সম্প্রতি মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজে ভয়াবহ বিমান দুর্ঘটনা ও হতাহতের ঘটনা ঘটেছে, যেখানে শিক্ষার্থীরা ক্লাসের পরে কোচিংয়ের জন্য অপেক্ষা করছিল। এ ঘটনা আমাদের সবাইকে গভীরভাবে নাড়িয়ে দিয়েছে। বাংলাদেশ বিমানবাহিনীর একটি যুদ্ধবিমান দোতলা একটি ভবনে বিধ্বস্ত হয় এবং সেখানে আগুন লেগে যায়।

এ ঘটনার পর ক্ষোভ ছিল প্রবল এবং যথার্থই; শিক্ষার্থী, অভিভাবক ও সাধারণ মানুষ অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের কাছে জবাবদিহি দাবি করেছেন; কিন্তু আমি যে প্রশ্নটি তুলতে চাই, তা হলো কেন বাংলাদেশে এ ধরনের দুর্ঘটনা বারবার ঘটছে?

এটি কোনো বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়। পোশাকশ্রমিকেরা কারখানায় আগুন ও ভবন ধসের কারণে মারা যান, পথচারীরা দিনের আলোতেই বাসচাপায় মারা যান, মানুষ অতিরিক্ত ভিড়ের কারণে বাস ও ট্রেন থেকে পড়ে যায়। এগুলো কোনো বিচিত্র দুর্ঘটনা নয়, এগুলো একটি প্যাটার্নের অংশ। এগুলো কাঠামোগত ঘাটতি, প্রাতিষ্ঠানিক অব্যবস্থাপনা এবং ক্ষমতাবানদের পক্ষ থেকে জননিরাপত্তার প্রতি চরম অবহেলার ফল।

তাহলে প্রশ্ন হলো কে সামরিক বিমানের ফ্লাইটপথ নির্ধারণ করে? কে ঘনবসতিপূর্ণ এলাকায় স্কুল নির্মাণের অনুমতি দেয়? এসব ভবনে অগ্নিনিরাপত্তার ব্যবস্থা আছে কি?
হ্যাঁ, বাংলাদেশের জনসংখ্যা বর্তমানে ১৬ কোটির বেশি—এটা একটি চ্যালেঞ্জ; কিন্তু ঠিক সেই কারণেই পরিকল্পনা আরও কঠোর হওয়া উচিত ছিল। একটি সামরিক প্রশিক্ষণ বিমান কখনোই উত্তরার মতো ঘনবসতিপূর্ণ এলাকায় ওড়ার কথা নয়।

ঘটনার তথ্য সবার জানা, তবে প্রেক্ষাপট বোঝাতে আবার তুলে ধরছি। জাতীয় পত্রিকা ও টেলিভিশন টক শোর সূত্রে আমি এগুলো বলছি। ২১ জুলাই ২০২৫ তারিখে বেলা ১টা ০৬ মিনিটে বাংলাদেশ বিমান বাহিনীর একটি এফ-৭ বিএজিআই প্রশিক্ষণ যুদ্ধবিমান বীর উত্তম এ কে খন্দকার ঘাঁটি (আগে কুর্মিটোলা) থেকে একটি প্রশিক্ষণ মিশনে ওড়ে।

পাইলট ফ্লাইট লেফটেন্যান্ট তৌকির ইসলাম সাগর তাঁর শেষ প্রশিক্ষণ ফ্লাইটে ছিলেন, পূর্ণ লাইসেন্স পাওয়ার আগে। তিনি একা উড়ছিলেন। উড্ডয়নের কিছুক্ষণের মধ্যেই বিমানটির ওপর নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলেন। গ্রাউন্ড কন্ট্রোলের সঙ্গে যোগাযোগে তিনি ত্রুটির কথা জানান এবং তাঁকে বিমান থেকে ইজেক্ট করতে পরামর্শ দেওয়া হয়। তিনি বিমানটিকে ঘনবসতিপূর্ণ এলাকা থেকে সরিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করেন, কিন্তু ব্যর্থ হন।

বিমানটি মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজের দোতলা ভবনে বিধ্বস্ত হয় এবং তাতে ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ড ঘটে। ভবনের গঠনগত ক্ষতি ছিল ব্যাপক। এ পর্যন্ত ৩১ জন মারা গেছেন, যাঁদের মধ্যে অন্তত ২৫ জন শিশু এবং ১৬০ জনের বেশি মারাত্মকভাবে দগ্ধ হয়েছে, যা তাদের সারা জীবনের জন্য ক্ষত হয়ে থাকবে।

ফায়ার সার্ভিস, পুলিশ ও চিকিৎসা দল, স্থানীয় জনগণের সঙ্গে মিলে উদ্ধারকাজে অংশ নেয়। অন্তর্বর্তীকালীন প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনুস ২২ জুলাই জাতীয় শোক দিবস ঘোষণা করেন এবং সরকার তদন্ত শুরু করেছে।

আমরা এই ধাঁচের ঘটনা আগেও দেখেছি। ২০১৮ সালের আগস্টে, দুটি স্কুলছাত্র নিহত হওয়ার পর  শিক্ষার্থীরা পাঁচ দিন ধরে ঢাকায় সড়ক অবরোধ করেছিল। গণ-আন্দোলনের পরেই তৎকালীন আওয়ামী লীগ সরকার সংস্কারের প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল। সড়ক নিরাপত্তা আইন ২০১৮ চালু হয়, তবে তার আগে শিক্ষার্থীদের ওপর কঠোর দমন-পীড়ন চলে। সরকার মুখে বলেছিল ‘শুনছে’, কিন্তু বাস্তবে তারা বুঝিয়ে দিয়েছিল বিরোধিতা সহ্য করা হবে না।

আমার বক্তব্য হলো, এখানে একটি গভীর সমস্যা আছে। এই তথাকথিত দুর্ঘটনাগুলো বারবার ঘটছে কারণ, সরকার দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনায় ব্যর্থ, সড়ক ব্যবস্থাপনায় বিশৃঙ্খলা বিরাজ করছে এবং সাধারণ মানুষের নিরাপত্তার জন্য কোনো কার্যকর উদ্যোগ নেই। ২০১৮ সালের ছাত্র আন্দোলনের কথাই ভাবুন—ছাত্রদেরই চালকদের লাইসেন্স পরীক্ষা করতে হয়েছিল। এটিই বলে দেয়, আমাদের প্রতিষ্ঠানগুলোর অবস্থা কতটা নাজুক।

বাংলাদেশে সড়ক দুর্ঘটনা যেন নৈমিত্তিক ঘটনায় পরিণত হয়েছে। রাস্তাঘাট অতিরিক্ত ভিড়ে ঠাসা, নিয়মকানুন মানা হয় না আর পুলিশ লাইসেন্সহীন চালক ধরলেও ঘুষ খেয়ে ছেড়ে দেয়। বাসগুলো ব্যক্তিমালিকানাধীন, তারা যাত্রী তুলতে দৌড়ায়, যত বেশি যাত্রী তোলা যায়, তত বেশি মুনাফা—নিরাপত্তা সেখানে গৌণ।

দুঃখজনক সত্য হলো, আমি নিশ্চিত নই এটি কোনো জাগরণ বা পরিবর্তন ঘটাবে। অভিজ্ঞতা বলছে, এই ঘটনাও রাজনীতির নাটক হয়ে যাবে। রাজনৈতিক পক্ষগুলো একে অপরকে দোষারোপ করে পয়েন্ট নেওয়ার চেষ্টা করেছে। অন্যদিকে যেসব শিক্ষার্থী জীবনের জন্য দাগ নিয়ে বাঁচবে এবং যেসব পরিবার তাদের সন্তান হারিয়েছে, তারা পড়ে থাকবে ভগ্নহৃদয়ে।

কিন্তু এই সাম্প্রতিক দুর্ঘটনাটি আরও ভয়ের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। কারণ, এটি একটি সামরিক বাহিনীর বিষয়। জাতীয় নিরাপত্তার দায়িত্বে থাকা প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে আমরা সর্বোচ্চ মান (স্ট্যান্ডার্ড) আশা করি। এটি কোনো বেপরোয়া চালক বা ত্রুটিপূর্ণ বাস ছিল না—এটি ছিল একটি যুদ্ধবিমান। সুতরাং, এই ফ্লাইটপাথ (উড্ডয়নপথ) বা ঢাকার মতো একটি ঘনবসতিপূর্ণ এলাকায় প্রশিক্ষণ যুদ্ধবিমান কেন ও কীভাবে ওড়ার অনুমতি পায় সেই প্রশ্ন খুবই স্বাভাবিক। সবচেয়ে বড় প্রশ্ন কেন সব সময় এত বড় ট্র্যাজেডি ঘটার পরেই কেবল ক্ষমতাসীনেরা দায় নেওয়ার অভিনয় করে?

দুঃখজনক সত্য হলো, আমি নিশ্চিত নই এটি কোনো জাগরণ বা পরিবর্তন ঘটাবে। অভিজ্ঞতা বলছে, এই ঘটনাও রাজনীতির নাটক হয়ে যাবে। রাজনৈতিক পক্ষগুলো একে অপরকে দোষারোপ করে পয়েন্ট নেওয়ার চেষ্টা করেছে। অন্যদিকে যেসব শিক্ষার্থী জীবনের জন্য দাগ নিয়ে বাঁচবে এবং যেসব পরিবার তাদের সন্তান হারিয়েছে, তারা পড়ে থাকবে ভগ্নহৃদয়ে।

আমরা এই নাটক আগেও দেখেছি। শেষ হয় প্রতিশ্রুতি, স্মরণসভা, সেমিনার আর তারপর সবকিছু ঢেকে যায় নীরবতায়।

ড.

লামিয়া করিম অধ্যাপক, নৃবিজ্ঞান বিভাগ, অরেগন বিশ্ববিদ্যালয় (ইউজিন), যুক্তরাষ্ট্র

মতামত লেখকের নিজস্ব

উৎস: Prothomalo

কীওয়ার্ড: দ র ঘটন র জন য র জন ত সরক র

এছাড়াও পড়ুন:

৪ কোম্পানির আর্থিক প্রতিবেদনে অনিয়ম: ৭ অডিটর নিষিদ্ধ

‎পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত চারটি কোম্পানির সমাপ্ত অর্থবছরের আর্থিক প্রতিবেদনে গুরুতর আর্থিক অনিয়ম ও আইনের লঙ্ঘন থাকা সত্ত্বেও তা নিরীক্ষা প্রতিবেদনে উত্থাপন না করায় সাত নিরীক্ষক (অডিটর) প্রতিষ্ঠানকে পাঁচ বছরের জন্য অডিট এবং অ্যাসিউর‍্যান্স কার্যক্রমে অংশগ্রহণের উপর নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ সিকিউরিটি এক্সচেঞ্জ কমিশন (বিএসইসি)।

সেইসঙ্গে ওই নিরীক্ষা ফার্ম এবং নিরীক্ষকদের কেন অযোগ্য ঘোষণা করা হবে না, সেই মর্মে ব্যাখ্যা তলব করে তাদের শুনানিতে ডাকার সিদ্ধান্ত নিয়েছে কমিশন।

আরো পড়ুন:

সোনালী পেপারের শেয়ার কারসাজি: ১১ কোটি ৮২ লাখ টাকা জরিমানা

পুঁজিবাজার উন্নয়নে ডিএসই ও ডিসিসিআইয়ের যৌথ সভা

‎গত মঙ্গলবার (১৬ সেপ্টেম্বর) বিএসইসির চেয়ারম্যান খন্দকার রাশেদ মাকসুদের সভাপতিত্বে ৯৭৩তম কমিশন সভায় এই সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। ‎বুধবার (১৭ সেপ্টেম্বর) বিএসইসির পরিচালক ও মুখপাত্র আবুল কালাম স্বাক্ষরিত সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে এ তথ্য জানানো হয়।

‎সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে উল্লেখ করা হয়, সুহৃদ ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেডের ৩০ জুন, ২০১৯ সমাপ্ত অর্থবছরের নিরীক্ষা ফার্ম ও নিরীক্ষক এ হক অ্যান্ড কোং চার্টার্ড এ্যকাউন্ট্যান্টস; রিংসাইন টেক্সটাইল লিমিটেডের ৩০ জুন, ২০১৭, ২০১৮, ২০১৯ এবং ২০২০ সমাপ্ত অর্থবছরের নিরীক্ষা ফার্ম ও নিরীক্ষক যথাক্রমে: আহমেদ অ্যান্ড আক্তার, মাহফেল হক অ্যান্ড কোং, আতা খান অ্যান্ড কোং এবং সিরাজ খান বসাক অ্যান্ড কোং চার্টার্ড এ্যকাউন্ট্যান্টস; আমান কটন ফাইব্রাস লিমিটেডের ৩০ জুন, ২০২০ সমাপ্ত অর্থবছরের নিরীক্ষা ফার্ম ও নিরীক্ষক ইসলাম কাজী শফিক অ্যান্ড কোং চার্টার্ড এ্যকাউন্ট্যান্টস এবং ফারইষ্ট ইসলামী লাইফ ইন্স্যুরেন্স কোম্পানি লিমিটেডের ৩০ জুন, ২০১৮ ও ২০১৯ সমাপ্ত অর্থবছরের নিরীক্ষা ফার্ম ও নিরীক্ষক মাহফেল হক অ্যান্ড কোং চার্টার্ড এ্যকাউন্ট্যান্টস আর্থিক প্রতিবেদনে গুরুতর আর্থিক অনিয়ম ও সিকিউরিটিজ আইনের লঙ্ঘন থাকা সত্ত্বেও নিরীক্ষা প্রতিবেদনে উত্থাপন করেনি। 

এ সকল নিরীক্ষা ফার্ম এবং নিরীক্ষককে পুঁজিবাজারের তালিকাভুক্ত সকল কোম্পানি, সকল ধরনের বিনিয়োগ স্কিম (যথা- মিউচ্যুয়াল ফান্ড, অল্টারনেটিভ ইনভেস্টমেন্ট ফান্ড ও এক্সচেঞ্জ ট্রেডেড ফান্ড) এবং পুঁজিবাজারে মধ্যস্থতাকারী সকল প্রতিষ্ঠানের অডিট ও অ্যাসিউর‍্যান্স কার্যক্রম পরিচালনার উপর নিষেধাজ্ঞা তথা পাঁচ বছরের জন্য অডিট ও অ্যাসিউর‍্যান্স কার্যক্রমে অংশগ্রহণে কেন অযোগ্য ঘোষণা করা হবে না এই মর্মে ব্যাখ্যা তলব করে শুনানি করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। 

‎ঢাকা/এনটি/বকুল 

সম্পর্কিত নিবন্ধ

  • ৪ কোম্পানির আর্থিক প্রতিবেদনে অনিয়ম: ৭ অডিটর নিষিদ্ধ
  • পুলিশের ৯ কর্মকর্তাকে বাধ্যতামূলক অবসর