গত ৫ আগস্টের পর ময়মনসিংহের ১১টি সংসদীয় আসনে রাজনীতির মাঠ এখন বিএনপি ও জামায়াতে ইসলামীর দখলে। আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে এই দুটি দলের তৎপরতাই বেশি। এবারের রোজা ও ঈদ ঘিরে মানুষের ‘আস্থা অর্জনে’ চেষ্টা করছেন আগামী নির্বাচনের সম্ভাব্য সংসদ সদস্য (এমপি) প্রার্থীরা।  

জামায়াতে ইসলামীর একক প্রার্থীরা মাঠে কাজ করলেও বিএনপির একাধিক সম্ভাব্য প্রার্থী আছেন। জেলার ১১টি সংসদীয় আসনের মধ্যে ১০টি আসনে গত ৩১ জানুয়ারি জামায়াতে ইসলামী ১০ প্রার্থীকে সম্ভাব্য প্রার্থী হিসেবে ঘোষণা করে। তবে নবগঠিত রাজনৈতিক দল জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) কোনো কমিটি না হওয়ায় তাদের কোনো তৎপরতা চোখে পড়েনি।

দলের একাধিক প্রার্থীর তৎপরতার বিষয়ে বিএনপির ময়মনসিংহ বিভাগের সহসাংগঠনিক সম্পাদক আবু ওয়াহাব আকন্দ বলেন, ‘দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান আমাদের জানিয়েছেন যে এবারের নির্বাচন গণমানুষের নির্বাচন ও ভোটের অধিকার ফিরিয়ে আনার নির্বাচন। অত্যন্ত কঠিন ও সুশৃঙ্খল নির্বাচন হবে। সুতরাং ভালোবাসা দিয়ে ভালোবাসা আদায় করা ছাড়া আর কোনো উপায় নেই। মানুষের সঙ্গে মিশতে হবে। কৌশলগত কারণে একটি বৃহৎ রাজনৈতিক দলের একটি আসনে তিন-চারজন প্রার্থী থাকা খুব স্বাভাভিক। কৌশলগত কারণে যদি চারজন প্রার্থী প্রতিযোগিতায় নামেন, তাহলে মানুষ শেষ পর্যন্ত দেখবে বিএনপির ধানের শীষ প্রতীক। বিভক্তির সুযোগ নেই।’

ময়মনসিংহ-১ (হালুয়াঘাট-ধোবাউড়া) আসনে কেন্দ্রীয় বিএনপির যুগ্ম মহাসচিব সৈয়দ এমরান সালেহ (প্রিন্স) ওয়ার্ড পর্যায়ে ইফতার মাহফিল, গণসংযোগ ও ঈদসামগ্রী বিতরণ করে যাচ্ছেন। এ আসনে বিএনপির আরেক সম্ভাব্য প্রার্থী সালমান ওমর (রুবেল) ইফতার মাহফিল ও প্রায় ১৫ হাজার পরিবারকে ঈদসামগ্রী বিতরণ কার্যক্রম করছেন। বিএনপির সাবেক সংসদ সদস্য (এমপি) আফজাল এইচ খানও গণসংযোগ ও ইফতার মাহফিলের পাশাপাশি ঈদসামগ্রীও বিতরণ করছেন।

সৈয়দ এমরান সালেহ বলেন, রমজানে ওয়ার্ড পর্যায়ে খোলা মাঠে ইফতার আয়োজন করে দীর্ঘ ১৫ বছরের ঘাটতি পূরণের চেষ্টা করছেন। নির্বাচন সামনে রেখে তাঁরা জনগণের সঙ্গে সম্পৃক্ত হয়ে কর্মকাণ্ড চালিয়ে যাচ্ছেন, মানুষের কাছে আস্থার জায়গা তৈরি করছেন।

এই আসনে জামায়াতের সম্ভাব্য একক প্রার্থী হিসেবে জেলা ছাত্রশিবিরের সাবেক সভাপতি মাহফুজুর রহমান নিজের কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছেন। তিনি বলেন, চাহিদা অনুযায়ী সংসদীয় আসনটিতে ঈদ উপহার বিতরণ করা হচ্ছে।

ময়মনসিংহ-২ (ফুলপুর-তারাকান্দা) সংসদীয় আসনে বিএনপির সম্ভাব্য প্রার্থী হিসেবে এলাকায় নানা তৎপরতা চালাচ্ছেন জেলা উত্তর বিএনপির যুগ্ম আহ্বায়ক মোতাহার হোসেন তালুকদার, সাবেক এমপি আবুল বাশার আকন্দ, ময়মনসিংহ মহানগর যুবদলের সাধারণ সম্পাদক জোবায়েদ হোসেন। ইফতার আয়োজন, ঈদসামগ্রী বিতরণ ও তৃণমূল পর্যায়ে গণসংযোগ কার্যক্রম করছেন তাঁরা। এ ছাড়া বিগত সংসদ নির্বাচনে প্রার্থী হয়ে দল থেকে বহিষ্কৃত সাবেক এমপি শাহ শহীদ সারোয়ারও বিএনপির ব্যানারে ইফতার মাহফিল করে নিজের সমর্থকদের চাঙা রাখার চেষ্টা করছেন। জামায়াতের প্রার্থী উপজেলার সাবেক আমির মাহবুব মন্ডল গণসংযোগ, ইফতার আয়োজন ও ঈদসামগ্রী বিতরণ করছেন।


বিএনপি নেতা মোহাতার হোসেন তালুকদার বলেন, অত্যন্ত অসহায় পরিবারগুলোর তালিকা করে প্রায় তিন হাজার পরিবারের মধ্যে ঈদসামগ্রী বিতরণ করা হচ্ছে। আগামী নির্বাচন সামনে রেখেই এসব কার্যক্রম চলছে।

ময়মনসিংহ-৩ (গৌরীপুর) সংসদীয় আসনে বিএনপির জাতীয় নির্বাহী কমিটির সদস্য প্রকৌশলী এম ইকবাল হোসাইন, উত্তর জেলা বিএনপির সদস্য আহম্মেদ তায়েবুর রহমান, জাতীয়তাবাদী আইনজীবী ফোরামের বিভাগীয় সহসভাপতি নূরুল হক, উত্তর জেলা বিএনপির সদস্য হাফেজ আজিজুল হক নানা কার্যক্রম করছেন। পিছিয়ে নেই জামায়াতে ইসলামীর প্রার্থী উপজেলা জামায়াতের আমির মাওলানা বরুজ্জামানও।

ময়মনসিংহ-৪ (সদর) আসনে বিএনপি থেকে সম্ভাব্য এমপি প্রার্থী বিভাগীয় সহসাংগঠনিক সম্পাদক আবু ওয়াহাব আকন্দ ও দক্ষিণ জেলা বিএনপির সদস্যসচিব রোকনুজ্জামান সরকার কার্যক্রম চালাচ্ছেন। রোকনুজ্জামান সরকার বলেন, ইফতার মাহফিল করার পাশাপাশি ১০ হাজার পরিবারে ঈদ উপহার বিতরণ করা হচ্ছে। আবু ওয়াহাব আকন্দ বলেন, তারেক রহমানের নামেও ঈদসামগ্রী বিতরণ করা হচ্ছে। প্রায় ২০ হাজার মানুষের মধ্যে সহায়তা পৌঁছে দেওয়া হচ্ছে।

জামায়াতে ইসলামীর প্রার্থী মহানগর জামায়াতের আমির কামরুল আহসান বলেন, রোজার শুরুতে ও ঈদের জন্য ২০ লাখ টাকার খাদ্যসামগ্রী বিতরণ করা হচ্ছে।

ময়মনসিংহ-৫ (মুক্তাগাছা) আসনে জেলা দক্ষিণ বিএনপির আহ্বায়ক জাকির হোসেন, কেন্দ্রীয় জামায়াতে ইসলামের প্রচার ও মিডিয়া বিভাগের সেক্রেটারি মতিউর রহমান আকন্দ এবং খেলাফত মজলিসের সম্ভাব্য প্রার্থী মুফতি হাবিবুর রহমান একই ধরনের তৎপরতা চালাচ্ছেন।

ময়মনসিংহ-৬ (ফুলবাড়িয়া) আসনে তৎপর বিএনপির সম্ভাব্য প্রার্থী উপজেলা বিএনপির আহ্বায়ক আখতারুল আলম, বিএনপির সাবেক এমপির ছেলে তানভীর হোসেন, জাতীয়তাবাদী আইনজীবী ফোরামের কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য রেজাউল করিম চৌধুরী ও যুবদল নেতা আবদুল করিম সরকার এবং ময়মনসিংহ জেলা জামায়াতের নায়েবে আমির কামরুল হাসান।

ময়মনসিংহ-৭ (ত্রিশাল) আসনে তৃণমূলের মানুষের মন জয়ে ঈদকেন্দ্রিক তৎপরতা চালাচ্ছেন উপজেলা বিএনপির সাবেক সাধারণ সম্পাদক জয়নাল আবেদিন, জেলা দক্ষিণ বিএনপির সাবেক আহ্বায়ক মাহবুবুর রহমান, দক্ষিণ জেলা স্বেচ্ছাসেবক দলের আহ্বায়ক শহীদুল আমিন, সাবেক পৌর মেয়র আমিনুল ইসলাম সরকার, ইসলামী আন্দোলনের সভাপতি মাওলানা ইব্রাহিম খলিলুল্লাহ ও ময়মনসিংহ মহানগর জামায়াতের নায়েবে আমির আসাদুজ্জামান সোহেল।

ময়মনসিংহ-৮ (ঈশ্বরগঞ্জ) আসনে উপজেলা বিএনপির আহ্বায়ক লুৎফুল্লাহেল মাজেদ ও সাবেক এমপি শাহ নূরুল কবীর কাজ করছেন। লুৎফুল্লাহেল মাজেদ ‘আয়নাঘরে’ বন্দী ছিলেন। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, নির্বাচন সামনে রেখে গণসংযোগ কার্যক্রম অব্যাহত আছে। রমজানে গরিব মানুষকে খাদ্যসহায়তা দেওয়া হয়েছে। সুলভ মূল্যে গরুর মাংস বিতরণ করা হয়েছে।

ময়মনসিংহ-৯ (নান্দাইল) আসনে তৎপর আছেন উপজেলা বিএনপির আহ্বায়ক ইয়াসের খান চৌধুরী, উপজেলা বিএনপির সদস্য ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.

) এ কে এম শামছুল ইসলাম। এ আসনে জামায়াতে ইসলামীর কোনো প্রার্থীর নাম জানানো হয়নি। ময়মনসিংহ-১০ (গফরগাঁও) ও ময়মনসিংহ-১১ (ভালুকা) আসনেও ঈদকেন্দ্রিক নানা তৎপরতা চালিয়ে যাচ্ছেন নেতারা।

ময়মনসিংহ জেলা জামায়াতে ইসলামীর সেক্রেটারি মোজাম্মেল হক আকন্দ বলেন, ‘ঈদ ঘিরে সংসদীয় আসনগুলোতে প্রার্থীরা শুভেচ্ছা পোস্টার দিচ্ছেন। গণসংযোগ কার্যক্রম চলছে। ইফতার ও ঈদসামগ্রী বিতরণ আমাদের নিয়মিত সামাজিক কার্যক্রমের অংশ।’ আগামী নির্বাচন বিএনপি ও জামায়াতে ইসলামীর প্রার্থীদের মধ্যে হবে কি না, এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘তা এখনো বলা যাচ্ছে না। নির্বাচনের জন্য আমাদের সব প্রস্তুতি চলছে। জাতীয় স্বার্থে সমমনা ইসলামি দল বা বৈষম্যবিরোধী কোনো দল যদি ঐক্যবদ্ধ জোট হয়, তাহলে আমরা যেকোনো আসন ছেড়ে দেব।’

বিগত সংসদ নির্বাচনগুলোতে ময়মনসিংহের বিভিন্ন আসনে ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের প্রার্থীরা নির্বাচনে অংশ নেন। দলটির ময়মনসিংহ উত্তর জেলা শাখার সভাপতি মাওলানা হাদিউল ইসলাম বলেন, ‘প্রতিটি আসন থেকে সম্ভাব্য প্রার্থী তালিকা করে চূড়ান্ত প্রার্থী নির্বাচনের জন্য আমাদের কার্যক্রম চলছে। নির্বাচন সামনে রেখে সংগঠনকে শক্তিশালী করতে ওয়ার্ড পর্যায়ে সভা, মানুষের কাছে গিয়ে আস্থা অর্জনের কার্যক্রম চালু আছে। ঈদ ঘিরে শুভেচ্ছা বিনিময় কার্যক্রম চলছে।’

উৎস: Prothomalo

কীওয়ার্ড: ব এনপ র সদস য ব এনপ র স ব ক ইসল ম র প র স ব ক এমপ ব তরণ ক গণস য গ র রহম ন পর ব র আম দ র পর য য় ঈদ ঘ র সরক র করছ ন আকন দ উপজ ল

এছাড়াও পড়ুন:

জিল হোসেন মারা গেছেন, আদালতে তাঁর লড়াই শেষ হবে কবে

জিল হোসেনের ৭২ বছরের জীবনের ৪৭ বছরই কেটেছে আইনি লড়াইয়ে। শুরুতে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পরীক্ষা পাসের সনদ পেতে, এরপর ক্ষতিপূরণের দাবিতে তাঁর এই দীর্ঘ লড়াই। লড়াই এখনো শেষ হয়নি। এর মধ্যেই মারা গেছেন জিল হোসেন।

জিল হোসেনের মৃত্যুর পর তিন বছর ধরে লড়াইটা করে যাচ্ছেন স্ত্রী ও তাঁর সন্তানেরা। কিন্তু পরিবারটির বিচারের অপেক্ষা শেষ হয়নি।

পরিবার ও মামলার নথিতে থাকা তথ্য অনুযায়ী, জিল হোসেনের জন্ম ১৯৫০ সালের ৭ জানুয়ারি। ১৯৭১-৭২ শিক্ষাবর্ষে তিনি ময়মনসিংহের বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের স্নাতকের (কৃষি) পরীক্ষার্থী ছিলেন। এই পরীক্ষা হয় ১৯৭৩ সালে। কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ পরীক্ষার ফলাফলে তাঁকে অকৃতকার্য ঘোষণা করে। ফলাফল পুনর্বিবেচনা চেয়ে একাডেমিক কাউন্সিলে আবেদন করেন জিল হোসেন। কিন্তু সেই আবেদনে কাজ হয়নি।

১৯৭৫ সালে জিল হোসেন আবার পরীক্ষায় অংশ নেন, কিন্তু তাঁকে বহিষ্কার করা হয়। এসবের প্রতিকার চেয়ে ১৯৭৫ সালের ২২ এপ্রিল ময়মনসিংহের প্রথম মুনসেফ আদালতে তিনি মামলা করেন। মামলায় তিনি দাবি করেছিলেন, তাঁর প্রাপ্ত নম্বরের (১৯৭৩ সালে দেওয়া পরীক্ষায়) সঙ্গে ভগ্নাংশ ছিল। বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ নম্বরের সঙ্গে ভগ্নাংশ যোগ না করে তাঁকে অকৃতকার্য ঘোষণা করে।

সেই আইনি লড়াইয়ের শুরু। নিম্ন আদালত পেরিয়ে বছরের পর বছর উচ্চ আদালতেও ছুটেছেন তিনি। সিরাজগঞ্জ সদরের চিলগাছা গ্রামে পরিবার নিয়ে থাকতেন জিল হোসেন। ছোটখাটো ব্যবসা করে সংসার চালাতেন। সংসারে স্ত্রী এবং চার ছেলে ও চার মেয়ে রয়েছে। আইনি লড়াই নিষ্পত্তি হওয়ার আগেই ২০২২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি মারা যান জিল হোসেন। এর পর থেকে মামলায় পক্ষ হয়ে তাঁর স্ত্রীসহ উত্তরাধিকারীরা লড়াই করে যাচ্ছেন।

বাবা উচ্চ আদালতের রায় দেখে যেতে পারেননি। বাবা নেই, বুকে চাপা কষ্ট হয়। বাবার কাছে শুনেছি, মামলা চালাতে গিয়ে জমিসহ অনেক কিছুই হারাতে হয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের খামখেয়ালির কারণে বাবার জীবন ধ্বংস হয়েছে, আমাদেরও ভোগান্তি পোহাতে হচ্ছে।নূর হোসেন, বাদী জিল হোসেনের ছোট ছেলে

জিল হোসেনের ছোট সন্তান নূর হোসেন গত শনিবার প্রথম আলোকে বলেন, ‘বাবা উচ্চ আদালতের রায় দেখে যেতে পারেননি। বাবা নেই, বুকে চাপা কষ্ট হয়। বাবার কাছে শুনেছি, মামলা চালাতে গিয়ে জমিসহ অনেক কিছুই হারাতে হয়েছে।’ তিনি অভিযোগ করে বলেন, ‘বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের খামখেয়ালির কারণে বাবার জীবন ধ্বংস হয়েছে, আমাদেরও ভোগান্তি পোহাতে হচ্ছে।’

আরও পড়ুনশিক্ষাসনদ নিয়ে ৪৮ বছরের আইনি লড়াই: ২ কোটি টাকা ক্ষতিপূরণের রায় বাস্তবায়নে বাধা নেই০৮ অক্টোবর ২০২৩

নূর হোসেন আরও বলেন, ‘মা এবং ভাইবোনেরা এখন মামলা চালাচ্ছি। মায়ের বয়স ৬৯ বছর। তিনিও নানা রোগে ভুগছেন। তিনিও চূড়ান্ত রায় দেখে যেতে পারবেন কি না, তা নিয়ে সন্দেহ রয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের লিভ টু আপিল এখন আপিল বিভাগে শুনানির অপেক্ষায় আছে। বাবা মারা যাওয়ার পরও বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের কোনো অনুশোচনা নেই, এটা কষ্টের।’

আইনি লড়াই

জিল হোসেন যখন বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের স্নাতক (কৃষি) দ্বিতীয় পর্বের চতুর্থ বর্ষের পুরোনো পাঠ্যক্রমের চূড়ান্ত পরীক্ষার্থী ছিলেন, তখন তাঁর বয়স ২৩ বছর। ময়মনসিংহের মুনসেফ আদালতে করা মামলায় জয়ী হন তিনি। আদালত ১৯৭৫ সালের ২৯ সেপ্টেম্বর একাডেমিক কাউন্সিলের সিদ্ধান্ত অবৈধ ঘোষণা করেন। একই সঙ্গে ভগ্নাংশ নম্বর যোগ না করে তাঁকে অকৃতকার্য করাকেও বেআইনি ঘোষণা করা হয়।

তবে জিল হোসেনের লড়াই তখনো বাকি। ওই রায়ের বিরুদ্ধে জজ আদালতে যায় বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ। এর পরিপ্রেক্ষিতে ১৯৭৬ সালের ৩১ জানুয়ারি এই আদালতের দেওয়া রায়েও জিল হোসেনের বহিষ্কারাদেশ বেআইনি ঘোষণা করা হয়।

একই বছর হাইকোর্টে আপিল করে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ। হাইকোর্ট ১৯৭৬ সালের ২৪ আগস্ট মামলাটি পুনর্বিচারের জন্য প্রথম মুনসেফ আদালতে পাঠান। এরপর ১৯৭৮ সালের ২৪ জানুয়ারি প্রথম মুনসেফ আদালত ভগ্নাংশ নম্বর যোগ করে ৩০ দিনের মধ্যে জিল হোসেনের পরীক্ষার ফলাফল প্রকাশ করার নির্দেশ দেন।

আরও পড়ুনসেবাদাতা বা গ্রহীতাদের সন্তুষ্টির মূল্যায়ন হয়নি২৮ এপ্রিল ২০২২

এর বিরুদ্ধে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ আবার জেলা জজ আদালতে আপিল করে, যা নামঞ্জুর হয়। পরে হাইকোর্টে আপিল করে কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ। এর ওপর ১৯৮৩ সালের ১৬ জানুয়ারি রায় দেওয়া হয়। এ রায়ে বিচারিক আদালতের সিদ্ধান্ত বহাল থাকে।

অতঃপর সনদ, ক্ষতিপূরণ মামলা

পরিবার ও মামলাসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, হাইকোর্টের রায়ের পর ১৯৮৬ সালের ২৮ ডিসেম্বর জিল হোসেনের একটি আবেদন গ্রহণ করে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ। পরে তাঁকে পাস নম্বর দিয়ে ১৯৯৭ সালের ২২ অক্টোবর নম্বরপত্রের সনদ দেওয়া হয়। তখন জিল হোসেনের বয়স ৪৭ বছর। তখন তাঁর সরকারি চাকরির বয়সসীমা অনেক আগেই শেষ হয়ে গেছে।

লিভ টু আপিল বিচারাধীন উল্লেখ করে একের পর এক সময় নিচ্ছে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ। সুপ্রিম কোর্টর স্থগিতাদেশ না থাকায় মামলা চলতে আইনগত বাধা নেই। অথচ মামলাটি চলছে না, যা জিল হোসেনের পরিবারের জন্য ভোগান্তির।চঞ্চল কুমার বিশ্বাস, বাদীপক্ষের আইনজীবী

এরপর ২০০০ সালের ১৮ অক্টোবর ক্ষতিপূরণ দাবি করে অধস্তন আদালতে মামলা করেন জিল হোসেন। মামলায় অভিযোগ করেন, হাইকোর্টের রায় ১৪ বছর ৯ মাস পরে কার্যকর করেছে বিশ্ববিদ্যালয়। বিশ্ববিদ্যালয়ের এমন কাজে তাঁর জীবন ধ্বংস হয়ে গেছে। নষ্ট হয়েছে সরকারি চাকরির সম্ভাবনাও।

ক্ষতিপূরণের এ মামলায় ২০০৮ সালের ২৬ আগস্ট রায় দেন ময়মনসিংহের প্রথম যুগ্ম জেলা জজ আদালত। রায়ে ৩০ দিনের মধ্যে জিল হোসেনকে ক্ষতিপূরণ হিসেবে ২ কোটি টাকা দিতে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষকে নির্দেশ দেওয়া হয়।

১৪ বছর পর নিষ্পত্তি

বিচারিক আদালতের ওই রায়ের বিরুদ্ধে ২০০৯ সালে হাইকোর্টে আপিল করে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ। এর পরিপ্রেক্ষিতে ২০০৯ সালের ৪ জুন হাইকোর্ট শর্ত সাপেক্ষে ময়মনসিংহের প্রথম যুগ্ম জেলা জজ আদালতের ২ কোটি টাকা ক্ষতিপূরণ দেওয়ার আদেশ স্থগিত করেন। শর্ত হিসেবে ২ কোটি টাকার ১২ দশমিক ৫ শতাংশ, অর্থাৎ ২৫ লাখ টাকা ৩ মাসের মধ্যে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষকে সংশ্লিষ্ট আদালতে জমা দিতে বলা হয়। এতে ব্যর্থ হলে স্থগিতাদেশ প্রত্যাহার হয়ে যাবে বলেও ওই আদেশে উল্লেখ করা হয়।

সংশ্লিষ্ট আইনজীবী জানান, জিল হোসেন মারা যাওয়ার পর আপিল শুনানির জন্য উঠলে ১৩ বছর আগে হাইকোর্ট ২ কোটি টাকার ১২ দশমিক ৫ শতাংশ সংশ্লিষ্ট আদালতে জমা দিতে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষকে যে নির্দেশ দিয়েছিলেন, তা সামনে আসে। এ অবস্থায় হাইকোর্ট আপিলকারী পক্ষকে ২৫ লাখ টাকা জমা দিয়ে আসতে বলেন। পরে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ ২০২২ সালে ৪ নভেম্বর ওই অর্থ জমা দেয়।

বিষয়টি আপিল বিভাগে বিচারাধীন। বিচারাধীন থাকলে নিম্ন আদালতে সাধারণ নিয়ম অনুযায়ী কার্যক্রম স্থগিত থাকে। এ বিষয়ে সুপ্রিম কোর্টের সিদ্ধান্তও আছে। আমরা শুনানির জন্য প্রস্তুত আছি।এ এম মাহবুব উদ্দিন খোকন, বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের পক্ষে নিয়োগ দেওয়া জ্যেষ্ঠ আইনজীবী

বিচারিক আদালতের রায়ের বিরুদ্ধে বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের করা আপিল খারিজ করে ২০২৩ সালের ৭ মার্চ রায় দেন হাইকোর্ট। ২ কোটি টাকা ক্ষতিপূরণ দিতে বিচারিক আদালতের দেওয়া রায় সংশোধন সাপেক্ষে বহাল রাখেন হাইকোর্ট। রায়ের দিন থেকে ওই অর্থের বিপরীতে ১০ শতাংশ হারে তারা (জিল হোসেনের পরিবার) লভ্যাংশ পাবেন বলেও জানানো হয়। অবশ্য এর আগে শর্ত অনুযায়ী, বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের জমা করা ২৫ লাখ টাকা ওই অর্থ থেকে বাদ যাবে।

বিশ্ববিদ্যালয়ের লিভ টু আপিল

হাইকোর্টের রায়ের বিরুদ্ধে ২০২৩ সালে লিভ টু আপিল করে বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়। সেই সঙ্গে হাইকোর্টের রায় স্থগিত চেয়ে আবেদন করা হয়। আবেদনটি ২০২৩ সালের ৮ অক্টোবর আপিল বিভাগে শুনানির জন্য ওঠে। শুনানি নিয়ে সেদিন তৎকালীন প্রধান বিচারপতির নেতৃত্বাধীন ছয় সদস্যের আপিল বিভাগ স্থগিতাদেশ চেয়ে করা আবেদন খারিজ করে দেন। লিভ টু আপিল ক্রম অনুসারে শুনানি হবে বলে আদেশে উল্লেখ করা হয়। এর ধারাবাহিকতায় লিভ টু আপিলটি শুনানির জন্য আপিল বিভাগের গত ৩১ আগস্টের কার্যতালিকায় ৫০৭ নম্বর ক্রমিকে ওঠে।

জিল হোসেনের পরিবারের পক্ষে সুপ্রিম কোর্টে মামলাটি পরিচালনার জন্য ২০২৩ সালের ৯ মার্চ আইনজীবী চঞ্চল কুমার বিশ্বাস নিয়োগ পান। তাঁকে নিয়োগ দেয় সুপ্রিম কোর্ট লিগ্যাল এইড কমিটি। চঞ্চল কুমার বিশ্বাস প্রথম আলোকে বলেন, হাইকোর্টের রায় স্থগিত চেয়ে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের আবেদন আপিল বিভাগ খারিজ করেছেন। এর পরিপ্রেক্ষিতে নিম্ন আদালতে অর্থ আদায়ে জারি মামলার (২০০৯ সালে করা) কার্যক্রম অগ্রসরের জন্য বাদীর উত্তারাধিকারীকারেরা আবেদন করেন।

আরও পড়ুনসনদ ও ক্ষতিপূরণের জন্য ৪৭ বছরের আইনি লড়াই ১৭ ডিসেম্বর ২০২২

চঞ্চল কুমার বিশ্বাস বলেন, লিভ টু আপিল বিচারাধীন উল্লেখ করে একের পর এক সময় নিচ্ছে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ। সুপ্রিম কোর্টের স্থগিতাদেশ না থাকায় মামলা চলতে আইনগত বাধা নেই। অথচ মামলাটি চলছে না, যা জিল হোসেনের পরিবারের জন্য ভোগান্তির।

বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের পক্ষে নিয়োগ দেওয়া জ্যেষ্ঠ আইনজীবী এ এম মাহবুব উদ্দিন খোকন প্রথম আলোকে বলেন, ‘বিষয়টি আপিল বিভাগে বিচারাধীন। বিচারাধীন থাকলে নিম্ন আদালতে সাধারণ নিয়ম অনুযায়ী কার্যক্রম স্থগিত থাকে। এ বিষয়ে সুপ্রিম কোর্টের সিদ্ধান্তও আছে। আমরা শুনানির জন্য প্রস্তুত আছি।’

আরও পড়ুন৩৩ বছর কেটে গেছে, কাজল কথা রেখেছেন০৫ আগস্ট ২০২৫

সম্পর্কিত নিবন্ধ

  • ঢাকাসহ সারা দেশে বৃষ্টির আভাস 
  • পটিয়ায় ব্যবসায়ীকে অপহরণ, দুই ঘণ্টা পর উদ্ধার
  • গাজীপুরে ডিপ্লোমা প্রকৌশলীদের মহাসড়ক অবরোধ, যান চলাচল বন্ধ
  • ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়কে যানচলাচল বন্ধ 
  • পুলিশের তৎপরতায় দুটি মোটরসাইকেল উদ্ধার, গ্রেপ্তার ৪
  • জিল হোসেন মারা গেছেন, আদালতে তাঁর লড়াই শেষ হবে কবে
  • ফতুল্লার ৫ ইউনিয়নে স্বেচ্ছাসেবক দলের নতুন কমিটি গঠনে তৎপরতা
  • ময়মনসিংহে সিলিন্ডার লিকেজে হোটেলে অগ্নিকাণ্ড