দুর্বৃত্তের গুলিতে আহত হয়ে হাসপাতালে চিকিৎসাধীন ইনকিলাব মঞ্চের আহ্বায়ক শরিফ ওসমান বিন হাদির অবস্থা অপরিবির্তত রয়েছে। পরিস্থিতির উন্নতি হলে তাঁকে উন্নত চিকিৎসার জন্য বিদেশে নেওয়া হতে পারে।

ইনকিলাব মঞ্চের সদস্যসচিব আবদুল্লাহ আল জাবের আজ রোববার সকালে প্রথম আলোকে এ কথা জানিয়েছেন। ঢাকার এভারকেয়ার হাসপাতালে চিকিৎসাধীন ওসমান হাদির পাশে রয়েছেন তিনি।

রোববার সকাল ১০টার দিকে ইনকিলাব মঞ্চের পক্ষ থেকে জানানো হয়, ওসমান হাদি এখনো আশঙ্কামুক্ত নন। চিকিৎসক ৭২ ঘণ্টা পর্যবেক্ষণের কথা জানিয়েছেন। সেই সময় আগামীকাল সোমবার রাতে শেষ হবে।

আবদুল্লাহ আল জাবের বলেন, ‘ওসমান হাদি এখনো ডিপ কোমায় আগের অবস্থায় আছেন। তাঁর শারীরিক অবস্থার তেমন উন্নতি হয়নি। তবে ইন্টারনাল রেসপন্স আছে।’

আরও পড়ুনতফসিলের পরদিন ‘প্রার্থী’ গুলিবিদ্ধ১২ ডিসেম্বর ২০২৫

ওসমান হাদিকে তাঁর পরিবার ও ইনকিলাব মঞ্চের পক্ষ থেকে বিদেশে নিয়ে চিকিৎসার পরিকল্পনা করা হচ্ছে। তবে বিদেশে নেওয়ার বিষয়টি তাঁর শারীরিক অবস্থার ওপর নির্ভর করছে। অবস্থা বিদেশে নেওয়ার মতো উন্নতি হলেই নেওয়া হবে।

গত শুক্রবার দুপুরে ঢাকার বিজয়নগরে গুলিবিদ্ধ হওয়ার পরপরই ওসমান হাদিকে নেওয়া হয়েছিল ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে। ওই হাসপাতালের পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মো.

আসাদুজ্জামান তখন বলেছিলেন, একটি গুলি ওসমান হাদির কানের ডান পাশ দিয়ে ঢুকে মাথার বাঁ পাশ দিয়ে বেরিয়ে যায়। হাসপাতালে নিউরোসার্জারি বিভাগের চিকিৎসকেরা তাঁর প্রাথমিক অস্ত্রোপচার করেন।

সেদিন সন্ধ্যায় ওসমান হাদিকে এভারকেয়ার হাসপাতালে নেওয়া হয়। এখন সেখানে ভেন্টিলেটর সাপোর্টে রয়েছেন তিনি। তাঁর চিকিৎসায় একটি মেডিকেল বোর্ড গঠন করা হয়েছে। বিএনপির চেয়ারপারসন, সাবেক প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়াও এই হাসপাতালে চিকিৎসাধীন রয়েছেন।

খালেদা জিয়া ও ওসমান হাদির খবরাখবর নিতে এভারকেয়ার হাসপাতালের সামনে অনেকে যাচ্ছেন। তাঁদের কেউ কেউ বিভিন্ন জেলা থেকে এসেছেন।
লন্ডন প্রবাসী ভাইকে নিতে ঢাকায় আসা সিলেটের সোহেল আহমেদকে এভারকেয়ার হাসপাতালের সামনে দেখা যায়। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘হাদি ভাইয়ের খোঁজ নিতে এসেছি। আর বেগম খালেদা জিয়াও এই হাসপাতালে আছেন।’

আরও পড়ুনবছরজুড়ে আলোচনায় ওসমান হাদি১২ ডিসেম্বর ২০২৫

দুজনকে নিয়ে উৎকণ্ঠিত সোহেল আহমেদ বলেন, ‘ওসমান হাদি একজন প্রতিবাদী মানুষ। যারা দেশের ভালো চায় না, তারা তাঁকে মেরে ফেলতে চাইছে। একটা নিরীহ মানুষকে এভাবে মেরে ফেলতে চাওয়াটা খুব নৃশংসতা। এই ঘটনাকে মেনে নিতে পারছি না। আর সাবেক প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়া গণতন্ত্রের মানসকন্যা। দেশে তাঁর প্রয়োজন এখনো অনেক। দুজনই এখন এই এভারকেয়ার হাসপাতালে। আমরা তাঁদের জন্য দোয়া করি, তাঁরা যাতে সুস্থ হয়ে আমাদের মাঝে ফিরে আসেন।’

জুলাই অভ্যুত্থানে সক্রিয় হাদি গত বছরের আগস্টে ইনকিলাব মঞ্চ গঠন করে পতিত আওয়ামী লীগ ও ভারতের বিরুদ্ধে সরব। কোনো রাজনৈতিক দলে যোগ না দিয়ে তিনি ঢাকা–৮ আসনে স্বতন্ত্র প্রার্থী হতে প্রচার চালাচ্ছিলেন। ত্রয়োদশ সংসদ নির্বাচন ও গণভোটের তফসিল ঘোষণার পরদিনই তাঁকে গুলি করা হয়।

আরও পড়ুনওসমান হাদিকে গুলির ঘটনায় সন্দেহভাজন কে এই ফয়সাল করিম দাউদ ১৩ ঘণ্টা আগে

ওসমান হাদির ওপর গুলিবর্ষণের জন্য পতিত আওয়ামী লীগকে দায়ী করছেন তাঁর সমর্থকেরা। এই হামলাকে নির্বাচন বানচালের ষড়যন্ত্র হিসেবে দেখছে অন্তর্বর্তী সরকার। বিএনপি, জামায়াতে ইসলামী, জাতীয় নাগরিক পার্টি এই হামলার নিন্দা জানিয়ে যেকোনো ষড়যন্ত্র ঐক্যবদ্ধ হয়ে মোকাবিলার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে।

ওসমান হাদির ওপর সন্দেহভাজন হামলাকারী হিসেবে ফয়সাল করিম মাসুদ ওরফে দাউদ খান নামে একজনকে চিহ্নিত করা কথা জানিয়েছে পুলিশ। হামলাকারীর বিষয়ে তথ্য দিতে ৫০ লাখ টাকা পুরস্কার ঘোষণা করেছে সরকার। যে মোটরসাইকেল হামলাকারীরা ব্যবহার করেছিল, তা শনাক্ত করে এর মালিককে আটকের কথাও পুলিশ জানিয়েছে।

আরও পড়ুনওসমান হাদির ওপর হামলায় ব্যবহৃত মোটরসাইকেল শনাক্ত, মালিক সন্দেহে আটক ১: পুলিশ১ ঘণ্টা আগে

উৎস: Prothomalo

কীওয়ার্ড: ওসম ন হ দ ক ওসম ন হ দ র র ওপর অবস থ

এছাড়াও পড়ুন:

একটি সাদাকালো ছবি

আলতাফ আমার কাছে একটি সাদাকালো ছবির নাম, আর সেই ছবিটা জুড়ে একটি বড় ইতিহাস। শোষকের বিরুদ্ধে একজন শিল্পীর বিপ্লবী হওয়ার ইতিহাস। 

সেই ১৯৪৮ সাল থেকেই মাত্র ১৫ বছর বয়সে ‘তরুণ মাহফিল’ সংঘের সঙ্গে যুক্ত হয়ে নিজের পিতার বিরুদ্ধে স্লোগান দেওয়া ছেলে তুমি আলতাফ। কালো অশুভ ছায়ার সঙ্গে লড়াই করতে করতে তুমি একটি কাঁথা আর তোমার বেহালা নিয়ে চলে এসেছিলে ঢাকাতে। সেখানে ধূমকেতু শিল্পী সংঘের নিজামুল হকের সাহচর্যে তোমার গণসংগীতের সঙ্গে পথচলা শুরু। বায়ান্নর রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনের প্রথম গান ‘মৃত্যুকে যারা তুচ্ছ করেছে ভাষা বাঁচাবার তরে’ তোমাকে এই বিপ্লবী পথে সুরে সুরে শক্ত করে বেঁধে ফেলেছিল তখন থেকেই। তোমার সুর করা প্রথম ভাষা আন্দোলনের গান ছিল এটি।

তখন থেকেই আসলে তুমি হয়ে উঠেছিলে একুশের মধ্যমণি। সারা বাংলাদেশ চষে বেড়িয়েছ চারণকবির মতো। গান লিখেছ, সুর করেছ, ছায়ানৃত্য তৈরি করেছ, গীতিনাট্য রচনা করেছ। পূর্ব পাকিস্তান শিল্পী সংসদ, যুবলীগ, যুক্তফ্রন্টের মঞ্চ বা কোনো সাহিত্য-সংস্কৃতির সম্মেলন বা অনুষ্ঠানে তোমার অংশগ্রহণ ছিল দ্বিধাহীন। এর মধ্যেই তুমি সুর করে ফেলেছিলে বাংলাদেশের জন্য তোমার শ্রেষ্ঠ উপহার। অমর একুশের গান। আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী রচিত ‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো’ কবিতাটি তোমার সুরে হয়ে উঠেছিল শোক, ঘৃণা, প্রতিরোধ আর মুক্তির জন্য অনন্য এক সৃষ্টি। 

তুমি মানুষকে কখনো ‘ওরে বাঙালি তোরা ঢাকা শহর রক্তে ভাসাইলি’ দিয়ে কাঁদিয়েছ, আবার ‘আমি মানুষের ভাই স্পার্টাকাস’ দিয়ে উদ্বেলিত করেছ। ১৯৭০-এর ভয়াবহ বন্যায় তুমি গেয়ে উঠেছ ‘এই ঝঞ্ঝা মোরা রুখব, এই বন্যা মোরা রুখব’, পথে পথে অর্থ সংগ্রহ করেছ। একটি শিল্প কখন যে বিপ্লবে পরিণত হয়, সেটা তোমার জীবনের পথে যাত্রী না হলে বুঝে ওঠা মুশকিল।

একাত্তরের ২৫ মার্চ নিরীহ বাঙালি নিধনের যে পৈশাচিক যজ্ঞ শুরু করেছিল পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী, তার চাক্ষুষ সাক্ষী ছিলে তুমি। আবদুল লতিফ, তোমার ছায়াসঙ্গী হাফিজ, রাজা হোসেন প্রমুখকে নিয়ে দিনরাত আচ্ছন্নের মধ্যে গান লিখেছ, সুর করেছ। গানগুলো সবার অগোচরে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রে পৌঁছে দিতে তুমি, যেন বেতারে প্রচারিত গানগুলো উজ্জীবিত করে মুক্তিযোদ্ধাদের।

ওই সময়ে কলা, সবজি, কাগজের ফেরিওয়ালাদের আনাগোনা বেড়ে গিয়েছিল তোমার ৩৭০ নম্বর আউটার সার্কুলার রোডে। এসব ফেরিওয়ালার সঙ্গে তোমার দীর্ঘক্ষণের আলাপচারিতা মাকে বিস্মিত করত। মা পরে বুঝতে পেরেছিল ওরা সবাই ছদ্মবেশী মুক্তিযোদ্ধা—ঢাকার খবর সীমান্তের ওপারে মেলাঘরে পৌঁছে দেয়। এই অতিথিদের মাধ্যমে তুমি ওখানে টাকা পাঠাতে, তোমার গান পাঠাতে আর নিজের কাছে গড়ে তুলতে হালকা গোলাবারুদের মজুত।

ধীরে ধীরে তোমার ৩৭০ নম্বর বাড়িটি দুর্গে পরিণত হলো। ঢাকার গেরিলা আক্রমণের সূচনা তোমার হাত ধরে, তোমার ছায়াসঙ্গী যন্ত্রসংগীতশিল্পী শহীদ হাফিজের মতিঝিলে পাকিস্তান স্টেট ব্যাংক লক্ষ্য করে গ্রেনেড নিক্ষেপের মধ্য দিয়ে। এর পর থেকেই ক্র্যাক প্লাটুন ও অন্য মুক্তিযোদ্ধাদের আস্তানা ও অস্ত্রাগার হিসেবে তোমার বাসা হয়ে উঠেছিল অন্যতম। তুমি ধারণা করতে শিল্পীদের কেউ শত্রু মনে করে না। একাত্তরে সুরে সুরে তোমার সক্রিয় ভূমিকা ছিল অবরুদ্ধ ঢাকা শহরে গেরিলা মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গে।

একাত্তরের আগস্টের ৩০ তারিখ দুই ট্রাংক অস্ত্রসহ ভোরবেলা তোমাকে পাকিস্তানি বাহিনী ধরে নিয়ে যায়। সঙ্গে ছিল তোমার শ্যালক, প্রতিবেশী, আশ্রয় নেওয়া মুক্তিযোদ্ধা। শত অত্যাচারেও কারও নাম বলোনি। উর্দুতে পারদর্শী আলতাফ একটি উর্দু শব্দ উচ্চারণ করোনি। তোমার সঙ্গের বন্দীদের জীবন দান করে গেছ তুমি।

আলতাফ, তোমার এই তিরোধান বাংলাদেশের ইতিহাসের একটি অংশ। তোমার লড়াই বাংলাদেশের একটি বিপ্লব। তোমার উন্নত শির এই স্বেচ্ছামৃত্যু একটি বীরগাথা। আলতাফ একটি দীর্ঘ পথের নাম, যেখানে আছে শুধু ‘স্বদেশ, স্বদেশ, স্বদেশ মোদের ঘর রে’।

প্রথম আলো, ১৪ ডিসেম্বর ২০১৩

লেখক: শহীদ আলতাফ মাহমুদের মেয়ে

সম্পর্কিত নিবন্ধ