একটি টক শোতে বিএনপি নেত্রী ব্যারিস্টার রুমিন ফারহানাকে যা বলতে শুনলাম, তার সারমর্ম এ রকম: বাংলাদেশে এখন একজন রাজনীতিকের ইমেজ হলো ক্লাস ফাইভ পাস, উঠতি লোকাল মাস্তান থেকে বড় মাস্তান, তারপর জাতীয় পর্যায়ের মাস্তান। চাঁদাবাজির রেট অনেক হাই। দুই নম্বরি ব্যবসা থেকে বিশাল টাকার মালিক। তারপর এমপি এবং একসময় হয়তো মন্ত্রী।
জানা কথা হলেও নতুন করে মন বিষণ্ন হলো। অথচ এই দেশেও একদা রাজনীতি ছিল শিক্ষিত, ত্যাগী ও মানবিক মানুষের ব্রত। কোথায়, কীভাবে হারিয়ে গেল সেই সব দিন? এমন চিন্তা থেকেই ‘রাজনীতিক’দের জন্য লিখতে ইচ্ছা হলো। জানি, প্লেটো-কাঙ্ক্ষিত ‘ফিলোসফার কিং’ আমাদের এ পোড়ার দেশে কখনোই হবে না। তবুও ভালো রাজনীতির কথা নিরন্তর বলে যেতে হবে, লিখে যেতে হবে।
বিংশ শতাব্দীর দ্বিতীয় ও তৃতীয় দশকে মানব ইতিহাসের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ঘটনাগুলো ঘটে, যেমন প্রথম বিশ্বযুদ্ধ, ভার্সাই চুক্তি, রুশ বিপ্লব ও সমাজতন্ত্রের সূচনা, ইতালিতে মুসোলিনির আবির্ভাব ও দুনিয়াব্যাপী ফ্যাসিজমের উত্থান, মহামন্দা, ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের ক্ষয়িষ্ণু প্রবণতা যা ইন্ডিয়া অ্যাক্টে প্রতিফলিত, ব্রিটিশ রাজনীতিতে লেবার পার্টির উত্থান ও শ্রমিকের অধিকার রক্ষার দিকে মনঃসংযোগ। এরই প্রেক্ষাপটে ব্রিটিশ দার্শনিক ও রাষ্ট্রবিজ্ঞানী হেরাল্ড লাস্কির চিন্তাজগতে ঘটে এক বিস্ময়কর বৈপ্লবিক পরিবর্তন। ১৯২৫ সালে লাস্কি রচিত মহাগ্রন্থ গ্রামার অব পলিটিকস এসব বৈশ্বিক ঘটনাবলির ও লাস্কি চিন্তাজগতের পরিবর্তনেরই প্রতিফলন।
লাস্কি এই গ্রন্থে রাষ্ট্র, সার্বভৌমত্ব, অধিকার, স্বাধীনতা এবং গণতন্ত্রের প্রকৃতি নিয়ে সমালোচনামূলক বিশ্লেষণ করেন। তিনি রাজনৈতিক কর্তৃত্বের একটি বহুবিধ ধারণা এবং এমন একটি সমাজতান্ত্রিক অর্থনৈতিক কাঠামোর পক্ষে যুক্তি উপস্থাপন করেন, যা সামাজিক ন্যায়বিচার ও অর্থনৈতিক সমতার ওপর গুরুত্ব দেয়।
লাস্কি রাষ্ট্রীয় সার্বভৌমত্বের প্রচলিত ধারণাকে চ্যালেঞ্জ করেন। বলেন, ক্ষমতা রাষ্ট্রে কেন্দ্রীভূত না হয়ে বিভিন্ন সামাজিক প্রতিষ্ঠানের মধ্যে বণ্টিত হওয়া উচিত। তিনি হবস এবং অস্টিন উত্থাপিত আইনি সার্বভৌমত্বের ধারণার সমালোচনা করেন। এর পরিবর্তে তিনি সার্বভৌমত্বের একটি বহুত্ববাদী ধারণা প্রকাশ করেন। তিনি বলেন, রাষ্ট্রের পাশাপাশি একাধিক কর্তৃত্বের কেন্দ্র (যেমন শ্রমিক ইউনিয়ন, পেশাগত সংগঠন, স্থানীয় সরকার এবং ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান) রাজনৈতিক জীবনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। এসব কর্তৃত্বকেন্দ্রের সহাবস্থানের প্রয়োজনীয়তার কথা বলেন তিনি।
তাঁর মতে, রাষ্ট্রই একমাত্র কর্তৃত্বের উৎস নয়। রাষ্ট্র বরং এমন একটি প্রতিষ্ঠান, যা অন্যদের সঙ্গে মিলেই শাসনব্যবস্থায় অংশগ্রহণ করে। লাস্কির এই বহুত্ববাদী দৃষ্টিভঙ্গি জি ডি এইচ কোল এবং লিয়ন দুগুইয়ের মতো চিন্তাবিদদের দ্বারা প্রভাবিত। তাঁরা মনে করতেন সমাজের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের মধ্যে ক্ষমতা বণ্টন করা জরুরি, যেন স্বেচ্ছাচারিতা ও দমন-পীড়ন ঠেকানো যায়।
লাস্কি জোর দিয়ে বলেন, সরকারের কাজ শুধু আইনশৃঙ্খলা রক্ষা করা নয়। সরকারের প্রধান কাজ হলো সবার জন্য কল্যাণ নিশ্চিত করা। তিনি বৈষম্য মোকাবিলায় অর্থনৈতিক নিয়ন্ত্রণ ও সামাজিক ন্যায়বিচারে রাষ্ট্রের সক্রিয় ভূমিকার পক্ষে মত দেন। লাস্কি বলেন, রাষ্ট্রের কর্তৃত্ব নিরঙ্কুশ নয় এবং তা সামাজিক ও অর্থনৈতিক বিবেচনার মাধ্যমে সীমাবদ্ধ হওয়া উচিত। তিনি সতর্ক করেন, একটি অনিয়ন্ত্রিত রাষ্ট্র সার্বভৌমত্বের নামে ব্যক্তিস্বাধীনতা দমন করতে পারে। এর পরিবর্তে তিনি এমন একটি বিকেন্দ্রীকৃত শাসনব্যবস্থার কথা বলেন, যেখানে একাধিক প্রতিষ্ঠান সম্মিলিতভাবে কর্তৃত্ব ভাগ করে নেয়। তিনি অনিয়ন্ত্রিত পুঁজিবাদ তথা বাজার অর্থনীতির সমালোচনা করেন। কারণ, এটি অর্থনৈতিক বৈষম্য ও সামাজিক অন্যায্যতার সৃষ্টি করে। তাঁর মতে, সরকারের উচিত শ্রমজীবী শ্রেণির স্বার্থ রক্ষার জন্য হস্তক্ষেপ করা।
লাস্কি তাঁর বইয়ে ব্যক্তিস্বাধীনতার একটি নতুন তত্ত্ব উপস্থাপন করেন। কেবলমাত্র রাষ্ট্রের হস্তক্ষেপের অনুপস্থিতিই ব্যক্তিস্বাধীনতা নয়; বরং ন্যায়ভিত্তিক সমাজে ব্যক্তির সম্ভাবনা বিকাশের সামর্থ্য হিসেবে তিনি ব্যক্তিস্বাধীনতাকে সংজ্ঞায়িত করেন। তিনি অর্থনৈতিক বৈষম্যকে স্বাধীনতার জন্য একটি মৌলিক হুমকি হিসেবে দেখেন এবং বলেন, অর্থনৈতিক নিরাপত্তা ছাড়া রাজনৈতিক অধিকার অর্থহীন। কারণ, বৈষম্য গরিব ও শ্রমজীবী শ্রেণির জন্য সুযোগ সীমিত করে দেয়।
গণতন্ত্রের দৃঢ় সমর্থক লাস্কি পুঁজিবাদী গণতন্ত্রের সমালোচনা করেন। কারণ, পুঁজিবাদী গণতন্ত্রে অর্থনৈতিক ক্ষমতা অভিজাত ও পুঁজিপতি শ্রেণির হাতে কেন্দ্রীভূত থাকে, তাঁরা সম্পদের ওপর নিয়ন্ত্রণ রাখে আর সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ জীবনধারণের জন্য সংগ্রাম করে। এভাবে পুঁজিবাদ শ্রেণি বিভাজন সৃষ্টি করে। এ জন্যই তিনি এই ব্যবস্থাকে অন্যায্য মনে করেন এবং বিশ্বাস করেন, অর্থনৈতিক ক্ষমতার আরও ন্যায্য বণ্টন প্রয়োজন।লাস্কি স্বাধীনতাকে দুটি ভাগে ভাগ করেন—আনুষ্ঠানিক স্বাধীনতা ও বাস্তব স্বাধীনতা। আনুষ্ঠানিক স্বাধীনতার মধ্যে রয়েছে আইনি ও রাজনৈতিক অধিকার। যেমন মতপ্রকাশের স্বাধীনতা, ভোটাধিকার, ও আইনের সুরক্ষা। বাস্তব স্বাধীনতা এমন সামাজিক ও অর্থনৈতিক শর্তের কথা বলে, যা ব্যক্তিকে তাঁর অধিকারগুলো অর্থবহভাবে প্রয়োগ করতে সক্ষম করে। অর্থনৈতিক নিরাপত্তা না থাকলে আনুষ্ঠানিক স্বাধীনতা অর্থহীন হয়ে পড়ে। একটি উদাহরণ দিয়ে লাস্কি ধারণাটি ব্যাখ্যা করেন: ভোটাধিকার আছে এমন একজন দরিদ্র মানুষের যদি যথাযথ শিক্ষা, স্বাস্থ্যসেবা বা ন্যায্য মজুরি না থাকে, তাহলে প্রকৃতপক্ষে তিনি স্বাধীন নন।
লাস্কির এই বক্তব্য বাংলাদেশের জন্য খুব প্রাসঙ্গিক। এখানে প্রত্যেক নাগরিকের ভোটাধিকার আছে। কিন্তু গরিব মানুষ নিজের পছন্দের প্রার্থীকে ভোট দিতে পারেন না। সামান্য টাকার বিনিময়ে তিনি তাঁর ভোট বিক্রি করে দিতে বাধ্য হন অথবা গ্রামের মাতবর বা এলাকার প্রভাবশালী নেতার পছন্দ অনুযায়ী তিনি ভোট দিতে বাধ্য হন। কারণ, সেই মাতবর বা প্রভাবশালী নেতা তাঁকে ‘বিপদে’ রক্ষা করেন, প্রয়োজনের সময় কিছু টাকাপয়সা দেন এবং এক সময় জমি বা ভিটা লিখে নেন।
৭৫ বছর পরে এসে অমর্ত্য সেন স্বাধীনতাকে নতুনভাবে ব্যাখ্যা করেছেন। নেগেটিভ ফ্রিডম, পজিটিভ ফ্রিডম। স্কুলে যাওয়ার অধিকারকে প্রফেসর সেন নেগেটিভ ফ্রিডম বলছেন। এখানে রাষ্ট্রের, সংগঠনের বা ব্যক্তির কাছে থেকে বাধা নেই, কিন্তু বাধা না থাকাই যথেষ্ট নয়। যাঁর স্কুলের বেতন দেওয়ার, বই কেনার টাকা নেই, সে এই স্বাধীনতা কী করবে? সে জন্য তিনি বলছেন, নেগেটিভ ফ্রিডম হলো প্রয়োজনীয় শর্ত; কিন্তু পর্যাপ্ত শর্ত নয়। পজিটিভ ফ্রিডমের মানে হলো আপনি যা মূল্যবান মনে করেন, তা করার বা হওয়ার বাস্তব সক্ষমতা থাকা। এটি শুধু স্বাধীনভাবে থাকতে পারার বিষয় নয়, এটি ক্ষমতায়নের বিষয়।
সেনের ক্যাপাবিলিটি অ্যাপ্রোচ তথা ক্ষমতাপদ্ধতিতে বিবৃত ‘ক্ষমতাসম্পন্ন স্বাধীনতা’র ধারণা আরও গভীর। এটা ব্যাখ্যা করতে তিনি ‘বাস্তব স্বাধীনতা’ শব্দটি ব্যবহার করেন। ব্যক্তি যে ধরনের জীবনকে মূল্যবান মনে করে, সেই জীবনযাপন করার সক্ষমতাই বাস্তব তথা কার্যকর স্বাধীনতা। তিনি জোর দিয়ে বলেন, স্বাধীনতা কেবল অধিকার থাকার বিষয় নয়; বরং সেই অধিকারগুলোকে অর্থবহভাবে ব্যবহার করার উপায় ও পরিবেশ থাকাও জরুরি। যেমন শিক্ষা, স্বাস্থ্যসেবা এবং সামাজিক সহায়তা।
গণতন্ত্রের দৃঢ় সমর্থক লাস্কি পুঁজিবাদী গণতন্ত্রের সমালোচনা করেন। কারণ, পুঁজিবাদী গণতন্ত্রে অর্থনৈতিক ক্ষমতা অভিজাত ও পুঁজিপতি শ্রেণির হাতে কেন্দ্রীভূত থাকে, তাঁরা সম্পদের ওপর নিয়ন্ত্রণ রাখে আর সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ জীবনধারণের জন্য সংগ্রাম করে। এভাবে পুঁজিবাদ শ্রেণি বিভাজন সৃষ্টি করে। এ জন্যই তিনি এই ব্যবস্থাকে অন্যায্য মনে করেন এবং বিশ্বাস করেন, অর্থনৈতিক ক্ষমতার আরও ন্যায্য বণ্টন প্রয়োজন।
লাস্কির মতে, প্রকৃত গণতন্ত্র তখনই সম্ভব, যখন রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক ক্ষমতা সমানভাবে বণ্টিত হয়। গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে অংশগ্রহণমূলক এবং শ্রমজীবী শ্রেণির চাহিদার প্রতি সাড়া দেওয়ার মতো হতে হবে। তিনি সতর্ক করেন, যদি না অর্থনৈতিক ক্ষমতার গণতন্ত্রীকরণ হয়, তবে রাজনৈতিক গণতন্ত্র কার্যকর হয় না। লাস্কি এমন এক অংশগ্রহণমূলক গণতন্ত্রের পক্ষে কথা বলেন, যেখানে শ্রমিক ও প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়ায় বেশি অংশগ্রহণ থাকবে। তিনি বিশ্বাস করেন যে নির্বাচনের বাইরে গণতান্ত্রিক অনুশীলনের সম্প্রসারণ দরকার এবং কর্মক্ষেত্রে গণতন্ত্র ও ট্রেড ইউনিয়নের অংশগ্রহণ একটি ন্যায়সংগত সমাজ গঠনে গুরুত্বপূর্ণ।
লাস্কি এমন একটি সমাজতান্ত্রিক কাঠামোর পক্ষে যেখানে অর্থনৈতিক সম্পদ ব্যক্তিগত স্বার্থের দ্বারা নয়; বরং গণতান্ত্রিকভাবে নিয়ন্ত্রিত হয়। তিনি পুঁজিবাদকে স্বভাবতই শোষণমূলক হিসেবে দেখেন এবং ন্যায় ও সমতা নিশ্চিত করতে প্রধান শিল্পগুলোর যৌথ মালিকানার প্রয়োজনীয়তা বিশ্বাস করেন। তিনি এমন একটি বিশ্বের রূপকল্প রচনা করেন, যেখানে রাষ্ট্রগুলো আন্তর্জাতিক সংস্থার মাধ্যমে সংঘাতের সমাধানে সহযোগিতা করে। তিনি যুদ্ধ ও অর্থনৈতিক শোষণ রোধে বৈশ্বিক শাসনকাঠামোর পক্ষে সমর্থন জানান।
রবীন্দ্রনাথের মতো হেরাল্ড লাস্কিও জাতীয়তাবাদের বিপদ সম্পর্কে আমাদের সতর্ক করেন। তাঁর পর্যবেক্ষণ হলো, জাতীয়তাবাদ প্রায়ই সংঘাত ও যুদ্ধের দিকে নিয়ে যায়। তিনি এমন একটি বিশ্ব কল্পনা করেন, যেখানে রাষ্ট্রগুলো বিরোধ মীমাংসা ও অর্থনৈতিক সমতা এবং শান্তির মতো যৌথ লক্ষ্য অর্জনের জন্য পারস্পরিক সহযোগিতা করবে। তিনি এমন আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠানের প্রতিষ্ঠাকে সমর্থন করেন, যেগুলো বাণিজ্য, শ্রমমান ও মানবাধিকারের নিয়মনীতি নির্ধারণ করবে। তাঁর মতে, শক্তিশালী দেশগুলোর অর্থনৈতিক শোষণকে আন্তর্জাতিক সমাজতান্ত্রিক আন্দোলনের মাধ্যমে চ্যালেঞ্জ করা প্রয়োজন।
সাম্রাজ্যবাদ-উপনিবেশবাদের কঠোর সমালোচক, প্রফেসর লাস্কি যখন বলেন ‘সাম্রাজ্যবাদ-উপনিবেশবাদ পুঁজিবাদী শোষণের সম্প্রসারিত রূপ', তখন তার মধ্যে মার্ক্সীয় তত্ত্বের প্রতিধ্বনি শোনা যায়। উপনিবেশমুক্তি ও নিপীড়িত জাতিগুলোর আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকারের পক্ষে লাস্কির জোরালো অবস্থান আমাদের প্রেরণা জোগায়।
লাস্কির গ্রামার অব পলিটিকস রাজনৈতিক তত্ত্বে একটি প্রভাবশালী রচনা হিসেবে বিবেচিত, যা রাষ্ট্রক্ষমতার সমালোচনা করে, বিকেন্দ্রীকৃত ও গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থার পক্ষে মত দেয়, এবং সমাজতান্ত্রিক নীতির মাধ্যমে অর্থনৈতিক ও সামাজিক ন্যায় প্রতিষ্ঠার আহ্বান জানায়। তাঁর চিন্তাধারা এখনো গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র এবং রাজনৈতিক বহুত্ববাদ নিয়ে আলোচনায় আমাদের উদ্দীপ্ত করে।
এন এন তরুণ অর্থনীতির অধ্যাপক, ইনডিপেন্ডেন্ট ইউনিভার্সিটি বাংলাদেশ, সাউথ এশিয়া জার্নালের এডিটর অ্যাট লার্জ [email protected]
.উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: ব শ ব স কর ন গণত ন ত র ক গণতন ত র র এমন একট র জন ত ক কর ত ত ব ব যবস থ ক ষমত র এমন এক র জন য আম দ র ন একট সরক র গ রহণ
এছাড়াও পড়ুন:
কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা যেভাবে সুষ্ঠু ভোটে বাধা হতে পারে
বাংলাদেশের মতো একটি উন্নয়নশীল দেশে, যেখানে নির্বাচনপ্রক্রিয়া নিয়ে ইতিমধ্যে প্রশ্ন ও চ্যালেঞ্জ রয়েছে, সেখানে এআইয়ের (কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা) ব্যবহার এক নতুন ধরনের হুমকি নিয়ে এসেছে। এটি শুধু প্রচলিত কারচুপির পদ্ধতিগুলোকেই আরও সফিসটিকেটেড বা কৌশলী করে তুলবে না; বরং আমাদের গণতন্ত্রের মূল ভিত্তি যে জনগণের বিশ্বাস, সেটিই নষ্ট করে দিতে পারে।
নির্বাচনে এআইয়ের প্রভাব কোনো কাল্পনিক গল্প নয়, এটি একটি বাস্তব ঝুঁকি। এআই-চালিত টুলগুলো ব্যবহার করে রাজনৈতিক নেতা বা কর্মকর্তাদের অত্যন্ত বিশ্বাসযোগ্য ‘ডিপফেক’ (ভুয়া অডিও, ভিডিও এবং ছবি) তৈরি করা সম্ভব।
এই ডিপফেকগুলো সহজেই মিথ্যা কেলেঙ্কারি ছড়াতে পারে, যা ভোটারদের বিভ্রান্ত করে তাঁদের সিদ্ধান্তকে প্রভাবিত করতে সক্ষম। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে এআই-চালিত বটগুলো সেকেন্ডের মধ্যে এমন সব মিথ্যা তথ্য ছড়িয়ে দিতে পারে, যা একটি রাজনৈতিক দলের জন্য ব্যাপক জনসমর্থনে বা বিরোধিতায় ভূমিকা রাখতে পারে।
যখন জনগণ দেখতে পাবে, তারা যা দেখছে বা শুনছে, তার মধ্যে কোনটা আসল আর কোনটা নকল, তা বোঝা কঠিন, তখন স্বাভাবিকভাবেই তাদের মধ্যে সংবাদমাধ্যম, নির্বাচন কর্তৃপক্ষ এবং পুরো গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ার বিষয়ে সন্দেহ ঢুকে যাবে। এটি একটি দেশের স্থিতিশীলতার জন্য দীর্ঘমেয়াদি হুমকি।
এআই অ্যালগরিদমগুলো বিশাল পরিমাণ ডেটা বিশ্লেষণ করে নির্দিষ্ট ভোটারদের লক্ষ করে তাদের ব্যক্তিগত আগ্রহ ও দুর্বলতা অনুযায়ী রাজনৈতিক বার্তা পাঠাতে পারে। এই ‘মাইক্রো টার্গেটিং’-এর মাধ্যমে ভোটারদের মনোভাবকে প্রভাবিত করা বা নির্দিষ্ট গোষ্ঠীকে ভোটদানের সময় বা স্থান সম্পর্কে ভুল তথ্য ছড়িয়ে দিয়ে তাদের ভোটদান থেকে বিরত রাখাও সম্ভব।
আমাদের গণতন্ত্রকে সুরক্ষিত রাখতে হলে এই নতুন প্রযুক্তির ঝুঁকিগুলো সম্পর্কে সচেতন হতে হবে এবং সময়োপযোগী পদক্ষেপ নিতে হবেএআই শুধু মিথ্যা তথ্য ছড়ানোর মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকে না, এটি নির্বাচনী পরিকাঠামোর ওপর সাইবার হামলাও জোরদার করতে পারে। এআই-চালিত টুলগুলো আরও সফিসটিকেটেড ফিশিং আক্রমণ তৈরি করে নির্বাচনী কর্মকর্তাদের অ্যাকাউন্ট হ্যাক করতে বা এমন ম্যালওয়্যার তৈরি করতে পারে, যা প্রচলিত নিরাপত্তাব্যবস্থা এড়িয়ে যেতে সক্ষম। এ ধরনের আক্রমণ ভোটার ডেটাবেজ বা ভোটিং মেশিনকে লক্ষ্য করে করা যেতে পারে। সেটি নির্বাচনের ফলাফল পরিবর্তন বা পুরো প্রক্রিয়াকে বিঘ্নিত করতে পারে।
প্রশ্ন হচ্ছে, এই বিপত্তির সমাধান কী? এ প্রশ্নের জবাব হিসেবে প্রথমেই মনে রাখা দরকার, এই গুরুতর চ্যালেঞ্জগুলো মোকাবিলায় একটি সমন্বিত ও কার্যকর পদক্ষেপ প্রয়োজন। এখানে এক্সপ্লেইনেবল এআই (এক্সএআই) একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে। এআই মডেলের সিদ্ধান্তগুলো মানুষের কাছে বোধগম্য করে তোলে এক্সএআই। এটি এআইয়ের স্বচ্ছতা বাড়ায়।
ডিপফেক শনাক্তকরণ: এক্সএআই ব্যবহার করে এমন টুল তৈরি করা সম্ভব, যা কেবল ডিপফেক শনাক্ত করে না; বরং কেন একটি বিষয়বস্তু জাল বলে চিহ্নিত হয়েছে, তার বিস্তারিত ব্যাখ্যাও দেয়। এর ফলে মানব ফ্যাক্ট-চেকাররা বিশ্লেষণ যাচাই করতে পারেন এবং জনগণের আস্থা তৈরি হয়।
প্রচারণার নিরীক্ষা: এক্সএআই রাজনৈতিক প্রচারণায় এআই ব্যবহারের নিরীক্ষা করতে পারে। এটি বিশ্লেষণ করে দেখাতে পারে, কীভাবে একটি অ্যালগরিদম তার সিদ্ধান্ত নিয়েছে, যা পক্ষপাতদুষ্ট বা কারসাজিমূলক টার্গেটিং কৌশলগুলো প্রকাশ করতে সাহায্য করে।
নিরাপত্তা বৃদ্ধি: সাইবার নিরাপত্তার ক্ষেত্রে এক্সএআই হুমকির শনাক্তকরণ সিস্টেমকে উন্নত করতে পারে। এটি ব্যাখ্যা করতে পারে, কেন একটি নির্দিষ্ট কার্যকলাপকে ক্ষতিকর বলে মনে করা হয়েছে। এই প্রক্রিয়া নিরাপত্তা বিশেষজ্ঞদের দ্রুত এবং কার্যকরভাবে প্রতিক্রিয়া জানাতে সাহায্য করে।
অংশগ্রহণকারীদের করণীয়: এআইয়ের হুমকি মোকাবিলায় সব গুরুত্বপূর্ণ অংশগ্রহণকারীকে সম্মিলিতভাবে কাজ করতে হবে। প্রথমত, রাজনৈতিক দলগুলো এবং নেতাদের প্রকাশ্যে প্রতিশ্রুতি দিতে হবে, তাঁরা প্রতারণামূলক এআই জেনারেটেড কনটেন্ট বা ভুল তথ্য ছড়ানোর প্রচারে জড়িত হবেন না। তাঁদের উচিত এআইয়ের যেকোনো বৈধ ব্যবহার সম্পর্কে স্বচ্ছ থাকা এবং এআই জেনারেটেড কনটেন্টে সুস্পষ্ট লেবেল ব্যবহার করা। দ্বিতীয়ত, নির্বাচন কমিশনকে রাজনৈতিক প্রচারে এআই ব্যবহারের বিষয়ে সুস্পষ্ট নিয়ম ও প্রবিধান তৈরি এবং প্রয়োগ করতে হবে। তাদের উচিত এআই-চালিত টুলগুলোতে বিনিয়োগ করা এবং ভোটারদের সচেতন করার জন্য বড় আকারের প্রচার চালানো।
এ ছাড়া একটি যৌথ গবেষণা ও উন্নয়ন দল গঠন করা প্রয়োজন, যারা নির্বাচনের আগপর্যন্ত কমিশনকে এআই এবং সাইবার নিরাপত্তা বিষয়ে নিরবচ্ছিন্ন সহায়তা দেবে। তৃতীয়ত, আইন প্রয়োগকারী সংস্থা, সংবাদমাধ্যম এবং সুশীল সমাজকে এআইয়ের হুমকি সম্পর্কে তথ্য আদান-প্রদান করতে একসঙ্গে কাজ করতে হবে। মিথ্যা তথ্য ছড়িয়ে পড়লে তা দ্রুত মোকাবিলা করার জন্য একটি সুস্পষ্ট প্রটোকল স্থাপন করা জরুরি। সংবাদমাধ্যম এবং সুশীল সমাজের উচিত ফ্যাক্ট-চেকিং এবং জনগণের মধ্যে মিডিয়া লিটারেসি বাড়াতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করা।
আমাদের গণতন্ত্রকে সুরক্ষিত রাখতে হলে এই নতুন প্রযুক্তির ঝুঁকিগুলো সম্পর্কে সচেতন হতে হবে এবং সময়োপযোগী পদক্ষেপ নিতে হবে। এআইয়ের ক্ষমতা যেমন বিশাল, তেমনি এর অপব্যবহারের বিপদও কম নয়।
জনগণের বিশ্বাস এবং একটি ন্যায্য নির্বাচনের অধিকার নিশ্চিত করতে এখনই আমাদের সবাইকে এই চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় ঐক্যবদ্ধ হতে হবে। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ হলো, বাংলাদেশ সরকারের একটি সম্মিলিত গবেষণা ও উন্নয়ন (আরএনডি) দল গঠন করা। এই বিশেষজ্ঞ দল এআই-সম্পর্কিত ঝুঁকিগুলো ক্রমাগত বিশ্লেষণ ও অনুমান করবে এবং দৃঢ় সিদ্ধান্ত গ্রহণের জন্য প্রয়োজনীয় তথ্য সরবরাহ করবে।
অধ্যাপক ড. আলমগীর হোসেন এআইয়ের সাবেক অধ্যাপক, যুক্তরাজ্যের কেমব্রিজে অবস্থিত এআরআইটিআইয়ের সাবেক পরিচালক