রেনু বেগমের ‘বুকভাসা চোখের পানি’ কেন
Published: 15th, June 2025 GMT
‘৩২ বছর ধরে পঙ্গু স্বামীক নিয়া ঘর করি। শ্বশুরের ১৪ একর জমি ছিল। সোগ নদীতে গেইচে। অগেও দুইবার বাড়ি ভাঙছে। এ বছরও বাড়ি ভাঙি যাইবে। খালি আল্লাহর কাছে কান্দি আর কই, আল্লাহ হামাক বাঁচান। হামার বাড়িটা ভাঙি যায়, তবুও কেউ রক্ষা করিল না।’ ঈদের আগের রাতে রেনু বেগম কাঁদতে কাঁদতে কথাগুলো বলছিলেন।
কুড়িগ্রাম জেলার রাজারহাট উপজেলার ঘড়িয়ালডাঙা ইউনিয়নের বুড়িরহাটে তিস্তা নদীসংলগ্ন রেনু বেগমের বাড়ি। তাঁদের বাড়িটি নদীগর্ভে বিলীন হতে পারে, এ খবর পেয়ে ঈদের আগের রাতে সেখানে গিয়েছিলাম। রেনু বেগম ঘড়িয়ালডাঙা ইউনিয়নের সংরক্ষিত আসনে দুইবার নির্বাচিত সদস্য ছিলেন। তৃতীয়বার ৫৯ ভোটে হেরেছেন। তাঁর হেরে যাওয়ার পরের বছর বাড়ি ভাঙতে শুরু করে। তাঁর থাকার টিনের ঘরের একাংশ বর্তমানে ভাঙনের মধ্যে পড়েছে। রেনু বেগমকে সহায়তা করার কেউ নেই। বরং এক মেয়ে ঘরজামাইসহ থাকেন। আরেক মেয়ে বিধবা হয়েছেন। তাঁর মেয়েকেও পালনের দায়িত্ব তাঁর কাঁধে।
ঈদের আগের রাতে রেনু বেগমের বাড়ি রক্ষা করা যাবে কি না, বুঝতে পারছিলাম না। এটা বুঝতে পারছিলাম, বাড়িটি রক্ষা করতে হলে রাতেই প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করা জরুরি। তিস্তায় কখন পানি বাড়বে, এটি বলা কঠিন। ঈদের রাতে ফোন দেওয়ার বিষয়ে উচিত-অনুচিত না ভেবে আমি পানি উন্নয়ন বোর্ডের রংপুর বিভাগের প্রধান প্রকৌশলী মাহবুবুর রহমানকে ফোন দিই। বিষয়টি জানিয়ে ব্যবস্থা গ্রহণের অনুরোধ করি। আরও কয়েকজন সংশ্লিষ্ট প্রকৌশলীর সঙ্গেও কথা বলি। রংপুরের প্রধান প্রকৌশলী আমাকে জানান, রাতেই কাজ শুরু করবেন। কখন কাজ শুরু হবে, আমি সেই অপেক্ষায় থাকি। অপেক্ষার ফাঁকে রেনু বেগমের সঙ্গে অনেক বিষয়ে কথা হয়।
রেনু বেগম এখন যে বাড়িতে আছেন, তাঁর গোয়ালঘর গত বছরে ভেঙে গেছে। এ বছর ভেঙেছে রান্নাঘর। অবস্থাসম্পন্ন গৃহস্থ ছিলেন রেনু বেগমরা। নদীর ভাঙনে নিঃস্ব। তাঁদের অনেক জিনিসপত্র ছিল। সেগুলো ছিল রান্নাঘরে। কয়েক দিন আগে রাতে বাড়িতে কোনো পুরুষ মানুষ ছিলেন না। প্রচণ্ড ঝড় ছিল। সারা রাত বাতাস। বাড়িও নদীসংলগ্ন। জোরে জোরে কেঁদে কেবল আল্লাহকে ডেকেছেন রেনু বেগম। বাতাসে ঘরের চাল উড়ে যাওয়ার শব্দ পেয়ে আরও আতঙ্কিত হয়েছেন।
একটি ঘরের বেড়া ভেঙে গেছে। এমন শব্দ শুনে তিনি এক মেয়ে ও তিন নাতনিকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরেছিলেন। সকালে উঠে দেখেন, তাঁর রান্নাঘর সম্পূর্ণটাই নদীতে চলে গেছে। চেয়ার-টেবিলসহ অনেক ফার্নিচার, প্রয়োজনীয় আসবাব—কিছুই ধরে রাতে পারেননি। মুরগি ছিল, সেগুলোও আর পাননি। রেনু বেগম বলেছিলেন, ‘আমি অনেককে বলছিল, বাহে হামার বাড়িটা বাঁচে দাও। মানুষের মনে কোনো মায়া নাই। যদি মানুষের জন্য মায়া না থাকে, তাহলে তারা কিসের মানুষ? রাইতে ঘুমাই না। কখন যে বাড়ি ভাঙি যায়, সেটাই ভয়।’
প্রতিবছর নদীভাঙনের শিকার মানুষগুলোর আর্থিক ক্ষতির কোনো পরিসংখ্যান রাখা না হলেও সেই ক্ষতি নিয়ে কথা হয়। ক্ষতির পরিমাণ নির্ধারণ করারও চেষ্টা হয়। কিন্তু নদীভাঙনে যে মানবিক ক্ষতি, সেই ক্ষতি কি পরিমাপ করা যায়? নদীপারের একজন মানুষেরও বাড়ি নদীগর্ভে আর বিলীন না হোক। নদীভাঙনের বিপর্যয় থেকে বাংলাদেশ মুক্ত হোক। রেনু বেগমদের বুকে যেন চোখের পানি আর না জমে।আকাশে মেঘ তখন চাঁদের সঙ্গে লুকোচুরি খেলছিল। রাতও গভীর হচ্ছিল। নদীর দিকে ঘন অন্ধকার। আমার সঙ্গে হামিদুল নামের একজন গিয়েছিল। তার কথার স্বরে বুঝতে পারছিলাম, সে রেনু বেগমের এই কষ্টের কথা নিতে পারছে না। আমি রেনু বেগমের সঙ্গে যতই কথা বলছিলাম, আমার বুকটাও কষ্টে ভারী হয়ে উঠছিল। একের পর এক কষ্টের কথা বলছিলেন তিনি। একজন মানুষ কত কষ্ট নিয়ে বেঁচে থাকতে পারে?
পরিবারের জন্য অন্যের বাড়িতে প্রায় এক যুগ কাজ করেছেন তিনি। ওই বাড়িতে একবার লোহার শলাকা ওপর থেকে মাথার ভেতরে ঢুকে গিয়েছিল। দুই দিন জ্ঞান ফেরেনি। তাঁর নাকি বাঁচারই কথা ছিল না। মাথায় হাত দিয়ে ক্ষতের জায়গা দেখাচ্ছিলেন রেনু বেগম।
প্রসঙ্গ পাল্টানোর জন্য তাঁর অন্য আত্মীয়ের খবর জিজ্ঞেস করেছিলাম। তখন আরেক কষ্টের ঝুড়ি খুললেন। তাঁর স্বামীরা ছয় ভাই ছিলেন। নদীভাঙনের কবলে পড়ে একেকজন একেক দিকে গেছেন। এক ভাই চলে যান কুমিল্লায় কাজ করতে। সেখানেই মারা গেছেন। এক ভাই কাজের সন্ধানে যান দিনাজপুরে। এক ভাই রাজারহাটে অন্য খানে কাজ করেন। দুই ভাই ১০ শতক জমি ভাড়া নিয়ে সেখানে থাকেন। এই বাড়ি ভেঙে গেলে তাঁরা চলে যাবেন ঢাকায়। ঢাকায় কোথায় যাবেন, কী করবেন, তা তিনি জানেন না।
ঈদের দিন কী করবেন, এ কথা জিজ্ঞেস করতেই আবারও কাঁদতে কাঁদতে বলেন, ‘খাওয়ার কিচ্ছু নাই। বাপের বাড়ি থাকি আইজ ৫০০ টাকা আনছি। কী করমো, জানি না। আল্লাক কই, আল্লাহ হামাক তুলি নেও। আমার বুকভরা চোখের পানি। আমার কোনো সুখ নাই বাবা।’ এরই মধ্যে যাঁরা নদীভাঙন রোধে কাজ করেন, তাঁদের একজন এসে হাজির হন। প্রধান প্রকৌশলী মাহবুবুর রহমান তাঁকে পাঠিয়েছেন।
মাহবুবুর রহমান রংপুর থেকে ঈদের রাতে ৪০ কিলোমিটার দূরে বুড়ির হাটে আসতে চেয়েছিলেন। কাজ শুরু হওয়ায় আর আসতে হয়নি। প্রকৌশলীদের সম্পর্কে হাজারও খারাপ কথার মধ্যে তাঁর আন্তরিকতাটুকু মনে রাখার মতো। তিনি কঠোর নির্দেশনা দিয়ে ভাঙন বন্ধে কাজের নির্দেশনা দিয়েছেন। এ বছর পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান চান, তিস্তায় যেন একটি বাড়িও না ভাঙে। তার জন্য যে ব্যবস্থা নিতে হয়, তিনি তা-ই সে ব্যবস্থা নিতে চান।
বাড়িটি আর কতদিন টিকে থাকবে.উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: ব যবস থ র জন য ক জ কর আল ল হ ব গম র বলছ ল
এছাড়াও পড়ুন:
সংগীতশিল্পী দীপ মারা গেছেন
রাস্টফ ব্যান্ডের ভোকাল আহরার মাসুদ মারা গেছেন। সেমাবার (১৫ সেপ্টেম্বর) দিবাগত রাতে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন (ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন)। ভক্তদের কাছে দীপ নামে পরিচিত ছিলেন আহরার মাসুদ।
মঙ্গলবার (১৬ সেপ্টেম্বর) সকাল ৮টায় ব্যান্ডের অফিশিয়াল ফেসবুক পেজে এ তথ্য জানানো হয়। তবে এ শিল্পীর মৃত্যুর কারণ সম্পর্কে কিছু জানা যায়নি।
আরো পড়ুন:
৫০ শয্যার থানচি হাসপাতাল চলছে একজন চিকিৎসকে
সিজেএফবি পারফরম্যান্স অ্যাওয়ার্ড ঘোষণা
রাস্টফ ব্যান্ডের ফেসবুক পেজে দীপের মৃত্যুর খবর জানিয়ে লেখা হয়, “এমন এক বেদনাদায়ক মুহূর্তে সঠিক শব্দ খুঁজে পাওয়া বা কোনো শব্দ খুঁজে পাওয়া—প্রায় অসম্ভব। প্রিয় ভোকালিস্ট, বন্ধু ও সহযাত্রী আহারার ‘দীপ’ মাসুদের মৃত্যুসংবাদ আমাদের স্তম্ভিত করেছে। আমরা শোকে ভেঙে পড়েছি, এখনো অবিশ্বাসের ভেতর ডুবে আছি। গত রাতেই তিনি আমাদের ছেড়ে চিরবিদায় নিয়েছেন।”
দীপের শূন্যতা ব্যাখ্যা করে লেখা হয়, “তার পরিবার, বন্ধু ও প্রিয়জনদের প্রতি আমাদের অন্তরের সমবেদনা ও প্রার্থনা। আপনাদের মতো আমরাও এই অপূরণীয় ক্ষতি বোঝার চেষ্টা করছি, চেষ্টা করছি দীপের অসাধারণ প্রতিভাকে সম্মান জানাতে এবং তার চেয়েও বড় কথা—মানুষ হিসেবে তিনি আমাদের কাছে যে অমূল্য ছিলেন, তাকে স্মরণ করতে। এই কঠিন সময়ে সবার কাছে অনুরোধ, দয়া করে পরিবার ও কাছের মানুষদের ব্যক্তিগত পরিসরকে সম্মান করুন এবং তার আত্মার শান্তির জন্য প্রার্থনা করুন। শান্তিতে ঘুমাও, দীপ। তোমার শূন্যতা চিরকাল বেদনাময় হয়ে থাকবে।”
তরুণদের কাছে জনপ্রিয় আরেকটি ব্যান্ড পাওয়ারসার্চও দীপের মৃত্যুতে শোক প্রকাশ করেছে। ব্যান্ডের অফিশিয়াল ফেসবুক পেজে লেখা হয়েছে, “স্মরণ করছি আহরার মাসুদ দীপকে। কিছুক্ষণ আগে আমরা হারিয়েছি আমাদের প্রিয় ভাই, ঘনিষ্ঠ বন্ধু এবং এক সত্যিকারের শিল্পীকে। এক্লিপস, কার্ল, ক্যালিপসো ও সবশেষ রাস্টফ ব্যান্ডের অবিস্মরণীয় কণ্ঠ আহরার মাসুদ দীপ আমাদের মাঝে আর নেই। ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন।”
পাওয়ারসার্চ আরো লেখেন, “আহরার মাসুদ দীপ শুধু একজন ভোকালিস্টই ছিলেন না, তিনি ছিলেন শক্তি, সৃজনশীলতা আর আবেগের প্রতীক, যিনি তার চারপাশের সবাইকে অনুপ্রাণিত করেছেন; একই সাথে তার অত্যন্ত নমনীয় ব্যবহার, যা সবাইকে তাঁর শুভাকাঙ্ক্ষীই করে ফেলত! শান্তিতে থাকো ভাই, তুমি সব সময় আমাদের গল্পের অংশ হয়ে থাকবে।”
ঢাকা/শান্ত