যশোরের ভবদহ অঞ্চলজুড়ে দীর্ঘদিনের জলাবদ্ধতা মানবিক সংকটে রূপ নিয়েছে। বছরের পর বছর ধরে হাজার হাজার পরিবার পানিবন্দী অবস্থায় দিন কাটাচ্ছে। ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে কৃষি, ভেঙে পড়ছে জীবিকা ও জনজীবনের স্বাভাবিকতা। অথচ এই সংকটের কেন্দ্রে রয়েছে অব্যবস্থাপনাপূর্ণ মৎস্যঘেরশিল্প। এই শিল্প কার্যকরভাবে কোনো নীতিমালার আওতায় আসেনি। এটি ছাড়া কোনোভাবেই ভবদহের সংকট দূর করা সম্ভব নয়, তা আমাদের নীতিনির্ধারকদের বুঝতে হবে।

সরকার ২০১৯ সালে যথাযথভাবে একটি মৎস্যঘের স্থাপন ও ব্যবস্থাপনা নীতিমালা প্রণয়ন করেছিল। কিন্তু সেই নীতিমালা বাস্তবায়িত হয়নি বললেই চলে। সরকারি হিসাবেই দেখা যাচ্ছে, ভবদহ এলাকায় প্রায় ১৮ হাজার মাছের ঘেরের মধ্যে মাত্র ৩২টি ঘের নিবন্ধিত। অধিকাংশ ঘেরমালিক নীতিমালার অস্তিত্বই জানেন না। এটি শুধু সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের অক্ষমতা নয়, চরম উদাসীনতার প্রমাণও বটে।

নীতিমালায় বলা আছে, ঘেরের আয়তন সর্বোচ্চ ১৫ হেক্টর হবে (সমবায় ভিত্তিতে ৫০ হেক্টর)। বাস্তবে দেখা যাচ্ছে, ঘেরের আয়তন ২০০ হেক্টরের বেশি। ঘেরের মাঝখানে পানিনিষ্কাশনের ব্যবস্থাও নেই, বরং একের পর এক বাঁধ দিয়ে প্রাকৃতিক জলপ্রবাহ রুদ্ধ করা হয়েছে। ঘেরমালিকেরা নদীর পাড়, সরকারি খাল—এমনকি সড়কের পাশে পর্যন্ত ঘেরের বাঁধ গড়ে তুলেছেন। এভাবে প্রাকৃতিক এবং কৃত্রিম উভয় ধরনের পানিনিষ্কাশনের পথ বাধাগ্রস্ত হওয়ায় ভবদহ অঞ্চলের জলাবদ্ধতা আরও ভয়াবহ রূপ নিয়েছে।

এই পরিস্থিতির জন্য শুধু ঘেরমালিকেরা নন, প্রশাসনের ব্যর্থতা এবং রাজনৈতিক প্রশ্রয়ও দায়ী। প্রশ্ন ওঠে, স্থানীয় প্রশাসন, পানি উন্নয়ন বোর্ড বা মৎস্য অধিদপ্তরের কাজটা কী? ভবদহের মানুষের দুর্দশা লাঘবে কতটা আন্তরিকতা তারা দেখাতে পেরেছে?

ভবদহের জলাবদ্ধতা নিয়ে প্রথম আলো একের পর এক প্রতিবেদন ও সম্পাদকীয় প্রকাশ করে গেছে বিগত কয়েক বছরে। রাষ্ট্র ও সরকারের দায়িত্বপ্রাপ্ত ব্যক্তিরা ওই এলাকা অনেকবারই পরিদর্শন করেছেন। ভবদহের সংকটের বিষয়টি কারোরই অজানা নয়। এরপরও এ সংকটের নিরসন না হওয়াটা খুবই দুঃখজনক।

সরকারকে অবশ্যই কঠোরভাবে নীতিমালা বাস্তবায়ন করতে হবে। এ ক্ষেত্রে যা করণীয় তা হচ্ছে, অবিলম্বে অবৈধ ঘের চিহ্নিত করে অপসারণ করতে হবে, নিবন্ধনবিহীন ঘের বন্ধে অভিযান চালাতে হবে এবং প্রাকৃতিক জলপ্রবাহ পুনরুদ্ধারে নদী ও খালের বাঁধ সরাতে হবে।

সরকারের প্রতি জোর আহ্বান থাকবে, ভবদহকে উদ্ধার করুন।

.

উৎস: Prothomalo

কীওয়ার্ড: ভবদহ র সরক র

এছাড়াও পড়ুন:

একসময়ের সর্ববৃহৎ প্রকল্প এখন ‘যশোরের দুঃখ’

যশোরের অভয়নগর উপজেলার ভবানিপুর গ্রামের ভবদহে শ্রী নদীর ওপর ২১ কপাট, ৯ কপাট ও ৬ কপাটের স্লুইসগেট পাকিস্তান আমলে সবচেয়ে বড় প্রকল্প ছিল। সময়ের ব্যবধানে সেই প্রকল্প দেখা দিয়েছে ‘যশোরের দুঃখ’ হয়ে। 

সরেজমিনে নদী ঘুরে দেখা গেছে, ২১ গেটের ওপর ১৩টি এবং ৯ গেটের ওপর পাঁচটি মোটর পাম্প বসানো আছে। সঙ্গে আছে চারটি পাওয়ার পাম্প। 

দীর্ঘদিন ধরে নদী খনন করে সে মাটি নদীর মধ্যেই রাখা হয়েছে। ফলে, নদী পরিণত হয়েছে নালাতে। ৯ গেটের সামনে দেখা যায়, নদীর তলদেশ উঁচু হয়ে আছে, কোনোরকমে নালা দিয়ে পানি প্রবাহিত হচ্ছে।

কপালিয়া সেতুর কাছে গিয়ে দেখা গেছে, নদীর প্রস্থ ১০ থেকে ১২ ফুট এবং গভীরতা ৪ থেকে ৫ ফুট। মনে হয়, লাফিয়ে পার হওয়া সম্ভব। 

বরণী শশ্মান ঘাট এলাকায় দেখা যায়, নদীর গভীরতা আছে ৪ থেকে ৫ ফুট। জোয়ারের সময় প্রস্থ হয় ১০ থেকে ১২ ফুট। 

রানায় পালপাড়া ব্রিজের নিচে দেখা যায়, প্রস্থ ২০ থেকে ২৫ ফুট এবং গভীরতা মাত্র ৪ থেকে ৫ ফুট। 

যশোর জেলার মণিরামপুর, কেশবপুর ও অভয়নগর, সদর উপজেলা, খুলনার ফুলতলা, ডুমুরিয়া প্রভৃতি এলাকা মুক্তেশ্বরী-টেকা-শ্রী-হরি এবং আপারভদ্রা-হরিহর- বুড়িভদ্রা নদী দিয়ে বেষ্টিত।

যশোর শহরসহ এ অঞ্চলে বৃষ্টির পানি এসব নদী ও এগুলোর সঙ্গে সংযুক্ত খালের মাধ্যমে ভাটিতে নিষ্কাশিত হয়। মুক্তেশ্বরী-টেকা-শ্রী-হরি এবং আপারভদ্রা-হরিহর-বুড়িভদ্রা নদীর জলপ্রবাহ কেশবপুর উপজেলার কাশিমপুরে মিলিত হয়েছে এবং মিলিত প্রবাহ ভদ্রা-তেলিগাতী-গ্যাংরাইল নামে শিপসা নদীতে পতিত হয়েছে। 

মুক্তেশ্বী-টেকা-হরি ও আপারভদ্রা-হরিহর-বুড়িভদ্রা এবং এগুলোর সঙ্গে সংযুক্ত খালগুলোর মাধ্যমে অভয়নগর, মণিরামপুর, কেশবপুর ও যশোর সদরের (অংশিক) প্রায় ৫৩টি ছোট-বড় বিলের পানি নিষ্কাশিত হয়। 

সমুদ্রের নোনা পানি প্রতিরোধে এবং কৃষিযোগ্য মিঠাপানি ধরে রাখার জন্য ষাটের দশকে হরি-টেকা-শ্রী নদীর অভয়নগর উপজেলার ভবদহ নামক স্থানে ২১ কপাটের স্লুইসগেট নির্মাণ করা হয়। আশির দশক পর্যন্ত ভবদহ স্লুইসের সুফল ভালোভাবে পাওয়া যায়। সত্তরের দশকের পর থেকে এই অঞ্চলের নদীগুলোর মূল উৎস প্রবাহ পদ্মা থেকে বিছিন্ন হওয়ায় সাগরবাহিত পলি উজানের দিকের নদী ও খালের তলদেশে জমা হতে থাকে। শুষ্ক মৌসুমে ভদ্রা-তেলিগাতি নদীর মাধ্যমে সাগর থেকে প্রচুর পলি বাহিত হয়ে হরি-টেকা-মুক্তেশ্বরী নদী ও আপারভদ্রা-হরিহর-বুড়িভদ্রা নদী এবং এগুলোর সংযুক্ত খালগুলোর তলদেশে পড়ে ভরাট হয়ে যাচ্ছে।

ভবদহ পানি নিষ্কাশন সংগ্রাম কমিটির নেতারা জানিয়েছেন, বছর চারেক আগেও ভবদহ স্লুইসগেট থেকে শিপসা নদী হয়ে বড় বড় মাছ ধরার ট্রলার চলাচল করতে পারত। কিন্তু, পানি উন্নয়ন বোর্ডের ভুল সিদ্ধান্তে ভবদহের স্লুসগেট বন্ধ করে সেখানে মোটর ব্যবহার করে পানি নিষ্কাশনের ব্যবস্থা করা হয়। ফলে, জোয়ারের সাথে আসা পলি নদীতেই থেকে যায়। এ সেচ প্রকল্পের ফলেই নদী দ্রুত ভরাট হয়ে যাচ্ছে।

নদীর পাশে পলি জমে থাকা স্থান দখল হতে শুরু করেছে। নদীর পাশ জুড়ে স্থাপন করা হচ্ছে ছোট-বড় মাছের ঘের ও স্থাপনা। এমনকি সরকারি আবাসন প্রকল্পও করা হয়েছে।

এ ব্যাপারে জানতে চাইলে ভবদহ পানি নিষ্কাশন সংগ্রাম কমিটির আহ্বায়ক রনজিত বাওয়ালী বলেছেন, নানা ষড়যন্ত্রে পানি উন্নয়ন বোর্ড এ জনপদকে জিম্মি করে লাভবান হতে চেয়েছে। তবে, তা আর হতে দেওয়া হবে না।

ডুমুরতলা গ্রামের শিবপদ বিশ্বাস বলেছেন, ভবদহের জলাবদ্ধতার সমাধান হলে একটি মহলের আয়ের উৎস বন্দ হবে। পানি উন্নয়ন বোর্ডের কাছ থেকে প্রজেক্ট নিয়ে দুর্নীতি করতে পারবে না।

ভবদহ পানি নিষ্কাশন সংগ্রাম কমিটির উপদেষ্টা ইকবাল কবীর জাহিদ বলেছেন, টিআরএম (নদীতে অবাধ জোয়ার–ভাটার ব্যবস্থা) ছাড়া বিকল্প কোনো উপায়ে ভবদহের জলাবদ্ধতার সমাধান সম্ভব নয়। 

ঢাকা/রফিক

সম্পর্কিত নিবন্ধ

  • মৎস্যঘের স্থাপনে নীতিমালা না মানায় বাড়ছে সংকট
  • একসময়ের সর্ববৃহৎ প্রকল্প এখন ‘যশোরের দুঃখ’