ধর্মনিরপেক্ষতার বদলে বহুত্ববাদ: ভাবের ঘরে চুরি
Published: 1st, August 2025 GMT
হজরত মুহাম্মদ (সা.)-কে নিয়ে কটূক্তির অভিযোগ তুলে রংপুরের গঙ্গাচড়ায় হিন্দু সম্প্রদায়ের বাড়িঘরে হামলা, ভাঙচুর ও লুটপাট হয়েছে। তাঁদের অনেকেই নির্যাতিত হয়েছেন। এ হামলা ও নির্যাতনের নিন্দা জানিয়েছে কয়েকটি রাজনৈতিক দল ও নাগরিক সংগঠন। তারা বলছে, এটি মানবাধিকারের লঙ্ঘন। এ ঘটনা ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের নিরাপত্তা ও নাগরিক অধিকারের ওপর আঘাত। এই অপরাধের সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিদের আইনের আওতায় আনা হবে।
কটূক্তি, ধর্ম অবমাননা, অনুভূতিতে আঘাত দেওয়া—এসব অভিযোগ তুলে হামলা-মামলা চলে আসছে অনেক দিন ধরে। নিকট অতীতে রামু, নাসিরনগর, কুমিল্লাসহ বিভিন্ন জায়গায় দেখা গেছে, ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত দেওয়ার ধুয়া তুলে দুর্বল সম্প্রদায়ের লোকদের ওপর জুলুম হয়েছে। অনুভূতিতে আঘাত দেওয়ার নালিশ জানালেই হলো। পুলিশ বিদ্যুৎগতিতে তাকে ধরে নিয়ে যাবে। আদালতে রিমান্ড চাইবে। আদালত সঙ্গে সঙ্গেই দিয়ে দেবেন। এই ফর্মুলার নড়চড় হতে দেখছি না।
ধর্ম একটি স্পর্শকাতর বিষয়। সম্প্রতি একটি পুরোনো বাংলা ছবির সংলাপ শুনলাম। উত্তমকুমার বলছেন, ‘ভগবানে আমার বিশ্বাস নেই।’ এতে তো ধর্মপ্রাণ হিন্দুর অনুভূতিতে প্রচণ্ড আঘাত লাগার কথা; কিন্তু সে রকম কিছু হয়েছে বলে শুনিনি। উত্তমকুমারের জনপ্রিয়তায় একটুও ভাটা পড়েনি।
এ অঞ্চলে হিন্দু-মুসলমানের ঝগড়া বেশ পুরোনো। একসময় ভারতের মুসলমানরা মনে করলেন, তাঁরা একটি জাতি। হিন্দুদের সঙ্গে বসবাস করলে ইমান-আকিদা নিয়ে বাঁচা যাবে না। আলাদা দেশ চাই। তো আলাদা দেশ ‘পাকিস্তান’ হলো। দেখা গেল পাকিস্তানের এক অঞ্চলের মুসলমানের সঙ্গে আরেক অঞ্চলের মুসলমানের অনেক দ্বন্দ্ব। এক ছাদের নিচে বসে তার সুরাহা হবে না। তাই পাকিস্তান ভেঙে ‘বাংলাদেশ’ হলো। এখন দেখা যাচ্ছে, তাতেও সব সমস্যার সমাধান হয়নি। হিন্দু-মুসলমান ভাগটা রয়েই গেল।
একসময় এ দেশে ছিল পৃথক নির্বাচনব্যবস্থা। মুসলমানরা ভোট দিত মুসলমানকে আর হিন্দুরা দিত হিন্দুকে। ১৯৫৪ সালের নির্বাচনের আগে পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগ হিন্দু নেতাদের বোঝাল, ‘আমাদের ভোট দিলে দেশে সাম্প্রদায়িকতা থাকবে না, ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র হবে।’
হিন্দু নেতারা বললেন, তাহলে আগে তোমরা অসাম্প্রদায়িক হও। আওয়ামী লীগ রাজি হলো। নির্বাচনে মুসলিম লীগের ভরাডুবি হলো।
১৯৫৫ সালে আওয়ামী লীগ দলের নাম থেকে ‘মুসলিম’ শব্দটা বাদ দিয়ে ‘অসাম্প্রদায়িক’ হওয়ার দাবি করল। ১৯৫৬ সালের সংবিধানে পৃথক নির্বাচনব্যবস্থা বিলুপ্ত হয়ে চালু হলো যুক্ত নির্বাচনব্যবস্থা। তবে কাগজে-কলমে অসাম্প্রদায়িক হলেও আচরণে আওয়ামী লীগ মুসলমানের দলই থেকে গেল।
১৯৭০ সালের নির্বাচনী ইশতেহারে শেখ মুজিব ঘোষণা দিলেন, ‘কাউকে কোরআন ও সুন্নাহবিরোধী আইন করতে দেওয়া হবে না।’ কার্যত হিন্দুরা হলেন আওয়ামী লীগের ভোটব্যাংক।
অনেক মুসলমান মনে করেন, হিন্দুরা সব ভারতের দালাল। কিছু হলেই তাঁরা দৌড় দেন ভারতের দিকে। ‘ভারতের দালাল’ কথাটা এ দেশে খুব খায়। পাকিস্তানি শাসকেরা মনে করতেন, বাঙালি মুসলমান খাঁটি মুসলমান নয়। নামে মুসলমান হলেও কার্যত তারা হিন্দু। তারা হিন্দু সংস্কৃতি লালন-পালন করে। শহীদ মিনার, পয়লা বৈশাখ উদ্যাপন—এসব হচ্ছে হিন্দু সংস্কৃতি।
১৯৭১ সালে এ দেশে গণহত্যা হয়েছিল। প্রধান টার্গেট ছিল হিন্দু সম্প্রদায়। পাকিস্তানিদের হাতে যত মুসলমান মারা গেছে, পাকিস্তানিরা তাদের হিন্দু মনে করেই মেরেছে। যে এক কোটি লোক ভারতে শরণার্থী হয়েছিল, তাদের ৮০ ভাগই ছিল হিন্দু।
দেশ স্বাধীন হওয়ার পর মুসলমানের চোখে হিন্দুরা হিন্দুই থেকে গেল, বাঙালি হতে পারেনি। রেডিও-টেলিভিশনে আর সরকারি অনুষ্ঠানে একজন পুরুত ডেকে গীতা পাঠ করিয়ে সরকার দায়িত্ব সারল। বলল ‘ধর্মনিরপেক্ষতা’ হয়ে গেছে। ১৯৭২ সাল থেকেই দেশের নানা জায়গায় পূজামণ্ডপে হামলা আর প্রতিমা ভাঙচুর হতে থাকে।
১৯৭৫ সালের পর কাগজে–কলমে বাংলাদেশ হয়ে যায় মুসলমানের দেশ। রাষ্ট্রের অনানুষ্ঠানিক ইসলামীকরণ জিয়াউর রহমানের হাত দিয়ে শুরু, এরশাদের হাতে তার মোক্ষলাভ।
শেখ হাসিনা ২০ বছর ক্ষমতায় থেকে জিয়া-এরশাদের তৈরি স্থিতাবস্থা বজায় রাখলেন। হিন্দুদের প্রতি তাঁর দরদ ছিল না। তাঁর দরকার ছিল হিন্দু ভোট। মুসলমানের প্রতিও যে তাঁর দরদ ছিল, এমনটি বলা যাবে না।
আসলে তাঁর একমাত্র চাওয়া ছিল ক্ষমতার চূড়ায় থাকা। সে জন্য সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলমানের অনুভূতি নিয়ে তিনি ডুগডুগি বাজিয়েছেন আর হিন্দুদের রেখে দিয়েছেন জিম্মি করে। ক্ষমতার ভিত টিকিয়ে রাখতে নির্ভর করেছেন ভারতের ওপর। সরকার চালিয়েছেন সামরিক-অসামরিক গোয়েন্দা আর সরকারি-বেসরকারি লাঠিয়াল দিয়ে।
এ দেশের হিন্দুদের আরও বিপদে ফেলে দিয়েছে ভারতের হিন্দুত্ববাদী মোদি সরকার। ভারত সরকার ঘোষণা দিয়েছে, বাংলাদেশ থেকে অমুসলিম কেউ ভারতে (২০১৪ সালের ৩১ ডিসেম্বরের মধ্যে যাঁরা গিয়েছেন) গেলে তাঁকে নাগরিকত্ব দেওয়া হবে। এর ফলে অনেকের কাছে মনে হতে পারে, বাংলাদেশের হিন্দুদের স্বয়ংক্রিয়ভাবেই ভারতের নাগরিক হওয়ার সুযোগ তৈরি হয়ে যায়।
মুসলমানদের বলতে সুবিধা হলো—তোমরা তো ভারতে এক পা দিয়েই রেখেছ। আমাদের নেতারা প্রায়ই জোরগলায় বলেন, এ দেশে সংখ্যালঘু নেই। সবাই বাংলাদেশি। কথাটা যে ফাঁকা আর ফাঁকি, সেটি বলার অবকাশ রাখে না। সমস্যাকে স্বীকার করে নিয়ে তার সমাধানের দিকে না গিয়ে তাঁরা সমস্যাটাকে অস্বীকার করে প্রকারান্তরে এটাকে জিইয়ে রেখেছেন। বাংলাদেশি মুসলমানের একটি বড় অংশের চোখে বাংলাদেশি হিন্দুরা হলো ‘আটকে পড়া ভারতীয়’।
সংখাগুরুর আধিপত্যবাদের বিপরীতে সংখ্যালঘু মনস্তত্ত্ব বলে একটি কথা আছে। এর পেছনে কাজ করে নিরাপত্তাহীনতার শঙ্কা। হিন্দুদের বাড়ি, জমি ও ব্যবসা দখলের মচ্ছব চলছে ১৯৪৭ সাল থেকে। যাঁদের বাড়িতে উঠতি বয়সী মেয়ে আছে, তাঁরা অনেকেই তাদের ভারতে পাঠিয়ে দেন এ দেশে তারা নিরাপদ নয় ভেবেই। অনেকে তাঁদের সঞ্চয়ও পাঠিয়ে দেন দেশের বাইরে। মুসলমানও টাকা পাচার করে। সে করে দুবাই, সিঙ্গাপুর, ইংল্যান্ড, কানাডা বা যুক্তরাষ্ট্রে। হিন্দু করে ভারতে। সে মনে করে, একদিন যদি সে এ দেশে থাকতে না পারে, সে তো যাবে ভারতেই। অতি অল্পসংখ্যক ভাগ্যবান যেতে পারবে পশ্চিমের দেশগুলোতে। এই সংখ্যালঘু মনস্তত্ত্ব বোঝা দরকার।
একই কথা প্রযোজ্য ভারতীয় মুসলমানের ক্ষেত্রে। তারা সবাই পাকিস্তানে যাবে না; কিন্তু তারা মনে করে, একটি শক্তিশালী পাকিস্তান হচ্ছে তাদের রক্ষাকবচ। সে জন্য অনেক ভারতীয় মুসলমানকে ‘পাকিস্তানি এজেন্ট’ গাল শুনতে হয়।
ইদানীং নেতারা গলদঘর্ম হচ্ছেন সংবিধান নিয়ে। কারও কারও মনে হয়েছে, ‘ধর্মনিরপেক্ষতা’ শব্দটি রাখার দরকার নেই। সে জায়গায় বসাতে হবে ‘বহুত্ববাদ’। দুটির অর্থ যে দুই রকম, এটা তাঁদের মাথায় ঢোকে না। ধর্মনিরপেক্ষতা হচ্ছে রাষ্ট্র কোনো বিশেষ ধর্মকে পৃষ্ঠপোষকতা দেবে না। রাষ্ট্রের চোখে সবাই সমান। ‘বহুত্ববাদ’ হচ্ছে বহু মতবাদের সহাবস্থান। একটি রাষ্ট্রধর্ম রেখে সত্যিকারের বহুত্ববাদ হয় না। যাঁরা বহুত্ববাদের কথা বলছেন; কিন্তু ধর্মনিরপেক্ষতার বিপক্ষে অবস্থান নিয়েছেন, তাঁরা সমাজে সাম্প্রদায়িকতার বীজটা যত্ন করে রেখে দিতে চাইছেন। এটা ‘ভাবের ঘরে চুরি’ ছাড়া আর কিছু নয়।
মহিউদ্দিন আহমদ লেখক ও গবেষক
*মতামত লেখকের নিজস্ব
.উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: ম সলম ন র র ম সলম ন অন ভ ত ত সরক র ব যবস আওয় ম
এছাড়াও পড়ুন:
ভাসানী বিশ্ববিদ্যালয়ে বিসিএস পরীক্ষার্থীদের জন্য বাস সার্ভিস চালু
৪৭তম বিসিএস প্রিলিমিনারি পরীক্ষার্থীদের জন্য ফ্রি বাস সার্ভিস চালুর উদ্যোগ নিয়েছে মাওলানা ভাসানী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় (মাভাবিপ্রবি) শাখা ছাত্রদল। বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস থেকে ঢাকা ও ময়মনসিংহের পরীক্ষা কেন্দ্রে শিক্ষার্থীদের নির্বিঘ্নে পৌঁছানোর লক্ষ্যে এ বিশেষ যাতায়াত সুবিধার ব্যবস্থা করা হয়েছে।
বুধবার (১৭ সেপ্টেম্বর) রাতে শাখা ছাত্রদলের কর্মী নাফিস ইকবাল পিয়াল বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি ফেসবুক গ্রুপে এ তথ্য জানিয়ে পোস্ট দেন। একইসঙ্গে শাখা সভাপতি সাগর নাইম ও সাধারণ সম্পাদক সাজিদ ইসলাম দীপুও তাদের ব্যক্তিগত ফেসবুক আইডিতে পোস্ট দিয়ে পরীক্ষার্থীদের এ সুবিধা গ্রহণের আহ্বান জানান।
আরো পড়ুন:
ভাসানী বিশ্ববিদ্যালয়ে নির্বাচনী রোডম্যাপের দাবিতে মানববন্ধন
বিশ্ববিদ্যালয় জ্ঞান অর্জন ও বিতরণের জায়গা: ইউজিসি চেয়ারম্যান
ছাত্রদল জানিয়েছে, ক্যাম্পাস থেকে দুটি বাস ছাড়বে। একটি ঢাকা রুটে এবং অপরটি ময়মনসিংহ রুটে যাবে। প্রতিটি বাসে ৫০ জন করে মোট ১০০ জন শিক্ষার্থী এই ফ্রি সার্ভিসের আওতায় যাতায়াত করতে পারবেন। এজন্য শিক্ষার্থীদের অবশ্যই আগাম রেজিস্ট্রেশন করতে হবে। বৃহস্পতিবার (১৮ সেপ্টেম্বর) সন্ধ্যা ৬টা পর্যন্ত গুগল ফর্মের মাধ্যমে রেজিস্ট্রেশন করা যাবে। রেজিস্ট্রেশন ছাড়া কেউ এই সার্ভিসের সুবিধা নিতে পারবেন না।
শিক্ষার্থীদের জন্য এ উদ্যোগ ইতোমধ্যেই বিশ্ববিদ্যালয়জুড়ে প্রশংসা কুড়িয়েছে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে অনেক শিক্ষার্থী পোস্ট দিয়ে ছাত্রদলের এ পদক্ষেপকে ‘শিক্ষার্থীবান্ধব ও সময়োপযোগী উদ্যোগ’ হিসেবে অভিহিত করেছেন।
শাখা সভাপতি সাগর নাইম তার পোস্টে বলেন, “প্রতি বছর বিসিএসে আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা সাফল্যের আলো ছড়িয়ে দেন। আমরা চাই এ সুনাম আরো দূরে ছড়িয়ে পড়ুক, আরো উজ্জ্বল হোক। এ ধারাবাহিক সাফল্যের পথে আপনাদের পাশে থাকতে, ভালোবাসা ও সম্মান জানাতে মাভাবিপ্রবি ছাত্রদল ৪৭তম বিসিএস পরীক্ষার্থীদের জন্য ফ্রি বিশেষ বাস সার্ভিসের ব্যবস্থা করেছে।”
এ বিষয়ে শাখা সাধারণ সম্পাদক সাজিদ ইসলাম দীপু বলেন, “জাতীয়তাবাদী ছাত্রদল সবসময়ই শিক্ষার্থীদের কল্যাণে কাজ করে থাকে। গত বিসিএসে আমাদের বড় ভাই বিসিএস প্রশাসনে প্রথম হয়েছেন। এটি শুধু আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য নয়, সারা দেশের জন্যই গর্বের বিষয়। সেই সাফল্যের ধারা অব্যাহত রাখতে এবং শিক্ষার্থীদের কল্যাণে আমরা এবার পরীক্ষার্থীদের জন্য ফ্রি বাস সার্ভিস চালু করেছি।”
তিনি বলেন, “বিশেষ করে অনেক নারী শিক্ষার্থী আছেন, যারা ক্যাম্পাস থেকে পরীক্ষাকেন্দ্র অনেক দূরে হওয়ায় অংশ নিতে পারেন না। আবার অনেকে যানবাহন না পেয়ে দেরিতে কেন্দ্রে পৌঁছান। আমরা চাইনি কেউ যেন যাতায়াত সমস্যার কারণে বিসিএস পরীক্ষায় পিছিয়ে পড়েন। তাই বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল বিএনপির প্রচার সম্পাদক সুলতান সালাউদ্দিন টুকু ভাইয়ের সহায়তায় আমরা এ বাস সার্ভিসের ব্যবস্থা করেছি।”
ঢাকা/আবিদ/মেহেদী