হামলার আগে ইরানে গোপন অভিযান চালায় মোসাদ
Published: 13th, June 2025 GMT
ইসরায়েলের গোয়েন্দা সংস্থা মোসাদের কমান্ডোরা শুক্রবার হামলার আগে ইরানের মধ্যে বেশ কয়েকটি গোপন অভিযান পরিচালনা করেছিলেন। ইসরায়েলি নিরাপত্তা সূত্র এ কথা জানিয়েছে।
গতকাল শুক্রবার সূত্র রয়টার্সকে জানিয়েছে, এসব অভিযানের মধ্যে রয়েছে– ইরানের ভূমি থেকে আকাশে নিক্ষেপযোগ্য ক্ষেপণাস্ত্র ব্যবস্থার কাছাকাছি খোলা জায়গায় নিখুঁত নিয়ন্ত্রিত অস্ত্র মোতায়েন, ইরানের বিমান প্রতিরক্ষা ব্যবস্থার বিরুদ্ধে ব্যবহৃত উন্নত প্রযুক্তি এবং তেহরানের কাছে একটি অ্যাটাক-ড্রোন ঘাঁটি স্থাপন। গতকাল স্থানীয় সময় সকালে ইরানের পরমাণু ও সামরিক স্থাপনা লক্ষ্য করে বড় আকারে হামলা চালায় ইসরায়েল। দেশটির দাবি, তেহরানকে পরমাণু অস্ত্র তৈরি থেকে বিরত রাখার জন্য এই হামলা চালানো হয়েছে।
ইরানের গণমাধ্যম ও প্রত্যক্ষদর্শীরা বেশ কয়েকটি স্থানে বিস্ফোরণের তথ্য দিয়েছেন, যার মধ্যে আছে তেহরানের মূল ইউরেনিয়াম পরিশোধন কেন্দ্র। তবে ইসরায়েলি হামলায় কী অস্ত্র ব্যবহার হয়েছে, তা এখনও স্পষ্ট নয়। ইসরায়েল এই সামরিক অভিযানের নাম দিয়েছে ‘রাইজিং লায়ন’ (উদীয়মান সিংহ)।
মোসাদের গত ২০ বছরের হিসাব এটি। শুধু ২০১০ থেকে ২০১২ সাল পর্যন্ত এই দুই বছরে চার ইরানি বিজ্ঞানীকে হত্যা করেছে মোসাদ। এসব হত্যাকাণ্ডে যেসব অত্যাধুনিক পদ্ধতি ব্যবহার করেছে মোসাদ, তা সত্যি চোখ কপালে তুলে দেওয়ার মতো।
আজকের ইরান-ইসরায়েলের মাঝে যে চরম বৈরী সম্পর্ক, অতীতে কিন্তু পরিস্থিতি এমন ছিল না। ইসরায়েলের জন্মলগ্নে ইরান এবং ইহুদিবাদী এ দেশটি ছিল একে অপরের বন্ধু। এমনকি ১৯৪২ সালে যখন ইসরায়েল রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা হয়, তখন তুরস্কের পর ইসরায়েলকে স্বীকৃতি দেওয়া দ্বিতীয় মুসলিম দেশটি ছিল ইরান।
১৯৫০ সালে ইসরায়েলকে এ স্বীকৃতি দেয় তেহরান। ক্রমে দুই দেশের মধ্যে গড়ে ওঠে অর্থনৈতিক এমনকি সামরিক সম্পর্কও। আরও অবাক করার মতো তথ্য হচ্ছে, মোসাদের প্রত্যক্ষ সহযোগিতাতেই ১৯৫৭ সালে প্রতিষ্ঠিত হয় ইরানের গোয়েন্দা সংস্থা সাভাক।
দুই দেশের গভীর এ সম্পর্ক ভেঙে পড়ে মূলত ১৯৭৯ সালে ইরানে ইসলামী বিপ্লবের পর। সেই সময় ক্ষমতায় আসা ইরানের বিপ্লবী সরকার রাষ্ট্রীয়ভাবে ফিলিস্তিনিদের পক্ষ নেওয়ার ঘোষণা দেয়। শিয়া সম্প্রদায়ের তৎকালীন আধ্যাত্মিক নেতা আয়াতুল্লাহ খোমেনি এবং তাঁর অনুসারীরা ছিলেন ফিলিস্তিনে ইহুদি রাষ্ট্র ইসরায়েল প্রতিষ্ঠার পুরোপুরি বিরুদ্ধে।
ইরানের সঙ্গে ইসরায়েলের সম্পর্ক খারাপ হওয়ার পেছনে দুটি কারণ চিহ্নিত করেছেন বিশ্লেষকরা। প্রথমত, ইরানের দূরপাল্লার মিসাইল তৈরির চেষ্টা। দ্বিতীয়ত, পরমাণু প্রকল্প গ্রহণ। আসলে দ্বিতীয় কারণটিই যে ইসরায়েলের রাতের ঘুম হারাম করে দিয়েছে, তা বলার অপেক্ষা রাখে না। ফলে স্বাভাবিকভাবেই ইরানের সামরিক উচ্চাকাঙ্ক্ষা, বিশেষত পরমাণু প্রকল্প ভেস্তে দিতে নানা অন্তর্ঘাতমূলক পদক্ষেপ নিতে শুরু করে ইসরায়েল। প্রথম পদক্ষেপে ইরানের পরমাণু বিজ্ঞানীদের টার্গেট করে মোসাদ। পরমাণু প্রকল্পের শীর্ষ বিজ্ঞানীরা গুপ্তহত্যার শিকার হতে থাকেন একের পর এক। এর পাশাপাশি তেহরানের পরমাণু কর্মসূচির দিকেও নজর রাখতে শুরু করে তেল আবিব।
.উৎস: Samakal
কীওয়ার্ড: ইসর য় ল ইসর য় ল র পরম ণ
এছাড়াও পড়ুন:
এপ্রিল যে কারণে নির্বাচনের অনুপযুক্ত মৌসুম
গত ৬ জুন অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস জাতির উদ্দেশে দেওয়া ভাষণে আগামী এপ্রিলের প্রথমার্ধে জাতীয় নির্বাচন হবে বলে ঘোষণা দিয়েছেন। এই ঘোষণার ভিত্তিতে নির্বাচন কমিশন উপযুক্ত সময়ে নির্বাচনের বিস্তারিত রোডম্যাপ দেবে বলেও জানিয়েছেন তিনি।
মজার বিষয় হলো, তাঁর এ ঘোষণা এতদিন যারা নির্বাচনের সুনির্দিষ্ট রোডম্যাপ বা পথনকশা দাবি করছিল তাদের হতাশ করেছে। আর যারা ‘দৃশ্যমান’ সংস্কার ও বিচার প্রক্রিয়ার আগে নির্বাচন নয় বলে কার্যত অন্তর্বর্তী সরকারের মেয়াদ বৃদ্ধির দাবি করছিল, তাদের খুশি করেছে। প্রথম পক্ষে আছে বিএনপি ও তার মিত্র দলগুলোর সঙ্গে বাম দলগুলো। দ্বিতীয় পক্ষে আছে জামায়াতে ইসলামী, নবগঠিত এনসিপি এবং তাদের সমমনা দলগুলো।
প্রথম পক্ষের দলগুলো অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব গ্রহণের কিছুদিন পর থেকেই নির্বাচনের পথনকশা দাবি করছিল। এক পর্যায়ে তারা সুনির্দিষ্টভাবে এ বছরের ডিসেম্বরে মধ্যে নির্বাচন অনুষ্ঠানের পক্ষে জনমত গড়ে তোলা শুরু করে। সংস্কার ও গণঅভ্যুত্থানকালে সংঘটিত হত্যাকাণ্ডের বিচার সম্পর্কেও তাদের বক্তব্য স্পষ্ট। তারা বলেছে, সংস্কার একটা ‘চলমান প্রক্রিয়া’। সুষ্ঠু ও অবাধ নির্বাচনের স্বার্থে যতটুকু প্রয়োজন ততটুকু সংস্কার শেষে ডিসেম্বরের আগেই নির্বাচন করা যায়। আর বিচার যেহেতু করছেন আদালত, সেখানে বিচারকে নির্বাচনের পূর্বশর্ত করা হলে শুধু আদালতই চাপে পড়বেন না; বিচার প্রক্রিয়াও প্রশ্নবিদ্ধ হবে। এ প্রেক্ষাপটে নির্বাচন এপ্রিলে গেলে তাদের হতাশ হওয়াই স্বাভাবিক।
নির্বাচনের ঘোষিত সময় নিয়ে হতাশার কারণ তো মোটামুটি বোঝা গেল। কিন্তু যারা, এমনকি প্রধান উপদেষ্টা যখন বারবার বলেছেন– ২০২৬ সালের জুনের ৩০ তারিখের পর এক দিনও ক্ষমতায় থাকবেন না; তখনও নির্বাচনের তারিখ নিয়ে মাথা ঘামাননি তারা, এপ্রিলেই সন্তুষ্ট কেন?
এর দুটি কারণ থাকতে পারে। প্রথমত, এ দলগুলো অন্তর্বর্তী সরকারের কড়া সমর্থক, এমনকি কথিত মানবিক করিডোর এবং চট্টগ্রাম বন্দর ব্যবস্থাপনা মার্কিন কোম্পানির হাতে তুলে দেওয়ার সরকারি ভাবনাতেও তারা বিএনপি ও বাম দলগুলোর মতো বিচলিত নয়। তাই কর্তা যা করবেন তাতেই খুশি তারা।
দ্বিতীয়ত, বাংলাদেশের প্রাকৃতিক ও সামাজিক-সাংস্কৃতিক বাস্তবতা অনুসারে এপ্রিল নির্বাচনের জন্য একেবারেই উপযুক্ত সময় নয়। ওই সময়ে নির্বাচন আয়োজিত হলে এমনকি জনগণের মধ্য থেকেই এর বিরোধিতা হতে পারে। নির্বাচনটি চলে যেতে পারে নভেম্বর-ডিসেম্বরে, যা ঝুলে যাওয়ারই নামান্তর। দ্বিতীয় পক্ষের ধারণা, এমন পরিস্থিতিতে নির্বাচন হলে তাদের ভাগ্য খুলে যেতে পারে। কারণ ততদিনে তারা নির্বাচন জয়ের কার্যকর কোনো ‘মেকানিজম’ পেতে পারে। উপরন্তু অনেকের ধারণা, নির্বাচন যত দেরিতে হবে ততই সম্ভাব্য বিজয়ী বিএনপির জনপ্রিয়তা হ্রাস পাবে; বিশেষত দলটির নেতাকর্মীর নানা নেতিবাচক কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে পড়ার কারণে। আমার বিবেচনায়, এ কারণকেই বরং নির্বাচনের এপ্রিল সময়সীমাকে দ্বিতীয় পক্ষের স্বাগত জানানোর মূল কারণ হিসেবে দেখা যেতে পারে।
মনে রাখতে হবে, জাতীয় তো বটেই, স্থানীয় নির্বাচনের জন্যও এ দেশে বরাবরই শীতকালকে আদর্শ মনে করা হয়। অন্যদিকে এপ্রিল হলো নানা প্রাকৃতিক দুর্যোগের মাস। ১৯৯১ সালের ভয়ংকর ২৯ এপ্রিলের কথা নিশ্চয় অনেকের স্মরণে আছে। এই দিনে ‘ম্যারি এন’ নামে এক প্রলয়ংকরী ঘূর্ণিঝড়ে সরকারি হিসাবেই মৃতের সংখ্যা ছিল ১ লাখ ৩৮ হাজার; বেসরকারি হিসাবে যা ছিল দ্বিগুণ। মারা যায় ২০ লাখ গবাদি পশু। এপ্রিলে তাপমাত্রাও থাকে বছরের সর্বোচ্চ পর্যায়ে। যে বোরো মৌসুমে প্রধান খাদ্য চালের দুই-তৃতীয়াংশেরও বেশি পাওয়া যায়, এপ্রিল হলো সেই মৌসুমের শেষ পর্যায়। প্রথমত ধানগাছের চূড়ান্ত পরিচর্যা এ সময়ে করতে হয়। ধান কাটারও সময় শুরু হয় এ মাসের শেষার্ধে। এত এত ঝামেলা ও ব্যস্ততার মধ্যে কে কার কথা মনোযোগ দিয়ে শুনবে? প্রার্থীর মনোযোগ থাকবে না ভোটারের দিকে; ভোটার মনোযোগ দিতে পারবে না প্রার্থী বিচারে।
শুধু কি তাই? আগামী বছর রমজান শুরু হবে ফেব্রুয়ারির মাঝামাঝি থেকে। অর্থাৎ ঈদুল ফিতর হবে মার্চের মাঝামাঝিতে। তার সঙ্গে আছে উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষা গ্রহণের জাতীয় ব্যস্ততা।
প্রধান উপদেষ্টা তাঁর ভাষণে বলেছেন, ‘ইতিহাসের সবচেয়ে অবাধ, সুষ্ঠু, প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন আয়োজনের জন্য’ তিনি সব পক্ষের সঙ্গে আলোচনা করেছেন। অথচ ইতোমধ্যে দু’একটি দলের প্রতি তাঁর সরকারের পক্ষপাতমূলক আচরণ নিয়ে রাজনৈতিক অঙ্গনে উঠেছে প্রশ্ন। এসব অভিযোগকারীর মধ্যে বিএনপিও আছে। সময়ের সঙ্গে এ অভিযোগ গভীরতা পাবে না, তা-ই বা কে বলতে পারে! তখন তো নতুন নিরপেক্ষ সরকারের দাবিও উঠতে পারে, যা নতুন এক রাজনৈতির সংকটের জন্ম দেবে।
সম্প্রতি বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমেদ বিবিসি বাংলাকে বলেছেন, সরকার তাদের দলের সঙ্গে ‘বিমাতাসুলভ’ আচরণ করছে। অন্যদিকে জামায়াতে ইসলামীর আমির শফিকুর রহমান আগামী নির্বাচনে ‘সম্ভাব্য ডাকাতি’ বিষয়ে হুঁশিয়ার করেছেন। এগুলো কিন্তু সম্ভাব্য সেই সংকটেরই আলামত।
প্রধান উপদেষ্টার নেতৃত্বাধীন জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সহসভাপতি অধ্যাপক আলী রীয়াজ বলেছেন, রাজনৈতিক দলগুলোর সহযোগিতা অব্যাহত থাকলে আগামী মাসের মধ্যেই ‘জুলাই সনদ’সহ সংস্কার কর্মসূচিগুলো চূড়ান্ত করা সম্ভব হবে। প্রধান উপদেষ্টার ইতোপূর্বে দেওয়া প্রতিশ্রুতি অনুসারে, এর পরই গোটা দেশ নির্বাচন প্রক্রিয়ায় ঢুকে যাওয়ার কথা। কিন্তু সাম্প্রতিক ভাষণে ড. ইউনূস বলেছেন, জুলাই সনদ অনুযায়ী আশু করণীয় সংস্কার কাজগুলো বাস্তবায়নের পাশাপাশি বাকি অংশের বেশ কিছু কাজও তারা শুরু করে যেতে চান। সে বিবেচনায় আগামী রোজার ঈদের মধ্যে সংস্কার ও বিচার বিষয়ে তারা একটি গ্রহণযোগ্য জায়গায় পৌঁছতে পারবেন বলে তিনি বিশ্বাস করেন। এগুলোও প্রধান উপদেষ্টার এপ্রিল সময়সীমা নিয়ে জনমনে সন্দেহের উদ্রেক ঘটানোর জন্য যথেষ্ট।
প্রধান উপদেষ্টা তাঁর ভাষণে বলেছেন, ‘আমরা চাই আগামী নির্বাচনে সবচেয়ে বেশি ভোটার, সবচেয়ে বেশি প্রার্থী ও দল অংশ নিক’ (বিবিসি নিউজ বাংলা)। প্রধান উপদেষ্টার এ বক্তব্যের যথার্থতা প্রমাণের জন্যও তাঁকে নির্বাচনের জন্য জনগণকে আগামী শীত মৌসুমের পর অপেক্ষায় রাখা ঠিক হবে না। তিনি দেশবাসীর প্রতি ‘যেসব সংস্কার প্রশ্নে ঐকমত্য অর্জিত হয়েছে তা কোনো প্রকার কাটাছেঁড়া ছাড়া’ যেন নির্বাচিত সরকার বাস্তবায়ন করে, তা নিশ্চিত করতে যে আহ্বান জানিয়েছেন সেটাই বরং বেশি গ্রহণযোগ্য।
সাইফুর রহমান তপন: সহকারী সম্পাদক, সমকাল