‘৩২ বছর ধরে পঙ্গু স্বামীক নিয়া ঘর করি। শ্বশুরের ১৪ একর জমি ছিল। সোগ নদীতে গেইচে। অগেও দুইবার বাড়ি ভাঙছে। এ বছরও বাড়ি ভাঙি যাইবে। খালি আল্লাহর কাছে কান্দি আর কই, আল্লাহ হামাক বাঁচান। হামার বাড়িটা ভাঙি যায়, তবুও কেউ রক্ষা করিল না।’ ঈদের আগের রাতে রেনু বেগম কাঁদতে কাঁদতে কথাগুলো বলছিলেন।

কুড়িগ্রাম জেলার রাজারহাট উপজেলার ঘড়িয়ালডাঙা ইউনিয়নের বুড়িরহাটে তিস্তা নদীসংলগ্ন রেনু বেগমের বাড়ি। তাঁদের বাড়িটি নদীগর্ভে বিলীন হতে পারে, এ খবর পেয়ে ঈদের আগের রাতে সেখানে গিয়েছিলাম। রেনু বেগম ঘড়িয়ালডাঙা ইউনিয়নের সংরক্ষিত আসনে দুইবার নির্বাচিত সদস্য ছিলেন। তৃতীয়বার ৫৯ ভোটে হেরেছেন। তাঁর হেরে যাওয়ার পরের বছর বাড়ি ভাঙতে শুরু করে। তাঁর থাকার টিনের ঘরের একাংশ বর্তমানে ভাঙনের মধ্যে পড়েছে। রেনু বেগমকে সহায়তা করার কেউ নেই। বরং এক মেয়ে ঘরজামাইসহ থাকেন। আরেক মেয়ে বিধবা হয়েছেন। তাঁর মেয়েকেও পালনের দায়িত্ব তাঁর কাঁধে।

ঈদের আগের রাতে রেনু বেগমের বাড়ি রক্ষা করা যাবে কি না, বুঝতে পারছিলাম না। এটা বুঝতে পারছিলাম, বাড়িটি রক্ষা করতে হলে রাতেই প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করা জরুরি। তিস্তায় কখন পানি বাড়বে, এটি বলা কঠিন। ঈদের রাতে ফোন দেওয়ার বিষয়ে উচিত-অনুচিত না ভেবে আমি পানি উন্নয়ন বোর্ডের রংপুর বিভাগের প্রধান প্রকৌশলী মাহবুবুর রহমানকে ফোন দিই। বিষয়টি জানিয়ে ব্যবস্থা গ্রহণের অনুরোধ করি। আরও কয়েকজন সংশ্লিষ্ট প্রকৌশলীর সঙ্গেও কথা বলি। রংপুরের প্রধান প্রকৌশলী আমাকে জানান, রাতেই কাজ শুরু করবেন। কখন কাজ শুরু হবে, আমি সেই অপেক্ষায় থাকি। অপেক্ষার ফাঁকে রেনু বেগমের সঙ্গে অনেক বিষয়ে কথা হয়।

রেনু বেগম এখন যে বাড়িতে আছেন, তাঁর গোয়ালঘর গত বছরে ভেঙে গেছে। এ বছর ভেঙেছে রান্নাঘর। অবস্থাসম্পন্ন গৃহস্থ ছিলেন রেনু বেগমরা। নদীর ভাঙনে নিঃস্ব। তাঁদের অনেক জিনিসপত্র ছিল। সেগুলো ছিল রান্নাঘরে। কয়েক দিন আগে রাতে বাড়িতে কোনো পুরুষ মানুষ ছিলেন না। প্রচণ্ড ঝড় ছিল। সারা রাত বাতাস। বাড়িও নদীসংলগ্ন। জোরে জোরে কেঁদে কেবল আল্লাহকে ডেকেছেন রেনু বেগম। বাতাসে ঘরের চাল উড়ে যাওয়ার শব্দ পেয়ে আরও আতঙ্কিত হয়েছেন।

একটি ঘরের বেড়া ভেঙে গেছে। এমন শব্দ শুনে তিনি এক মেয়ে ও তিন নাতনিকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরেছিলেন। সকালে উঠে দেখেন, তাঁর রান্নাঘর সম্পূর্ণটাই নদীতে চলে গেছে। চেয়ার-টেবিলসহ অনেক ফার্নিচার, প্রয়োজনীয় আসবাব—কিছুই ধরে রাতে পারেননি। মুরগি ছিল, সেগুলোও আর পাননি। রেনু বেগম বলেছিলেন, ‘আমি অনেককে বলছিল, বাহে হামার বাড়িটা বাঁচে দাও। মানুষের মনে কোনো মায়া নাই। যদি মানুষের জন্য মায়া না থাকে, তাহলে তারা কিসের মানুষ? রাইতে ঘুমাই না। কখন যে বাড়ি ভাঙি যায়, সেটাই ভয়।’

প্রতিবছর নদীভাঙনের শিকার মানুষগুলোর আর্থিক ক্ষতির কোনো পরিসংখ্যান রাখা না হলেও সেই ক্ষতি নিয়ে কথা হয়। ক্ষতির পরিমাণ নির্ধারণ করারও চেষ্টা হয়। কিন্তু নদীভাঙনে যে মানবিক ক্ষতি, সেই ক্ষতি কি পরিমাপ করা যায়? নদীপারের একজন মানুষেরও বাড়ি নদীগর্ভে আর বিলীন না হোক। নদীভাঙনের বিপর্যয় থেকে বাংলাদেশ মুক্ত হোক। রেনু বেগমদের বুকে যেন চোখের পানি আর না জমে।

আকাশে মেঘ তখন চাঁদের সঙ্গে লুকোচুরি খেলছিল। রাতও গভীর হচ্ছিল। নদীর দিকে ঘন অন্ধকার। আমার সঙ্গে হামিদুল নামের একজন গিয়েছিল। তার কথার স্বরে বুঝতে পারছিলাম, সে রেনু বেগমের এই কষ্টের কথা নিতে পারছে না। আমি রেনু বেগমের সঙ্গে যতই কথা বলছিলাম, আমার বুকটাও কষ্টে ভারী হয়ে উঠছিল। একের পর এক কষ্টের কথা বলছিলেন তিনি। একজন মানুষ কত কষ্ট নিয়ে বেঁচে থাকতে পারে?

পরিবারের জন্য অন্যের বাড়িতে প্রায় এক যুগ কাজ করেছেন তিনি। ওই বাড়িতে একবার লোহার শলাকা ওপর থেকে মাথার ভেতরে ঢুকে গিয়েছিল। দুই দিন জ্ঞান ফেরেনি। তাঁর নাকি বাঁচারই কথা ছিল না। মাথায় হাত দিয়ে ক্ষতের জায়গা দেখাচ্ছিলেন রেনু বেগম।

প্রসঙ্গ পাল্টানোর জন্য তাঁর অন্য আত্মীয়ের খবর জিজ্ঞেস করেছিলাম। তখন আরেক কষ্টের ঝুড়ি খুললেন। তাঁর স্বামীরা ছয় ভাই ছিলেন। নদীভাঙনের কবলে পড়ে একেকজন একেক দিকে গেছেন। এক ভাই চলে যান কুমিল্লায় কাজ করতে। সেখানেই মারা গেছেন। এক ভাই কাজের সন্ধানে যান দিনাজপুরে। এক ভাই রাজারহাটে অন্য খানে কাজ করেন। দুই ভাই ১০ শতক জমি ভাড়া নিয়ে সেখানে থাকেন। এই বাড়ি ভেঙে গেলে তাঁরা চলে যাবেন ঢাকায়। ঢাকায় কোথায় যাবেন, কী করবেন, তা তিনি জানেন না।

ঈদের দিন কী করবেন, এ কথা জিজ্ঞেস করতেই আবারও কাঁদতে কাঁদতে বলেন, ‘খাওয়ার কিচ্ছু নাই। বাপের বাড়ি থাকি আইজ ৫০০ টাকা আনছি। কী করমো, জানি না। আল্লাক কই, আল্লাহ হামাক তুলি নেও। আমার বুকভরা চোখের পানি। আমার কোনো সুখ নাই বাবা।’ এরই মধ্যে যাঁরা নদীভাঙন রোধে কাজ করেন, তাঁদের একজন এসে হাজির হন। প্রধান প্রকৌশলী মাহবুবুর রহমান তাঁকে পাঠিয়েছেন।

মাহবুবুর রহমান রংপুর থেকে ঈদের রাতে ৪০ কিলোমিটার দূরে বুড়ির হাটে আসতে চেয়েছিলেন। কাজ শুরু হওয়ায় আর আসতে হয়নি। প্রকৌশলীদের সম্পর্কে হাজারও খারাপ কথার মধ্যে তাঁর আন্তরিকতাটুকু মনে রাখার মতো। তিনি কঠোর নির্দেশনা দিয়ে ভাঙন বন্ধে কাজের নির্দেশনা দিয়েছেন। এ বছর পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান চান, তিস্তায় যেন একটি বাড়িও না ভাঙে। তার জন্য যে ব্যবস্থা নিতে হয়, তিনি তা-ই সে ব্যবস্থা নিতে চান।

বাড়িটি আর কতদিন টিকে থাকবে.

উৎস: Prothomalo

কীওয়ার্ড: ব যবস থ র জন য ক জ কর আল ল হ ব গম র বলছ ল

এছাড়াও পড়ুন:

চবি ছাত্রদলের ৪২০ জনের কমিটিতে নারী মাত্র ১১

আংশিক কমিটির মেয়াদ শেষ হওয়ার পর চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় (চবি) শাখা ছাত্রদলে পূর্ণাঙ্গ কমিটি ঘোষণা করা হয়েছে। এতে ৪২০ সদস্যের পূর্ণাঙ্গ কমিটিতে নারী সদস্য রয়েছেন মাত্র ১১ জন। যা শতকরা হিসেবে তাদের অংশগ্রহণের হার মাত্র ২.৬২ শতাংশ।

এর মধ্যে, সহ-সভাপতি পদে একজন, যুগ্ম-সাধারণ সম্পাদক পদে তিনজন, সহ-সাধারণ সম্পাদক পদে একজন, সহ-সাংগঠনিক সম্পাদক পদে একজন, মানবাধিকার সম্পাদক পদে একজন, সহ-সাংস্কৃতিক সম্পাদক পদে একজন, ছাত্রীবিষয়ক সম্পাদক পদে একজন এবং সহ-ছাত্রী বিষয়ক সম্পাদক পদে দুইজন।

আরো পড়ুন:

বগুড়ায় স্ত্রীকে পিটিয়ে হত্যার অভিযোগে স্বামী আটক

কুমিল্লায় প্রবাসীর স্ত্রীকে মারধর-তালাক, অন্যজনের সঙ্গে বিয়ে

বুধবার (২৯ অক্টোবর) রাতে ছাত্রদলের কেন্দ্রীয় সভাপতি রাকিবুল ইসলাম রাকিব ও সাধারণ সম্পাদক নাছির উদ্দীন নাছির স্বাক্ষরিত এক বিজ্ঞপ্তিতে এই কমিটি ঘোষণা করা হয়েছে।

পূর্ণাঙ্গ কমিটিতে সহ-সভাপতি পদে ৬০ জন, যুগ্ম-সাধারণ সম্পাদক ৯২ জন, সহ-সাধারণ সম্পাদক ৬৩ জন, সহ-সাংগঠনিক সম্পাদক ৬৪ জন এবং সদস্য রয়েছেন ৬২ জন।

এর আগে, ২০২৩ সালের আগস্ট মাসে মো. আলাউদ্দিন মহসিনকে সভাপতি ও আবদুল্লাহ আল নোমানকে সাধারণ সম্পাদক করে পাঁচ সদস্যের আংশিক কমিটি পায় চবি ছাত্রদল। এরপর নানা জটিলতা ও সাংগঠনিক স্থবিরতায় ২ বছর পেরিয়ে গেলেও পূর্ণাঙ্গ কমিটি দিতে পারেনি সংগঠনটি। অবশেষে দীর্ঘ প্রতীক্ষা শেষে ৪২০ সদস্যের পূর্ণাঙ্গ কমিটি ঘোষণা করা হয়েছে।

ছাত্রদলের গঠনতন্ত্র অনুযায়ী, একটি কমিটির মেয়াদ থাকে সর্বোচ্চ ২ বছর। সেখানে চবি ছাত্রদলের পাঁচ সদস্যের কমিটির মেয়াদ শেষ হওয়ার তিন মাস পর কমিটি পূর্ণাঙ্গ করেছে কেন্দ্রীয় সংসদ।

এদিকে, গত ১২ অক্টোবর চাকসু নির্বাচনের আগে সাংগঠনিক শৃঙ্খলা ভঙ্গের অভিযোগে চবি ছাত্রদলের সিনিয়র সহ-সভাপতির পদ থেকে মোহাম্মদ মামুন উর রশিদ মামুনকে সংগঠনের সদস্য পদসহ স্থায়ী বহিষ্কার করেছে কেন্দ্রীয় সংসদ। পূর্ণাঙ্গ কমিটিতে সিনিয়র সহ-সভাপতির পদটি শূন্য রয়েছে।

পূর্বের আংশিক কমিটিতে সভাপতি ছিলেন মো. আলাউদ্দিন মহসিন, সাধারণ সম্পাদক আব্দুল্লাহ আল নোমান, সিনিয়র যুগ্ম-সাধারণ সম্পাদক মো. ইয়াসিন ও সাংগঠনিক সম্পাদক সাজ্জাদ হোসেন হৃদয়। পূর্ণাঙ্গ কমিটিতেও তারা একই পদে বহাল আছেন।

ঢাকা/মিজান/মেহেদী

সম্পর্কিত নিবন্ধ

  • বিবাহবিচ্ছেদ ও খোরপোষ নিয়ে ক্ষুদ্ধ মাহি
  • ফতুল্লায় দুই ট্রাকের মাঝে পড়ে যুবকের মৃত্যু
  • ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় দুই পক্ষের সংঘর্ষে ২০ মামলার আসামি নিহত, গুলিবিদ্ধ ৩
  • নামতে গেলেই চালক বাস টান দিচ্ছিলেন, পরে লাফিয়ে নামেন
  • তানজানিয়ার বিতর্কিত প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে ফের বিজয়ী সামিয়া
  • আমার স্ত্রী খ্রিষ্টধর্ম গ্রহণ করছেন না: জেডি ভ্যান্স
  • নির্বাচন সামনে রেখে সরকারের ৩১ বিভাগকে প্রস্তুতির নির্দেশ ইসির
  • কর্মদিবসের শেষ দিনে প্রধান শিক্ষকের মৃত্যু
  • প্রশিক্ষকদের দায়িত্বে উদাসীনতাসহ যেসব অসংগতি উঠে এল প্রাথমিক তদন্তে
  • চবি ছাত্রদলের ৪২০ জনের কমিটিতে নারী মাত্র ১১