১৯৮০ সালের ২৩ জুন, নয়াদিল্লি। সকালটা ছিল শান্ত, তবু ইতিহাসের এক অমোঘ অধ্যায়ের সূচনা হয়। ভারতের একমাত্র নারী প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর ছোট ছেলে, সাবেক কংগ্রেস নেতা সঞ্জয় গান্ধী মাত্র ৩৩ বছর বয়সে বিমান দুর্ঘটনায় মারা যান। তাঁর এমন মৃত্যু একটি ঐতিহ্যবাহী রাজনৈতিক পরিবারের শুধু শোকের ঘটনাই নয়; বরং ভারতীয় রাজনীতির ইতিহাসে বিতর্ক, ষড়যন্ত্র ও রহস্যের গভীর অধ্যায় হিসেবেও চিহ্নিত হয়ে আছে।

সঞ্জয় গান্ধীর জীবন ছিল রাজনৈতিক উত্থান-পতনের এক মেলবন্ধন। বিমান দুর্ঘটনায় নিহত হওয়ার আগে তিনি একাধিকবার হত্যাচেষ্টারও শিকার হন। কিন্তু কীভাবে ঘটেছিল রহস্যেঘেরা সেই বিমান দুর্ঘটনা? রাজনীতিবিদ, সাংবাদিক ও অনেক সাধারণ মানুষের কাছে আজও এটি কৌতূহলী এক প্রশ্ন।

সঞ্জয় গান্ধী জন্মগ্রহণ (১৪ ডিসেম্বর ১৯৪৬) করেন ভারতের প্রভাবশালী রাজনৈতিক পরিবারে। প্রপিতামহ মোতিলাল নেহরু ছিলেন ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনের নেতা ও মহাত্মা গান্ধীর ঘনিষ্ঠ সহযোগী। নানা জওহরলাল নেহরু স্বাধীন ভারতের প্রথম প্রধানমন্ত্রী। মা ইন্দিরা গান্ধীও ছিলেন দেশের প্রথম নারী প্রধানমন্ত্রী (১৯৬৬-৭৭ ও ১৯৮০-৮৪)। ভাই রাজীব গান্ধী পরে প্রধানমন্ত্রী হন। সঞ্জয়কে ব্যাপকভাবে তাঁর মায়ের রাজনৈতিক উত্তরসূরি হিসেবে মনে করা হতো।

সঞ্জয় গান্ধীর সবচেয়ে সমালোচিত পদক্ষেপ ছিল ‘স্টপ অ্যাট টু’ নামে জন্মনিয়ন্ত্রণ অভিযান। লক্ষ্য ছিল, ভারতের জনসংখ্যা দ্রুত নিয়ন্ত্রণ করা। সরকারি প্রতিবেদন অনুযায়ী, এক বছরে ৬ মিলিয়নেরও (৬০ লাখ) বেশি পুরুষকে জোর করে বন্ধ্যাকরণ করা হয়। এ অভিযান ব্যাপক সমালোচনার মুখে পড়ে।

সঞ্জয় পড়াশোনায় খুব ভালো ছিলেন না এবং বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হননি। তবে ছোটবেলা থেকেই মনোযোগ ছিল প্রযুক্তি ও যন্ত্রপাতির ওপর। ইংল্যান্ডে রোলস-রয়েস প্রতিষ্ঠানে তিনি অটোমোটিভ ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে প্রশিক্ষণ নেন। ১৯৭৬ সালে পাইলট হিসেবে লাইসেন্স নেন এবং অ্যারোবেটিক চালনায় তাঁর দক্ষতা ছিল। এ আগ্রহ তাঁর ভবিষ্যতের রাজনৈতিক ও ব্যক্তিগত জীবনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে।

উইকিলিকসের নথি অনুযায়ী, ইন্দিরা গান্ধী ছেলে সঞ্জয়কে কখনো রাজনৈতিক নেতা হিসেবে দেখেননি। তিনি শুধু ‘ছোট কর্মী’ হিসেবে মূল্যায়ন করেছিলেন। তবু জরুরি অবস্থার সময় ক্ষমতার কেন্দ্রে থাকা এবং কংগ্রেসের ভেতরে রাজনৈতিক প্রভাব বিস্তার করার দায়িত্ব সঞ্জয়ের হাতে ছিল।

রাজনৈতিক উত্থান ও বিতর্কিত ভূমিকা

দেশজুড়ে রাজনৈতিক ও সামাজিক উত্তেজনাকে কেন্দ্র করে ১৯৭৫ সালের জুনে ইন্দিরা গান্ধী জরুরি অবস্থা ঘোষণা করেন। এরপর সঞ্জয় গান্ধীর রাজনৈতিক জীবনের শুরু। জরুরি অবস্থায় ইন্দিরা গান্ধী নাগরিক অধিকার স্থগিত করেন এবং হাজার হাজার রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে গ্রেপ্তার করেন। এ সময় সঞ্জয় মায়ের প্রধান উপদেষ্টার ভূমিকা নেন এবং ব্যাপক রাজনৈতিক প্রভাব বিস্তার করেন। এক মার্কিন সাংবাদিক তাঁকে সরকারের ‘জাতীয় প্রধান তত্ত্বাবধায়ক’ হিসেবে বর্ণনা করেছিলেন। ওই সময় (জুন ১৯৭৫-মার্চ ১৯৭৭) নিজের রাজনৈতিক ক্ষমতা আরও দৃঢ় করতে বেশ কিছু বিতর্কিত নীতি গ্রহণ করেন তিনি।

সঞ্জয় গান্ধীর সবচেয়ে সমালোচিত পদক্ষেপ ছিল ‘স্টপ অ্যাট টু’ নামে জন্মনিয়ন্ত্রণ অভিযান। লক্ষ্য ছিল, ভারতের জনসংখ্যা দ্রুত নিয়ন্ত্রণ করা। সরকারি প্রতিবেদন অনুযায়ী, এক বছরে ৬০ লাখের বেশি পুরুষকে বন্ধ্যাকরণ করা হয়। এ অভিযান ব্যাপক সমালোচনার মুখে পড়ে। কারণ, বহু ক্ষেত্রে জোর করে পুরুষদের বন্ধ্যাকরণ করা হয়। পুলিশ অনেক গ্রাম ঘিরে ফেলত এবং দরিদ্র পুরুষদের ধরে এনে বন্ধ্যাকরণ করানো হতো।

‘স্টপ অ্যাট টু’ ছিল সঞ্জয় গান্ধীর পাঁচ দফা কর্মসূচির একটি। অন্য চারটি ছিল গাছ লাগানো, সাক্ষরতা বাড়ানো, যৌতুকপ্রথার বিরুদ্ধে লড়াই ও বর্ণব্যবস্থার বিলুপ্তি।

শেষ পর্যন্ত টিডিকে-কে (সোনিয়া গান্ধীকে বোঝাতে ব্যবহার করা সংক্ষিপ্ত শব্দ) সুবিধা দেওয়ার জন্য সোভিয়েতরা তাঁর (সঞ্জয় গান্ধী) বিমানে একটি ফাটল তৈরি ও জীবন শেষ করে। বিমানটি আশোকা হোটেলের কাছে বিধ্বস্ত হয়, কিন্তু বিস্ফোরিত হয়নি। কেন?সুব্রামানিয়াম স্বামী, বিজেপির রাজ্যসভার সাবেক সদস্য

সঞ্জয়ের আরেকটি বিতর্কিত কর্মকাণ্ড ছিল ভিড়ভাট্টা ও দরিদ্র মানুষের বসতি উচ্ছেদ। কিছু এলাকাকে নগর উন্নয়নের পথে বাধা মনে করতেন তিনি। ফলে পুরোনো দিল্লির বহু বাড়ি ভেঙে ফেলার নির্দেশ দেন, যার মধ্যে জামা মসজিদ ও তুর্কমান গেটের এলাকাগুলোও ছিল।

দিল্লিই ছিল এসব উচ্ছেদের প্রধান কেন্দ্র, তবে গুজরাট, হরিয়ানাসহ আরও কয়েকটি রাজ্যে একই ধরনের অভিযান চালানো হয়। তুর্কমান গেটে উচ্ছেদকে কেন্দ্র করে দাঙ্গা ছড়িয়ে পড়ে এবং পুলিশের গুলিতে কয়েকজন নিহত হন। মৃত্যুর সঠিক সংখ্যা অজানা। ১৯৭৭ সালে গঠিত শাহ কমিশন (জাস্টিস জে সি শাহ কমিশন অব এনকোয়ারি) জানায়, সেখানে অন্তত ৬ থেকে ২০ জন নিহত হয়েছিলেন। পুরো অভিযানের ফলে লাখ লাখ মানুষ গৃহহীন হয়ে পড়েন। শাহ কমিশন এ উচ্ছেদ অভিযানকে জরুরি অবস্থার সময় সরকারের করা ‘সবচেয়ে বড় মাত্রার অতিরিক্ত ক্ষমতার ব্যবহার’ বলে মন্তব্য করে।

ব্যঙ্গাত্মক চলচ্চিত্র ‘কিসসা কুর্সি কা’ (একটি সিংহাসনের কাহিনি) ধ্বংসের ঘটনায়ও সঞ্জয় সরাসরি জড়িত ছিলেন। ‘কিসসা কুর্সি কা’ ১৯৭০-এর দশকে তৈরি ব্যঙ্গাত্মক রাজনৈতিক চলচ্চিত্র, যা ইন্দিরা গান্ধী এবং তাঁর সরকারের নীতি ও কর্মকাণ্ডকে ব্যঙ্গ করেছিল। সঞ্জয় চলচ্চিত্রটির প্রিন্ট পুড়িয়ে দেওয়ার নির্দেশ দেন। এ পদক্ষেপকে সাংবাদিকতা ও সৃজনশীল স্বাধীনতার ওপর আঘাত হিসেবে উল্লেখ করেন অনেক সমালোচক।

পরে ১৯৭৮ সালে, জরুরি অবস্থা শেষে, চলচ্চিত্রটি পুনরায় চিত্রায়িত হয় ও মুক্তি পায়। কিন্তু দিল্লি হাইকোর্টে চলচ্চিত্র ধ্বংসের ঘটনায় মামলা হয়েছিল। মামলায় আদালত সঞ্জয় গান্ধীকে দোষী সাব্যস্ত করে দুই বছরের কারাদণ্ড দেন। বিচার চলাকালীন তিনি এক মাস কারাগারে ছিলেন। পরবর্তী সময় সুপ্রিম কোর্ট থেকে খালাস পান।

বিতর্কিত নানা পদক্ষেপের কারণে ১৯৭৭ সালের নির্বাচনে ইন্দিরা গান্ধী ক্ষমতাচ্যুত হন। তবে ১৯৮০ সালে কংগ্রেস আবার জয়ী হয় এবং সঞ্জয় গান্ধী লোকসভার সদস্য হন। তিনি দেশের রাজনীতিতে মায়ের পর দ্বিতীয় ক্ষমতাধর ব্যক্তি হয়ে ওঠেন।

জরুরি অবস্থার সময় সরকারের অতিরিক্ত ক্ষমতা প্রয়োগের প্রতিক্রিয়ায় ১৯৭৭ সালের নির্বাচনে ইন্দিরা গান্ধী ক্ষমতাচ্যুত হন। তবে অপরাধ বৃদ্ধি ও মূল্যস্ফীতিতে ক্ষুব্ধ ভোটাররা ১৯৮০ সালে আবার তাঁকে বিপুল ভোটে জয়ী করেন। একই বছর সঞ্জয় গান্ধী লোকসভার সদস্য নির্বাচিত হন। সংসদে তিনি অত্যন্ত প্রভাবশালী হয়ে ওঠেন এবং তাঁকে দেশে মায়ের পর সবচেয়ে ক্ষমতাধর ব্যক্তি হিসেবে ধরা হতো। ১৯৮০ সালের মে মাসে, মৃত্যুর ঠিক এক মাস আগে, তিনি তাঁর মায়ের নেতৃত্বাধীন কংগ্রেস (আই বা ইন্দিরা) দলকে ৯টি রাজ্যের নির্বাচনের মধ্যে আটটিতে বিজয়ী করতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন।

পশ্চিমবঙ্গে একটি জনসভায় ভাষণ দিচ্ছেন সঞ্জয় গান্ধী। ০২ জুন ১৯৭৬.

উৎস: Prothomalo

কীওয়ার্ড: র জন ত ক প র র জন ত ক চলচ চ ত র ১৯৮০ স ল ব তর ক ত পদক ষ প সরক র র ইন দ র র ঘটন ক ষমত অবস থ সবচ য

এছাড়াও পড়ুন:

বিমানবন্দরে ১০ মিনিট, আকাশে ১২ মিনিট—‘ভারতের রাজকুমারের’শেষ দিন কী ঘটেছিল

১৯৮০ সালের ২৩ জুন, নয়াদিল্লি। সকালটা ছিল শান্ত, তবু ইতিহাসের এক অমোঘ অধ্যায়ের সূচনা হয়। ভারতের একমাত্র নারী প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর ছোট ছেলে, সাবেক কংগ্রেস নেতা সঞ্জয় গান্ধী মাত্র ৩৩ বছর বয়সে বিমান দুর্ঘটনায় মারা যান। তাঁর এমন মৃত্যু একটি ঐতিহ্যবাহী রাজনৈতিক পরিবারের শুধু শোকের ঘটনাই নয়; বরং ভারতীয় রাজনীতির ইতিহাসে বিতর্ক, ষড়যন্ত্র ও রহস্যের গভীর অধ্যায় হিসেবেও চিহ্নিত হয়ে আছে।

সঞ্জয় গান্ধীর জীবন ছিল রাজনৈতিক উত্থান-পতনের এক মেলবন্ধন। বিমান দুর্ঘটনায় নিহত হওয়ার আগে তিনি একাধিকবার হত্যাচেষ্টারও শিকার হন। কিন্তু কীভাবে ঘটেছিল রহস্যেঘেরা সেই বিমান দুর্ঘটনা? রাজনীতিবিদ, সাংবাদিক ও অনেক সাধারণ মানুষের কাছে আজও এটি কৌতূহলী এক প্রশ্ন।

সঞ্জয় গান্ধী জন্মগ্রহণ (১৪ ডিসেম্বর ১৯৪৬) করেন ভারতের প্রভাবশালী রাজনৈতিক পরিবারে। প্রপিতামহ মোতিলাল নেহরু ছিলেন ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনের নেতা ও মহাত্মা গান্ধীর ঘনিষ্ঠ সহযোগী। নানা জওহরলাল নেহরু স্বাধীন ভারতের প্রথম প্রধানমন্ত্রী। মা ইন্দিরা গান্ধীও ছিলেন দেশের প্রথম নারী প্রধানমন্ত্রী (১৯৬৬-৭৭ ও ১৯৮০-৮৪)। ভাই রাজীব গান্ধী পরে প্রধানমন্ত্রী হন। সঞ্জয়কে ব্যাপকভাবে তাঁর মায়ের রাজনৈতিক উত্তরসূরি হিসেবে মনে করা হতো।

সঞ্জয় গান্ধীর সবচেয়ে সমালোচিত পদক্ষেপ ছিল ‘স্টপ অ্যাট টু’ নামে জন্মনিয়ন্ত্রণ অভিযান। লক্ষ্য ছিল, ভারতের জনসংখ্যা দ্রুত নিয়ন্ত্রণ করা। সরকারি প্রতিবেদন অনুযায়ী, এক বছরে ৬ মিলিয়নেরও (৬০ লাখ) বেশি পুরুষকে জোর করে বন্ধ্যাকরণ করা হয়। এ অভিযান ব্যাপক সমালোচনার মুখে পড়ে।

সঞ্জয় পড়াশোনায় খুব ভালো ছিলেন না এবং বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হননি। তবে ছোটবেলা থেকেই মনোযোগ ছিল প্রযুক্তি ও যন্ত্রপাতির ওপর। ইংল্যান্ডে রোলস-রয়েস প্রতিষ্ঠানে তিনি অটোমোটিভ ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে প্রশিক্ষণ নেন। ১৯৭৬ সালে পাইলট হিসেবে লাইসেন্স নেন এবং অ্যারোবেটিক চালনায় তাঁর দক্ষতা ছিল। এ আগ্রহ তাঁর ভবিষ্যতের রাজনৈতিক ও ব্যক্তিগত জীবনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে।

উইকিলিকসের নথি অনুযায়ী, ইন্দিরা গান্ধী ছেলে সঞ্জয়কে কখনো রাজনৈতিক নেতা হিসেবে দেখেননি। তিনি শুধু ‘ছোট কর্মী’ হিসেবে মূল্যায়ন করেছিলেন। তবু জরুরি অবস্থার সময় ক্ষমতার কেন্দ্রে থাকা এবং কংগ্রেসের ভেতরে রাজনৈতিক প্রভাব বিস্তার করার দায়িত্ব সঞ্জয়ের হাতে ছিল।

রাজনৈতিক উত্থান ও বিতর্কিত ভূমিকা

দেশজুড়ে রাজনৈতিক ও সামাজিক উত্তেজনাকে কেন্দ্র করে ১৯৭৫ সালের জুনে ইন্দিরা গান্ধী জরুরি অবস্থা ঘোষণা করেন। এরপর সঞ্জয় গান্ধীর রাজনৈতিক জীবনের শুরু। জরুরি অবস্থায় ইন্দিরা গান্ধী নাগরিক অধিকার স্থগিত করেন এবং হাজার হাজার রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে গ্রেপ্তার করেন। এ সময় সঞ্জয় মায়ের প্রধান উপদেষ্টার ভূমিকা নেন এবং ব্যাপক রাজনৈতিক প্রভাব বিস্তার করেন। এক মার্কিন সাংবাদিক তাঁকে সরকারের ‘জাতীয় প্রধান তত্ত্বাবধায়ক’ হিসেবে বর্ণনা করেছিলেন। ওই সময় (জুন ১৯৭৫-মার্চ ১৯৭৭) নিজের রাজনৈতিক ক্ষমতা আরও দৃঢ় করতে বেশ কিছু বিতর্কিত নীতি গ্রহণ করেন তিনি।

সঞ্জয় গান্ধীর সবচেয়ে সমালোচিত পদক্ষেপ ছিল ‘স্টপ অ্যাট টু’ নামে জন্মনিয়ন্ত্রণ অভিযান। লক্ষ্য ছিল, ভারতের জনসংখ্যা দ্রুত নিয়ন্ত্রণ করা। সরকারি প্রতিবেদন অনুযায়ী, এক বছরে ৬০ লাখের বেশি পুরুষকে বন্ধ্যাকরণ করা হয়। এ অভিযান ব্যাপক সমালোচনার মুখে পড়ে। কারণ, বহু ক্ষেত্রে জোর করে পুরুষদের বন্ধ্যাকরণ করা হয়। পুলিশ অনেক গ্রাম ঘিরে ফেলত এবং দরিদ্র পুরুষদের ধরে এনে বন্ধ্যাকরণ করানো হতো।

‘স্টপ অ্যাট টু’ ছিল সঞ্জয় গান্ধীর পাঁচ দফা কর্মসূচির একটি। অন্য চারটি ছিল গাছ লাগানো, সাক্ষরতা বাড়ানো, যৌতুকপ্রথার বিরুদ্ধে লড়াই ও বর্ণব্যবস্থার বিলুপ্তি।

শেষ পর্যন্ত টিডিকে-কে (সোনিয়া গান্ধীকে বোঝাতে ব্যবহার করা সংক্ষিপ্ত শব্দ) সুবিধা দেওয়ার জন্য সোভিয়েতরা তাঁর (সঞ্জয় গান্ধী) বিমানে একটি ফাটল তৈরি ও জীবন শেষ করে। বিমানটি আশোকা হোটেলের কাছে বিধ্বস্ত হয়, কিন্তু বিস্ফোরিত হয়নি। কেন?সুব্রামানিয়াম স্বামী, বিজেপির রাজ্যসভার সাবেক সদস্য

সঞ্জয়ের আরেকটি বিতর্কিত কর্মকাণ্ড ছিল ভিড়ভাট্টা ও দরিদ্র মানুষের বসতি উচ্ছেদ। কিছু এলাকাকে নগর উন্নয়নের পথে বাধা মনে করতেন তিনি। ফলে পুরোনো দিল্লির বহু বাড়ি ভেঙে ফেলার নির্দেশ দেন, যার মধ্যে জামা মসজিদ ও তুর্কমান গেটের এলাকাগুলোও ছিল।

দিল্লিই ছিল এসব উচ্ছেদের প্রধান কেন্দ্র, তবে গুজরাট, হরিয়ানাসহ আরও কয়েকটি রাজ্যে একই ধরনের অভিযান চালানো হয়। তুর্কমান গেটে উচ্ছেদকে কেন্দ্র করে দাঙ্গা ছড়িয়ে পড়ে এবং পুলিশের গুলিতে কয়েকজন নিহত হন। মৃত্যুর সঠিক সংখ্যা অজানা। ১৯৭৭ সালে গঠিত শাহ কমিশন (জাস্টিস জে সি শাহ কমিশন অব এনকোয়ারি) জানায়, সেখানে অন্তত ৬ থেকে ২০ জন নিহত হয়েছিলেন। পুরো অভিযানের ফলে লাখ লাখ মানুষ গৃহহীন হয়ে পড়েন। শাহ কমিশন এ উচ্ছেদ অভিযানকে জরুরি অবস্থার সময় সরকারের করা ‘সবচেয়ে বড় মাত্রার অতিরিক্ত ক্ষমতার ব্যবহার’ বলে মন্তব্য করে।

ব্যঙ্গাত্মক চলচ্চিত্র ‘কিসসা কুর্সি কা’ (একটি সিংহাসনের কাহিনি) ধ্বংসের ঘটনায়ও সঞ্জয় সরাসরি জড়িত ছিলেন। ‘কিসসা কুর্সি কা’ ১৯৭০-এর দশকে তৈরি ব্যঙ্গাত্মক রাজনৈতিক চলচ্চিত্র, যা ইন্দিরা গান্ধী এবং তাঁর সরকারের নীতি ও কর্মকাণ্ডকে ব্যঙ্গ করেছিল। সঞ্জয় চলচ্চিত্রটির প্রিন্ট পুড়িয়ে দেওয়ার নির্দেশ দেন। এ পদক্ষেপকে সাংবাদিকতা ও সৃজনশীল স্বাধীনতার ওপর আঘাত হিসেবে উল্লেখ করেন অনেক সমালোচক।

পরে ১৯৭৮ সালে, জরুরি অবস্থা শেষে, চলচ্চিত্রটি পুনরায় চিত্রায়িত হয় ও মুক্তি পায়। কিন্তু দিল্লি হাইকোর্টে চলচ্চিত্র ধ্বংসের ঘটনায় মামলা হয়েছিল। মামলায় আদালত সঞ্জয় গান্ধীকে দোষী সাব্যস্ত করে দুই বছরের কারাদণ্ড দেন। বিচার চলাকালীন তিনি এক মাস কারাগারে ছিলেন। পরবর্তী সময় সুপ্রিম কোর্ট থেকে খালাস পান।

বিতর্কিত নানা পদক্ষেপের কারণে ১৯৭৭ সালের নির্বাচনে ইন্দিরা গান্ধী ক্ষমতাচ্যুত হন। তবে ১৯৮০ সালে কংগ্রেস আবার জয়ী হয় এবং সঞ্জয় গান্ধী লোকসভার সদস্য হন। তিনি দেশের রাজনীতিতে মায়ের পর দ্বিতীয় ক্ষমতাধর ব্যক্তি হয়ে ওঠেন।

জরুরি অবস্থার সময় সরকারের অতিরিক্ত ক্ষমতা প্রয়োগের প্রতিক্রিয়ায় ১৯৭৭ সালের নির্বাচনে ইন্দিরা গান্ধী ক্ষমতাচ্যুত হন। তবে অপরাধ বৃদ্ধি ও মূল্যস্ফীতিতে ক্ষুব্ধ ভোটাররা ১৯৮০ সালে আবার তাঁকে বিপুল ভোটে জয়ী করেন। একই বছর সঞ্জয় গান্ধী লোকসভার সদস্য নির্বাচিত হন। সংসদে তিনি অত্যন্ত প্রভাবশালী হয়ে ওঠেন এবং তাঁকে দেশে মায়ের পর সবচেয়ে ক্ষমতাধর ব্যক্তি হিসেবে ধরা হতো। ১৯৮০ সালের মে মাসে, মৃত্যুর ঠিক এক মাস আগে, তিনি তাঁর মায়ের নেতৃত্বাধীন কংগ্রেস (আই বা ইন্দিরা) দলকে ৯টি রাজ্যের নির্বাচনের মধ্যে আটটিতে বিজয়ী করতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন।

পশ্চিমবঙ্গে একটি জনসভায় ভাষণ দিচ্ছেন সঞ্জয় গান্ধী। ০২ জুন ১৯৭৬

সম্পর্কিত নিবন্ধ