‘ওসমান হাদীর ওপর গুলি বর্ষনকারী জামায়াত–শিবিরের রাজনীতির সাথে জড়িত’—ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) কমিশনার শেখ মো. সাজ্জাত আলীকে উদ্ধৃত এমন একটি ভুয়া ফটোকার্ড ফেসবুকে ছড়িয়ে বিভ্রান্তি ছড়ানো হয়েছে। আর এই ফটোকার্ডের বক্তব্য ধরে জামায়াতে ইসলামীকে দায়ী করে বিএনপি নেতা রুহুল কবির রিজভী বক্তব্য দেন, যা নিয়ে জামায়াতে ইসলামী কড়া প্রতিক্রিয়া ও প্রতিবাদ জানিয়েছে। পরে রাতে দুঃখ প্রকাশ করে বিবৃতি দেন রিজভী।

এদিকে এমন ভুয়া ফটোকার্ড ছড়িয়ে বিভ্রান্তি না ছড়াতে সবাইকে সতর্ক থাকার অনুরোধ জানিয়েছে ডিএমপি। এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে ডিএমপির পক্ষ থেকে বলা হয়, কে বা কারা অসৎ উদ্দেশ্যে একটি ফটোকার্ড তৈরি করে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে জনমনে বিভ্রান্তি সৃষ্টির চেষ্টা করছে। বিষয়টিকে ঘৃণ্য অপচেষ্টা হিসেবে উল্লেখ করে পুলিশ জানিয়েছে, এ ধরনের গুজব ও মিথ্যা তথ্যে বিভ্রান্ত না হওয়ার জন্য সর্বসাধারণকে অনুরোধ করা হচ্ছে।

ডিএমপি আরও জানায়, ওসমান হাদির ওপর হামলাকারীদের ইতোমধ্যে শনাক্ত করা হয়েছে। তাঁদের গ্রেপ্তারে পুলিশ তৎপর রয়েছে। একই সঙ্গে ঘটনাটি নিয়ে অহেতুক বিভ্রান্তি তৈরির সঙ্গে জড়িতদেরও চিহ্নিত করে শিগগিরই আইনের আওতায় আনা হবে। এ ছাড়া সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমসহ যেকোনো মাধ্যমে পাওয়া তথ্য যাচাই-বাছাই করার জন্য সর্বসাধারণকে আবারও অনুরোধ জানিয়েছে পুলিশ।

আজ শনিবার দুপুরে ঢাকায় এক বিক্ষোভ সমাবেশে বিএনপির জ্যেষ্ঠ যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী হাদির ওপর গুলির ঘটনায় জামায়াতকে জড়িয়ে বক্তব্য দেন। তিনি বলেন, ‘আজকে পুলিশ কমিশনার বলছে যে, যে হামলাকারীকে শনাক্ত করা হয়েছে, জামায়াত-শিবিরের লোক। এখন আমি বলি, এগুলো বিএনপির কোনো নেতার স্টেটমেন্ট নয়। এটা যাঁরা তদন্তকারী কর্মকর্তা রয়েছেন, যারা রাষ্ট্রের আইনের স্বীকৃত সংস্থা, তারা বলছেন। এখন ফেসবুকে কী লিখবেন, আমি সেই ছাত্রনেতাকে জিজ্ঞেস করতে চাই।’

বিএনপির জ্যেষ্ঠ যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভীর এই বক্তব্যের প্রতিবাদ জানিয়েছে জামায়াতে ইসলামী। দলটির সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল এহসানুল মাহবুব জুবায়ের আজ সন্ধ্যায় এক বিবৃতিতে বলেন, বিএনপির জ্যেষ্ঠ  যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী ডিএমপি কমিশনার শেখ সাজ্জাত আলীকে উদ্ধৃত করে যে মিথ্যা ও ভিত্তিহীন বক্তব্য দিয়েছে, সেটার নিন্দা ও প্রতিবাদ জানাচ্ছি। তিনি বলেন, রাষ্ট্রের একটি গুরুত্বপূর্ণ বাহিনীর কর্মকর্তাকে জড়িয়ে এ ধরনের মনগড়া বক্তব্য দেওয়া রাজনৈতিক শিষ্টাচারবিরোধী এবং জনমনে বিভ্রান্তি সৃষ্টির শামিল।

দুঃখ প্রকাশ করে রিজভীর বিবৃতি

‘আরটিভির লোগো ব্যবহার করে ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশ কমিশনারের বক্তব্য সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে ভাইরাল হয় এবং এ ছাড়াও শরিফ ওসমান হাদিকে আক্রমণকারী একজন সন্দেহভাজন ব্যক্তির সাথে ডাকসুর ভিপির চা খাওয়ার দৃশ্যটিও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ভাইরাল হয়। এ দুইটি বিষয় ছিল ভিত্তিহীন এবং এআই জেনারেটেড। ফ্যাক্ট চেক না করে উল্লিখিত বিষয় দুটি নিয়ে আজ দুপুরে নয়াপল্টনস্থ বিএনপি কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের সামনে একটি সভায় বক্তব্য রাখি। এই অনিচ্ছকৃত ভুল বক্তব্যের জন্য আন্তরিকভাবে দুঃখিত।’

.

উৎস: Prothomalo

কীওয়ার্ড: ব এনপ র ড এমপ

এছাড়াও পড়ুন:

ওসমান হাদিকে হামলা: গুলির লক্ষ্য একজন না, লক্ষ্য নির্বাচন

শরিফ ওসমান হাদির ওপর হামলাকে ‘একটা বিচ্ছিন্ন ঘটনা’ হিসেবে দেখার সুযোগ নেই। এটা একটা বার্তা। আর বার্তাটা খুব সোজা, রাজনীতির মাঠে যে কণ্ঠটা একটু আলাদা, আবার বড় দলগুলোর সরাসরি ছায়ায় নেই, তাকে আঘাত করো। কম ঝুঁকি, বেশি লাভ।

ঘটনাটা ঘটেছে ১২ ডিসেম্বর ২০২৫, পল্টন থানাধীন বিজয়নগর বক্স কালভার্ট এলাকায়, দিনের আলোয়, জুমার পরের সময়ের মধ্যে। প্রত্যক্ষদর্শীর ভাষ্যেও জুমার পরের কথাই এসেছে। পুলিশ বলছে, মোটরসাইকেল আরোহীরা গুলি করে পালিয়েছে। হাদি জুলাই অভ্যুত্থানের আকাঙ্ক্ষা নিয়ে গড়ে ওঠা প্ল্যাটফর্ম ইনকিলাব মঞ্চের মুখপাত্র, আবার ঢাকা-৮ আসনে স্বতন্ত্র প্রার্থী হওয়ার কথা বলে মাঠে ছিলেন। পরে তাঁকে ঢাকা মেডিকেল থেকে এভারকেয়ারে নেওয়ার খবরও আসে।

এখানে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক দিকটা হলো টাইমিং। তফসিল ঘোষণার পর ২৪ ঘণ্টার মধ্যেই এমন একটা হামলা, এটাকে ‘সাধারণ অপরাধ’ বলে উড়িয়ে দিলে বাস্তবতা ধরা পড়বে না। সংবাদ রিপোর্টে পরিষ্কার যে তফসিল ঘোষণার পরপরই ঘটনাটা ঘটেছে, আর দেশ এখন ফেব্রুয়ারি ২০২৬ নির্বাচনকে সামনে রেখে দাঁড়িয়ে।

এই মুহূর্তে একজন পরিচিত মুখকে গুলি করা মানে এক ঢিলে অনেক পাখি মারা। জনমনে আতঙ্ক বাড়বে, রাজনৈতিক পক্ষগুলো সন্দেহ করবে, পাল্টা ভাষা আরও কড়া হবে, মাঠ আরও উত্তপ্ত হবে। নির্বাচনের আগের বাংলাদেশে অস্থিরতা তৈরি করার চেয়ে কার্যকর অস্ত্র খুব কম আছে।

এই মুহূর্তে একজন পরিচিত মুখকে গুলি করা মানে এক ঢিলে অনেক পাখি মারা। জনমনে আতঙ্ক বাড়বে, রাজনৈতিক পক্ষগুলো সন্দেহ করবে, পাল্টা ভাষা আরও কড়া হবে, মাঠ আরও উত্তপ্ত হবে। নির্বাচনের আগের বাংলাদেশে অস্থিরতা তৈরি করার চেয়ে কার্যকর অস্ত্র খুব কম আছে।

হাদিকে টার্গেট করার যুক্তিটা এখানেই। তিনি বিএনপি-জামায়াতের মতো বড় দলগুলোর প্রকাশ্য কর্মী নন। ইনকিলাব মঞ্চ নিজেকে আলাদা প্ল্যাটফর্ম হিসেবে তুলে ধরে, হাদি নিজেও সেই পরিচয়ই সামনে রাখেন।

ফলে তাঁকে আঘাত করলে কোনো দল ‘দলীয় আক্রমণ’ বলে সঙ্গে সঙ্গে পুরো মেশিন নামাবে না, কিন্তু জনমনে তার প্রতিক্রিয়া হবে বড়। কারণ, হাদি এক বছরের বেশি সময় ধরে জনপরিসরে দৃশ্যমান ছিলেন, শক্ত ভাষায় কথা বলতেন, যার অনেক কথা নিয়ে সমালোচনা তৈরি হয়, সেই কথার সঙ্গে যেমন কিছু মানুষ একমত হয়েছেন, তেমনি অনেকে বিরোধিতা করেছেন, কিন্তু মানুষ তাঁকে শুনতেন। এই শোনা, এই দৃশ্যমানতা, এই আবেগই তাঁকে হাই ভ্যালু টার্গেট করে তোলে।

আরও পড়ুনতফসিল ঘোষণা, গুলিবিদ্ধ ওসমান হাদি ও নির্বাচন নিয়ে উদ্বেগ৫ ঘণ্টা আগে

আরেকটি বিষয় আছে, আমাদের দেশে ‘নিরপেক্ষ’ শব্দটা যতটা গ্ল্যামারাস, ততটাই বিপজ্জনক। দলীয় রাজনীতির ছায়া না থাকলে আপনি স্বাধীন থাকেন, কিন্তু একা থাকেন। নিরাপত্তা, সংগঠন, শৃঙ্খলা, পাল্টা চাপ তৈরি করার ক্ষমতা, এগুলো একা থাকলে কমে যায়। হাদির ক্ষেত্রে এই একা থাকার সুবিধা আর ঝুঁকি দুটোই কাজ করেছে।

এখন প্রশ্ন আসে, রাষ্ট্র কোথায় ছিল? ৫ আগস্ট ২০২৪-এর সরকার পতনের পর দেশ একটা দীর্ঘ ট্রানজিশনের পথে যাত্রা করেছে, ৮ আগস্ট ড. মুহাম্মদ ইউনূস অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা হিসেবে শপথ নেন। সেই সময় মানুষ ভাবছিল আইনশৃঙ্খলা ঠিক হবে, ভয়ের চক্র থামবে, নির্বাচন হবে, ক্ষমতা হস্তান্তর হবে। রাজনৈতিক সরকার ক্ষমতা গ্রহণ করবে।

কিন্তু বাস্তবতা হলো, আইনশৃঙ্খলা নিয়ে রাষ্ট্র বারবার আশ্বাস দিয়েছে, মাঠে মানুষ বারবার অনিশ্চয়তা দেখেছে। তফসিল ঘোষণার পরদিন দিনের আলোয় একজন প্রার্থী এবং রাজনৈতিক প্ল্যাটফর্মের মুখপাত্রকে গুলি করার ঘটনা সেই অনিশ্চয়তাকে নগ্ন করে দিল।

রাষ্ট্রের প্রতিক্রিয়া আনুষ্ঠানিকভাবে এসেছে। প্রধান উপদেষ্টার দপ্তর দ্রুত তদন্ত ও গ্রেপ্তারের নির্দেশ দিয়েছে। পুলিশও ‘ম্যানহান্ট’ বলছে। কিন্তু সমস্যা কেবল নির্দেশে না, সমস্যাটা হলো বিশ্বাসে। মানুষ কাগজে নির্দেশ দেখে না, মানুষ রাস্তায় নিরাপত্তা দেখে। মানুষ দেখে, নির্বাচনের আগের মাঠে কে হাঁটতে পারছে, কে হাঁটতে ভয় পাচ্ছে।

গুলিবিদ্ধ শরিফ ওসমান হাদি। শুক্রবার বিকেলে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে।

সম্পর্কিত নিবন্ধ

  • রিজভীর বক্তব‌্য দায়িত্বজ্ঞানহীন, জনমনে বিভ্রান্তি সৃষ্টির শামিল: জামায়াত
  • ওসমান হাদিকে হামলা: গুলির লক্ষ্য একজন না, লক্ষ্য নির্বাচন