যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের মেয়ে টিফানি ট্রাম্প ও তাঁর বর মাইকেল বুলোস চলতি বছরের গ্রীষ্মকালীন অবকাশ যাপন করেছেন বিলাসবহুল এক প্রমোদতরিতে। এটির মালিক তুরস্কের এক ধনকুবের, যিনি লিবিয়ার জ্বালানি তেল ব্যবসার সঙ্গে সরাসরি যুক্ত।

স্বামীর সঙ্গে টিফানি যখন কোনো সমুদ্র উপকূলে অলস সময় কাটাচ্ছিলেন, এ সময়েতে টিফানির শ্বশুর ও যুক্তরাষ্ট্রের বিশেষ দূত মাসাদ বুলোস লিবিয়ায় জ্বালানিচুক্তির কাজে ব্যস্ত ছিলেন। গত বৃহস্পতিবার দ্য নিউইয়র্ক টাইমস এক প্রতিবেদনে এমনটি নিশ্চিত করেছে।

উত্তর আফ্রিকার যুদ্ধবিধ্বস্ত তেলসমৃদ্ধ দেশ লিবিয়ার সঙ্গে বুলোস পরিবারের স্বার্থসংশ্লিষ্ট নানা গল্প দীর্ঘদিন ধরে সংবাদমাধ্যমে আলোচিত হচ্ছে। ব্যক্তিগত স্বার্থ কূটনীতিকে কীভাবে প্রভাবিত করে, এটি তার নতুন উদাহরণ হয়ে উঠেছে। সম্পর্কটি বহুস্তরীয় ও জটিল।

দ্য নিউইয়র্ক টাইমস জানায়, টিফানি ট্রাম্প ও মাইকেল বুলোস এবারের গ্রীষ্মে দক্ষিণ ফ্রান্সের সমুদ্রতীরবর্তী বিলাসবহুল এলাকা ফরাসি রিভিয়েরায় ফিনিক্স-২ নামের একটি প্রমোদতরিতে অবকাশ যাপন করেছেন। প্রমোদতরিটির মালিক তুর্কি ধনকুবের এরকুমেন্ট বায়েগান ও তাঁর স্ত্রী রুইয়া বায়েগান।

বুলোস পরিবার প্রমোদতরিটি ভাড়া নিয়েছিল কি না, তা নিশ্চিত নয়। তবে সর্বশেষ দর অনুযায়ী প্রতি সপ্তাহে ভাড়া ছিল ১৪ লাখ মার্কিন ডলার, যা বাংলাদেশি মুদ্রায় প্রায় ১৪ কোটি ৯৮ লাখ টাকা।

টিফানি ডোনাল্ড ট্রাম্পের চতুর্থ সন্তান। সম্প্রতি ব্রিটিশ রাজপরিবার আয়োজিত এক রাষ্ট্রীয় ভোজসভায় তাঁকে বাবার পাশে দেখা গেছে। সঙ্গে ছিলেন মাইকেল বুলোসও।

টিফানির শ্বশুর মাসাদ বুলোস লেবানিজ বংশোদ্ভূত মার্কিন ব্যবসায়ী। ২০২৪ সালের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে যুক্তরাষ্ট্রে বসবাসরত আরব জনগোষ্ঠীকে ট্রাম্পকে ভোট দিতে উদ্বুদ্ধ করতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছিলেন তিনি। পরবর্তী সময়ে ট্রাম্প মাসাদকে মধ্যপ্রাচ্য–বিষয়ক জ্যেষ্ঠ উপদেষ্টা ও আফ্রিকার বিশেষ দূত হিসেবে দায়িত্ব দেন।

তবে মাসাদ প্রথাগত কূটনৈতিক ব্যবস্থার বাইরে গিয়ে কাজ শুরু করেছিলেন। পেশাদার মার্কিন কূটনীতিকদের সঙ্গে তাঁর মতবিরোধ তৈরি হয়। মাসাদ প্রথমে লেবাননে, পরে আফ্রিকার বিভিন্ন রাজনৈতিক ব্যক্তির সঙ্গে অনানুষ্ঠানিক বৈঠক করেন। ব্যক্তিগত ব্যবসা ও রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডকে মিশিয়ে চলার কারণে ট্রাম্প প্রশাসনও হতাশ হয়েছিল বলে মিডল ইস্ট আইকে জানিয়েছে একটি সূত্র।

মিডল ইস্ট আই প্রথম প্রতিবেদনে জানিয়েছিল, কাতারের রাজধানী দোহায় মাসাদ লিবিয়ার প্রভাবশালী কর্মকর্তা ইব্রাহিম দবিবেহর সঙ্গে গোপন বৈঠক করেছিলেন। আলোচনার বিষয় ছিল, লিবিয়ার জব্দ করা কোটি কোটি ডলারের তহবিল উন্মুক্ত করা এবং এর একটি অংশ মার্কিন কোম্পানির কাছে যাওয়া। দ্য নিউইয়র্ক টাইমস গত বৃহস্পতিবার এ তথ্য নিশ্চিত করেছে।

২০১১ সালে ন্যাটো-সমর্থিত গণ-অভ্যুত্থানে লিবিয়ার নেতা মুয়াম্মার গাদ্দাফি ক্ষমতাচ্যুত হন। সেই সময় যুক্তরাষ্ট্র দেশটির উল্লিখিত তহবিল জব্দ করে। জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদ দেশটির ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি করেছিল। তাই জব্দ অর্থ লিবিয়ার জন্য উন্মুক্ত করা হলে সেটি সংস্থার নিষেধাজ্ঞা লঙ্ঘন করতে পারে।

লিবিয়া

২০১১ সালের অক্টোবরে গাদ্দাফি ক্ষমতাচ্যুত ও নিহত হওয়ার পর থেকে লিবিয়া গৃহযুদ্ধে জড়িয়ে পড়েছে। দেশটি বর্তমানে দুই ভাগে বিভক্ত। ত্রিপোলিতে রয়েছে আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত সরকার। অন্যদিকে পূর্ব লিবিয়ায় রয়েছে সাবেক জেনারেল খলিফা হাফতারের নেতৃত্বাধীন প্রশাসনের নিয়ন্ত্রণে।

২০১৯ সালে দুই পক্ষের মধ্যে ত্রিপোলি দখল নিয়ে রক্তক্ষয়ী সংঘাত হয়। পরে এটি আঞ্চলিক শক্তিগুলোর ছায়াযুদ্ধে রূপ নেয়। তুরস্ক জাতিসংঘ–স্বীকৃত সরকারের পক্ষে অবস্থান নেয়। রাশিয়া, মিসর ও সংযুক্ত আরব আমিরাত (ইউএই) হাফতারকে সমর্থন দেয়। উভয় পক্ষই লিবিয়ার তেলসম্পদ নিয়ন্ত্রণের জন্য লড়াই করছে।

মাসাদ বুলোস লিবিয়ায় ইব্রাহিম দবিবেহরের সঙ্গে একাধিক বৈঠক করেছেন। ইব্রাহিম ত্রিপোলির সরকার প্রধানমন্ত্রী আবদুল হামিদ দবিবেহরের আত্মীয়। গত জুলাইয়ে তাঁরা সমুদ্রতীরবর্তী ভিলায় একান্ত নৈশভোজে মিলিত হন। তবে এর আগে মাসাদ দেশটির জ্বালানিচুক্তি নিয়ে প্রকাশ্যভাবে কথা বলেছিলেন।

গত আগস্টে মিডল ইস্ট আইয়ের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছিল, গাজা থেকে জোরপূর্বক বাস্তুচ্যুত ফিলিস্তিনিদের গ্রহণ নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের আলোচনায় ইব্রাহিমও যুক্ত ছিলেন। মাসাদের দাবি, তিনি এ আলোচনায় অংশ নেননি।

ফিনিক্স-২ প্রমোদতরিতে টিফানি ও মাইকেলের অবকাশযাপন এই পরিবারের বিলাসি জীবনধারার প্রথম নজরকাড়া ঘটনা নয়; আগেও তাদের ব্যয়বহুল প্রমোদতরিতে অবকাশযাপনের খবর সংবাদ শিরোনামে এসেছে।

গত আগস্টে দ্য নিউইয়র্ক টাইমস জানায়, ট্রাম্পের অন্য জামাতা ও মধ্যপ্রাচ্যবিষয়ক সাবেক উপদেষ্টা জ্যারেড কুশনারকে বিলাসবহুল প্রমোদতরির জন্য অতিরিক্ত ২৫ লাখ ডলার (২৬ কোটি ৭৫ লাখ টাকা) দিতে হয়েছিল। আন্তর্জাতিক ব্রোকারেজ ফার্মের মাধ্যমে কুশনার প্রমোদতরিটি ভাড়া করেছিলেন। মাইকেল বুলোস ওই ফার্মের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন।

মাসাদ লেবানিজ বংশোদ্ভূত হলেও আরব নেতাদের সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপনে ব্যর্থ হয়েছেন। লিবিয়ায় তাঁর কর্মকাণ্ড মিসরের কর্মকর্তাদের ক্ষুব্ধ করেছে। জুলাইয়ে তিনি তিউনিসিয়ায় প্রেসিডেন্ট কাইস সাইদের সঙ্গে বৈঠক করেন। ক্ষুধার্ত ফিলিস্তিনি শিশুদের ছবি দেখিয়ে সাইদ বলেন, ‘পুরো মানবজাতির জেগে ওঠার এটাই সময়।’

চলতি গ্রীষ্মে মাসাদ বুলোস মরক্কোর বাদশাহ কিং মোহাম্মদ ষষ্ঠর সঙ্গে সাক্ষাতের চেষ্টা করেছিলেন। তবে মার্কিন কর্মকর্তারা মরোক্কান অংশীদারদের তাঁর সঙ্গে না বসার পরামর্শ দিয়েছিলেন। ফলে বৈঠক হয়নি।

.

উৎস: Prothomalo

কীওয়ার্ড: দ য ন উইয়র ক ট ইমস য ক তর ষ ট র কর ছ ল ন ক টন ত ক পর ব র ব যবস অবক শ

এছাড়াও পড়ুন:

ব্যালটে মামদানি, অদৃশ্য ‘প্রার্থী’ ট্রাম্প

নিউইয়র্কের মেয়র নির্বাচন আগামীকাল মঙ্গলবার। ‘বিশ্বের রাজধানী’ হিসেবে পরিচিত এই শহরে প্রথমবার এমন একজন মেয়র পদে নির্বাচিত হতে পারেন, যিনি যুক্তরাষ্ট্রের রাজনীতির চলতি ধারার একদম বিপরীতমুখী। প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ও তাঁর রিপাবলিকান পার্টি এক ‘শ্বেতকায়, খ্রিষ্টান ও রক্ষণশীল’ আমেরিকার কথা বলছেন।

জোহরান মামদানি শ্বেতকায় নন, তিনি বাদামি রঙের দক্ষিণ এশীয়। তিনি খ্রিষ্টান নন, একজন মুসলিম। তিনি অবশ্যই রক্ষণশীল নন, তিনি খোলামেলাভাবে একজন প্রগতিশীল, যিনি নিজেকে সমাজতন্ত্রী বলতে দ্বিধা করেন না।

‘মামদানি একজন ভয়ানক মানুষ’, সাবধান করে বলেছেন অ্যান্ড্রু কুমো, মঙ্গলবারের নির্বাচনে যিনি মামদানির প্রতিদ্বন্দ্বী। সারা জীবন ডেমোক্রেটিক পার্টির সদস্য থাকলেও বাছাইপর্বে পরাজিত হয়ে তিনি এখন স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে লড়ছেন।

ব্যালটে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের নাম না থাকলেও এই নির্বাচনে তিনি একজন অদৃশ্য প্রার্থী। কুমোর পক্ষ নিয়ে তিনিও এই নির্বাচনের একজন অংশগ্রহণকারী। বড় ব্যবধানে মামদানির বিজয় হলে অনেকেই তা ট্রাম্পের বিরুদ্ধে অনাস্থা হিসেবেই দেখবেন।

প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প নিউইয়র্কের আদি বাসিন্দা। তিনি কোনোভাবেই চান না মামদানি এই শহরের মেয়র নির্বাচিত হোন। তাঁর বিবেচনায় মামদানি শুধু একজন পাক্কা কমিউনিস্টই নন, রীতিমতো উন্মাদ। এমন একজনকে নির্বাচিত করা হলে তিনি নিউইয়র্ক সিটির জন্য কেন্দ্রীয় সরকারের তহবিল আটকে দেবেন বলে জানিয়েছেন। তিনি সন্দেহ প্রকাশ করেছেন, মামদানি একজন অবৈধ অভিবাসী। তা প্রমাণিত হলে তাঁকে বহিষ্কার করা হবে। মেয়র নির্বাচিত হয়ে মামদানি যদি অবৈধ অভিবাসীদের বিরুদ্ধে তাঁর সরকারের চলতি অভিযানে বাধা দেন, তাহলে তাঁকে গ্রেপ্তার করা হবে, এমন হুমকিও দিয়েছেন ট্রাম্প।

শহরের প্রতিটি প্রধান কেন্দ্র হেঁটে জনসংযোগ সেরেছেন মামদানি। ৫০ হাজারের বেশি স্বেচ্ছাসেবক, যাঁদের অধিকাংশই নবীন, শহরের প্রতিটি বাসায় কড়া নেড়েছেন। টিকটক ও ইউটিউবে তাঁর উপস্থিতি অভূতপূর্ব। মামদানির এই ‘মাঠপর্যায়ের খেলা’ ঠেকাতে কুমো বেছে নিয়েছেন একদিকে ঘৃণা, অন্যদিকে ভীতি।

ট্রাম্পের ব্যাপারে জনরায়

শুধু নিউইয়র্কে নয়, যুক্তরাষ্ট্রজুড়ে আরও অন্তত তিনটি রাজ্যে নির্বাচন হবে আগামীকাল, যার ফলাফল ট্রাম্প ও তাঁর প্রশাসনের ব্যাপারে একটি রেফারেন্ডাম বা জনরায় হবে ভাবা হচ্ছে। এর মধ্যে রয়েছে নিউ জার্সি ও ভার্জিনিয়ায় গভর্নর পদে নির্বাচন। এই দুই রাজ্যে প্রতিনিধি পরিষদ ও উচ্চ পরিষদেও ভোট গ্রহণ করা হবে। উভয় রাজ্যই ডেমোক্রেটিক রাজনীতির সমর্থক, বা ‘ব্লু স্টেট’। গত প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে এই দুই রাজ্যেই ট্রাম্পের হার হয়, কিন্তু ২০১৬ সালের তুলনায় তিনি অনেক ভালো ফল করেন। দেখার বিষয়, দ্বিতীয় দফায় ক্ষমতায় এসে এই দুই রাজ্যে ট্রাম্পের জনসমর্থন এখন কোন পর্যায়ে রয়েছে।

এ ছাড়া ক্যালিফোর্নিয়ায় গভর্নর গেভিন ন্যুসাম নির্বাচনী ম্যাপ পরিবর্তনের অনুমতি চেয়ে একটি গণভোটের আয়োজন করেছেন। আগামী বছরের নভেম্বরে মধ্যবর্তী নির্বাচনে ক্ষমতাসীন দল হিসেবে রিপাবলিকান পার্টি বড় রকমের বিপর্যয়ের সম্মুখীন হতে পারে। তা ঠেকাতেই ট্রাম্পের নির্দেশে টেক্সাসের নির্বাচনী ম্যাপ ঢেলে সাজানো হয়েছে, যার ফলে রিপাবলিকান দল কংগ্রেসে আরও পাঁচটি আসন নিজেদের দখলে আনতে সক্ষম হবে ভাবা হচ্ছে। এই সিদ্ধান্তের পাল্টা ব্যবস্থা হিসেবে ‘ব্লু স্টেট’ ক্যালিফোর্নিয়ার গভর্নর ন্যুসামের নির্দেশে নির্বাচনী ম্যাপ বদলানোর উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে, যার ফলে সেখানে ডেমোক্রেটিক পার্টির জন্য কংগ্রেসে পাঁচটি আসনে বিজয়ের সম্ভাবনা তৈরি হবে।

এই তিনটি নির্বাচনের প্রতিটিতেই ভোটারদের মনে থাকবেন ট্রাম্প, তাতে কোনো সন্দেহ নেই। দ্বিতীয়বার ক্ষমতায় এসে আইনি বাধা উপেক্ষা করে বিভিন্ন ডেমোক্রেটিক শহরে অবৈধ অভিবাসনবিরোধী অভিযানের নামে সেনাসদস্যদের পাঠাচ্ছেন তিনি। যেসব ডেমোক্রেটিক নেতাকে শত্রু মনে করেন, তাঁদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়া শুরু করেছেন। কোনো যুক্তি বা কারণ ছাড়াই ২০২৪ সালের নির্বাচনে তাঁর পক্ষে ভোট দেয়নি এমন ডেমোক্রেটিক রাজ্যের কেন্দ্রীয় অনুদান বাতিল করছেন। কংগ্রেসের সঙ্গে আলাপ-আলোচনা ছাড়াই একাধিক সরকারি দপ্তর আংশিক বা পুরোপুরি বন্ধ করে দিয়েছেন। প্রচলিত আইনের তোয়াক্কা না করে মাদক পাচার বন্ধের নামে ভেনেজুয়েলার সমুদ্রসীমায় সামরিক হামলা চালাচ্ছেন। আমদানি শুল্কের নামে যে বাণিজ্যযুদ্ধ তিনি শুরু করেছেন, তার ফলে নিত্যব্যবহার্য দ্রব্যের দাম বাড়া শুরু হয়েছে।

গ্যালপ জানাচ্ছে, ২০২১ সালে দেশের ৬০ শতাংশ মানুষ ধনতন্ত্রের সমর্থক ছিল, তা এখন কমে ৫৩ শতাংশে দাঁড়িয়েছে। এই যে পরিবর্তিত আমেরিকা, ডেমোক্রেটিক পার্টির নেতারা সে কথা জানেন না বা জানতে চান না। গাজা প্রশ্নে তাঁদের রক্ষণশীল অবস্থান দলটির প্রতি নবীন প্রজন্মের ভোটারদের অবজ্ঞার জন্ম দিয়েছে।

এসব কার্যকলাপের ফলে সারা দেশে ট্রাম্পের জনসমর্থন কমেছে। অধিকাংশ জনমত জরিপে তাঁর প্রতি সমর্থন ৪২ থেকে ৪৫ শতাংশের বেশি নয়। সাম্প্রতিক সময়ে মাত্র ১০ মাসের মাথায় অন্য আর কোনো প্রেসিডেন্টের জনসমর্থনে এমন ধস নামেনি।

এবারের নির্বাচনে ট্রাম্প কোনো রাজ্যেই ব্যক্তিগতভাবে সরাসরি প্রচারে আসেননি। এমনকি রিপাবলিকান প্রার্থীদের পক্ষে সরব সমর্থনও জানাননি। এর একটা সম্ভাব্য কারণ, জয়ী হবেন এমন প্রার্থীর সমর্থন দিতেই ট্রাম্প ভালোবাসেন। আগামীকালের নির্বাচনে তেমন সম্ভাবনা কম।

এই নির্বাচন যে ট্রাম্পের ব্যাপারে জনরায়, তার আরেক প্রমাণ নির্বাচনী প্রচারণায় সাবেক প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামার অংশগ্রহণ। ডেমোক্রেটিক পার্টিতে জাতীয় নেতা বলতে তিনিই সবেধন নীলমণি। শনিবার নিউ জার্সির ডেমোক্রেটিক গভর্নর পদপ্রার্থী মাইকি শেরিলকে পাশে নিয়ে নির্বাচনী প্রচারণায় অংশ নেন তিনি। একই দিন ভার্জিনিয়ায় ডেমোক্রেটিক গভর্নর পদপ্রার্থী এবিগেইল স্প্যানবার্গারের পক্ষেও প্রচারণায় অংশ নেন তিনি। উভয় রাজ্যেই ওবামা কঠোর ভাষায় ট্রাম্পের সমালোচনা করে বলেন, ট্রাম্পের কর্তৃত্ববাদী নীতির কারণেই আমেরিকা আজ এক দুঃসময়ের মুখোমুখি।

জনমতে এগিয়ে মামদানি

ওবামা মামদানিকে আনুষ্ঠানিকভাবে সমর্থন দেননি। তবে তিনি যে মামদানির পাশে আছেন, সে কথাও গোপন রাখেননি। মামদানির ক্যাম্পেইন থেকে জানানো হয়েছে, সম্প্রতি ওবামা নিজেই ফোন করে জানিয়েছেন, তাঁর (মামদানির) বিজয়ের ওপর অনেক কিছু নির্ভর করছে। তিনি বলেছেন, মামদানির নির্বাচনী প্রচার ‘ইম্প্রেসিভ’ বা নজরে পড়ার মতো।

কুমো ক্যাম্প থেকে অহোরাত্রি তাঁকে ‘কমিউনিস্ট’ ও ‘ইহুদিবিদ্বেষী’ হিসেবে প্রচার সত্ত্বেও মামদানি যেসব জনমত জরিপে এগিয়ে, তার একটি বড় কারণ মাঠপর্যায়ে তাঁর এই ‘ইম্প্রেসিভ’ প্রচারণা। শহরের প্রতিটি প্রধান কেন্দ্র হেঁটে জনসংযোগ সেরেছেন মামদানি। ৫০ হাজারের বেশি স্বেচ্ছাসেবক, যাঁদের অধিকাংশই নবীন, শহরের প্রতিটি বাসায় কড়া নেড়েছেন। টিকটক ও ইউটিউবে তাঁর উপস্থিতি অভূতপূর্ব। মামদানির এই ‘মাঠপর্যায়ের খেলা’ ঠেকাতে কুমো বেছে নিয়েছেন একদিকে ঘৃণা, অন্যদিকে ভীতি। এতে তিনি ফল পাচ্ছেন, গত দুই সপ্তাহে মামদানির সঙ্গে তাঁর ব্যবধান ১০ শতাংশের মতো কমে এসেছে। নিউইয়র্কের চলতি মেয়র নির্বাচন থেকে এরিক অ্যাডামস সরে দাঁড়ানোয় কুমোর লাভ হয়েছে সন্দেহ নেই, তবে এখনো মামদানির সঙ্গে যে ১৬-১৭ পয়েন্টের ব্যবধান রয়েছে, তা অতিক্রম করা কার্যত অসম্ভব, এই মত অধিকাংশ পর্যবেক্ষকের।

ভূমিধস পরিবর্তন

একটা বিষয় স্পষ্ট। মেয়র নির্বাচনে মামদানি জয়ী হলে তা মার্কিন রাজনীতিতে প্রজন্মগত ও নীতিগত পরিবর্তনের সূচনা করবে। ভূমিধস পরিবর্তন আসবে ডেমোক্রেটিক পার্টির রাজনীতিতে। মধ্যপন্থী ও ডানঘেঁষা রাজনৈতিক নেতৃত্বের কারণে এই দল অন্য যেকোনো সময়ের চেয়ে কম জনপ্রিয়। এই দলে যাঁরা নেতৃত্বে, তাঁদের অধিকাংশই বয়োবৃদ্ধ, করপোরেট আমেরিকার কাছে এদের হাত-পা বাঁধা। ইসরায়েল প্রশ্নে তাদের সমর্থন এখনো আগের মতো নতজানু।

পিউ রিসার্চের তথ্য অনুসারে, ইসরায়েল প্রশ্নে এখন নেতিবাচক মনোভাব রয়েছে এমন আমেরিকানের সংখ্যা ৫৩ শতাংশ, যা তিন বছর আগের তুলনায় ১১ শতাংশ বেশি। একইভাবে ধনতন্ত্রের প্রতিও আমেরিকানদের সমর্থন নিম্নগামী। গ্যালপ জানাচ্ছে, ২০২১ সালে দেশের ৬০ শতাংশ মানুষ ধনতন্ত্রের সমর্থক ছিল, তা এখন কমে ৫৩ শতাংশে দাঁড়িয়েছে। এই যে পরিবর্তিত আমেরিকা, ডেমোক্রেটিক পার্টির নেতারা সে কথা জানেন না বা জানতে চান না। গাজা প্রশ্নে তাঁদের রক্ষণশীল অবস্থান দলটির প্রতি নবীন প্রজন্মের ভোটারদের অবজ্ঞার জন্ম দিয়েছে।

অন্যদিকে ট্রাম্পের নেতৃত্বে রিপাবলিকান পার্টি খোলামেলাভাবে অভিবাসনবিরোধী, দক্ষিণপন্থী, খ্রিষ্টবাদী ও রক্ষণশীল। চলতি সপ্তাহের নতুন উদ্বাস্তু নীতিতে বলা হয়েছে, ট্রাম্প প্রশাসন শ্বেতকায় ও ইউরোপীয় আশ্রয়প্রার্থীদের অগ্রাধিকার দেবে। এই অগ্রাধিকার তালিকায় রয়েছে দক্ষিণ আফ্রিকার শ্বেতকায় নাগরিকবৃন্দ, ট্রাম্প প্রশাসনের চোখে যারা সে দেশের সরকারের বৈষম্যের শিকার।

এই প্রতিক্রিয়াশীল রিপাবলিকান পার্টির বিপরীতে একটি আধুনিক ও প্রগতিশীল ডেমোক্রেটিক আন্দোলন গড়ে ওঠার সুযোগ রয়েছে। সিনেটর বার্নি স্যান্ডার্স ও কংগ্রেস সদস্য ওকাসিও-কর্তেজ ইতিমধ্যে এই আন্দোলনের প্রধান মুখপাত্র হয়ে উঠেছেন। সবাই মানেন, মামদানির মতো তরুণ ও বুদ্ধিমান নেতৃত্ব এই আন্দোলনকে আরও বেগবান করবে।

এই সম্ভাবনার কথা খুব স্পষ্ট করে বলেছেন বার্নি স্যান্ডার্স। তাঁর কথায়, এই দেশ করপোরেট আমেরিকার নির্দেশে চলবে, না তার রাজনীতির কেন্দ্রে থাকবে সাধারণ খেটে খাওয়া মানুষ—এ মুহূর্তে এটাই সবচেয়ে বড় প্রশ্ন। ‘যদি আমরা দ্বিতীয় পথটি বেছে নিতে চাই, করপোরেট আমেরিকার বদলে সাধারণ মানুষের স্বার্থকে অগ্রাধিকার দিই, তাহলে আমাদের মামদানির পাশে দাঁড়াতে হবে।’

কোন পথ বেছে নেবে নিউইয়র্ক, মঙ্গলবারেই তা নিশ্চিত হবে।

সম্পর্কিত নিবন্ধ

  • জোহরান মামদানির কতটা বিরোধী, কুমোকে সমর্থন দিয়ে সেটি বুঝিয়ে দিলেন ট্রাম্প
  • নিউইয়র্কে মেয়র নির্বাচন আজ, যা জানা দরকার
  • নিউইয়র্ক ছাড়িয়ে জাতীয় মুখ মামদানি
  • মামদানির উত্থান থেকে শিক্ষা নিচ্ছেন ইউরোপের বামপন্থীরা
  • অধ‍্যাপক অমর্ত‍্য সেন: আমাদের স্মৃতির পথযাত্রা
  • নিউইয়র্কের মেয়র নির্বাচনে রেকর্ডসংখ্যক আগাম ভোট, তরুণেরা কেন আগাম ভোট দিচ্ছেন
  • ব্যালটে মামদানি, অদৃশ্য ‘প্রার্থী’ ট্রাম্প
  • মামদানিকে বারাক ওবামার ফোন, করলেন নির্বাচনী প্রচারের প্রশংসা