মহান মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি বহনকারী কুমিল্লার লাকসাম রেলওয়ে জংশনের বেলতলী বধ্যভূমি স্বাধীনতার ৫৪ বছর পেরিয়ে গেলেও অরক্ষিত অবস্থায় রয়েছে। রাত নামলেই সেখানে বসছে মাদকসেবীদের আড্ডা। বীর মুক্তিযোদ্ধাদের মতে, এটি শহীদদের অবমাননা। অবিলম্বে বধ্যভূমিটি সংরক্ষণের দাবি জানিয়েছেন সচেতন মহল।

১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে লাকসাম রেলওয়ে জংশন ছিল পাকিস্তানি বাহিনীর একটি গুরুত্বপূর্ণ ঘাঁটি। বিভিন্ন এলাকা থেকে আটক নিরীহ বাঙালি নারী-পুরুষ ও মুক্তিযোদ্ধাদের ট্রেনে করে এখানে আনা হতো। নির্মম নির্যাতনের পর তাদের হত্যা করে বেলতলী এলাকায় গণকবর দিয়ে মাটি চাপা দিত পাকিস্তানি বাহিনী।

আরো পড়ুন:

মুক্তিযুদ্ধ বিরোধীদের লাল চিঠি পাঠাতাম

কক্সবাজার হানাদারমুক্ত দিবস ১২ ডিসেম্বর

লাকসাম রেলওয়ে জংশনের দক্ষিণ পাশে প্রায় ২ হাজার ফুট এলাকাজুড়ে বিস্তৃত এই বধ্যভূমিতে মাটি খুঁড়লে আজও বেরিয়ে আসে মানুষের হাড়গোড় ও কঙ্কাল। স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধাদের ভাষ্যমতে, ১৯৭১ সালে পাক সেনারা এখানে প্রায় ১০ হাজার বাঙালি নারী-পুরুষকে হত্যা করে মাটিচাপা দেয়।

১৯৯৯ সালে ঢাকার একদল সাংবাদিকের অনুরোধে ডোম শ্রীধাম দাস বেলতলী বধ্যভূমিতে খনন কাজ চালিয়ে মাটিচাপা দেওয়া মানুষের কয়েকটি কঙ্কাল, মাথার খুলি ও হাড়গোড় উদ্ধার করেন। সেসময় উদ্ধারকৃত কিছু নিদর্শন বর্তমানে ঢাকার মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরে সংরক্ষিত রয়েছে।

লাকসামের বীর মুক্তিযোদ্ধা আবদুল কাদের বলেন, ‍“১৯৭১ সালে নিজের চোখে দেখেছি, কীভাবে ট্রেন থেকে নামিয়ে মানুষকে এনে নির্যাতনের পর হত্যা করা হতো। আজ সেই জায়গায় কোনো সাইনবোর্ড নেই, কোনো স্মৃতিচিহ্ন নেই—এটা আমাদের জন্য লজ্জার। নতুন প্রজন্ম জানবেই বা কীভাবে আমাদের ইতিহাস?”

বীর মুক্তিযোদ্ধা মো.

শাহজাহান বলেন, “বেলতলী বধ্যভূমিতে মাটি খুঁড়লেই মানুষের হাড়গোড় বেরিয়ে আসে। এই জায়গা অরক্ষিত থাকায় মাদকসেবী আর অপরাধীরা আড্ডা দেয়। আমরা বেঁচে থাকতে থাকতে চাই, রাষ্ট্র যেন এই বধ্যভূমিকে সংরক্ষণ করে, শহীদদের সম্মান দেয়।”

লাকসাম উপজেলা মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার মোহাম্মদ আলী বলেন, “মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের জরিপ অনুযায়ী দেশের চিহ্নিত ১০টি বধ্যভূমির মধ্যে লাকসাম বেলতলী একটি। অথচ আজও এটি অরক্ষিত অবস্থায় পড়ে আছে, যা আমাদের জন্য লজ্জার।”

তিনি আরো বলেন, “বধ্যভূমিটি সংরক্ষণের অভাবে সেখানে মাদকসেবীদের আড্ডা বসছে, যা শহীদদের আত্মত্যাগের অবমাননার শামিল।”

লাকসাম উপজেলা নির্বাহী অফিসার (ইউএনও) নার্গিস সুলতানা বলেন, “আমরা প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের উদ্যোগ নিয়েছি।”

ঢাকা/রুবেল/মাসুদ

উৎস: Risingbd

কীওয়ার্ড: চ কর চ কর অরক ষ ত স রক ষ রক ষ ত ব লতল

এছাড়াও পড়ুন:

জেনারেল নিয়াজি তিন দিন আগেও বলেছিলেন, আত্মসমর্পণের প্রশ্নই ওঠে না

পুলিৎজার পুরস্কারপ্রাপ্ত মার্কিন সাংবাদিক পিটার আর কান ১৯৭১ সালের ডিসেম্বরে ঢাকায় ছিলেন। ওই সময় প্রতিদিন যুক্তরাষ্ট্রে লেখা পাঠানোর সুযোগ না পেয়ে দিনপঞ্জি রাখতে শুরু করেন তিনি। কয়েক দিনের দিনপঞ্জি একসঙ্গে পাঠালে তা প্রকাশ করত ‘দ্য ওয়াল স্ট্রিট জার্নাল’। ১৯৭১ সালের ডিসেম্বরে ওয়াল স্ট্রিট জার্নাল তাঁর দিনপঞ্জি প্রকাশ করে। প্রথম আলোর পাঠকদের জন্য আজ তাঁর ১৩ ডিসেম্বরের দিনপঞ্জি তুলে ধরা হলো।

সকালে একটি পত্রিকায় বড় বড় শিরোনামে ঘোষণা করল, ‘শত্রুর অগ্রসর হওয়া থেমে গেছে’, কিন্তু পত্রিকার সবচেয়ে বড় নিবন্ধটি হলো, ‘দুর্ভিক্ষের ছোবলে আক্রান্ত আপার ভোল্টা’। সকালের খাবার খাওয়ার কক্ষ থেকে দেখা যায় যে হোটেলের কর্মীরা বিমানবিধ্বংসী অস্ত্রের পরিত্যক্ত অবশেষ তুলছে সুইমিংপুল থেকে। তার জন্য একটি দড়িতে চুম্বক বেঁধে সুইমিংপুলে নামানো হচ্ছিল।

কারফিউ উঠিয়ে নেওয়ার পরবর্তী ছয় ঘণ্টা সময়ে গাড়ি চালিয়ে শহরের কেন্দ্রে যাওয়া গেল। বেশির ভাগ বাঙালি শহর ছেড়ে চলে গেছে, কিন্তু অনেক বিহারিকে (সংখ্যালঘু অবাঙালি) রাস্তায় দেখা গেল এবং অবশ্যই ছিল রিকশাওয়ালা। আজ পাকিস্তানের পতাকা কিছুটা কম দেখলাম আমি। কূটনীতিক বললেন, ‘ঢাকায় প্রতিটি সেলাই মেশিন এখন বাংলাদেশের পতাকা নিয়ে কাজ করতে ব্যস্ত।’

পূর্বাঞ্চলের পাকিস্তান সেনাবাহিনীর কমান্ডার জেনারেল এ এ কে নিয়াজি হোটেল থেকে রাস্তার পাশে এসে দেখা দিলেন এবং সাক্ষাৎকার দিলেন সেখানেই।

‘যুদ্ধ কেমন চলছে?’

‘যেভাবে আমি পরিকল্পনা করেছি।’

‘আপনি কি শহর রক্ষা করতে পারবেন?’

‘শেষ পর্যন্ত।’

‘কিন্তু এর অর্থ কি এটি নয় যে তাতে ঢাকা ধ্বংস হয়ে যেতে পারে?’

‘এগুলো স্বাধীনতার মূল্য।’

‘যুদ্ধবিরতি বা আত্মসমর্পণ বিষয়ে ভাবনা কী?’

‘সেনাবাহিনী মরে যাবে। আত্মসমর্পণের প্রশ্নই ওঠে না। প্রত্যাবাসনের জন্য কেউ থাকবে না।’

যদি তাঁর সেনারাও একই আবেগ ধারণ করে, তবে বিস্ময়ের ব্যাপার হবে।

জেনারেল নিয়াজির চারপাশ ঘিরে ২৫ জনের মতো বিহারির একটি দল চিৎকার করছিল, ‘পাকিস্তান, জিন্দাবাদ, পাকিস্তান, জিন্দাবাদ,’ যার অর্থ হলো, ‘পাকিস্তান দীর্ঘজীবী হোক।’ কিছু লোক কাঁদছিল। কিছু ব্যক্তি আবার লাফাচ্ছিল এবং পাগলের মতো চিৎকার করছিল। রিকশা যাচ্ছিল পাশ দিয়ে এবং বিহারি যাত্রীরা রিকশায় বসে যুদ্ধের বুনো নাচ নাচছিল, তখন মাথা নিচু করে রিকশার প্যাডেলে পা চালাচ্ছিল বাঙালি রিকশাচালক। বিহারিরা যেন নরকের উগ্র আচরণ করার জন্যই ঘরের বাইরে বেরিয়েছিল।

আরও পড়ুনপাকিস্তানি বাহিনীর ধ্বংসযজ্ঞ চলছেই, আগুন দেখা যাচ্ছে হোটেল থেকে১২ ডিসেম্বর ২০২৫

রেডক্রসের কর্মকর্তাদের পরিচালনায় ‘দ্য প্রেস কোর’ বর্তমানে হোটেলের নিরাপত্তা বিধানের সব দায়িত্ব কাঁধে তুলে নিয়েছে, হোটেলটিকে এখন নিরপেক্ষ এলাকা হিসেবে ঘোষণা করা হয়েছে। তাই দুপুরের পরপরই সেখানকার সব কক্ষে অস্ত্র খোঁজার অভিযান চলে, যার মূল উদ্দেশ্য হলো অস্ত্র জব্দ করা এবং সুনির্দিষ্টভাবে জানা যে হোটেলে কারা কোন কক্ষে আছে এবং তাদের পরিচয় কী।

আরও পড়ুনজেনারেল নিয়াজিকে বলা হয়েছে, অস্ত্র নিয়ে হোটেলে ঢুকতে পারবেন না১০ ডিসেম্বর ২০২৫

পশ্চিম পাকিস্তানের বেসামরিক নাগরিকদের কাছে আরও চারটি বন্দুক পাওয়া গেছে, যাদের অনেকে এক কক্ষে ছয়জন পর্যন্ত থাকত। সন্ধ্যায় হোটেলের অধিবাসীরা যে কক্ষে মিলিত হয়ে দেখা করে, সেটি একসময় ছিল অস্ট্রেলীয় নর্তকীদের দেখার জায়গা। সেখানে কথা হয় প্রাথমিক চিকিৎসার ব্যবস্থা ও অগ্নিনির্বাপণ উপকরণ নিয়ে, নিরাপত্তারক্ষীদের দায়িত্ব ও পরিখা তৈরির বিষয়ে।

* ২০২১ সালের ১৬ ডিসেম্বর প্রথম আলোতে প্রকাশিত প্রতিবেদনটির একাংশ আবার প্রকাশ করা হলো।

আরও পড়ুনরাও ফরমান আলী পাকিস্তানি বাহিনীর আত্মসমর্পণের বিষয়ে গোপন সমঝোতা করছেন১১ ডিসেম্বর ২০২৫আরও পড়ুনবিমানবিধ্বংসী কামান থেকে বের হচ্ছিল সাদা ধোঁয়ার কুণ্ডলী০৯ ডিসেম্বর ২০২৫

সম্পর্কিত নিবন্ধ

  • মৃত্যুতেও হয়রানির শেষ হয়নি
  • বুদ্ধিজীবী হত্যাকাণ্ড ছিল জেনোসাইড পরিকল্পনার কৌশলগত অংশ
  • শহীদ বুদ্ধিজীবী স্মৃতিসৌধে রাষ্ট্রপতি ও প্রধান উপদেষ্টার শ্রদ্ধা
  • রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের গণহত্যা
  • চূড়ান্ত পরাজয়ের আগে বুদ্ধিজীবী হত্যা
  • বুদ্ধিজীবীদের প্রত্যাশার বাংলাদেশ গড়ার ডাক তারেক রহমানের
  • জেনারেল নিয়াজি তিন দিন আগেও বলেছিলেন, আত্মসমর্পণের প্রশ্নই ওঠে না
  • আকাশপথে কিলো ফ্লাইটের আক্রমণ
  • পাকিস্তানে বাঙালি বন্দিশিবিরের গোপন ইতিহাস