Samakal:
2025-12-14@06:46:39 GMT

মা হতে এসে প্রাণ হারাচ্ছে ওরা

Published: 31st, January 2025 GMT

মা হতে এসে প্রাণ হারাচ্ছে ওরা

কক্সবাজার সমুদ্র উপকূলে প্রায় প্রতিদিনই ভেসে আসছে অলিভ রিডলি বা জলপাই রঙের সামুদ্রিক কচ্ছপ। স্থানীয়দের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, ২৪ থেকে ৩০ জানুয়ারি পর্যন্ত সাত দিনে অন্তত ১৫১টি কচ্ছপ মারা গেছে। কক্সবাজার সৈকত ছাড়াও সেন্টমার্টিন, সোনাদিয়া, কুতুবদিয়া সৈকতেও অনেক মৃত কচ্ছপ ভেসে আসছে। কচ্ছপ নিয়ে কাজ করা বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থার লোকজন জানান, বাংলাদেশে অলিভ রিডলি কচ্ছপের প্রজনন ক্ষেত্র কক্সবাজারের সোনাদিয়া থেকে সেন্টমার্টিন সমুদ্র উপকূলের সৈকতের বালিয়াড়ি। প্রজনন মৌসুমে (নভেম্বর থেকে মার্চ) এ প্রজাতির মা কচ্ছপ দল বেঁধে হাজার মাইল পাড়ি দিয়ে বালিয়াড়িতে ডিম পাড়তে আসে। গত দুই দশকে কক্সবাজার সৈকতে কচ্ছপের ডিম দেওয়ার নিরাপদ স্থান কমে নেমে এসেছে অর্ধেকে। 

গত বছরও প্রজনন মৌসুমে কক্সবাজার সৈকতের বিভিন্ন পয়েন্টে মৃত মা কচ্ছপ ভেসে এসেছিল বা ডিম পাড়তে এসে মারা পড়েছে। 
মৃত অধিকাংশ কচ্ছপের পেটে ডিম ছিল। 

গত বছরের তুলনায় এ বছর কচ্ছপের মৃত্যুর হার অস্বাভাবিক। 
বাংলাদেশ সমুদ্র গবেষণা ইনস্টিটিউটের (বোরি) বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা শিমুল ভূঁইয়া জানান, গত সাত দিনে ১৫১টি কচ্ছপ মারা গেছে। সর্বশেষ ২৯ জানুয়ারি কক্সবাজার সৈকতের নাজিরারটেক, হিমছড়ি ও প্যাঁচারদ্বীপ এলাকায় ১৪টি মৃত কচ্ছপ পাওয়া গেছে। এর মধ্যে পুরুষ ও স্ত্রী কচ্ছপ রয়েছে। এসব কচ্ছপ এক থেকে দুই দিন বা তারও আগে মারা পড়েছে। কিছু কচ্ছপ এক সপ্তাহ বা ১০-১২ দিন আগে মারা গেছে। মৃত্যুর কারণ অনুসন্ধানে মৃত কচ্ছপের নমুনা সংগ্রহ করা হয়েছে।
শিমুল ভূঁইয়া বলেন, ‘নভেম্বর থেকে মার্চ পর্যন্ত সামুদ্রিক কচ্ছপের প্রজনন মৌসুম। এ সময় সমুদ্র উপকূলের বালিয়াড়িতে ডিম দিতে আসে মা কচ্ছপ। এই মা কচ্ছপগুলো উপকূলের কাছাকাছি এসে জেলেদের জালে আটকা পড়ছে বা বড় নৌযানের ধাক্কা কিংবা অন্য কোনোভাবে আঘাতপ্রাপ্ত হয়ে মারা পড়ছে।’ 

সমুদ্রবিজ্ঞানীরা জানান, অলিভ রিডলি কাছিম সমুদ্রের হাজার হাজার কিলোমিটার পাড়ি দেওয়ার সময় বার্নাকল, ক্রাস্টেসিয়ানের ছোট প্রাণীরা তাদের গায়ে আশ্রয় নেয়। এতে ছোট প্রাণীগুলো শিকারির হাত থেকে রক্ষা পায়। এ ধরনের কচ্ছপ সামুদ্রিক ঘাস, শ্যাওলা, অমেরুদণ্ডী প্রাণী যেমন– জেলিফিশ, পোকামাকড় খেয়ে সমুদ্রের পরিবেশ ঠিক রাখে। কাছিম যখন সৈকতে ডিম পাড়ে, তখন তারা বালু ও গাছপালার জন্য গুরুত্বপূর্ণ পুষ্টি সরবরাহ করে। কচ্ছপের ডিমের খোসা সার হিসেবেও কাজ করে এবং উপকূলের বালুর স্থিতিশীলতা বৃদ্ধি করে ভাঙন রোধে সহায়ক। 
কচ্ছপের প্রজনন ও সংরক্ষণ নিয়ে কাজ করা নেচার কনজারভেশন ম্যানেজমেন্টের (নেকম) ২০০৩ সালে করা এক জরিপে দেখা গেছে, কক্সবাজার উপকূলের ৫২ পয়েন্টে সামুদ্রিক মা কচ্ছপ ডিম দিতে আসে। ওই সময় এসব পয়েন্ট মা কচ্ছপের কাছে অত্যন্ত নিরাপদ পয়েন্ট ছিল। এখন এই সংখ্যা ৩০ থেকে ৩২-এ ঠেকেছে। নেকমের উপপ্রকল্প পরিচালক ড.

শফিকুর রহমান বলেন, মা কচ্ছপের ডিম দেওয়ার সময় সাধারণত নভেম্বর থেকে শুরু হলেও এখন এপ্রিল-মে পর্যন্ত চলে। রাতের বেলায় নির্জন সৈকতে এসে বালুতে গর্ত তৈরি করে ডিম দেয়। এর পর মা কচ্ছপ ফিরে যায় সাগরে। ৬০ থেকে ৬৫ দিনের মধ্যে প্রাকৃতিকভাবে ডিম থেকে বাচ্চা জন্ম নেয়। এর পর বাচ্চাগুলো গর্ত থেকে বের হয়ে চলে যায় সাগরে। কচ্ছপের ডিম পাড়ার স্থানগুলো কুকুর-শিয়াল বা অন্য কোনো প্রাণী যাতে নষ্ট করতে না পারে, তার জন্য পাহারা ও ঘের দেওয়ার ব্যবস্থা করা হচ্ছে বলে জানান তিনি।
শফিকুর রহমান আরও বলেন, সোনাদিয়া থেকে সেন্টমার্টিন দ্বীপ পর্যন্ত সৈকতের নির্জন এলাকায় কচ্ছপ দলবেঁধে ডিম দিত। 
সৈকতে অপরিকল্পিত পর্যটন, অবকাঠামো নির্মাণ, আলোকায়ন, সমুদ্রে পরিত্যক্ত জাল ফেলে দেওয়াসহ নানা কারণে কচ্ছপের প্রজনন বাধা পাচ্ছে।
পরিবেশ অধিদপ্তর কক্সবাজার জেলা কার্যালয়ের উপপরিচালক জমির উদ্দিন বলেন, কচ্ছপসহ সব জীববৈচিত্র্য এবং পরিবেশ-প্রতিবেশ সংরক্ষণের জন্য কক্সবাজারে পরিবেশবান্ধব পর্যটনের বিকাশ ঘটাতে হবে। নইলে কোনোভাবেই পরিবেশ কিংবা জীববৈচিত্র্য কিংবা সামুদ্রিক প্রাণী সংরক্ষণ সম্ভব নয়।

উৎস: Samakal

কীওয়ার্ড: উপক ল র র উপক ল পর ব শ স কত র

এছাড়াও পড়ুন:

স্বাদুপানির মাছ কমে যাচ্ছে: প্রাকৃতিক বাস্তুতন্ত্র কি টিকে থাকবে

‘নদীমাতৃক বাংলাদেশ’ শব্দবন্ধটি একসময় শুধু পাঠ্যবইয়ের বুলি ছিল না, ছিল আমাদের যাপিত জীবনের প্রতিচ্ছবি। বর্ষায় থই থই করা বিলে মাছের দাপাদাপি, জলের রুপালি ফসলে জেলের মুখে হাসি, আর পাতে ভাপে সেদ্ধ বা ঝোল করা দেশি মাছের স্বাদ—বাঙালির সংস্কৃতির এই অবিচ্ছেদ্য অংশটি আজ হুমকির মুখে।

আমাদের স্বাদুপানির মাছ বা দেশি মাছের ভান্ডার আজ আশঙ্কাজনক হারে ফুরিয়ে যাচ্ছে; কিন্তু প্রশ্ন হলো, এটি কি কেবলই আমাদের রসনার তৃপ্তি বা আমিষের অভাব? নাকি এর পেছনে লুকিয়ে আছে এক ভয়াবহ পরিবেশগত বিপর্যয়?

হারিয়ে যাওয়া শৈশব ও বর্তমান বাস্তবতা

বেশি দিন আগের কথা নয়, গ্রামবাংলার খাল-বিল, হাওর-বাঁওড় ছিল দেশি মাছের প্রজননক্ষেত্র। পাবদা, ট্যাংরা, পুঁটি, খলিসা, মলা, ঢেলা, শোল, গজার নামগুলো বলে শেষ করা যাবে না।

আন্তর্জাতিক প্রকৃতি ও প্রাকৃতিক সম্পদ সংরক্ষণ সংঘের (আইইউসিএন) তথ্যমতে, বাংলাদেশে প্রায় ২৬০ প্রজাতির স্বাদুপানির মাছ ছিল; কিন্তু বর্তমানে এর একটি বিশাল অংশ বিপন্ন, অতি বিপন্ন অথবা বিলুপ্তির পথে।

আমরা এখন বাজারে যে মাছ দেখি, তার বড় অংশই চাষের—পাঙাশ, তেলাপিয়া কিংবা হাইব্রিড কই। এই মাছগুলো আমাদের আমিষের চাহিদা মেটাচ্ছে সত্য; কিন্তু প্রাকৃতিকভাবে জন্মানো মাছের যে অভাব তৈরি হয়েছে, তা কোনোভাবেই পূরণীয় নয়।

কেন এই বিষণ্নতা

মাছ কমে যাওয়ার পেছনে একক কোনো কারণ নেই; বরং এটি মানুষের অপরিণামদর্শী কর্মকাণ্ডের সমষ্টিগত ফল। উন্নয়নের নামে নদী, খাল ও বিল ভরাট করে তৈরি হচ্ছে আবাসন বা শিল্পকারখানা। মাছের প্রাকৃতিক প্রজননক্ষেত্র বা ‘নার্সারি গ্রাউন্ড’ ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে। আবার কলকারখানার অপরিশোধিত বর্জ্য ও কৃষিজমিতে ব্যবহৃত মাত্রাতিরিক্ত কীটনাশক বৃষ্টির পানিতে ধুয়ে জলাশয়ে মিশছে। এতে পানি বিষাক্ত হয়ে মাছের বেঁচে থাকা অসম্ভব করে তুলছে।

কারেন্ট জালের ব্যবহার এবং প্রজনন মৌসুমে মা মাছ ও পোনা মাছ নিধন মাছের বংশবিস্তারে বড় বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে। তা ছাড়া বাংলাদেশের অস্থিতিশীল আবহাওয়া মাছের প্রজননে প্রভাব ফেলছে। অনিয়মিত বৃষ্টিপাত, খরা ও তাপমাত্রার পরিবর্তন মাছের প্রজনন চক্রকে ব্যাহত করছে।

প্রাকৃতিক বাস্তুতন্ত্র কি টিকে থাকবে

এখন মূল প্রশ্ন এখানেই—মাছ কমে গেলে পরিবেশের কী এমন ক্ষতি হবে? উত্তর হলো চরম বিপর্যয় ঘটবে।

খাদ্যশৃঙ্খলে ধস: স্বাদুপানির মাছ কেবল মানুষের খাদ্য নয়, এটি জলজ বাস্তুতন্ত্রের খাদ্যশৃঙ্খলের একটি অপরিহার্য অংশ। মাছ কমে গেলে মাছরাঙা, বক, চিল, পানকৌড়ি এবং ভোঁদড়ের মতো প্রাণী খাদ্যসংকটে পড়ে। ইতিমধ্যে গ্রামবাংলা থেকে অনেক মাছশিকারি পাখি বিলুপ্ত হয়ে গেছে।

পানির গুণ রক্ষা: অনেক প্রজাতির মাছ (যেমন আবর্জনাভুক মাছ) পানি পরিষ্কার রাখতে সাহায্য করে। এরা পচনশীল দ্রব্য খেয়ে জলাশয়ের স্বাস্থ্য রক্ষা করে। মাছ না থাকলে জলাশয়গুলো দ্রুত দূষিত হবে এবং মশা-মাছির উপদ্রব বাড়বে।

বাস্তুতন্ত্রের ভারসাম্য: জলজ উদ্ভিদের বৃদ্ধি নিয়ন্ত্রণ এবং প্লাঙ্কটনের ভারসাম্য রক্ষায় মাছের ভূমিকা অপরিসীম। মাছের অভাব পুরো জলজ পরিবেশকে মৃতপ্রায় বা ডেড জোনে পরিণত করতে পারে।

সুতরাং মাছ কমে যাওয়া মানে কেবল খাবারের প্লেটে সংকট নয়; বরং পুরো প্রাকৃতিক বাস্তুতন্ত্র বা ইকোসিস্টেম ভেঙে পড়ার সতর্কবার্তা।

অর্থনৈতিক ও পুষ্টির সংকট

গ্রামের দরিদ্র জনগোষ্ঠীর পুষ্টির, বিশেষ করে ক্যালসিয়াম ও ভিটামিন এ–এর প্রধান উৎস ছিল ছোট মাছ। এই মাছগুলো হারিয়ে যাওয়ায় গ্রামীণ জনস্বাস্থ্যে নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে। এ ছাড়া যারা বংশপরম্পরায় জেলে পেশায় জড়িত, নদীতে মাছ না পেয়ে তাঁরা আজ বেকার। বাধ্য হয়ে তাঁরা পেশা পরিবর্তন করছেন, যা গ্রামীণ অর্থনীতিতে চাপ সৃষ্টি করছে।

হতাশার মধ্যে ও আশার আলো হলো প্রকৃতিকে সুযোগ দিলে সে নিজেকে সারিয়ে তুলতে পারে। তবে এর জন্য প্রয়োজন আশু পদক্ষেপ—

মৎস্য অভয়াশ্রম বৃদ্ধি: হাওর ও নদীগুলোর নির্দিষ্ট কিছু অংশকে সারা বছরের জন্য বা প্রজনন মৌসুমে মৎস্য অভয়াশ্রম ঘোষণা করে কঠোরভাবে রক্ষণাবেক্ষণ করতে হবে।

দূষণ রোধ: শিল্পবর্জ্য নদীতে ফেলার আগে শোধন (ইটিপি ব্যবহার) বাধ্যতামূলক করতে হবে। কৃষিতে জৈব সারের ব্যবহার বাড়াতে হবে।

জনসচেতনতা ও আইন প্রয়োগ: কারেন্ট জাল বা বিষ দিয়ে মাছ ধরা বন্ধে আইনের কঠোর প্রয়োগ এবং জেলেদের মধ্যে সচেতনতা তৈরি করতে হবে।

জলাশয় পুনরুদ্ধার: ভরাট হয়ে যাওয়া খাল-বিল খনন করে পানির প্রবাহ ফিরিয়ে আনতে হবে।

স্বাদু পানির মাছ রক্ষা করা কেবল মৎস্য অধিদপ্তরের কাজ নয়, এটি আমাদের অস্তিত্ব রক্ষার লড়াই। নদী বাঁচলে মাছ বাঁচবে; আর মাছ বাঁচলে টিঁকে থাকবে আমাদের প্রাণবৈচিত্র্য ও বাস্তুতন্ত্র। আমরা যদি এখনই সচেতন না হই, তবে ভবিষ্যৎ প্রজন্ম হয়তো জাদুঘরে গিয়ে জানবে—একদা এ দেশে ‘মাছে-ভাতে বাঙালি’ নামে একটি জাতি ছিল।

প্রাকৃতিক বাস্তুতন্ত্র টিঁকে থাকবে কি না, তার উত্তর নির্ভর করছে আজ আমরা প্রকৃতির প্রতি কতটা সদয় আচরণ করছি, তার ওপর। সময় দ্রুত ফুরিয়ে আসছে, সিদ্ধান্ত নিতে হবে এখনই।

হেনা শিকদার দর্শন বিভাগ, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়

সম্পর্কিত নিবন্ধ

  • স্বাদুপানির মাছ কমে যাচ্ছে: প্রাকৃতিক বাস্তুতন্ত্র কি টিকে থাকবে