রায়েরবাজারে অচেনা এক নারীর মুখ
Published: 14th, December 2025 GMT
বিজয়ের পরের দিন পড়ন্ত দুপুর। রায়েরবাজারের পরিত্যক্ত ইটখোলায় একটি দৃশ্য দেখে রশীদ তালুকদারের রক্ত হিম হয়ে আসে। গর্তের কাদাপানিতে দেবে থাকা শরীর পুরোটা দেখা যায় না। চাপা মাটি আর কঠিন ইটের আস্তরণ ভেদ করে মমির মতো ভেসে উঠেছে এক নারীর মুখ। তাঁর বুকে বুলেটের ক্ষত। শরীরে আঘাতের চিহ্ন। বাঁ চোখটা উপড়ে ফেলা হয়েছে। ডান চোখ বন্ধ। মুখটা হাঁ হয়ে আছে। রোলিফ্লেক্সের শাটার টিপতে গিয়ে রশীদ তালুকদারের চোখ নোনা হয়ে আসে। অশ্রুতে ঝাপসা হয় তাঁর ভিউ ফাইন্ডার। নাকে প্যাঁচানো রুমাল দিয়ে ভিউ ফাইন্ডারের কাচ মোছেন তিনি। এরপর কাদাপানিতে নেমে এই নারীর মুখ বরাবর ক্যামেরা রেখে ভার্টিক্যাল ফ্রেমে কয়েকটা ছবি তোলেন। ৫৪ বছর কেটে গেছে। হতভাগী এই নারীর পরিচয় পাওয়া যায়নি। কিন্তু অচেনা এই নারীর ছবিই বাংলাদেশের গণহত্যার এক ঐতিহাসিক দলিল হয়ে উঠেছে।
পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী ও তাদের এদেশীয় দোসরদের বর্বরতার শিকার হওয়া এই নারীর সাদাকালো ছবিটি আমাদের সমস্ত মানবিক অনুভূতিকে স্তব্ধ করে দেয়। শিরশিরে অনুভূতি জাগানো ছবিটি দেখে মুক্তিযুদ্ধের পরবর্তী প্রজন্ম পাকিস্তানিদের প্রতি ঘৃণা প্রদর্শন করে। পেছনে ফিরে তারা জানতে চায় বাংলাদেশের স্বাধীনতা অর্জনের ইতিহাস। পাকিস্তানিদের প্রতি এই যে ঘৃণা আর মুক্তিযুদ্ধে নিধনযজ্ঞ সম্পর্কে তাদের জানার যে আকুলতা; এই ছবির মাধ্যমে তার একটা দৃশ্যমান পটভূমি নির্মাণ করতে পেরেছিলেন রশীদ তালুকদার। এই কালজয়ী ছবি ছাড়াও মুক্তিযুদ্ধের অনেক ঐতিহাসিক ঘটনার সাক্ষী তাঁর রোলিফ্লেক্স ক্যামেরা। ফলে রশীদ তালুকদারের চোখ দিয়েই বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের দৃশ্য-ইতিহাস পাঠ করতে হয়।
পাকিস্তানিদের প্রতি এই যে ঘৃণা আর মুক্তিযুদ্ধে নিধনযজ্ঞ সম্পর্কে জানার যে আকুলতা; এই ছবির মাধ্যমে তার একটা দৃশ্যমান পটভূমি নির্মাণ করতে পেরেছিলেন রশীদ তালুকদার। এই কালজয়ী ছবি ছাড়াও মুক্তিযুদ্ধের অনেক ঐতিহাসিক ঘটনার সাক্ষী তাঁর রোলিফ্লেক্স ক্যামেরা।রশীদ তালুকদারের শেষজীবনের অন্তত এক যুগ সময় আমি তাঁর স্নেহ পেয়েছি। বাংলাদেশের বিভিন্ন রাজনৈতিক ঘটনাপ্রবাহের মাঠে একসঙ্গে ছবি তুলেছি। তিনি আমার মোটরবাইকে চেপে অ্যাসাইনমেন্টে যেতে পছন্দ করতেন। ছবি তোলার ফাঁকে ফাঁকে, অবসরে তিনি আমাকে তাঁর দীর্ঘ সাংবাদিকতা জীবনের অভিজ্ঞতা আর মুক্তিযুদ্ধের কঠিন সময়গুলোর কথা বলতেন। ক্যামেরার মাধ্যমে সারা জীবন তিনি জীবনকে খুঁজে ফিরেছেন। এমন ছবি তুলতে চেয়েছেন, যা জীবনের কথা বলে। সেই সব স্মৃতি থেকেই রায়েরবাজারের এই করুণ অধ্যায়টা লিপিবদ্ধ করার চেষ্টা করেছি।
রশীদ তালুকদার [২৪ অক্টোবর, ১৯৩৯-২৫ অক্টোবর, ২০১১]। আলোকচিত্র: সাহাদাত পারভেজ.উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: এই ন র র
এছাড়াও পড়ুন:
রায়েরবাজারে অচেনা এক নারীর মুখ
বিজয়ের পরের দিন পড়ন্ত দুপুর। রায়েরবাজারের পরিত্যক্ত ইটখোলায় একটি দৃশ্য দেখে রশীদ তালুকদারের রক্ত হিম হয়ে আসে। গর্তের কাদাপানিতে দেবে থাকা শরীর পুরোটা দেখা যায় না। চাপা মাটি আর কঠিন ইটের আস্তরণ ভেদ করে মমির মতো ভেসে উঠেছে এক নারীর মুখ। তাঁর বুকে বুলেটের ক্ষত। শরীরে আঘাতের চিহ্ন। বাঁ চোখটা উপড়ে ফেলা হয়েছে। ডান চোখ বন্ধ। মুখটা হাঁ হয়ে আছে। রোলিফ্লেক্সের শাটার টিপতে গিয়ে রশীদ তালুকদারের চোখ নোনা হয়ে আসে। অশ্রুতে ঝাপসা হয় তাঁর ভিউ ফাইন্ডার। নাকে প্যাঁচানো রুমাল দিয়ে ভিউ ফাইন্ডারের কাচ মোছেন তিনি। এরপর কাদাপানিতে নেমে এই নারীর মুখ বরাবর ক্যামেরা রেখে ভার্টিক্যাল ফ্রেমে কয়েকটা ছবি তোলেন। ৫৪ বছর কেটে গেছে। হতভাগী এই নারীর পরিচয় পাওয়া যায়নি। কিন্তু অচেনা এই নারীর ছবিই বাংলাদেশের গণহত্যার এক ঐতিহাসিক দলিল হয়ে উঠেছে।
পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী ও তাদের এদেশীয় দোসরদের বর্বরতার শিকার হওয়া এই নারীর সাদাকালো ছবিটি আমাদের সমস্ত মানবিক অনুভূতিকে স্তব্ধ করে দেয়। শিরশিরে অনুভূতি জাগানো ছবিটি দেখে মুক্তিযুদ্ধের পরবর্তী প্রজন্ম পাকিস্তানিদের প্রতি ঘৃণা প্রদর্শন করে। পেছনে ফিরে তারা জানতে চায় বাংলাদেশের স্বাধীনতা অর্জনের ইতিহাস। পাকিস্তানিদের প্রতি এই যে ঘৃণা আর মুক্তিযুদ্ধে নিধনযজ্ঞ সম্পর্কে তাদের জানার যে আকুলতা; এই ছবির মাধ্যমে তার একটা দৃশ্যমান পটভূমি নির্মাণ করতে পেরেছিলেন রশীদ তালুকদার। এই কালজয়ী ছবি ছাড়াও মুক্তিযুদ্ধের অনেক ঐতিহাসিক ঘটনার সাক্ষী তাঁর রোলিফ্লেক্স ক্যামেরা। ফলে রশীদ তালুকদারের চোখ দিয়েই বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের দৃশ্য-ইতিহাস পাঠ করতে হয়।
পাকিস্তানিদের প্রতি এই যে ঘৃণা আর মুক্তিযুদ্ধে নিধনযজ্ঞ সম্পর্কে জানার যে আকুলতা; এই ছবির মাধ্যমে তার একটা দৃশ্যমান পটভূমি নির্মাণ করতে পেরেছিলেন রশীদ তালুকদার। এই কালজয়ী ছবি ছাড়াও মুক্তিযুদ্ধের অনেক ঐতিহাসিক ঘটনার সাক্ষী তাঁর রোলিফ্লেক্স ক্যামেরা।রশীদ তালুকদারের শেষজীবনের অন্তত এক যুগ সময় আমি তাঁর স্নেহ পেয়েছি। বাংলাদেশের বিভিন্ন রাজনৈতিক ঘটনাপ্রবাহের মাঠে একসঙ্গে ছবি তুলেছি। তিনি আমার মোটরবাইকে চেপে অ্যাসাইনমেন্টে যেতে পছন্দ করতেন। ছবি তোলার ফাঁকে ফাঁকে, অবসরে তিনি আমাকে তাঁর দীর্ঘ সাংবাদিকতা জীবনের অভিজ্ঞতা আর মুক্তিযুদ্ধের কঠিন সময়গুলোর কথা বলতেন। ক্যামেরার মাধ্যমে সারা জীবন তিনি জীবনকে খুঁজে ফিরেছেন। এমন ছবি তুলতে চেয়েছেন, যা জীবনের কথা বলে। সেই সব স্মৃতি থেকেই রায়েরবাজারের এই করুণ অধ্যায়টা লিপিবদ্ধ করার চেষ্টা করেছি।
রশীদ তালুকদার [২৪ অক্টোবর, ১৯৩৯-২৫ অক্টোবর, ২০১১]। আলোকচিত্র: সাহাদাত পারভেজ