করা হচ্ছে। কিছু শুভানুধ্যায়ী তথ্য দেন, সেসব জায়গায়ও অভিযান হয়। হাইল হাওর, বাইক্কা বিল ও ভৈরব বাজার এলাকায় নিয়মিত অভিযান দেওয়া হয়েছে। তবে জনবলসংকটের কারণে শিকার পুরোপুরি বন্ধ করা যাচ্ছে না।

আবুল কালাম আরও বলেন, উপজেলা পর্যায়ে আলাদা অফিস থাকলে দ্রুত ব্যবস্থা নেওয়া সম্ভব হতো। বিভিন্ন সংগঠন ও পরিবেশকর্মীদের সঙ্গে নিয়ে শিকার-ঝুঁকিপূর্ণ এলাকাগুলোতে সচেতনতামূলক কার্যক্রম বাড়ানো হবে।

.

উৎস: Prothomalo

কীওয়ার্ড: হ ওরপ র র শ ক র কর এসব প খ পর য য় পর ব শ

এছাড়াও পড়ুন:

ফতুল্লায় অপরাধ কর্মকান্ডে ড্রোন ব্যবহারের অভিযোগ কিলার বাবুর বিরুদ্ধে

নারায়ণগঞ্জের ফতুল্লায় পেশাদার ছিনতাইকারী বাবু ওরফে কিলার বাবুর নেতৃত্বে সংঘবদ্ধ একটি ছিনতাই চক্র ড্রোন ব্যবহার করে নতুন কৌশলে অপরাধ চালাচ্ছে বলে অভিযোগ উঠেছে। 

এলাকাবাসী জানায়,চক্রটি প্রথমে ড্রোন উড়িয়ে আশপাশে পুলিশি টহল বা সন্দেহজনক অবস্থান আছে কিনা তা নিশ্চিত হয়। পরিস্থিতি ‘নিরাপদ’ মনে হলে তারা রাস্তায় নেমে ছিনতাই সংঘটিত সটকে পরে।চক্রটির এই নতুন কৌশলে স্থানীয় বাসিন্দাদের মধ্যে বাড়ছে উদ্বেগ ও আতঙ্ক।

তথ্য মতে, ফতুল্লার ছাত্রলীগ ক্যাডার ৫ টি হত্যা সহ একাধিক বৈষম্যবিরোধী মামলার আসামী বাবু ওরফে কিলার বাবু প্রতি রাতেই বিসিক নতুন সড়কে অবস্থিত একটি গার্মেন্টেসের ছাদে অবস্থান করে ড্রোন উড়িয়ে পুলিশের অবস্থান নিশ্চিত হয়ে সময় সুযোগ বুঝে একাধিক দলে বিভিক্ত হয়ে ঢাকা-নারায়নগঞ্জ পুরাতন সড়কের পঞ্চবটী বাস স্ট্যান্ড মোড় থেকে পুলিশ লাইন লোহার মার্কেট পর্যন্ত ছিনতাই করে নিরাপদে পালিয়ে যায়।

ঢাকা-নারায়নগঞ্জ পুরাতন সড়কের পঞ্চবটী বাস স্ট্যান্ড, বিসিক নতুন রাস্তা,পাচঁতলা, কলোনী,লোহার মার্কেট  এবং পুলিশ লাইন এলাকায় সম্প্রতি এ ধরনের ড্রোন দেখার ঘটনা ঘটেছে বলে জানায় বাসিন্দারা। কয়েকজন পথচারী জানিয়েছেন, ড্রোন দেখার কিছুক্ষণ পরই একাধিক মোটরসাইকেল আরোহী এসে মোবাইল, টাকা-পয়সা এবং মূল্যবান জিনিসপত্র ছিনিয়ে নিয়ে যায়।

এলাকাবাসীর অভিযোগ, সন্ধ্যা থেকে গভীর রাত পর্যন্ত কয়েকটি স্থানে অজানা ড্রোন উড়তে দেখা যায়। ড্রোনটি প্রথমে এলাকার আশপাশে পুলিশ বা নিরাপত্তা বাহিনীর উপস্থিতি আছে কিনা, রাস্তায় মানুষের চলাচল কেমন—সে বিষয়ে পর্যবেক্ষণ চালায়। পরিস্থিতি ‘ঝুঁকিমুক্ত’ মনে হলেই কিছুক্ষণ পরেই একই এলাকায় ছিনতাই সংঘটিত হয়।

এরই ধারাবাহিকতায় বৃহস্পতিবার রাত নয়টার দিকে স্থানীয় ব্যবসায়ী ও এলাকাবাসী আকাশে একটি ড্রোন উড়তে দেখতে পেয়ে তারা আতংকিত হয়ে পরে। এক পর্যায়ে তারা সংঘটিত হয়ে ড্রোনের উৎস খুজতে গিয়ে দেখতে পায় যে বিসিক নতুন রাস্তার এস,কে টাওয়ারের উপর থেকে শির্ষ যুবলীগ ক্যাডার বাবু ওরফে কিলার বাবু ড্রোন উড়িয়ে সেখানে অবস্থান করছে।

এমন সংবাদ পেয়ে সংঘবদ্ধ ব্যবসায়ী ও এলাকাবাসী এস,কে টাওয়ারের সামনে এগিয়ে গেলে টাওয়ারটির নিচে অপেক্ষামান কিলার বাবুর সহোযোগিরা দৌড়ে ঘটনাস্থল ত্যাগ করে। স্থানীয় জনতা তখন এস,কে টাওয়ার চতূর্দিক ঘিরে রাখে এবং কিলার বাবুর কে গ্রেফতারের দাবীতে বিক্ষোভ করতে থাকে।

পরে পুলিশ ঘটনাস্থলে গেলে এস,কে টাওয়ারের ভবনে থাকা গার্মেন্টসের ভিতরে পুলিশ প্রবেশ করতে চাইলে কতৃপক্ষ গেইট খুলতে অস্বীকার করে। পরে স্থানীয় জনতার বিক্ষোভের মুখে গার্মেন্টস কতৃপক্ষ প্রায় দেড়ঘন্টা পর গেইট খুলে দিলে পুলিশ ভিতরে প্রবেশ করে তল্লাশি চালায়। তবে কিলার বাবুকে তারা পায়নি।

কিলার বাবুকে না পেলেও তার সহোযোগি ফেলে যাওয়া বেশ কিছু দেশীয় তৈরি ধারালো অস্ত্র উদ্ধার করে পুলিশ। নাম প্রকাশ করার না শর্তে অভিযানে অংশ নেওয়া পুলিশের এক সদস্য জানায়, আমরা গার্মেন্টসের বিভিন্ন কক্ষে খুঁজেছি কিন্ত পাইনি।

এই গার্মেন্টেসে একজন, দুইজন লোক ফেব্রিক্স ও কোন কার্টনের ভিতরে লুকিয়ে থাকলে কারো পক্ষে সম্ভব নয় খুজে বের করা। তিনি আরো বলেন আমরা গার্মেন্টসের ভিতরের সিসি ক্যামেরা দেখতে চেয়েছিলাম কিন্ত তারা সেটা দেখাতে অপারগতা প্রকাশ করে। 

সোহান নামের এক  ভুক্তভোগী বলেন, গত কয়েক দিন পূর্বে রাত তিনটার দিকে কাজ শেষে বাসায় ফেরার পথে  পঞ্চবটী বন বিভাগের সামনের রাস্তায় মিশুক করে যাওয়ার পথে ন, আকাশে ড্রোন উড়তে দেখি।ড্রোন দেখে ভাবলাম কেউ হয়তো ভিডিও করছে। কিন্তু কিছুক্ষণ পরই তিনজন এসে আমার ফোন ছিনিয়ে নিয়ে যায়।”

স্থানীয়দের দাবি—এটি কোনো সাধারণ ছিনতাই নয়, পরিকল্পিত এবং প্রযুক্তি ব্যবহার করে পরিচালিত একটি সংঘবদ্ধ চক্র। তারা দ্রুত পুলিশের টহল বৃদ্ধি এবং ড্রোন শনাক্ত করতে বিশেষ নজরদারি চাইছেন।

ফতুল্লা মডেল থানার পরিদর্শক (ওসি তদন্ত) আনোয়ার হোসেন জানান,“বিষয়টি আমরা গুরুত্বসহকারে দেখছি। ড্রোন ব্যবহার করে অপরাধের চেষ্টার ঘটনার বিষয়ে তিনি অবগত নন।

আইনশৃঙ্খলা বিশেষজ্ঞরা বলছেন—ড্রোন এখন কেবল বাণিজ্যিক নয়, অপরাধীদের হাতেও পৌঁছে গেছে। তাই নজরদারি, রেজিস্ট্রেশন ও মনিটরিং আরও কঠোর করা জরুরি।

এ ঘটনায় এলাকার মানুষের মধ্যে চরম উদ্বেগ দেখা দিয়েছে। তারা মনে করছেন, ড্রোন নজরদারি চালিয়ে ছিনতাইয়ের মতো অপরাধ আরও বেড়ে যেতে পারে যদি দ্রুত ব্যবস্থা না নেওয়া হয়।
 

সম্পর্কিত নিবন্ধ

  • ফতুল্লায় অপরাধ কর্মকান্ডে ড্রোন ব্যবহারের অভিযোগ কিলার বাবুর বিরুদ্ধে