কক্সবাজার সমুদ্র উপকূলে প্রায় প্রতিদিনই ভেসে আসছে অলিভ রিডলি বা জলপাই রঙের সামুদ্রিক কচ্ছপ। স্থানীয়দের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, ২৪ থেকে ৩০ জানুয়ারি পর্যন্ত সাত দিনে অন্তত ১৫১টি কচ্ছপ মারা গেছে। কক্সবাজার সৈকত ছাড়াও সেন্টমার্টিন, সোনাদিয়া, কুতুবদিয়া সৈকতেও অনেক মৃত কচ্ছপ ভেসে আসছে। কচ্ছপ নিয়ে কাজ করা বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থার লোকজন জানান, বাংলাদেশে অলিভ রিডলি কচ্ছপের প্রজনন ক্ষেত্র কক্সবাজারের সোনাদিয়া থেকে সেন্টমার্টিন সমুদ্র উপকূলের সৈকতের বালিয়াড়ি। প্রজনন মৌসুমে (নভেম্বর থেকে মার্চ) এ প্রজাতির মা কচ্ছপ দল বেঁধে হাজার মাইল পাড়ি দিয়ে বালিয়াড়িতে ডিম পাড়তে আসে। গত দুই দশকে কক্সবাজার সৈকতে কচ্ছপের ডিম দেওয়ার নিরাপদ স্থান কমে নেমে এসেছে অর্ধেকে।
গত বছরও প্রজনন মৌসুমে কক্সবাজার সৈকতের বিভিন্ন পয়েন্টে মৃত মা কচ্ছপ ভেসে এসেছিল বা ডিম পাড়তে এসে মারা পড়েছে।
মৃত অধিকাংশ কচ্ছপের পেটে ডিম ছিল।
গত বছরের তুলনায় এ বছর কচ্ছপের মৃত্যুর হার অস্বাভাবিক।
বাংলাদেশ সমুদ্র গবেষণা ইনস্টিটিউটের (বোরি) বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা শিমুল ভূঁইয়া জানান, গত সাত দিনে ১৫১টি কচ্ছপ মারা গেছে। সর্বশেষ ২৯ জানুয়ারি কক্সবাজার সৈকতের নাজিরারটেক, হিমছড়ি ও প্যাঁচারদ্বীপ এলাকায় ১৪টি মৃত কচ্ছপ পাওয়া গেছে। এর মধ্যে পুরুষ ও স্ত্রী কচ্ছপ রয়েছে। এসব কচ্ছপ এক থেকে দুই দিন বা তারও আগে মারা পড়েছে। কিছু কচ্ছপ এক সপ্তাহ বা ১০-১২ দিন আগে মারা গেছে। মৃত্যুর কারণ অনুসন্ধানে মৃত কচ্ছপের নমুনা সংগ্রহ করা হয়েছে।
শিমুল ভূঁইয়া বলেন, ‘নভেম্বর থেকে মার্চ পর্যন্ত সামুদ্রিক কচ্ছপের প্রজনন মৌসুম। এ সময় সমুদ্র উপকূলের বালিয়াড়িতে ডিম দিতে আসে মা কচ্ছপ। এই মা কচ্ছপগুলো উপকূলের কাছাকাছি এসে জেলেদের জালে আটকা পড়ছে বা বড় নৌযানের ধাক্কা কিংবা অন্য কোনোভাবে আঘাতপ্রাপ্ত হয়ে মারা পড়ছে।’
সমুদ্রবিজ্ঞানীরা জানান, অলিভ রিডলি কাছিম সমুদ্রের হাজার হাজার কিলোমিটার পাড়ি দেওয়ার সময় বার্নাকল, ক্রাস্টেসিয়ানের ছোট প্রাণীরা তাদের গায়ে আশ্রয় নেয়। এতে ছোট প্রাণীগুলো শিকারির হাত থেকে রক্ষা পায়। এ ধরনের কচ্ছপ সামুদ্রিক ঘাস, শ্যাওলা, অমেরুদণ্ডী প্রাণী যেমন– জেলিফিশ, পোকামাকড় খেয়ে সমুদ্রের পরিবেশ ঠিক রাখে। কাছিম যখন সৈকতে ডিম পাড়ে, তখন তারা বালু ও গাছপালার জন্য গুরুত্বপূর্ণ পুষ্টি সরবরাহ করে। কচ্ছপের ডিমের খোসা সার হিসেবেও কাজ করে এবং উপকূলের বালুর স্থিতিশীলতা বৃদ্ধি করে ভাঙন রোধে সহায়ক।
কচ্ছপের প্রজনন ও সংরক্ষণ নিয়ে কাজ করা নেচার কনজারভেশন ম্যানেজমেন্টের (নেকম) ২০০৩ সালে করা এক জরিপে দেখা গেছে, কক্সবাজার উপকূলের ৫২ পয়েন্টে সামুদ্রিক মা কচ্ছপ ডিম দিতে আসে। ওই সময় এসব পয়েন্ট মা কচ্ছপের কাছে অত্যন্ত নিরাপদ পয়েন্ট ছিল। এখন এই সংখ্যা ৩০ থেকে ৩২-এ ঠেকেছে। নেকমের উপপ্রকল্প পরিচালক ড.
শফিকুর রহমান আরও বলেন, সোনাদিয়া থেকে সেন্টমার্টিন দ্বীপ পর্যন্ত সৈকতের নির্জন এলাকায় কচ্ছপ দলবেঁধে ডিম দিত।
সৈকতে অপরিকল্পিত পর্যটন, অবকাঠামো নির্মাণ, আলোকায়ন, সমুদ্রে পরিত্যক্ত জাল ফেলে দেওয়াসহ নানা কারণে কচ্ছপের প্রজনন বাধা পাচ্ছে।
পরিবেশ অধিদপ্তর কক্সবাজার জেলা কার্যালয়ের উপপরিচালক জমির উদ্দিন বলেন, কচ্ছপসহ সব জীববৈচিত্র্য এবং পরিবেশ-প্রতিবেশ সংরক্ষণের জন্য কক্সবাজারে পরিবেশবান্ধব পর্যটনের বিকাশ ঘটাতে হবে। নইলে কোনোভাবেই পরিবেশ কিংবা জীববৈচিত্র্য কিংবা সামুদ্রিক প্রাণী সংরক্ষণ সম্ভব নয়।
উৎস: Samakal
কীওয়ার্ড: উপক ল র র উপক ল পর ব শ স কত র
এছাড়াও পড়ুন:
মশা নিধনে জোরালো পদক্ষেপ নিতে হবে
চট্টগ্রামে এডিস মশার প্রজনন ও লার্ভার ঘনত্ব গত এক বছরে দ্বিগুণ হয়েছে, আর এর সরাসরি ফল ভোগ করছেন নগরবাসী। স্বাস্থ্য কর্মকর্তাদের মতে, এবার ডেঙ্গুর চেয়েও চিকুনগুনিয়া ঘরে ঘরে মারাত্মক আকার ধারণ করেছে, যা এক নতুন উদ্বেগের জন্ম দিয়েছে। মশা নিধনে কার্যকর ও সমন্বিত উদ্যোগের অভাবই এ রোগের দ্রুত বিস্তারের প্রধান কারণ বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা। চট্টগ্রামে এভাবে জনস্বাস্থ্য ভেঙে পড়ার বিষয়টি খুবই উদ্বেগজনক।
রোগতত্ত্ব, রোগনিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের (আইইডিসিআর) গবেষণা প্রতিবেদন বলছে, চট্টগ্রাম নগর এডিস মশাবাহিত রোগের জন্য এখন অতি ঝুঁকিপূর্ণ। গত বছর সিভিল সার্জন কার্যালয়ের কীটতত্ত্ব বিভাগ একই ধরনের জরিপ চালিয়েছিল। এই দুই জরিপের তুলনামূলক চিত্র আমাদের সামনে এক ভয়াবহ বাস্তবতা তুলে ধরে—এডিস মশার প্রজনন ও লার্ভার ঘনত্ব দুটিই আশঙ্কাজনক হারে বেড়েছে।
২০২৪ সালে চট্টগ্রামে এডিস মশার লার্ভার ঘনত্ব (ব্রুটো ইনডেক্স) ছিল ৩৬ শতাংশ, যা এবার আইইডিসিআরের গবেষণায় পৌঁছেছে ৭৫ দশমিক ২৯ শতাংশে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার নির্ধারিত মান যেখানে ২০ শতাংশ, সেখানে চট্টগ্রামের এ চিত্র রীতিমতো ভয়াবহ। বাসাবাড়িতেও লার্ভার উপস্থিতি বেড়েছে। গত বছর ৩৭ শতাংশ বাড়িতে লার্ভা পাওয়া গেলেও এবার তা প্রায় ৪৮ শতাংশে পৌঁছেছে।
চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে এবার ডেঙ্গুর চেয়ে চিকুনগুনিয়ার রোগী বেশি পাওয়া যাচ্ছে। আবার অনেকের ডেঙ্গু ও চিকুনগুনিয়া দুটিই হচ্ছে। এর সঙ্গে যোগ হয়েছে জিকা ভাইরাসের উপস্থিতি, যা পরিস্থিতিকে আরও জটিল করে তুলেছে। চলতি বছরেই ৭৬৪ জনের চিকুনগুনিয়া ও ৭৯৩ জনের ডেঙ্গু শনাক্ত হয়েছে এবং ডেঙ্গুতে আটজন প্রাণ হারিয়েছেন, যার মধ্যে ছয়জনই মারা গেছেন এই জুলাই মাসে।
সিভিল সার্জন জাহাঙ্গীর আলম বলেছেন, আইইডিসিআরের সুপারিশগুলো সিটি করপোরেশন ও জেলা প্রশাসনের কাছে পাঠানো হয়েছে এবং সে অনুযায়ী কাজ চলছে। সিটি করপোরেশনের মশক নিয়ন্ত্রণ কর্মকর্তা শরফুল ইসলাম দাবি করছেন যে মশকনিধনে ক্রাশ কর্মসূচি চলছে এবং নতুন জরিপ অনুযায়ী হটস্পট ধরে কাজ করা হচ্ছে। তবে প্রশ্ন হলো এ উদ্যোগগুলো কি যথেষ্ট? লার্ভার ঘনত্ব যেখানে তিন-চার গুণ বেশি, সেখানে গতানুগতিক কর্মসূচির ওপর নির্ভর করলে চলবে না।
মশাবাহিত রোগ থেকে মুক্তি পেতে হলে মশার প্রজননস্থল ধ্বংস করার কোনো বিকল্প নেই। এ কাজে সিটি করপোরেশনকে সবচেয়ে বেশি ভূমিকা রাখতে হবে। বাসাবাড়িতে নানা জায়গায় জমে থাকা স্বচ্ছ পানিও এডিস মশার প্রজননের জন্য যথেষ্ট। ফলে নাগরিকদের সচেতনতা এখানে খুবই গুরুত্বপূর্ণ। চট্টগ্রাম শহরকে মশাবাহিত রোগের ভয়াবহতা থেকে রক্ষা করতে হলে স্থানীয় প্রশাসন, নগর কর্তৃপক্ষকে দ্রুত পদক্ষেপ নিতে হবে; নগরবাসীকে দ্রুত তৎপর হতে হবে।