এই দিনে হানাদার মুক্ত হয়েছিল কুষ্টিয়ার যেসব স্থান
Published: 8th, December 2025 GMT
আজ ৮ ডিসেম্বর। ১৯৭১ সালের আজকের এই দিনটি ছিল কুষ্টিয়ার মানুষের কাছে স্মরণীয় এক মুহূর্ত। এ দিন মুক্ত হয় জেলার মিরপুর, দৌলতপুর ও ভেড়ামারা উপজেলা। মুক্তিকামী জনতা স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলন করে বিজয় আনন্দে মেতে ওঠেন।
মিরপুর: ১৯৭১ সালের ৮ ডিসেম্বর ভোরে ই-৯ এর গ্রুপ কমান্ডার আফতাব উদ্দিন খান ১৭০ জন মুক্তিযোদ্ধা নিয়ে মিরপুর থানায় স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশের জাতীয় পতাকা গান স্যালুটের মাধ্যমে উত্তোলন করেন। এরপর ৬৫ জন পাকহানাদার বাহিনীর দোসর ও রাজাকার পাহাড়পুর মুক্তিবাহিনীর ক্যাম্পে আত্মসমর্পন করে। মিরপুর হানাদার মুক্ত হওয়ার সংবাদ এলাকায় ছড়িয়ে পড়লে বিভিন্ন বয়সের হাজারো নারী-পুরুষ রাস্তায় নেমে আনন্দ উল্লাস করতে থাকেন।
আরো পড়ুন:
ঝালকাঠি পাক হানাদার মুক্ত দিবস আজ
আজ গোপালগঞ্জ মুক্ত দিবস
দৌলতপুর মুক্ত দিবস: ১৯৭১ সালের এই দিন থানা চত্বরে বিজয় পতাকা উড়ানোর মধ্য দিয়ে দৌলতপুরকে হানাদার মুক্ত ঘোষণা করেন বীর মুক্তিযোদ্ধারা।
দৌলতপুরকে হানাদার মুক্ত করতে মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গে পাকিস্তানি সেনাদের সম্মুখসহ ছোট-বড় ১৬টি যুদ্ধ সংঘঠিত হয়। এসব যুদ্ধে ৩৫ জন বীর মুক্তিযোদ্ধাসহ কয়েক’শ নারী-পুরুষ শহীদ হন।
সবচেয়ে বড় যুদ্ধ সংঘঠিত হয় উপজেলার ধর্মদহ ব্যাংগাড়ী মাঠে। এ যুদ্ধে প্রায় সাড়ে ৩০০ পাকিস্তানি সেনা নিহত হন। শহীদ হন তিন বীর মুক্তিযোদ্ধা ও তিন ভারতীয় মিত্র বাহিনীর সদস্য।
৮ ডিসেম্বর সকালে আল্লারদর্গা এলাকায় পাক সেনাদের গুলিতে বীর মুক্তিযোদ্ধা রফিক শহীদ হন। এরপর দৌলতপুর হানাদার মুক্ত ঘোষণা করেন তৎকালীন মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার মেজর নুরুন্নবী।
ভেড়ামারা মুক্ত দিবস: মিত্র বাহিনীর সহায়তায় আজকের দিনে মুক্তিযোদ্ধারা কুষ্টিয়ার ভেড়ামারাকে শত্রু মুক্ত করেন।
এই দিন ৮ নম্বর সেক্টরের কমান্ডার মেজর আবুল মুনছুরের নেতৃত্বে জেলা কমান্ডার বীর মুক্তিযোদ্ধা রাশেদুল আলমের নেতৃত্বে ২ ভাগে বিভক্ত হয়ে ভোর ৭টার দিকে ভেড়ামারা ফারাকপুরে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর সঙ্গে সম্মুখ যুদ্ধে অবতীর্ণ হয়। প্রায় ৭ ঘণ্টার এই যুদ্ধে আটজন পাকসেনা নিহত হয়। যুদ্ধের পরপরই মুক্তিযোদ্ধাদের গুলিতে প্রায় ৫০/৬০ জন বিহারী নিহত হন।
এই ঘটনার সংবাদ পেয়ে ভেড়ামারায় অবস্থানরত পাকবাহিনীর অন্য সদস্যদের মনোবল ভেঙ্গে যায়। তারা সন্ধ্যার আগেই ভেড়ামারা থেকে হার্ডিঞ্জ ব্রিজ দিয়ে পালিয়ে যায়। এই দিন রাতে মুক্তিপাগল মানুষ ও মুক্তিযোদ্ধারা দলে দলে ভেড়ামারায় প্রবেশ করতে থাকেন। তখন তারা বিজয়ের আনন্দে রাস্তায় নেমে উল্লাস করতে থাকেন।
ঢাকা/কাঞ্চন/মাসুদ
.উৎস: Risingbd
কীওয়ার্ড: চ কর চ কর ম ক ত দ বস কম ন ড র দ লতপ র এই দ ন
এছাড়াও পড়ুন:
পাকিস্তানি বাহিনী পিছু হটে, মুক্তিকামীদের উল্লাস
ঠাকুরগাঁও ১৯৭১ সালের ৩ ডিসেম্বর পাকিস্তানি বাহিনীর কবল থেকে মুক্ত হয়। মিত্র বাহিনীর সহায়তায় মুক্তিযোদ্ধারা ২৯ নভেম্বর পঞ্চগড় থানা নিয়ন্ত্রণে নেন। পাকিস্তানি বাহিনী সেখান থেকে পিছু হটে সবশেষ ঠাকুরগাঁও থানার ভুল্লিতে ঘাঁটি গাড়ে। মুক্তিযোদ্ধারা যাতে না আসতে পারেন, তাই তারা বোমা মেরে ভুল্লি সেতুটি উড়িয়ে দেয়। তারা শহরের প্রবেশপথের জায়গায় জায়গায় মাইন পেতে রাখে। মিত্র বাহিনী ভুল্লি সেতু মেরামত করে ট্যাংক ও ভারী অস্ত্র নিয়ে এগিয়ে যায়।
তবে মাইনের কারণে শহরে ঢুকতে দেরি হয়। ২ ডিসেম্বর প্রচণ্ড গোলাগুলির পর পাকিস্তানি বাহিনী পিছু হটে। ওই রাতে পাকিস্তানি বাহিনী সত্যপীর সেতু উড়িয়ে দিয়ে পালিয়ে যায়। এ খবর নিশ্চিত হওয়ার পর ৩ ডিসেম্বর মুক্তিযোদ্ধাদের বিভিন্ন দল একের পর এক শহরে ঢুকে পড়ে। মুক্ত হয় ঠাকুরগাঁও। মুক্তিকামী মানুষ উল্লাসে ফেটে পড়েন।
ঠাকুরগাঁওয়ে মুক্তিযুদ্ধের শুরুর দিনগুলোর কথা উল্লেখ আছে ক্ল্যাসিক পাবলিকেশনস থেকে প্রকাশিত মোহাম্মদ এমদাদুল হকের লেখা মুক্তিযুদ্ধে ঠাকুরগাঁও বইয়ে। সেখানে তিনি লিখেছেন, ১৯৭১ সালের ২৭ মার্চ সকাল থেকে শহরে খণ্ড খণ্ড মিছিল আসতে থাকে। পরে তারা এক হয়ে বিশাল মিছিল বের করে। চৌরাস্তায় গণজমায়েত হয়। ভাষণ হয়। মিছিলটি ইপিআর (ইস্ট পাকিস্তান রাইফেলস) ক্যাম্প আক্রমণের জন্য এগিয়ে যায়। কালীবাড়ি এলাকায় কেরামত আলী মোক্তারের বাড়ির সামনে গিয়ে মিছিলটি থেমে যায়। মিছিলের খবরে দক্ষিণ দিক থেকে দ্রুতগতিতে গাড়িতে করে ছুটে আসে ইপিআরের একদল সৈন্য। ইপিআরের সৈন্যরা ইতিমধ্যে বাঙালি-অবাঙালি ভাগে নিজেদের মতো করে বিভক্ত হয়ে গিয়েছিল। মোহাম্মদ আলী নামের এক রিকশাচালক সামনে চলে আসেন। ‘জয় বাংলা’ বলে চিৎকার করেন। সঙ্গে সঙ্গে তিনটি গুলির শব্দ হলো। মাটিতে লুটিয়ে পড়লেন তিনি। তিনিই মুক্তিযুদ্ধে ঠাকুরগাঁওয়ের প্রথম শহীদ।
ঠাকুরগাঁও মুক্ত হওয়ার সময়টিতে বহু মানুষ রাস্তার দুই পাশে দাঁড়িয়ে ‘জয় বাংলা’ স্লোগান দিয়ে মুক্তিযোদ্ধাদের স্বাগত জানান। কামরুল ইসলাম, অবসরপ্রাপ্ত কলেজশিক্ষকসূচিপত্র প্রকাশনী থেকে প্রকাশিত মোহাম্মদ এমদাদুল হকের লেখা সংগ্রামী ঠাকুরগাঁও ও একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ বইয়ে লেখা হয়েছে, ঠাকুরগাঁওয়ে ১৪ এপ্রিল পর্যন্ত পাকিস্তানি সেনাবাহিনী উপস্থিতি ছিল না। ১৫ এপ্রিল তারা ১০টি ট্রাক ও ৮টি জিপে করে গুলি করতে করতে ঠাকুরগাঁও শহরে ঢোকে। আতঙ্কে মানুষ ঘরবাড়ি ছাড়তে শুরু করে। কিছুক্ষণের মধ্যেই ঠাকুরগাঁও শহর জনমানবশূন্য হয়ে পড়ে। এরপর রাজাকার, আলবদর ও আলশামসের সহায়তায় পাকিস্তানি বাহিনী মুক্তিকামী জনগণের ওপর অমানবিক নির্যাতন ও হত্যাযজ্ঞ চালাতে শুরু করে।
মুক্তিযুদ্ধের সময় ঠাকুরগাঁওয়ে অনেকগুলো গণহত্যার ঘটনা ঘটে। অন্যতম বড় একটি হলো জাটিভাঙ্গা গণহত্যা। কথাপ্রকাশ থেকে প্রকাশিত মানিক মোহাম্মদ রাজ্জাকের উত্তরের গণহত্যা ১৯৭১ বইয়ে জাটিভাঙ্গা বধ্যভূমি ও গণহত্যা সম্পর্কে বলা হয়েছে, ঠাকুরগাঁও সদরের জাটিভাঙ্গা গ্রামটি এখন বধ্যভূমির গ্রাম হিসেবে পরিচিত। জাটিভাঙ্গা হাটসংলগ্ন পশ্চিম পাশে উপজেলা পরিষদের রাস্তার ওপরে একটি ছোট পুল। এরই নিচ দিয়ে বয়ে যাওয়া ছোট্ট খালের শুকনো মাটি প্রায় এক হাজার মানুষের রক্তে সিক্ত হয়েছিল একাত্তরের এপ্রিলে মাসে। গড়েয়া, আশপাশের গোপালপুর, পশ্চিম সুকানপুকুর, লউথুতি, ঠাঙ্গামেলী, কালিগঞ্জ, বাহাদুর বাজার, ঝাড়বাড়ি ও বীরগঞ্জ থানার বেশ কিছু এলাকা থেকে ভারতের দিকে পালিয়ে যেতে থাকা নিরীহ প্রায় এক হাজার মানুষকে এখানে হত্যা করা হয়।
শত্রুমুক্ত হওয়ার খবর ছড়িয়ে পড়ার সঙ্গে সঙ্গে স্লোগানে স্লোগানে মুখর হয়ে ওঠে গোটা শহর। সেদিন তাঁরা শহরে স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা উড়িয়ে দেন। নুর করিম, মুক্তিযোদ্ধা সংসদ, ঠাকুরগাঁওহত্যাকাণ্ড ও বর্বরতার পথ পাড়ি দিয়ে বিজয়ের দিকে যেতে থাকে ঠাকুরগাঁও। ঠাকুরগাঁও মুক্ত হওয়ার দিনের প্রত্যক্ষদর্শী জেলা শহরের অবসরপ্রাপ্ত কলেজশিক্ষক কামরুল ইসলাম। তখন তিনি ছিলেন উচ্চমাধ্যমিকের ছাত্র। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ঠাকুরগাঁও মুক্ত হওয়ার সময়টিতে বহু মানুষ রাস্তার দুই পাশে দাঁড়িয়ে ‘জয় বাংলা’ স্লোগান দিয়ে মুক্তিযোদ্ধাদের স্বাগত জানান। সেই দিনের কথা ভুলে যাওয়ার নয়।
মুক্তিযোদ্ধা সংসদ ঠাকুরগাঁও জেলা কমান্ডের আহ্বায়ক নুর করিম বলেন, ৩ ডিসেম্বর সকালে বীরের বেশে মুক্তিযোদ্ধারা শহরে প্রবেশ করেন। শত্রুমুক্ত হওয়ার খবর ছড়িয়ে পড়ার সঙ্গে সঙ্গে স্লোগানে স্লোগানে মুখর হয়ে ওঠে গোটা শহর। সেদিন তাঁরা শহরে স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা উড়িয়ে দেন। সেই পতাকা পত পত করে উড়তে উড়তে যেন বিজয়ের কথা জানান দিচ্ছিল।